স্কুল থেকে ফিরে তড়িঘড়ি করে ব্যাগটা রেখে হাতমুখ ধুয়ে বাবার সঙ্গে বেরোনোর এই সময়টা দিনের সবচেয়ে প্রিয় অদ্রীশের কাছে। ওর স্কুলের অন্যান্য ছেলেমেয়েরা যখন ফিরে পড়ার বই, ল্যাপটপ, কম্পিউটার গেমস নিয়ে বসে ঠিক তখনই ও বেরোয় বাবার সঙ্গে, খেলতে। তারা হয়তো বাবাকে পায় না রাতে অফিস থেকে না ফেরা অব্দি, কিন্তু অদ্রীশ বাড়ি ফিরলেই বাবাকে পায়। আর ওর বাবা যেখানেই যান ওকে সঙ্গে নিয়েই যান। আসলে অদ্রীশের বাবা মেঘাদ্রি রায় একজন ফুটবল কোচ। দুটো তিনটে ক্লাবে, স্কুলে ফুটবলের পাঠ দেন। খেলাধুলো যে পড়াশোনার মতোই জরুরি তা তিনি বোঝেন। তাই বিকেলের দিকে যখন তাঁকে বেরোতে হয় তিনি অদ্রীশকে সঙ্গে নিয়ে নেন। সকলের সঙ্গে ওরও খেলার দিকে মন দেন। তবে সবদিন যে খেলার মাঠে যান, তাই নয় মাঝে মাঝে নদীর ধার, ধানক্ষেত, হাটবাজার, মন্দির-মসজিদ-গির্জা, রাজবাড়ি সব জায়গাতেই যান। এই আজ যেমন বাজার পেরিয়ে নদীর ধারে যাচ্ছে ওরা। অদ্রীশের খুব প্রিয় এই নদীর ধার, তবে বাজারে এত জ্যাম যে সবটা পেরিয়ে যেতে যেতে একটু বিকেল গড়িয়ে গেল। নদীর ধারে শোঁ শোঁ শব্দে হাওয়া যেন আছড়ে পড়ছে ওদের ওপর, আজ কী কারণে যেন অদ্রীশ বিরক্ত।
" কী হয়েছে অদ্রীশ?"
অদ্রীশ একটা ইঁটের টুকরো পা দিয়ে জোরে মেরে বললো, " পৃথিবীতে এত খারাপ লোক কেন বাবা? এত গাড়িঘোড়া, এত যন্ত্র, ফাঁকা জায়গা নেই একটুও। সবাই যেন একে অপরের ওপর চেপে বসছে। গাবলুদের বাড়িটাও ভেঙে ফ্ল্যাট হচ্ছে, ওরা নাকি কিছুই করতে পারছে না। প্রোমোটারদের চাপ, ফ্ল্যাট উঠবেই। এখানেও আর মাঠঘাট থাকবে না বাবা?"
" থাকবে, থাকবে। চিন্তা করিস না। প্রকৃতি ঠিক সব সমান করে দেয়। বেশি চাপ দিলে ধ্বংস করে আবার ঠিক করে দেবে। আসলে পৃথিবীতে অনেক মানুষ, তাই খারাপ যেমন আছে, তেমন ভালো লোকও আছে, তবে জানিস এক সময় পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ছিলই না, আমাদের অস্তিত্ব সংকটে এসে গেছিলো।"
" তাহলে সেখান থেকে আজ এত লোক?"
" হাহাহাহা। শুনলে অবাক হবি, তবে যবে থেকে আমরা চাষাবাদ শুরু ..."
হঠাৎই অদ্রীশ ছিটকে উঠলো। কী যেন পায়ের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়লো। মেঘাদ্রিও সতর্ক হয়ে ঝুঁকে দেখলেন। এদিকে সাপের প্রভাব বেশি। না, এ তো ছোট্ট এক কুকুরছানা। পাশের ঝোপটা থেকে হঠাৎ বেরিয়ে এসেছে। তবে খুব মিষ্টি দেখতে, সাদা রঙের শরীরের ওপর বাদামি ছোপ ছোপ জায়গায় জায়গায়। ল্যাজটা দ্রুত নড়ছে এদিক থেকে ওদিক। অদ্রীশ হাঁটু মুড়ে বসলো।
৷৷ ১ ৷৷
" ইদ্রিস আমাদের পালাতে হবে, ইদ্রিস।"
ইদ্রিসের ঘোর কাটে না। কী দেখলো এ চোখের সামনে!
" কী...কী... কিন্তু বাবা ঐ ঐ …"
ইদ্রিস কথা শেষ করতে পারে না, ওর হাতে টান পড়ে, মেগাদ্রিস ওর হাত ধরে সামনের দিকে ছুটতে থাকেন। ও পেছনে তাল মেলাতে না পারলেও প্রাণপণ চেষ্টা করতে থাকে দৌড়ানোর, ডাকতে থাকে বাবাকে। চারপাশে কাউকে দেখতে পাচ্ছে না, কোথায় মা? কোথায় রেইসা? কোথায় ওর বন্ধু গ্রাস, কোথায় বাকিরা? কোথায় সবাই? ও বাবাকে চিৎকার করে ডাকতে থাকে, বাবার কানে কী পৌঁছচ্ছে? ওর নিজের কানেই ওর ডাক পৌঁছচ্ছে না ভালো করে, শুধু শন শন হাওয়া আর মেঘের গুম গুম ডাক, চারিদিক যেন একসঙ্গে রাগে ফেটে পড়েছে, দামামা বাজছে যেন। ও হাত ধরে টেনে বাবাকে থামাতে যায়, মেগাদ্রিস দৌড়তে দৌড়তেই পিছনে ফিরে তাকান ছোট্ট ইদ্রিসের দিকে, দৃষ্টি যেন ইদ্রিসকে পেরিয়ে আরো অনেক দূরে চলে যায়, ভীতু মুখটা আরো ভয়ার্ত হয়ে যায়,
" ইদ্রিস আমাদের আরো জোরে ছুটতে হবে, দানো …"
মেগাদ্রিস কী যেন বলেন, শেষের কথাগুলো হারিয়ে যায়। মেগাদ্রিস ইদ্রিসকে সঙ্গে নিয়ে যেন আরো জোরে ছোটার চেষ্টা করেন। ইদ্রিসের পায়ের তলার মাটি কেঁপে ওঠে, কেঁপে ওঠে যেন চারপাশটাও, এক তীব্র গর্জনে সমস্ত চরাচর যেন ধ্বংসের আভাস দেয়, ধ্বংস ... দানো জেগে উঠেছে।
৷৷ ২ ৷৷
" আমরা যখন খুব ছোট, আমাদের এই গোষ্ঠীতে একজন খুব দুরন্ত ছেলে ছিল। আমাদেরই বন্ধু আর কী ... ওর নাম ছিল রিদাস। আমরা ছোট থেকেই একসঙ্গে থাকতাম, একসঙ্গে অস্ত্র চালানো শিখেছিলাম, হ্যাঁ, এখন যেমন তোমরা শিখছো। তবে রিদাসের সব ভালো হলেও ও ছিল খুব কৌতূহলী, কারোর কথাই তেমন শুনতো না। বড়রা যা যা করতে বারণ করতো তাই করে বসতো ও, যেন সেটা না করলে চলবেই না। আমাদের সবাইকেও সঙ্গে নেওয়ার চেষ্টা করতো, কিন্তু আমরা যেতাম না ওর সঙ্গে, কে যাবে? সবাই যে বারণ করেছে। ওকে বারণ করতাম কিন্তু ও কোনো বারণ শুনতো না।"
" কী করতো ও?"
" ও বেরিয়ে পড়তো একা একা, বাবাদের সঙ্গে শিকারে চলে যেত জোর করে, ওকে নিয়ে না গেলে ও লুকিয়ে লুকিয়ে পিছু নিতো। এভাবেই একদিন লুকিয়ে লুকিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎই ওর সামনে পড়ে গেল ..."
" কী বাবা!?"
" একটা ভীষণ বড় দাঁতওয়ালা জন্তু। দেখতেও বিশাল, আর গর্জনও। হঠাৎ রিদাস ওকে সামনে দেখতে পেয়ে ভয় পেলেও পালাতে পারলো না, হয়তো বুদ্ধি লোপ পেয়েছিল। যখন জ্ঞান হলো তখন পালাতে চেয়েও পালাতে পারলো না। এক বিশাল থাবায় রিদাসকে একদম পিষে ফেলে দিয়েছিল।"
ইদ্রিস, রেইসা আর আরো ছোট যারা বসেছিল সবাই শুনে কেঁপে ওঠে ভয়ে। " তা ..তা .. তারপর?"
" তারপর তেমন কিছু না, আমরা আর কেউ বেরোতাম না আরোই, বড়দের কথা শুনতাম, বড়রা যখন নিয়ে যেতে চাইতো তখনই যেতাম।"
পেছনে কিছুদূরে বসা গোষ্ঠীর বড়রা যেন একটু হেসে উঠলেন। মেগাদ্রিস ওদের দিকে তাকাতে সবাই ভয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বা মাথা নামিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে লাগলেন।
ইদ্রিস এত ভয় পেয়েছে ও কিছুই দেখতে পায়নি। ওর মনে অনেক প্রশ্ন। একবার ভুল করে ও গুহা থেকে বেরিয়ে বাইরে গিয়েছিল, একটা রঙিন পাখির পিছু নিতে নিতে চলে গিয়েছিল, আর তখনই টের পেয়েছিল কতটা আলাদা জগৎ এই গুহার বাইরে, কত কী দেখার আছে, চারপাশের সবকিছু দেখে মনে মনে প্রশ্ন জাগছিলো, এটা কী, ওটা কীভাবে হতে পারে, সেটা কেন ঐরকম, এরকম তো আগে ও দেখেনি, কিন্তু কেউ তো ধারেকাছে নেই, তাই কেউ ওকে কিছু উত্তর দিতে পারেনি। এদিকে বাবা-মা ওকে খুঁজে না পেয়ে অস্থির হয়ে গিয়েছিলেন। অনেক ডাকে ওকে না পেয়ে তন্ন তন্ন করে খুঁজছিলেন আশপাশে সবটা, খুঁজতে খুঁজতে বাবা ওকে হঠাৎই দেখতে পান একটি গাছের পাশে, গাছটিতে ঝুলে আছে বড় বড় ফল, এই ফল মেগাদ্রিস চিনতেন, বিষাক্ত ফল, খেলে শ্বাসরোধ হয়ে আসে, ওর গোষ্ঠীর দুই একজন প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেয়েছে। মেগাদ্রিস দৌড়ে এসে ওকে কোলে তুলে নিয়েই ছুট লাগান ওখান থেকে। ও কোলে বসে অনেককিছু জিজ্ঞেস করছিল কিন্তু কিছুই যেন বাবার কানে পৌঁছয়নি। শুধু বাবা ওকে গুহার সামনে নামিয়ে শান্ত ধীর গলায় বলেছিলেন, " আর কোনোদিনও গুহার বাইরে যাবে না।"
তারপর থেকে রোজই বাবা এরকম কারোর না কারোর মৃত্যুর গল্প শোনায়, যারা বড়দের কথা না শুনে গুহার বাইরে গেছে কিন্তু আর বেঁচে ফেরেনি।
ইদ্রিস গল্প শুনে মায়ের কোলে সিঁটিয়ে যায়। মা রেলিয়া মেগাদ্রিসকে এবার থামতে ইশারা করেন।
" তাহলে তোমরা সবাই মনে রাখবে তো?" বলে মেগাদ্রিস উঠে যান। আলো আঁধারিতে মেগাদ্রিস ভালো করে দেখতে পান না ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ইশারাতে উত্তর দিলো কিনা।
রেলিয়া ইদ্রিসকে জড়িয়ে ধরেন। ইদ্রিস তাঁর একমাত্র সন্তান। সাধারণত গোষ্ঠীর আর সব মায়েদের একাধিক সন্তান থাকলেও রেলিয়া ইদ্রিসের পর আর সন্তানধারণ করতে পারেননি। তাই বারবারই তাঁর মনে হয় ইদ্রিস বিশেষ কোনো ক্ষমতার অধিকারী যা একদিন ঠিক প্রকাশ পাবে। একমাত্র সন্তান হওয়ায় ইদ্রিসকে তিনি ভীষণ আগলে রাখেন, এমন অনেককিছুর সঙ্গে পরিচয় করানোর চেষ্টা করেন যা দলের আর কারোর নজরে পড়ে না। রেলিয়া জানেন, তাঁদের জীবনে জীবন-মৃত্যু শুধু মুহূর্তের পার্থক্য। বিপদ যেকোনো সময় আসতে পারে আর রেলিয়ার জীবনের প্রধান লক্ষ্য হলো সমস্ত রকম বিপদ থেকে ইদ্রিসকে বাঁচিয়ে রাখা।
৷৷ ৩ ৷৷
মেগাদ্রিসের বাবা যখন বেঁচে ছিলেন তখন থেকেই তাঁদের গোষ্ঠী বা দলের মধ্যে মেগাদ্রিস পরিবর্তন লক্ষ্য করেছিলেন। যেসব গোষ্ঠীরা বেশি মানুষের সন্ধান করে নিজেদের গোষ্ঠীভুক্ত করতো আরো বেশি শিকারের সম্ভাবনায়, বনের হিংস্র জন্তু জানোয়ারদের সঙ্গে লড়াইয়ে নিজেদের সুরক্ষিত রাখার চেষ্টায়, সেই গোষ্ঠীগুলোই দলগুলোকে ছোট করতে শুরু করে, একটা বড় গোষ্ঠীর সবার জন্য পর্যাপ্ত খাবারের সন্ধান না পাওয়া ছিল এর মূল কারণ। শিকারের সন্ধানে ক্রমাগত চলতে থাকাই ছিল তাঁদের জীবন। শিকারের পিছু নিয়ে অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছে যেত একটা সম্পূর্ণ অন্য জায়গায়। দিন দিন এই এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়ার জন্য অবস্থার পরিবর্তন তাঁদের দুর্বল করছিল, কমে যাচ্ছিল লড়াই করার ক্ষমতাও। মেগাদ্রিস মনে করতেন জীবন ধারণের এটাই একমাত্র পথ হতে পারে না । কিন্তু কোনটা যে পথ তা তিনি অনেক ভেবেও বুঝতে পারতেন না।
মেগাদ্রিস একটা জিনিস বুঝতেন তাঁদের এই নিরন্তর চলতে থাকা তাঁদের জীবনকে কঠিন করে দেয়। তিনি টের পেয়েছিলেন বেঁচে থাকতে গেলে তিনটে জিনিসের দরকার তা হলো, জল, মাংস আর নিরাপদ থাকার জায়গা। তাই তিনি চেষ্টা করলেন কোনো জলরাশির কাছাকাছি যেতে, চেষ্টা করলেন তাঁর সঙ্গে এমন কিছুজনকে নিতে যাঁরা পাথরের মুখ সূচালো বানিয়ে খুব ভালো মজবুত অস্ত্র বানাতে পারেন, যাতে দূর থেকেই শিকারকে আক্রমণ করা যায়, শিকারকে কাবু করতে যেন লড়তে বেশি না হয়। এক জায়গায় বেশীদিন থাকলে অস্ত্র বানানোর কাজও অনেকটা এগিয়ে যায়। মেগাদ্রিসের নিজের একটা ধারালো সূচালো পাথরের অস্ত্র রয়েছে যা তাঁর উন্নত পেশির শক্তির জোরে অনায়াসেই ঘায়েল করতো দূরে থাকা জীবজন্তুদের। জীবজন্তুরা একটু কাবু হয়ে গেলে দলের অন্যান্য ছেলেরা অন্য ধারালো অস্ত্র ছুঁড়ে আঘাত করতো শিকারকে, আর শেষে মজবুত বড় পাথরের অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে নিঃশেষ করে দেওয়া হতো শিকারের প্রাণকে।
মেগাদ্রিস, দপলস, বেকরাকাস, গ্রগ, গেটিনা আজ একসঙ্গে বেরিয়েছেন। খাদ্যের সঞ্চয়ে খুব টান পড়েছে এবার। আজ বড়সড় কোনো জন্তুকে মেরে নিয়ে যেতে হবে, খুব ভালো হয় যদি একাধিক শিকার তাঁরা করতে পারেন, নাহলে ওঁদের সামনে সত্যি বিপদ। এমনিতেই দলের কিছুজন মেগাদ্রিসের এই এক জায়গায় কিছুদিন থাকার সিদ্ধান্তকে আর ভালো চোখে দেখছে না। এতে খাটনি কমছে কিন্তু খাদ্যের সন্ধানও কমছে। কিন্তু মেগাদ্রিস অনেক বুঝিয়েও পারছেন না যে আশেপাশে সত্যিই শিকারের অভাব ঘটেছে, অনেকদূর যাত্রা করার মতো শক্তি, খাদ্য সঞ্চয় করে তবে এগোনো উচিত, নইলে পথে মারা পড়তে হতে পারে।
৷৷ ৪ ৷৷
ইদ্রিসের কাছে এই সূর্য ডুবে যাওয়ার সময়টা বেশ আনন্দের। অনেক গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে সূর্য ওর সঙ্গে খেলতে থাকে, কখনো ও দৌড়ে গাছের গুঁড়ির পেছনে গিয়ে সূর্যের আড়াল হয় আবার কখনো এদিক ওদিকে থাকা ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে। এই সময়টা সূর্যের তেজ গায়েও লাগে না দিনের বাকি সময়ের মতো। সূর্য দূরের লম্বা লম্বা গাছগুলোর আড়ালে গেলেই মা ওকে নিয়ে গুহার বাইরে আসে। গুহার বাইরে এসে মা হাতটা ছেড়ে দেয় আলতো করে, ইদ্রিস দৌড়ে নেয় প্রথমেই একটু, অন্ধকার থেকে আলোতে আসার আনন্দ হয়তো। বেরোনোর সময় এক দমকা হাওয়া যখন ওর শরীর ছুঁয়ে গুহার ভেতর ঢুকে সোঁ সোঁ আওয়াজ সৃষ্টি করে তখন ওর খুব ভালো লাগে। মা ওকে দেখে হাসেন, ইদ্রিসকে নজরের সামনে রেখে ডালপালা কুড়োতে থাকেন, শক্ত পাথর খোঁজাও আরেকটা কাজ। মাকে দেখে ইদ্রিসও নানা জিনিস কুড়িয়ে বেড়াতে থাকে। তবে রেলিয়ার মতো ও জানে না কোন জিনিসটা নিতে হয়, কোনটা নিতে নেই। ওর ছোট্ট মুঠোয় যতটা আসে ও নিয়ে মাকে দিয়ে দেয়। কখনো ও গাছের নিচে পড়ে থাকা শুকনো পাতা কুড়োয়, হয়তো সেইসময় মুঠোর ভেতর কিছু পোকামাকড় চলে আসে। ইদ্রিস উত্তেজনায় লাফিয়ে উঠে জিজ্ঞেস করে, " মা, খেয়ে নেব?" বা কিছু ফুল কুড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, " মা এগুলো নেব?" কখনো কীসব ছোট ছোট দানা কুড়িয়ে মায়ের সামনে ঢেলে দেয়। কুড়োতে থাকার সময় এরকমই অনেককিছু জিজ্ঞেস করতে থাকে, রেলিয়া কখনো উত্তর দেন, কখনো হাসেন, বিপদের কিছু দেখলে হাত থেকে ফেলে দেন, কখনো আবার সামান্য বিরক্ত হয়ে যান। তবে ইদ্রিস কোনো উত্তর শোনারই অপেক্ষা করে না, প্রশ্ন করাটাই আসল।
আজ বাবা আর অন্যান্যরা বেরিয়েছেন বিকেল থাকতেই, দূরে কোথাও গিয়েছেন। ফিরতে ফিরতে হয়তো সূর্য ডুবে যাবে। ইদ্রিসের মাথায় হঠাৎ এলো, " মা, বাবারা কেন শিকারে যায়?"
রেলিয়া বেশ শক্ত একটা সরু পাথর খুঁজে পেয়েছেন, এটা দিয়ে ভালো অস্ত্র বানানো যাবে, মেগাদ্রিসের এখনকার অস্ত্রের ফলার থেকেও এটা আরো তীক্ষ্ণ হবে হয়তো। মনটা বেশ খুশি হলো, নাহলে আজকাল যেন দুশ্চিন্তা কাটতে চায় না, দুশ্চিন্তা, বাঁচার চিন্তা। এইসময় ইদ্রিসের প্রশ্ন শুনে রেলিয়ার হাসি পেয়ে গেল। কিছুক্ষণ হাসতে রেলিয়া দেখলেন ছেলের মুখ ঝুলে পড়েছে, এই প্রথমবার। প্রশ্ন করবার পর তো এরকম হতে কোনোদিন দেখেননি। তিনি কাছে এসে হাঁটু গেড়ে বসে বললেন, " শিকার না করলে যে আমরা বাঁচতে পারবো না। আর বাবা কেন, আমিও শিকারে যেতাম। তুমি আসার পর কমিয়ে দিয়েছি। শিকার করে না খেলে যে ইদ্রিস বাবার মতো শক্তিশালী হবে না।"
ইদ্রিস খানিক ভেবে বললো, " যদি এই ফলমূল খাই শুধু, তাহলে?"
" তাহলে তুমি দুর্বল হয়ে পড়বে। হিংস্র পশুর মোকাবিলা করতে যে শক্তির প্রয়োজন। শুধু তো খাওয়া নয়, ওদের হাত থেকে নিজেদের বাঁচাতেও শক্তির দরকার।"
" আমার ভালো লাগে না এইভাবে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে বারবার।"
রেলিয়া কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে গেলেন। না, এই ভাবনাটা থাকুক, মেগাদ্রিসের মনেও ছোট থেকে এই ভাবনা আছে, শুধু উত্তর মেলেনি। ইদ্রিসের মনেও থাকুক। ও হয়তো উত্তরটা খুঁজে পাবে।
ইদ্রিস দুই হাতে মুঠো করে অনেককিছু কুড়িয়ে নিয়েছে। প্রতিদিন নেয় আর গুহার ভেতরে গিয়ে রেলিয়া এক এক করে সব গুছিয়ে রাখেন, পাথর, ফুল, ডালপালা আরো কত কী। ওগুলোকে আবার ইদ্রিসের মাথার কাছে রাখতে হয়, নাহলে ঘুম হয় না। ইদ্রিস যখন ঝোপে ঝোপে ঘুরছে, হঠাৎই ওর সামনের ঝোপটা যেন নড়ে উঠলো। রেলিয়ার নজর এড়িয়ে যায়নি। হাতের ডালপালা, পাথরটা ফেলে কোমরে আটকানো একটা সরু পাথরের ফলাকে হাতের মধ্যে শক্ত করে ধরলেন। ইদ্রিসকে নিজের কাছে টেনে নিলেন। ইদ্রিস একটু ভয় পেয়েছে। ও একদৃষ্টে সামনের ঝোপের দিকে তাকিয়ে। শেষ বিকেলের পড়ন্ত আলোয় দুজনে দেখলো ঝোপ থেকে বেরিয়ে এলো একটা ছোট্ট চারপেয়ে জন্তু। গায়ের রং বেশ উজ্জ্বল। মাঝে মাঝে আবার অন্য রঙের অনেকগুলো ছোপ রয়েছে। জন্তুটি আকারে খুবই ছোট, ছোট্ট ইদ্রিসেরও হাঁটুর সাইজের। রেলিয়া খুশি হলেন। খাদ্যের লোভে মনটা সজাগ হয়ে গেল। ওদের দুজনকে দেখে জন্তুটা ভয় পেলো না কোনো, যেন ভয় বলে কিছু হয় তাই জানে না, লেজ নাড়তে নাড়তে ওদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো, রেলিয়া ফলাটা উঁচু করে ধরলেন, এখান থেকে ছুঁড়লেই নিশ্চিত মৃত্যু। ইদ্রিস পেছনে ঘুরে মাকে দেখে সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলো, " না মা, মেরো না।"
ইদ্রিসের গলার স্বরে যেন কিছু ছিল। রেলিয়া হাত নামিয়ে নিলেন। জন্তুটা এসে ইদ্রিসের দিকে একবার মাথা উঁচু করে দেখে ইদ্রিসের পা চাটতে লাগলো। ইদ্রিসের বেশ ভালো লাগলো। ও ঝুঁকে বসে জন্তুটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে শুরু করলো, যেমন রোজ ওর মা ওকে দেয়। জন্তুটা আরো বেশি করে লেজ নাড়তে শুরু করলো। সঙ্গে সঙ্গে জন্তুটা উল্টে ডিগবাজি খেলো। তারপর আবার সোজা হয়ে ইদ্রিসের গায়ের ওপর ওঠার চেষ্টা করতে লাগলো। ইদ্রিসও ওর ছোট্ট দুই হাত দিয়ে ওকে যেন কোলে তুলবে, পারলো না, তবে ইদ্রিসের ভারী মজা হয়েছে। হাসিতে খিলখিল করে উঠলো ও।
রেলিয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলেন। এরকমও বুঝি হয়? এতদিন ওরা পশুদের সঙ্গে আর পশুরা ওদের সঙ্গে শুধু লড়ে গিয়েছে খাদ্যের জন্য, জায়গার জন্য, অধিকারের জন্য, কিন্তু এই নতুন জন্তু যে ইদ্রিসের পেছনে ঘুরঘুর করছে। আর ইদ্রিস কী করে ওকে আদর করছে, স্বভাব অনুযায়ী দুজন দুজনকে দেখে ভয় পাচ্ছে না কেন? রেলিয়ার হাত মাঝে মাঝেই পৌঁছে যাচ্ছে ওর অস্ত্রের ওপর। কিন্তু রেলিয়া নিজে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। ইদ্রিস দৌড়োচ্ছে তো ওর পেছনে জন্তুটাও দৌড়োচ্ছে, ইদ্রিস থামছে তো সেও থামছে। রেলিয়া তাড়াতাড়ি ফেলে রাখা সব জিনিসগুলো হাতে, কোলে তুলে নিয়ে হাঁটা লাগালেন ইদ্রিসের এক হাত ধরে। পেছনে ফিরে অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলেন, ছোট্ট পশুটাও ওদের পেছনে আসতে শুরু করেছে।
৷৷ ৫ ৷৷
মেগাদ্রিস বুঝছেন এবার আস্তানা পাল্টাতে হবে। আশেপাশে খাদ্যের জোগান অনেক কমে গেছে। তাঁদের উপস্থিতি যেন এই বিশাল জঙ্গলে সবাই টের পেয়ে গেছে, তাই হয়তো পালিয়েছে বা হয়তো অন্য কোনো কারণ, দানো জেগে উঠছে বলে কি? এখন মাঝে মাঝেই এক চাপা গুম গুম আওয়াজ হয়, এই আওয়াজ খুব নতুন কিছু নয়, বাবার মুখে শুনেছেন তিনি দানোর কথা, কিন্তু সবটা ওঁর বাবাও নিজেও জানতেন না, তাই এই অজানাকে আরো ভয় হয়। আজই গিয়ে সবাইকে জায়গা পাল্টানোর কথা বলতে হবে। কিন্তু এই জায়গাটা বড় ভালো ছিলো। গুহা আর তার পাশে কিছুদূরে জলাশয়। একসঙ্গে দুটো জিনিস এত কাছে আর পাননি ওঁরা এর আগে।
মেগাদ্রিস তাঁর নিজের হাতে বানানো অস্ত্রটার একদিক শক্ত করে ধরলেন। বড় কাজের এই অস্ত্রটি। লম্বা হালকা মজবুত কাঠের মুখে সরু একটা সূচালো পাথর শক্ত করে আটকানো। হালকা হওয়ায় অনেকটা দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে। তারপর মেগাদ্রিস একটি নতুন কৌশল শিখেছেন যাতে শিকারের কাছে না গিয়েই অনেক দূর থেকে শিকারকে ঘায়েল করা যায়। আগে ওঁরা সবাই দাঁড়িয়ে শিকারের প্রায় কাছে গিয়ে শিকার করতেন, এতে ওঁদের আহত হওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যেত। কিন্তু এখন শিকার যদি প্রায় স্থির অবস্থায় থাকে, তাহলে মেগাদ্রিস পেছনের দিকে সামান্য ঝুঁকে হাতটা সামান্য তুলে অস্ত্রের মুখটা সোজা না রেখে সামান্য তেরচা রেখে আকাশের দিকে ওঁর অস্ত্রটা ছোঁড়েন। একটু ওপরের দিকে উঠে অস্ত্রটা অনেকটা পথ পেরিয়ে নিচের দিকে নেমে দূরে থাকা শিকারকে ঠিক ঘায়েল করে। বেশ কিছু শিকার করেছেন এইভাবে ওঁর এই অস্ত্র দিয়ে।
শেষ বিকেলের আলো আবছায়ায় দুটো ছায়া জলাশয়ের দিকে এগোতে লাগলো। ঠিক টেরও পেলো না যে আরো কিছু ছায়া তাদের দূর থেকে অনুসরণ করে চলেছে। মেগাদ্রিস দেখলেন চারপেয়ে ছায়া দুটোর একটা বড়, একটা ছোট। বড় বড় গাছের তলায় ছোট ছোট ঝোপের পেছনে মেগাদ্রিসরা লুকিয়ে বসে থাকলেন, অপেক্ষা করতে লাগলেন তাদের জল খাওয়ার। মেগাদ্রিস একটা হাঁটু মাটিতে রেখে অন্য হাঁটু তুলে অস্ত্রটি ছোঁড়ার জন্য তৈরি হলেন। কোনো জন্তুর গলা বরাবর ছুঁড়তে পারলেই অনেকটা কাজ হয়ে যায়। কিন্তু ছুঁড়তে গিয়ে মেগাদ্রিস আটকে গেলেন। পশু দুটিকে দেখে হঠাৎই তাঁর একমুহূর্তের জন্য রেলিয়া আর ইদ্রিসের কথা মনে পড়ে গেলো। কেন এরকম হলো? হাতটা স্থির হয়েই রইলো, বাকিরা মেগাদ্রিসের অস্ত্র চালানোর অপেক্ষা করছিলেন, তাঁরা অবাক হয়ে মেগাদ্রিসকে নাড়া দিলেন জোরে। মেগাদ্রিস কেমন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন। কেন এমন হলো? এরকম তো হওয়ার কথা নয়। অস্ত্রটি ছুঁড়তে গিয়েও ছুঁড়তে পারলেন না, হাত নামিয়ে রাখলেন। এত কাছে এসে শিকার হাতছাড়া হবে কেউ ভাবেননি, পাশ থেকে তিনজন ক্ষিপ্ত হয়ে ঝোপ থেকে বেরিয়ে দৌড় লাগালেন, তাঁদের কাছে মেগাদ্রিসের মতো উন্নত অস্ত্র নেই তাই তাঁদের অস্ত্রের যাত্রাপথও সীমিত। ছুট লাগানোর সঙ্গে সঙ্গেই এক প্রকট আর্তনাদে কেঁপে উঠলো সমস্ত জঙ্গল, যেন পায়ের নিচের মাটি হঠাৎ চলতে শুরু করেছে, দৌড়তে থাকা তিনজন মুখ থুবড়ে পড়লেন, পড়ে গেলেন ঝোপের আড়ালে থাকা মেগাদ্রিসও। জন্তু দুটির আর চিহ্ন দেখা গেল না। কয়েক মুহূর্তে সবটা এভাবে পাল্টে যাবে মেগাদ্রিস চিন্তাও করেননি। উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতেই তিনি কেঁপে উঠলেন। রেলিয়ার কাছে যেতে হবে, ইদ্রিসের কাছে। প্রলয় আসছে।
৷৷ ৬ ৷৷
রেলিয়া কুড়িয়ে আনা পাথর, ফুল, ফল সব আলাদা করতে লাগলেন। আজ কিছু রংবাহারি ফুল পেয়েছেন। আগুনের আলোয় গুহার ভেতরটা অতি উজ্জ্বল। গুহার গায়ে ফুটে উঠেছে নানা চিত্র। রেলিয়া নিজে ফুলগুলো পিষে বা পশুর চর্বি গলিয়ে সেটা একটু ঠান্ডা হলে তা দিয়ে দেওয়ালে আঁকতে থাকেন, যখন যা মনে হয়। এই গুহায় এসে এটাই তাঁর সবচেয়ে বড় পাওয়া। তাঁর বেশিরভাগ আঁকা ছবিই অস্ত্র বা পশুদের সঙ্গে লড়াইয়ের। তিনি ফুলগুলো পিষতে লাগলেন, চর্বির থকথকে রসের সঙ্গে মিশিয়ে দিলেন। গুহার ভিতর বিভিন্ন যে গর্ত থাকে, সেখানে তিনি এই তরল জমিয়ে রাখেন। পাশে বসে ইদ্রিস আপনমনে দেওয়ালে কী যেন ঘষে চলেছে, এতক্ষণ তিনি খেয়াল করেননি। খেয়াল করতেই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলেন, সত্যিই ইদ্রিস কী এতটা আলাদা, ইদ্রিসের ছোট ছোট হাতের টানে ফুটে উঠছে আজকের বিকেলের চিত্র, ঠিক কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া সময়ের ছবি। এতটা সুন্দর কেউ আঁকতে পারে তা রেলিয়ার বিশ্বাস হচ্ছে না। ছবিটির সবটাই অস্পষ্ট, তবু বোঝা যায় ইদ্রিস কী এঁকেছে, কী বোঝাতে চেয়েছে। গুহার গর্তে জমে থাকা রং গুলো দিয়ে ইদ্রিস যেন আপনমনে খেলছে। ওপরে উজ্জ্বল আকাশ, আর নীচে দুটো মানুষ হেঁটে চলেছে, একটু দূরে পেছনে পাপলুস। ওদের ডেরার নবাগত এই জন্তুটার এই নামটাই দিয়েছে ইদ্রিস। জন্তুটা গুহায় প্রথমে ঢুকতে চায়নি। তবে ইদ্রিস জোরাজুরি করায় ঢুকে পড়ে গুটিগুটি পায়ে। গোষ্ঠীর বাকি সবার লোলুপ দৃষ্টি এসে পড়েছে জন্তুটার ওপর। বুঝতে পেরে রেলিয়া সবাইকে বোঝান, ঠিক কী বোঝান তা তিনি নিজেও জানেন না, শুধু এটুকু বোঝানোর চেষ্টা করেন, জন্তুটি ইদ্রিসের খুব পছন্দের, তাই জন্তুটিকে কেউ যেন আঘাত না করেন। চুপচাপ থাকা ইদ্রিসকে গোষ্ঠীর সবাইই খুব ভালোবাসেন। তাই সবাই বারবার অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলেও কিছু করতে যাননি এখনো অব্দি। ইদ্রিসের প্রতি ভালোবাসা নিজেদের চরম প্রবৃত্তিকে কতক্ষণ আটকে রাখতে পারবে তা রেলিয়া নিজেও জানেন না। আজ মেগাদ্রিসরা কিছু আনুক, নইলে সত্যি হয়তো জন্তুটিকে রেলিয়া বা ইদ্রিস কেউই আগলে রাখতে পারবে না।
রেলিয়া ইদ্রিসের মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিলেন। হঠাৎই পাপলুস খুব জোরে ডাকতে লাগলো, ছটফট করতে লাগলো নিজের জায়গা জুড়ে। দলের কিছুজন অস্ত্র শক্ত হাতে ধরে এগোতে লাগলেন। ইদ্রিস সহসা পাপলুসের কাছে ছুটে গেল। রেলিয়া হাত ধরে আটকাতে গিয়েও আটকাতে পারলেন না। পাপলুস গুহার বাইরের দিকে দৌড়তে লাগলো, পেছনে ইদ্রিসও।
৷৷ ৭ ৷৷
কিছুক্ষণ হয়েই মাটির কাঁপন থেমে গেছে। মেগাদ্রিসের মাথা খুব ঘুরছে, দাঁড়িয়ে ওঠার চেষ্টা করতে গিয়েও পারলেন না। দপলস উঠে দাঁড়িয়েছেন। মেগাদ্রিসের দিকে তীব্র ভর্ৎসনার দৃষ্টিতে দেখে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। মেগাদ্রিস লজ্জায়, অনুশোচনায় দৃষ্টি নামিয়ে নিলেন। তিনি সত্যিই জানেন না, আজ কী হলো তাঁর। কেন তিনি অস্ত্র ছুঁড়তে পারলেন না। এরকম কোনোদিনই হয় না। দপলস বাকি সবাইকে বলে উঠলেন, " দানো জেগে উঠছে, প্রলয় আসার সম্ভাবনাও দূরে নেই। আজকের মধ্যেই আমাদের অনেক শিকার চাই। তাহলে আমরা সেই সমস্ত খাদ্য সঞ্চয় করে এই এলাকা ছাড়বো। জানি এই সবটাই মেগাদ্রিসের ভাবনা, তবে আজকের পর আমরা মেগাদ্রিসের কোনো কথা শুনবো না। নিজেদের মতো চলবো। তাই আমি ঠিক করেছি শিকার সন্ধানের চরম পথ নেওয়ার। তোমরা কি রাজি?"
মেগাদ্রিস জানেন চরম পথ কী, তিনি শিউরে উঠলেন। মেগাদ্রিসরা জঙ্গলের এক প্রান্তের গুহায় থাকেন। গুহার পেছনদিক থেকে ওঁরা এসেছেন, ঐদিকে তাই ফিরে যেতে চান না আর, ওদিকে গেলে খাদ্যের অভাবও ঘটবে। গুহার সামনের দিকে জঙ্গল পেরিয়েই দাঁড়াতে হয় দানোর সামনে। এই দূর থেকে শুধু দানোর ছোট মাথাটা দেখা যায়, এখান থেকে ছোট মনে হলেও আসলে দানোর মতো বৃহৎ কিছু নেই, মেগাদ্রিসের বাবা বলেছিলেন। গুহার আর দুই দিকেও শুধু জঙ্গল, একদিকে বেশ কিছুটা জঙ্গল শেষে কিছুটা ফাঁকা জমি, সেটা পেরিয়ে গায়ে গায়ে কিছু ছোট পাহাড় আছে আর তার অন্য পারে কী আছে তা ওঁরা জানেন না। আর অপরদিকে জঙ্গল কত বড় তার ধারণাও তাঁদের নেই। দানো যে ফুঁসছে তা মেগাদ্রিস ভালো করেই জানেন। সে জেগে উঠলে তার প্রকোপ থেকে বাঁচার জন্য কোনদিকে যাবেন তাঁরা? জঙ্গলের দিকে না পাহাড়ের দিকে? কিন্তু চরম পথ নেওয়া মানে এই সমস্ত জঙ্গলে থাকা প্রতিটি জীবের প্রাণ আশঙ্কায় ফেলে দেওয়া, জঙ্গলে আর থাকা যাবে না। একদিকে যাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যাবে চিরদিনের মতো। সবকিছু ভেবে মেগাদ্রিস কাকুতি মিনতি করে উঠলেন।
" জঙ্গলে আগুন লাগালে সব জন্তুর সঙ্গে আমাদের সবারই প্রাণ বিপন্ন হবে। আমায় নেতা মানতে হবে না। কিন্তু একটু ভেবে ..."
গ্রগ বলে উঠলেন, " আমরা তার আগেই জঙ্গল ছেড়ে পাহাড়ের দিকে যাব।"
" গোষ্ঠীর সবাইকে নিয়ে পাহাড় অতিক্রম করা সোজা ব্যাপার নয়, কিন্তু জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যাওয়া অনেক সোজা। জানি, দানো জেগে উঠলে কোনো পাহাড়, জঙ্গলই আমাদের রক্ষা করতে পারবে না। আমাদের আজই এই এলাকা ছেড়ে এই পাহাড়গুলো ডিঙিয়ে দূরে যেতে হবে। নাহলে উল্টোদিকে সমস্ত জঙ্গল পেরিয়ে আরো আলোর দিকে যেতে হবে।"
" আলোর দিক মানে সূর্য ওঠার দিকে?"
" হ্যাঁ। আমি ভুল ছিলাম, একটা জায়গায় এতদিন না থাকলে হতো, খাদ্য সঞ্চয় করার মতো সময় নেই আমাদের কাছে। কাল সূর্য উঠলেই আমাদের যাত্রা শুরু করতে হবে। এখন সবাই গুহায় ফিরে যাই।"
সবাই চুপ করে থাকলেও দপলস যেন ফুঁসছে, তা মেগাদ্রিসের নজর এড়ালো না।
৷৷ ৮ ৷৷
তাহলে কী মাটি কেঁপে ওঠা, দানো জেগে ওঠার সম্ভাবনা পাপলুস আগেই টের পেয়েছিল? রেলিয়া ঠিক বুঝতে পারেন না। নাহলে ঠিক মাটি কেঁপে ওঠার আগে পাপলুস ঐভাবে ছটফট করছিল কেন? ওঁরা সত্যি সবাই ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন মাটি কেঁপে ওঠার সময়। গুহার ভেতর ফেরত এসেও ভয়টা ঠিক যাচ্ছে না। যদি আবার কিছু হয়! ইদ্রিসও খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল। ওর জীবনে এরকম প্রথমবার। না, ইদ্রিসকে আর ভয় পেতে দেবে না রেলিয়া।
মেগাদ্রিস শিকার করতে পেরেছে? কখন ফিরবে ওরা? সূর্য ডুবে গেছে অনেকক্ষণ আগে। ঐ তো মেগাদ্রিস ঢুকছে।
দপলস, গ্রগ ঢুকতেই চেঁচিয়ে ওঠেন, " এই তো শিকার! কিন্তু এখনো বেঁচে কেন?"
নিজেদের গুহায় এক জ্যান্ত পশুকে দেখে শিকারে যাওয়া সবাই বেজায় চমকে গেলেন। দপলস হতভম্ব ভাব কাটিয়ে এগোতে লাগলেন পশুটার দিকে। দপলসের ক্ষিপ্রভাব দেখে ইদ্রিস পাপলুসকে জড়িয়ে ধরলো। রেলিয়া রুখে দাঁড়ালেন ছেলেকে দেখে।
" দপলস, ওকে ছেড়ে দাও। ইদ্রিস ওকে কাছছাড়া করতে চায় না। ওকে ছেড়ে দাও।"
দপলস কিছু বুঝতেই পারলেন না। একটা পশু তাদের খাদ্য। তাকে জড়িয়ে ধরার মানে? হুঙ্কার ছেড়ে বললেন, " তোমরা ভেবেছো কী? মেগাদ্রিসের জন্য আজ দুটো শিকার ছেড়ে দিতে হলো, এখন গুহায় হাতের কাছে থাকা শিকারকে তোমরা বাঁচাচ্ছ। মেগাদ্রিস, কাল আমি এই জঙ্গলে আগুন লাগাবোই, আমরা গুহা ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার পরই। তোমরা শিকার করবে না, কোনো পশুকে খাবে না ঠিক আছে, আমরা সবাই ঐভাবে বাঁচতে পারবো না।"
মেগাদ্রিস পুরো ব্যাপারটা দেখে ভীষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলেন। শুধু রেলিয়া চোখ দিয়ে আশ্বস্ত করতে লাগলেন যেন, ‘সব ঠিক আছে, সব ঠিক হয়ে যাবে।’
৷৷ ৯ ৷৷
" রেলিয়া, রেলিয়া, রেলিয়া ..."
মেগাদ্রিসের গলা থেকে স্বর বেরোচ্ছে না। এটা কী করলো সবাই? দলের প্রতি ওঁর সব কাজ, সব ত্যাগ এইভাবে ভুলে যেতে পারলো? এতটুকু আটকালো না কারো? ভয়ে ওঁর হাত পা কাঁপছে। ইদ্রিসের ঘুমন্ত, শান্ত মুখটা দেখে চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে এলো। না, এখন ভেঙে পড়লে চলবে না। এক্ষুণি পালাতে হবে, এক্ষুণি।
এবার জোরে ঝাঁকুনি দিয়ে ফ্যাসফেসে গলায় মেগাদ্রিস ডাকতে লাগলেন, " রেলিয়া, রেলিয়া, রেলিয়া …"
রেলিয়া ধড়মড় করে উঠে বসলেন।
" কী হয়েছে?"
" ইদ্রিসকে কোলে নাও, আমাদের এক্ষুণি গুহা ছেড়ে পালাতে হবে।"
রেলিয়ার চোখে অনেক প্রশ্ন। গুহার চারিদিকে চোখ যায়। কেউ নেই কোথাও। একটা ভয় আসে মনে, অজানা আশঙ্কায় সমস্ত স্নায়ু সজাগ হয়ে ওঠে, তবু কোনো প্রশ্ন করেন না। এরইমধ্যে ইদ্রিসকে কোলে তুলে নিয়েছেন। ইদ্রিসের মুঠোর মধ্যে কীসব যেন ধরা। মুঠো খুললেন না। যদি ঘুম ভেঙে যায়! গুহার বাইরে যেন কীসের আলো জ্বলছে। মেগাদ্রিস ওঁদের দুজনের কোমরের সঙ্গে অস্ত্রগুলো বেঁধে নিলেন। " চলো, রেলিয়া, পালাতে হবে।"
গুহার বাইরে বেরিয়ে আসতেই রেলিয়ার মুখ থেকে এক আর্তনাদ বেরিয়ে আসে। মুখে হাত দিয়ে নিজের আর্তনাদের শব্দ চেপে দেন। গুহার থেকে কিছু দূরের জঙ্গলে শুধু আলোর ছটা। লেলিহান শিখা সব গ্রাস করছে ধীরে ধীরে, যতদূর চোখ যায় ততদূর শুধু আগুন আর আগুন। কতরকম বিভিন্ন জান্তব চিৎকার ভেসে আসছে কানে, বুকের ভিতরটা সেই চিৎকারগুলোয় বারবার কেঁপে উঠছে। সবদিকে যেন এক ভয়ের পরিবেশ। হাওয়ার বেগ বিপরীতে থাকায় এখনো গুহার অপরদিকে যেদিকে ফাঁকা জমি আছে, সেদিকে আগুন ছড়িয়ে যায়নি, শুধু জঙ্গলের দিকেই অগ্রসর হচ্ছে। মেগাদ্রিস রেলিয়ার হাত ধরে টানেন। স্তব্ধবাক রেলিয়া সম্বিৎ ফিরে পেয়ে এগোতে থাকেন মেগাদ্রিসের পেছনে। দানো আর এই সর্বগ্রাসী আগুনের হাত থেকে পালানোর একমাত্র পথ এখন এই জঙ্গল ছাড়িয়ে মাঠ পেরিয়ে পাহাড় ডিঙিয়ে তার অন্য পারে যাওয়া। দুজনে ছুটতে থাকেন। দৌড়ানোর ঝাঁকুনিতে ইদ্রিসের ঘুম ভেঙে যায়।
" মা, পাপলুস কোথায় মা? আমরা কেন ছুটছি? পাপলুস কোথায় মা?"
রেলিয়ার টনক নড়ে। সত্যি ছোট্ট জীবটা কোথায়? তাকে কি দপলসরা নিয়ে গেছে? না তিনি দেখেছেন? গুহার এক কোণে কি সিঁটিয়ে ছিল? তিনি দেখেও দেখেননি, শুনেও শোনেননি? রেলিয়া দাঁড়িয়ে পড়েন। একবেলা আগে দেখা একটা জন্তু, যাদের তাঁরা এতদিন শুধু শিকার করে এসেছেন তাকে ফেলে আসা উচিৎ না ইদ্রিসের জন্য তার কাছে ফিরে যাওয়া উচিৎ?
ইদ্রিস আবার বলে ওঠে, " মা, পাপলুস?"
মেগাদ্রিস বলে ওঠেন, " রেলিয়া দাঁড়ানোর সময় নেই। এই আগুনের হাত থেকে বাঁচতে হবে। আর দানো যদি …"
" তুমি পাপলুসকে গুহার মধ্যে দেখেছিলে?"
" এখন এসব কথা বলার সময় নয়। আমাদের দ্রুত জঙ্গল ছাড়তে হবে।"
রেলিয়ার যেন কিছু মনে পড়ে যায়। " আমি দেখেছিলাম। ছেলেটার বড় মায়া পড়ে গেছে ওর ওপর। একবার চেষ্টা করে দেখি যদি আনা যায়। তাড়াতাড়ি চলো।"
মেগাদ্রিস নিজেও জানেন তিনি দেখেছিলেন। কিন্তু এভাবে আবার মৃত্যুর দিকে পা বাড়ানো? কী হয়েছে আজ ওঁদের তিনজনের? এত অস্বাভাবিকতা কেন এই একদিনে? না এতদিন ধীরে ধীরে এই অন্যরকম ভাবনা মনের ভিতরে কোথাও সযত্নে বেড়ে উঠছিল? রেলিয়ার কোল থেকে ইদ্রিসকে নিজের কোলে নিয়ে দুইজনে আবার জঙ্গলের দিকে, গুহার দিকে ছুটতে লাগলেন।
৷৷ ১০ ৷৷
আগুন এখনো গুহার দিকে ছড়ায়নি, হয়তো দপলসরা নিজেদের বাঁচানোর জন্য জল ছড়িয়ে দিয়ে গেছে গাছে গাছে, যাতে সহজে না ধরে। ফেরার পথে মেগাদ্রিস, রেলিয়ার চোখ এড়ায়নি বিভিন্ন রকম জন্তুদের প্রাণ ভয়ে পালানোর দৃশ্য। তার মানে বিপরীতদিকে আর পালানোর পথ নেই, সব পশুপাখি মাঠের দিকেই দৌড়বে। গুহার এক কোণে সিঁটিয়ে থাকা পাপলুসকে খুঁজে পেতে খুব বেগ পেতে হলো না। গুহা থেকে বেরিয়ে অন্য সব জন্তুদের মাঝে যেন তাঁরাও মিশে গেলেন। মেগাদ্রিস ইদ্রিসকে কোল থেকে নামিয়ে অস্ত্রটি হাতে ধরে দৌড়তে শুরু করলেন। ইদ্রিসের অন্য হাতের মুঠোটা এখনো বদ্ধ, কী ধরে রেখেছে ও? মেগাদ্রিস অন্য পশুদের থেকে ওঁদের চারজনকে নিরাপদে রাখার জন্য তাঁর অস্ত্রের মাথায় আগুন জ্বালিয়ে নিয়েছেন। প্রলয়ের কাছে প্রতিটি প্রাণীই অসহায়। তাদের সবার এই দৌড় যেন তাই বুঝিয়ে দিচ্ছে আরেকবার।
এইসময় হঠাৎই এক ভীষণ আওয়াজে আবার মাটি কেঁপে উঠলো। দাঁড়িয়ে পড়লেন তাঁরা। যেন বহু পাহাড় ভেঙে পড়ছে, অনেক অনেক পাথর গড়িয়ে পড়ছে। রেলিয়া ভয়ার্ত চোখে মেগাদ্রিসের দিকে তাকালেন। তাঁরা দুজনেই জানেন আর বেশি সময় নেই। রেলিয়া ইদ্রিসের দিকে তাকালেন। প্রচন্ড ভয়ে মুখের ভাব পাল্টে গিয়েছে, পাপলুস ইদ্রিসের পা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়েছে। আর বাঁচার পথ আছে কি?
আশপাশে কিছু দূরে দৌড়তে থাকা জন্তুরা এলোপাথাড়ি পড়তে লাগলো মাটিতে। এক বিশাল দেহের পশু আচমকাই ধাক্কা খেয়ে ছিটকে দ্রুত গড়িয়ে এলো ইদ্রিসের দিকে। রেলিয়া সঙ্গে সঙ্গে ইদ্রিসকে সরিয়ে সামনের দিকে ধাক্কা দিলেন, জন্তুর বিশাল দেহ এসে পড়ল রেলিয়ার ওপর। জন্তুটা ভয়ে তাড়াহুড়ো করে উঠতে গিয়ে রেলিয়ার বুকে, গলায় থাবা মারলো, ছুট লাগালো সামনের দিকে। ইদ্রিস সামনে পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারিয়েছে। মেগাদ্রিস দ্রুত তাকে কোলে তুলে নিলেন। চোখের পলকে কী ঘটে গেল! রেলিয়ার কাছে এসে রেলিয়াকে অন্য কাঁধে তুলে নিলেন অতি কষ্টে। দৌড়ের গতি শ্লথ হয়ে গেল। রেলিয়ার গলায়, বুকে গভীর ক্ষত, ভেতরে যেন সব হাড় ভেঙে গিয়েছে, মুখ থেকে শুধু গোঁ গোঁ শব্দ বেরোচ্ছে। মেগাদ্রিসের চোখ ঝাপসা হয়ে গেল। ঝাপসা চোখেই দেখলেন আকাশ যেন রঙিন আলোয় ভেসে যাচ্ছে, দানোর মুখ থেকে নানা রং ছিটকে বেরিয়ে যেন আকাশের বিভিন্ন তারা হয়ে যাচ্ছে। দানো জেগে উঠেছে। আকাশের আলোয় তিনি দেখলেন, দানোর মুখ থেকে এক উজ্জ্বল উত্তপ্ত তরল বেরিয়ে দানোর রুক্ষ শরীর বেয়ে নামছে নিচের দিকে, খুব ধীরে। মেগাদ্রিস জানেন এবার দানো সবকিছু গ্রাস করে নেবে তার মুখের লালা দিয়ে। মেগাদ্রিসকে দ্রুত মাঠ পেরিয়ে পাহাড় ডিঙোতে হবে, অনেকটা পথ। দপলস, গ্রগ এবার খুশি হয়েছে কি? কটা জন্তুকে ধরতে পেরেছে, মারতে পেরেছে? ওরা এবার নিজেরা বাঁচবে তো?
রেলিয়া হাত দিয়ে আলতো করে টোকা দিলেন মেগাদ্রিসের পিঠে, অস্ফুটে বললেন কাঁধ থেকে নামিয়ে দিতে। মেগাদ্রিস কিছুটা উপেক্ষা করে এগিয়ে গেলেও পারলেন না বেশিক্ষণ, রেলিয়া নামার জন্য মেগাদ্রিসের কাঁধ থেকে সরে গিয়ে শরীরকে এলিয়ে দিতে লাগলেন নিচের দিকে। মেগাদ্রিস নামিয়ে বললেন, " আমি তোমায় ছেড়ে যাবো না।"
রেলিয়ার শরীর থেকে অনেকটা রক্ত বেরিয়ে গেছে। মুখ হাঁ করে অনেকটা হাওয়া বুকের মধ্যে টেনে কোনোমতে তিনি বললেন, " ইদ্রিসকে বেঁচে থাকতে হবে। তোমায় পালাতে হবে। আমি থাকলে তা হবে না। ইদ্রিসকে বাঁচাও।"
মেগাদ্রিসের চোখ বাঁধ মানছে না। এ কী দিন দেখালো আকাশের দেবতা? রেলিয়াকে ছাড়া তিনি বাঁচবেন কী করে?
" যাও, ইদ্রিসকে ..." রেলিয়ার মুখ থেকে কথা বেরোলো না। শুধু ঠোঁট নড়তে লাগলো। মেগাদ্রিস রেলিয়াকে শুইয়ে দিয়ে রেলিয়ার অস্ত্র দিয়ে রেলিয়ার চারপাশে মোটা করে দাগ কেটে গর্তের মতো করে দিলেন। তারপর নিজের কোমরে বেঁধে নিলেন অস্ত্রটি। আর তিনি পেছনে দেখবেন না। কোনোভাবেই দেখবেন না। তিনি জানেন, আকাশের দেবতারা তাঁর রেলিয়াকে ঠিক বাঁচিয়ে রাখবেন। মেগাদ্রিস ইদ্রিসকে কোলে নিয়ে ছুটতে লাগলেন, ছুটতে লাগলো পাপলুসও। মেগাদ্রিস আর কোনদিকে দেখলেন না, দাঁড়ালেন না, শুধু ছুটতে লাগলেন। ইদ্রিসকে নিয়ে জঙ্গল পেরিয়ে, জন্তুদের এড়িয়ে, মাঠ হারিয়ে, পাহাড় ডিঙিয়ে ছুটতে লাগলেন।
।। ১১ ।।
" বাবা, বাবা দেখো একবার।"
মেগাদ্রিস ছেলের ডাক শুনে পাথরের ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।
পাহাড়ের এপারে এক নদীর ধারে এই পাথরের সুন্দর সাজানো ঘরগুলো দেখে মেগাদ্রিস যেন জীবন ফিরে পেয়েছিলেন। পাহাড় ডিঙিয়ে আসার পর কতক্ষণ দৌড়েছিলেন ইদ্রিস আর পাপলুসকে নিয়ে তা তাঁর মনে নেই, শুধু মাঝে মাঝে পেছন ফিরে দেখছিলেন দানোর আকাশছোঁয়া মুখ দেখা যাচ্ছে কিনা, যখন দানোর অস্তিত্ব চোখ থেকে হারিয়ে গেল, তখন তিনি দৌড় থামিয়েছিলেন, প্রায় ঠিক সেই সময়ই এই পাথরের ঘরগুলো দেখতে পান। এক বড় গোষ্ঠী এই পাথরের ঘরগুলোয় থাকে। এতবড় গোষ্ঠী মেগাদ্রিস আগে দেখেননি। পাথরকে পিটিয়ে পিটিয়ে ভেঙে একরকম আকারের করে এরা পাথরের ওপর পাথর সাজিয়ে ঘরগুলো তৈরি করেছে। খাবারের জন্যও এরা শুধুমাত্র শিকারের ওপর নির্ভরশীল নয়। জঙ্গলে গিয়ে বিভিন্ন সুস্বাদু ফলের গাছের ডাল কেটে আনে, আর সেটা মাটিতে পুঁতে দেয়, রোজ সেটায় জল দেয়। অবাক করা ব্যাপার সেই কিছু কিছু গাছের ডাল থেকে আবার নতুন একটা গাছ হয়ে যায়, ঠিক একইরকম, যেরকম ফলের গাছ জঙ্গলে ছিল। এদের সবটাই যেন বড় অদ্ভুত। এরা কথাও বলে অন্যরকম ভাবে, মেগাদ্রিস এখনো সবটা শিখে উঠতে পারেননি, তবে চেষ্টা করছেন। শুধু ইদ্রিসই যেন কোন জাদুবলে এদের সঙ্গে খুব মিলে মিশে গেছে। এরাও ইদ্রিসের সঙ্গে পাপলুসকে দেখে খুব অবাক হয়েছিল, তবে দপলসদের মতো খেতে উদ্যত হয়নি, বরং বোঝার চেষ্টা করেছে এই নতুন সম্ভাবনাকে। পশুরা যদি মানুষের সঙ্গে থাকতে পারে, মানুষের কথা শোনে তাহলে অনেক সুবিধা। পশুদের দিয়ে অনেক কাজ হয়তো করানো যাবে। এরা সবাই আর মেগাদ্রিসও অবাক হয়ে দেখতেন কীভাবে পাপলুস ইদ্রিসের সব কথা শোনে। মেগাদ্রিস ছোটবেলা থেকেই জানতেন তাঁদের সবাইকে পাল্টাতে হবে, তাহলেই বেঁচে থাকতে পারবেন তাঁরা, সময়ের সঙ্গে লড়তে লড়তে হারিয়ে যাবেন না। আজ এই নতুন গোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে যেন আরো বেশি ভালোভাবে টের পান তিনি। নতুন কিছু হলেই সেটায় ভয় পেলে চলবে না, জানতে হবে, বুঝতে হবে।
" কী হয়েছে ইদ্রিস?"
" বাবা, এই দেখো কীরকম গাছ হয়েছে।"
মেগাদ্রিস অবাক হয়ে দেখলেন, এরকম গাছ তো আগে দেখেননি। এক হাঁটু উঁচু উজ্জ্বল রঙের গাছগুলোর সরু সরু ডালগুলোয় অনেক সারিতে খুব খুব ছোট ছোট ফল হয়েছে। ফলগুলোর ভারে ডালগুলো মাটির দিকে নুয়ে গেছে।
" ইদ্রিস এটা কী?"
" জানিনা ঠিক বাবা। আমি যেদিন পাপলুসকে খুঁজে পেলাম, সেদিন মায়ের সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে আমি কিছু জিনিস কুড়িয়ে পেয়েছিলাম। সেগুলোই এইখানে ফেলে দিয়েছিলাম, তোরিয়ার মতো আমিও সেটায় জল দেওয়া শুরু করি কী ভেবে কে জানে আর আজ দেখো।"
" এটা কী ফল? খুব ছোট তো, খাওয়া যাবে?"
" হ্যাঁ বাবা, একটু শক্ত, অনেকগুলো একসঙ্গে নাও, চিবিয়ে ভালোই লাগছে।"
" শক্ত বলছিস? নরম করা যাবে আগুনে পুড়িয়ে?"
" না বাবা, মনে হয় না। তোরিয়া যেমন জলে ভিজিয়ে রাখে, তেমন করে দেখা যেতে পারে।"
" দে দেখি ফলটা।" মেগাদ্রিস হাত পাতেন।
ইদ্রিস হাত উপুড় করে দেয়। নখের আকৃতির ছোট সরু জিনিসগুলো মেগাদ্রিসের হাতে পড়লো। মেগাদ্রিস মুখে দিতে যান। ইদ্রিস বাধা দেয়, " বাবা, ঐ পাতলা আস্তরণটাকে খুলে খাও, আরো ভালো লাগবে।"
মেগাদ্রিস ফলের গায়ে জড়িয়ে থাকা পাতলা আস্তরণ খুলে ফেলেন। দুই আঙুলের মাথায় চেপে ধরেন। বেশ শক্ত, তবে বেশি চাপ দিলে ভাঙা যাবে। মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে কামড়ে দেন। ঝুরো ঝুরো হয়ে যায় মুখের মধ্যে। বেশ ভালো খেতে, অন্যরকম।
মেগাদ্রিস বলেন, " ইদ্রিস আরো গাছ ফলাতে হবে আমাদের। গোষ্ঠীর সবার খুব ভালো লাগবে।"
ইদ্রিসের মনটা নেচে ওঠে। ও খোসাশুদ্ধু ফলগুলো ছড়িয়ে দেয়। মায়ের সঙ্গে থাকলে রোজ কতকিছুই না নতুন নতুন জিনিস পেতো ও, শিখতে পারতো ও। মায়ের সঙ্গেই ও এই বাইরের জগৎ চিনতে শুরু করেছিল। মা যেন ওর সবটা আগলে রাখতো। চোখ বুজলে এখনো টের পায় মায়ের ওকে ধাক্কা দেওয়ার মুহূর্তটা। ওকে বাঁচাতেই, ওকে বাঁচাতে গিয়েই মা … না ও বাজে কিছু ভাববে না। ও জানে ও মাকে একদিন ঠিক ফিরে পাবে। দূরের ঐ পাহাড়গুলো ডিঙিয়ে যেতে পারলেই আবার মাকে দেখতে পাবে। বিকেলের দিকে বাবা যখন গোষ্ঠীর বাকিদের সঙ্গে গল্পে একটু বেখেয়ালে থাকেন, ওর দিকে নজর দেন না, সেই মুহূর্তগুলোয় ও পালিয়ে পাহাড়ের দিকে ছুটতে থাকে, পাহাড়ের গা বেয়ে ওঠার চেষ্টা করে, কিন্তু ওর সরু, দুর্বল, ছোট হাতগুলো ওকে টেনে তুলতে পারে না। তবে ও জানে ও একদিন ঠিক পারবেই, মাকে খুঁজে পাবেই। তবে ওর এই রোমাঞ্চে ও একা থাকে না, ওর সঙ্গে সঙ্গে পেছন পেছন দৌড়ে যায় ওর সর্বক্ষণের সঙ্গী পাপলুস।
" তুই এটাকে সত্যি বাড়ি নিয়ে যাবি?"
" হ্যাঁ, বাবা প্লিজ। কী মিষ্টি দেখতে দেখো, আর দেখা হওয়ার পর থেকে একদম আমায় ছাড়ছে না।"
মেঘাদ্রি সেটাই দেখছেন। দেখা হওয়ার পর থেকে অদ্রীশের সঙ্গে একদম লেপ্টে থাকছে এই ছোট্ট কুকুরটা। থেকে থেকে খালি ল্যাজ নাড়ছে আর অদ্রীশের পায়ের আঙুল চেটে দিচ্ছে।
" কী নাম রাখবি?"
অদ্রীশ কুকুর ছানাটিকে কোলে তুলে ভাবতে থাকে। " কী রাখি? কী রাখি? দাঁড়াও, দাঁড়াও। আচ্ছা, পাপলুস রাখলে কেমন হয়?"
" পাপলুস? এ আবার কেমন নাম?"
" জানি না, হঠাৎ মাথায় এলো। ভালো না নামটা?"
" খুব ভালো। খুব মজার।" বলে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন মেঘাদ্রি।
ছবিঃ আবির