৷৷ ১ ৷৷
ঋকের বাড়ি থেকে ওর মাসির বাড়ি খুব একটা দূরে নয়। সময় সুযোগ পেলেই ও মাসির বাড়ি চলে আসে। মাসির হাতের লুচি, কষা মাংসের একটা ভীষণ লোভ ছাড়াও ওর সবচেয়ে বড় ভালোলাগা হলো ওর মাসতুতো ভাই পিকন। পিকন ওর থেকে দুই বছরের ছোট হলেও ও পিকনকে বন্ধু হিসাবেই দেখে। পিকনকে ও বলেছে ওর নাম ধরে ডাকতে, কিন্তু পিকন এখনও ওকে দাদা বলেই ডাকে। পিকনের অনেক গুণ, তবে তার মধ্যে সবচেয়ে যেটা ভালো লাগে ওর সেটা হলো, বিভিন্ন গাছপালা আর পতঙ্গ নিয়ে পিকনের অকুন্ঠ ভালোবাসা। ঋক নিজে আর্টস নিয়ে পড়লেও পিকনের জন্যই ওর ভীষণ কৌতূহল উদ্ভিদ এবং প্রাণীজগৎ সম্পর্কে। এখনও পিকন ক্লাস ইলেভেনে না উঠলেও পিকন নিজে কী হতে চায় তা তার কাছে পরিষ্কার। শুধু একটু ছোট কনফিউশন আছে - এন্টোমোলজিস্ট না বোটানিস্ট?
এই এখনও ঋক সাইকেল চালিয়ে মাসির বাড়ির পথেই চলেছে, মা-বাবা আগে থেকেই ওখানে উপস্থিত রবিবারের আড্ডায়। তবে আজ যাওয়ার একটা অন্য কারণও আছে। আজ নাকি একটা ভীষণ ঝড় আসবে বিকেলে, পিকন নিশ্চিতরূপে জানে এই ঝড়ের ব্যাপারে, আর তাই এর ব্যাপারে পিকনের থেকে না শোনা অব্দি ওর মনের খুঁতখুঁতে ভাবটা যাবে না। তবে এই ঝড় একদম অন্যরকম, অদ্ভুত ঝড়!
৷৷ ২ ৷৷
মৌমাছি
"ছাদে উঠে কী করছিস? এক্ষুণি কিন্তু নীচে নামতে হবে। টিভিতে শুনেছিস?"
কথাগুলো যেন কানেই গেল না পিকনের। সে একমনে কী যেন দেখছে। একটু এগিয়ে গিয়ে ওর চোখে পড়লো ব্যাপারটা। মাসতুতো ভাইয়ের এই অদ্ভুত খেয়াল সম্পর্কে যে ঋক জানে না তা নয়। একটি প্রায় খালি বয়ামের মধ্যে দুটো মৌমাছি ঘুরছে। আর বয়ামের নীচে একটু চিনির রস পড়ে। ঢাকনাটা একটু আলগা করে রাখা, বেরোতে পারছে না। ওরা বয়ামের মধ্যে ফরফর করে উড়ে উড়ে ঘুরছে। পিকন একদৃষ্টে চেয়ে সেদিকে, ও যে এসেছে যেন বুঝতেই পারেনি।
"তোর তো বড্ড সাহস, তুই এদের ধরলি কীভাবে?"
পিকন এবার কথা বললো, "ধরতে তো হয়নি, জারটা খোলা রেখেছিলাম, ওরা ঢুকে পড়েছে, এখন ঢাকনাটা আলগা করে ঢেকে রেখেছি। আমার দেখতে বেশ লাগছে।"
"হ্যাঁ, শরীরে হুল ফোটানোর আগে অব্দি সব বেশই লাগে। "
"হুল তো ফোটায় নিজেকে বাঁচাতে। শুধু শুধু ঝামেলা না করলেই হলো। একমাত্র রানী মৌমাছি যেহেতু বংশ বাড়াতে পারে, তাই শ্রমিক মৌমাছিরা সবসময় অ্যালার্ট থাকে, কোনও বিপদের সম্ভাবনা দেখলে নিজেদের প্রাণের ঝুঁকি নিয়েও কাছেপিঠে থাকা হ থ্রেটের শরীরে হুল ফোটায়। "
"মানুষরা মৌমাছিকে মেরে দিতে পারে বলে বলছিস প্রাণের ঝুঁকি?"
"সেটা তো আছেই, কিন্তু মানুষ বা অন্য প্রাণীরা না মারলেও নিজেরা হুল ফোটালেই বেশিরভাগ শ্রমিক মৌমাছি মারা যায়।"
"কীভাবে?"
"হুলটা এমনভাবেই ফোটায় প্রাণীর শরীরে যে সেটা নিয়ে আর বেরোতে পারে না, হুলটা সেই প্রাণীর শরীরেই থেকে যায়। হুলটা শরীর থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার ফলে ওর নিজের শরীরে গভীর ক্ষত সৃষ্টি হয়, শেষে মারা যায়। অবশ্য মারা যাওয়ার আগে নিজেদের দেহ থেকে একটা ফেরোমোন (pheromone) ছেড়ে যায় বাকি শ্রমিক মৌমাছিদের জানানোর জন্য, যার ফলেই ঝাঁকে ঝাঁকে মৌমাছিরা একসঙ্গে মানুষকে কামড়েছে শুনতে পাই আমরা।"
"এবার বুঝলাম। আচ্ছা মৌমাছিরা হুল ফোটালে এত ব্যথা কেন হয়? শুধুই কি কাঁটা ফোটার মতো ব্যাপার?"
"না, তা ঠিক নয়। মৌমাছি, ভিমরুল, পিঁপড়ে এরা হুল ফোটানোর সঙ্গে সঙ্গে শরীরে বিষ ঢুকিয়ে দেয়। বিষগুলো মানুষের শরীর সহজে নিতে পারে না, নানারকম রিয়াকশন হয়। যেমন মৌমাছি হুল ফোটানোর সঙ্গে মেলিটিন (melittin) পেপটাইড নামে এক অ্যামিনো অ্যাসিড শরীরে ঢুকিয়ে দেয় যা আসলে অত যন্ত্রণার কারণ। তবে মৌমাছি, ভিমরুলের থেকেও পিঁপড়ের কামড়ানো ভয়ানক।"
"পিঁপড়ে! ধুর, কী বলিস?"
পিকন হঠাৎ জোরে হেসে উঠলো। "জানতাম বিশ্বাস করবে না। তাহলে একজনের কথা বলি শোনো। বিখ্যাত এন্টোমোলজিস্ট জাস্টিন ও. স্মিট। স্মিটমশাই ছোটবেলা থেকেই সাধারণ বাচ্চাদের থেকে একটু আলাদা ছিলেন, বরং বলতে পারো একটু বেশি দুষ্টুই ছিলেন। নিজের যখন সাত বছর বয়স তখন তিনি ফুলের উপর বসে থাকা একটি মৌমাছি ধরে নিজের টিচারের হাতের উপর ছেড়ে দিয়ে ভেবেছিলেন মৌমাছিটা এবার নিজেকে বাঁচাতে হুল ফোটাতে পারে। আর ঠিক তাই হয়েছিল। এরপর থেকেই কীটপতঙ্গের নিজেদের বাঁচানোর প্রক্রিয়া জানতে তিনি ভীষণ আগ্রহী হয়ে পড়েছিলেন।
এই স্মিটমশাই ভবিষ্যতে বিপজ্জনক রিসার্চ করে তৈরি করেছিলেন একরকম পেইন ইনডেক্স যা স্মিট পেইন ইনডেক্স (Schmidt Pain Index) নামে পরিচিত। এই ইনডেক্স বিভিন্ন পতঙ্গের কামড়ানোর তীব্রতা বুঝতে সাহায্য করে, কারটা বেশি যন্ত্রণাদায়ক, কারটা কম। "
ঋক অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, "বিপজ্জনক রিসার্চ কেন?"
"বিপজ্জনক বলবো না তো কী বলবো ঋকদা, তিনি প্রায় দেড়শোর বেশি কীটপতঙ্গের কামড় খেয়েছিলেন।"
বুলেট অ্যান্ট
ঋকের মুখ হাঁ হয়েই থেকে যায়। পিকন বলে যায়।
"যেটা বলছিলাম, আমরা ভাবি পিঁপড়ে কী করবে, কিন্তু রেইনফরেস্টে একপ্রকার পিঁপড়ে থাকে যার দংশন হলো সবচেয়ে ভয়ংকর, স্মিট পেইন ইনডেক্সে এ সবার উপরে। এর নাম বুলেট অ্যান্ট (Bullet Ant)। এই পিঁপড়ে যখন হুল ফোটায়, তখন পনেরাটক্সিন (poneratoxin) নামে একপ্রকার বিষাক্ত পেপটাইড বেরোয় যা তীব্র যন্ত্রণা দেয়, ১২ ঘন্টা থেকে একদিন এই যন্ত্রণার তীব্রতা থাকে।
জানো, অ্যামাজন রেইনফরেস্টে স্যাটারে মাওয়ে (Satere-Mawe) নামে একটি উপজাতি থাকে যাদের একটি আচার, রীতি হলো আমাদের বয়সী ছেলেদের শয়ে শয়ে এই বুলেট পিঁপড়ের কামড় খেয়ে প্রমাণ করতে হয় তারা বড় হয়েছে, তারা জীবনের লড়াই করতে প্রস্তুত। দুটো গ্লাভসের মধ্যে আটকানো হয় অনেক পিঁপড়ে। সেই গ্লাভস ছেলেগুলোকে পরতে হয়, একবার-দুবার নয়, পুরো কুড়ি বার, বিভিন্ন বিভিন্ন দিনে। কেউ যদি না কেঁদে কুড়িবার এই যন্ত্রণা সহ্য করতে পারে তাহলেই মানা হয় সে যুবক হয়েছে, সে এবার যোগ্য মানুষ। "
ঋক যেন শুনেই কেঁপে ওঠে। ও বিড়বিড় করে বলে ওঠে, "ভাগ্যিস আমরা অ্যামাজন রেইনফরেস্টে থাকি না।"
পিকন ঠিক শুনতে পায় না। "কী বললে?"
ঋকের আর ভালো লাগে না এই আলোচনা। ও তাড়া দেয়। "কিছু না। চল, চল, নীচে চল, আরেকটু পরেই ঝড় এলো বলে। সব দরজা, জানালা বন্ধ করতে হবে।"
পিকন বয়ামের ঢাকনাটা খুলে দিয়ে দাদার সঙ্গে নীচে নামে।
৷৷ ৩ ৷৷
পঙ্গপাল
ঝড় এলো। সমস্ত আকাশ ছেয়ে এলো। সব বাড়িতে দরজা, জানালা বন্ধ। তবে প্রতি বাড়িতেই কেউ না কেউ জানালায় চোখ রেখেছে, তাকিয়ে রয়েছে বাইরে। কেউ কেউ জানালায় মোবাইল ঠেকিয়ে রিল, ভিডিও বানানো শুরু করলো। ঋকও করলো। ওর মা, বাবা, মাসি, মেসো, পিকন সবাই দেখতে থাকলো। পিকন ছাদের ঘরে গিয়ে একা আরও কাছ থেকে দেখতে চেয়েছিল, কিন্তু কেউ যেতে দেয়নি। তবে এই ঝড় বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না, যেমন হঠাৎ এসেছিল, হঠাৎ চলেও গেল। চলে যাওয়ার পর পিকন আর ঋক ধীরে ধীরে ছাদে উঠলো। ছাদটা যেমন দেখে গিয়েছিল, তেমন আর নেই। পিকন আর মেসো আগেই প্রায় সব গাছ সরিয়ে রেখে গিয়েছিল, কিন্তু যেগুলো পারেনি, সেগুলো যেন প্রায় ন্যাড়া হয়ে গেছে। এদিক ওদিক ছড়িয়েও আছে কিছু আধখাওয়া পাতা। পঙ্গপালের ঝড় পাতাগুলোকে একটুও রেহাই দেয়নি।
সরকার বেশ কিছুদিন ধরেই ভারতের বিভিন্ন জায়গায় পঙ্গপালের ঝাঁক বা লোকাস্ট সোয়ার্ম-এর (locust swarm) আক্রমণের কথা বলছিল। অবশ্য ঝাঁক বা সোয়ার্ম বললে ঠিক বোঝা যায় কিনা কে জানে, কারণ কোটি কোটি পঙ্গপাল থাকে এক একটি ঝাঁকে, কয়েক কিলোমিটার অব্দি ছড়িয়ে থাকে। ঋক অপেক্ষা করলো, ও জানতো পিকন নিজের থেকেই বলা শুরু করবে ঠিক কিছু।
চারিদিকে তাকাতে তাকাতে পিকন বললো, "প্লেনে করে একপ্রকার ফাংগাল রোগের জীবাণু স্প্রে করলে এদের এই বাড়বাড়ন্ত বন্ধ করা যাবে। "
ঋক জিজ্ঞেস করলো, "কিন্তু কীভাবে? ফসল নষ্ট হবে না? অন্য প্রাণী বা মানুষের ক্ষতি হবে না? মাইলের পর মাইল, যেখানে যেখানে যেতে পারে সবজায়গায় বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে দিতে হবে তো?"
পিকন বললো, "হ্যাঁ, বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে স্প্রে করতে হবে, তবে এতে এই পঙ্গপাল ছাড়া আর কারোর ক্ষতি হবে না, সেরকম কীটনাশক বেরিয়েছে, পরিবেশও সুরক্ষিত থাকে। অলরেডি বিভিন্ন জায়গায় ব্যবহার করে সম্পূর্ণরূপে এদের ধ্বংস করা গেছে। যেহেতু এরা দশ-কুড়ি কিলোমিটার থেকে কয়েকশো কিলোমিটার অব্দি ছড়িয়ে এগোতে থাকে, তাই স্যাটেলাইটের ছবি দিয়ে সহজে এদের গতিপথ আন্দাজ করা যায়, ঠিকঠাক প্রেডিক্ট করে যদি এই স্প্রে করা যায়, তাহলে মারা যাবে এদের।"
ঋক জিজ্ঞেস করলো, "এমনি এরা কতদিন বাঁচে?"
"যতদূর জানি, যদি এরা ঠিকঠাক পরিবেশ পায়, এদের এই ঝাঁক দশ বছর অব্দি টিকে যেতে পারে। মানে কিছু মারা যায়, কিছু নতুন সদস্য আসে, এরকমভাবে। কিন্তু এরাই যখন আলাদা থাকে, তখন তিনমাসের বেশি বাঁচতে পারে না।"
ঋক অবাক হলো। কিন্তু ও কিছু বলার আগেই পিকন বললো, "চলো নীচে চলো, তোমার সব প্রশ্নের উত্তর হয়তো এখন আমিও দিতে পারবো না, আমার ঘরে চলো, কিছু আর্টিকল আছে, আগে পড়েছি, আরেকবার ঝালিয়ে নিই। "
৷৷ ৪ ৷৷
দুজনে নেমে এসে পিকনের ঘরে বসলো। ডেস্কটপটা অন করে পিকন কিছু সাইট পরপর খুলে নিলো। তারপর পড়তে আরম্ভ করলো। ঋক ডিস্টার্ব করলো না। বিভিন্ন সাইট খুলে ও নিজেও খুঁজে পড়তে পারে, কিন্তু যেভাবে পিকন মাতৃভাষায় বলে দেয়, সেটা শুনেই যেন ও আসলে বোঝে সবটা, নাহলে কোথায় যেন ফাঁক থেকে যায়।
পিকন কিছু মিনিট পর ওর দিকে ঘুরলো। নিজের মনেই যেন বললো,"ঠিকই ভেবেছিলাম।"
একটু থেমে সে বলা শুরু করলো, " যেসব লোকাস্ট (locust) বা পঙ্গপাল এই ধ্বংসলীলা চালায় তাদের ডিম সাধারণত মরুভূমির মতো শুষ্ক এলাকায় মাটির গভীরে স্যাঁতস্যাঁতে এলাকায় জন্মায়। শুষ্ক আবহাওয়ায় এরা সংখ্যায় ভীষণ কম থাকে, বলতে গেলে একা একাই থাকে। এইসময় এরা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় খাবারের সন্ধানে ঘুরতে থাকে, ঘুরতে ঘুরতে অপর লিঙ্গের সঙ্গী জুটিয়ে ফেলে। মিলনের পর স্ত্রী লোকাস্টের ডিম পাড়ার সময় হয়। স্ত্রী লোকাস্ট মাটির মধ্যে ২ থেকে ১০ সেন্টিমিটার গর্ত করে টিউবের মতো আকৃতিতে ডিম পাড়ে। ডিমগুলো ঘিরে থাকে ফেনা, যা ডিমগুলোকে ফুটতে সাহায্য করে। এই অবস্থায় লোকাস্ট বেশিদিন বাঁচে না, মারা যায়, ঠিক অনেকটা গঙ্গাফড়িংয়ের মতো জীবন কাটে এদের। তখন এরা খাবারও বেশি খুঁজে পায় না, ক্ষতিকারকও থাকে না। কিন্তু যখনই এই এলাকাগুলোয় প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়, তখনই পুরো ব্যাপারটা পাল্টে যায়। প্রচুর ঘাস, গাছ জন্মায় কাছাকাছি। পরিবেশ অনুকূল হওয়াতে এদের খাবারের সন্ধানে আর বেশিদূর যেতে হয় না প্রথমে, এরা বেশি খেতে থাকে, ঘন ঘন ডিম পাড়ে এবং সংখ্যায় দ্রুত বাড়তে থাকে। এই বাড়তে থাকার সময়ে এদের একে অপরের পায়ের রোমে ঘষাঘষি লেগে একপ্রকার হরমোন বেরোয় যা এদের একসঙ্গে একদম গায়ে গায়ে থাকতে সাহায্য করে। সেরোটোনিন হরমোনও তৈরি হওয়া বেড়ে গিয়ে এদের একসঙ্গে ঝাঁকে থাকতে সুবিধা করে দেয়, এরা তখন এভাবে থাকতেই পছন্দ করে। কয়েকশো পঙ্গপাল কিছুদিনের মধ্যেই কয়েক লক্ষ, কয়েক কোটির ঝাঁকে রূপান্তরিত হয়ে যায়। এদের খাবার ধরণ পাল্টে যাওয়ায় শুধু সংখ্যায় নয়, এরা আকারেও বাড়তে থাকে, বারবার নিজেদের পুরানো খোলস ছেড়ে আকারে বড় হতে থাকে। একটি পূর্ণাঙ্গ পঙ্গপাল তার প্রাথমিক আকার থেকে প্রায় পঞ্চাশ গুণ বড় হয়ে যায় মাত্র এক মাসের মধ্যে। তাই একই পতঙ্গের এই দুটো রূপকে মেলানো যায় না। "
ঋক পিকনকে থামিয়ে দিয়ে বললো, " এরা কি পৃথিবীর সব জায়গায় যেতে পারে? গেলেও কতদূর যেতে পারে?"
একটু হেসে পিকন বললো, "যেতে তো পারে সব জায়গাতেই। তবে এরা হাওয়া যেদিকে বয় সেদিকে যাত্রা করে। হাওয়ার অভিমুখে এই ঘন মেঘের মতো পঙ্গপালের টর্নেডো দিনে ১৫০ কিলোমিটার অব্দি যেতে পারে। আর এরা যেতে যেতেই ফসলের মাঠ ফাঁকা করে দিয়ে যায়। একটি বড় শহরের সব মানুষ মিলে রোজ যতটা খেতে পারে, এদের এই কয়েকশো কিলোমিটার ছড়িয়ে থাকা ঝাঁকও ততটা খেয়ে নিতে পারে। যেহেতু এরা সংখ্যায় কয়েকশো কোটিও হতে পারে, তাই যাত্রাপথে অনেকই মারা যায়। সমুদ্রের উপর দিয়ে যাওয়ার সময় জীবিত পঙ্গপালগুলো রাতে তাদেরই বন্ধু, আত্মীয়দের মৃতদেহ, খোলসের উপর ভেসে থাকে আর দিন হলেই আবার ওড়া শুরু করে। ১৯৮৮ সালে একবার এরা এভাবে আটলান্টিক মহাসাগরও পার করে ফেলেছিল। তবে এরা সাধারণত পূর্ব আফ্রিকা থেকে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দিকেই যায়।"
"আচ্ছা এই জন্যই মড়ক লাগে?"
"হ্যাঁ, যে সব দেশগুলোর উপর দিয়ে যায়, তারা প্রধানত গরিব দেশ, নিজেদের ফসল নিজেরাই ফলায়। তাই পঙ্গপালের আক্রমণ হলে দুর্ভিক্ষের অবস্থা তৈরি হয়।"
"তাহলে বাঁচার উপায়? শুধু কীটনাশক স্প্রে?"
"সে তো একটা আছেই, তবে প্রাকৃতিক নিয়মেও এদের নাশ হয়। যখনই বৃষ্টি কমে যায়, শুষ্ক আবহাওয়া একটু বেশীদিন থাকে, তখনই এদের বংশবিস্তার কমে যায়, আশেপাশে এদের খাবার কমে যায়, এরাও মারা যায় তাড়াতাড়ি। তবে গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের জন্য জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এদের আবির্ভাবের ঠিকঠাক প্রেডিকশন করা যাচ্ছে না। যার ফলে এদের হাবভাব বোঝা মুশকিল হয়ে পড়ছে আজকাল।"
ঋক এবার ঠিক বলে দেয়, "তার মানে যত কার্বন এমিশন কমবে, তত এদের দাপটও কমবে।"
"ঠিক তাই ঋকদা, এছাড়া আমরা যদি বিস্তীর্ণ জমিতে বিভিন্ন রকম ফসল ফলাই, তাহলেও এরা অতটা ফসল নষ্ট করতে পারে না যতটা পারে একইরকম ফসল ফলালে। এছাড়া এই বিভিন্ন পতঙ্গগুলো অত্যন্ত প্রোটিন রিচ হওয়ায় এদের মানুষ নিজেদের খাবারের লিস্টেও রাখতে পারে, যদিও বিভিন্ন কীটনাশক স্প্রে দেওয়ার ফলে খেতে বারণ করা হয়। তবে ঠিকমতো এদের পালন করলে এদের খাওয়া নিরাপদ, অনেক ক্ষেত্রে পরিবেশ রক্ষার জন্য এটা জরুরিও। সবদিকগুলোই ভেবে চিন্তে দেখা দরকার।"
"কী বলিস? কীটপতঙ্গ খাবো?"
"হ্যাঁ, একশো-দুশো বছর আগে সারা পৃথিবীতেই এদের খাওয়া হতো। এখনও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় খাওয়া হয়। এরা অন্য প্রাণীর মতো বিষাক্ত নয়, বরং উপকারী। গুবরে পোকা, গঙ্গাফড়িং, লোকাস্ট, গুটিপোকা, ড্রাগনফ্লাই, উইপোকা সবই নিরাপদ।"
"থাম, থাম, যখন হবে, তখন দেখা যাবে। আচ্ছা একটা ব্যাপার আমায় খুব ভাবাচ্ছে শুরু থেকে, মানে একবার এরা পঙ্গপাল হয়ে গেলে আবার গঙ্গাফড়িংয়ের মতো অবস্থায় পাল্টানো যায় না?"
"হ্যাঁ যায়। যখনই এরা সংখ্যায় কম থাকে তখনই এরা গঙ্গাফড়িংয়ের মতো একা একা চলতে পছন্দ করে। তাই এদের যদি সংখ্যায় ভীষণ কমিয়ে দেওয়া যায় বা এরা যদি একপ্রকার পরজীবী প্যারানোসেমা লোকাস্টের (Paranosema locustae) দ্বারা আক্রান্ত হয়, তাহলে এরা আবার এদের প্রাথমিক অবস্থায় ফিরে যেতে পারে। এই পরজীবী এদের মধ্যে সেরোটোনিন তৈরি হওয়া কমিয়ে দেয়।"
"যাক, তার মানে উপায় অনেকই আছে এদের প্রকোপ কমানোর, আর অতটাও ভয়ের নয় যদি মানুষ আর সরকার একটু সচেতন থাকে।"
"ঠিক বলেছো।"
ঋক বলে, "আমার কাজী নজরুল ইসলামের একটা কবিতার দুটো লাইন মনে পড়ে যাচ্ছে,
কে খায় এই মাঠের ফসল, কোন সে পঙ্গপাল?
আনন্দের এই হাটে কেন তাহার হাড়ির হাল? "
গল্প করতে করতে কখন যে খাওয়ার সময় হয়ে গেছে দুজনেই টের পায়নি। মায়েদের ডাকে টের পেলো। খাওয়াদাওয়ার পর ঋক তার মা-বাবার সঙ্গে বাড়ি চলে গেল। ঋকদাকে টাটা করে পিকন নিজের ঘরে শুতে এলো। অভ্যাসমতো জানালাগুলো বন্ধ করতে গিয়ে দেখলো, একটা লোকাস্ট স্লাইডিং জানালার গায়ে সেঁটে বসে আছে, দলছুট হয়ে পড়েছে। পিকনের অদ্ভুত আনন্দ হলো, লোকাস্টচরিত অনুযায়ী এটা মনেহয় আজ রাতে এখানেই থেকে যাবে।
ছবিঃ উইকিপিডিয়া