তোমরা সত্যজিৎ রায়ের নাম যতটা শুনেছ, ঋত্বিক ঘটকের নাম সম্ভবতঃ ততটা শোনোনি। অথচ সত্যজিতের গুগাবাবা বেরোনোর এগারো বছর আগে চমৎকার এক ছোটদের সিনেমা বানিয়েছিলেন ঋত্বিক। সে ছবির নাম ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ (১৯৫৮)। মূল চরিত্র কাঞ্চনের ভূমিকায় অভিনয় করেছিল পরম ভট্টারক লাহিড়ী। ছবিটা বানানো হয়েছিল শিবরাম চক্রবর্তীর ১৯৪৬ এ লেখা একই শিরোনামের এক বই থেকে। অতএব 'বাড়ি থেকে পালিয়ে' একটা অ্যাডাপটেশন। এখানে একটা জিনিস শিখিয়ে দিই। পরে যখনই এরকম কোনো বই থেকে ছবি হতে দেখবে, আগে শিগগির বইটা পড়ে ফেলো। তাতে পরিচালক ছবিতে কী কী রাখলেন, কী পাল্টালেন সেসব ধরতে পারবে। সিনেমা যদি ভালোবাসো, তবে এই অভ্যাস বড় হয়ে খুব কাজে লাগবে।
ঋত্বিক ঘটক
এবার সিনেমায় আসার আগে একটু বইটার সাথে সংক্ষেপে পরিচয় করা যাক। একটু জ্যাঠা গোছের এক দামাল ছেলেকে নিয়ে এই বই। নাম তার কাঞ্চন, বাবাকে খুব ভয় পায়। একদিন সে তার চেয়ে বয়সে একটু বড় বিনোদের মাথায় দইয়ের ভাঁড় উপুড় করে বাবার কাছে মার খাওয়ার ভয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে কলকাতা শহরে চলে যায়। হাবভাব এমন, গ্রামের ছেলে হলে কী হবে, কলকাতা শহরে এসেছে সে রোজগার করতে। মনে সাধ, অনেক টাকা হলে মাকে গিয়ে অনেক বিলাসিতার জিনিস কিনে দেবে। এসব ভাবতে ভাবতে সে কলকাতার রাস্তায় হাঁটে। বিভিন্ন মানুষের সাথে পরিচয় হতে থাকে, কোথাও সে স্থির হয় না। বিয়েবাড়িতে মানুষ আর কুকুরকে কাড়াকাড়ি করে খাবার খেতে দেখে, ঘোড়ায় চাপা সাহেব দেখে, সি আর দাস আর গান্ধিজীর দলে যোগ দেবে বলে ঠিক করে, কনক নামে এক ছেলের সাথে তার আলাপ জমে। তারপর হঠাৎ সত্যি সত্যিই কয়েকদিন পর অনেক টাকার মালিক হয়ে সে ট্রেনে করে আবার গ্রামে ফিরে আসে। কীভাবে সে বড়লোক হল জানতে পড়ে ফেলো বইখানা।
বাঁ দিকে মূল বই, ডান দিকে ছবির পোস্টার
সিনেমাটা কিন্তু বইয়ের মতো করে শেষ হয় না। বইটা স্বাধীনতার আগে লেখা। ঋত্বিক যখন সিনেমা বানালেন, ততদিনে দেশভাগ হয়ে গেছে। হাজার হাজার মানুষ তাঁদের ওপার বাংলার ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ এপার বাংলায় আসতে বাধ্য হয়েছেন। বাবার ভয়ে নয়, জীবনের ভয়ে। সিনেমার শুরুর সিনে দেখা যায় কাঞ্চন ‘এল ডোরাডো’ পড়ছে। যত সিনেমায় প্রবেশের করা যায়, বোঝা যায় কলকাতাই সেই এল ডোরাডো - 'সোনা দেশ’ । কিন্তু সে যা ভেবেছিল, তার চেয়ে অনেক আলাদা। তারপর বইয়ের শুরুর গল্পের মতোই বিনোদের মাথায় ভাঁড় উল্টে সে শহরে পালিয়ে আসে। শহরের রাস্তায় এসে প্রথমেই পরিচয় হয় হরিদাসের সাথে। এ চরিত্র কিন্তু শিবরামের বইতে নেই, এই চরিত্র ঋত্বিকের তৈরি। সে এক মজার মানুষ, রবি ঠাকুরের মতো ইয়াব্বড় দাড়ি , ছেলেমেয়েদের জুটিয়ে এনে সে গান গায় “হরিদাসের বুলবুলভাজা, টাটকা তাজা খেতে মজা”। অসামান্য মনভালো করে দেওয়া গান এটা। সংগীত পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন সলিল চৌধুরী। তাঁর সাথে ঋত্বিক ঘটকের প্রথম কাজ এই সিনেমা। ‘হরিদাসের বুলবুলভাজা’ গানটা এতই সুন্দর, যে পরে শ্রীমান পৃথ্বীরাজ সিনেমার শুরুতেও পরিচালক তরুণ মজুমদার ব্যবহার করেন গানটিকে। তবে তার কথা আর সুর একটু আলাদা।
ছিন্নমূল উদ্বাস্তু মানুষগুলোর সাথে গ্রামবাংলার কাঞ্চনের কোনো পরিচয় ছিল না। এদিকে আজব নগরী কলকাতায় চলছে হরেকরকম কারবার। সেখানে বাউল গান গায় "আমি অনেক ঘুরিয়া শ্যাষে আইলাম রে কলকাতা, হাওড়ার পুল দেইখ্যা আমার ঘুইরা গেছে মাথা"। তোমরা এখন হয়তো ভেবে অবাক হবে, হাওড়া ব্রিজ আর এমন কী, কিন্তু তখন ইন্টারনেট ছিল না, এত সহজে ছবিও দেখা যেত না, অজ পাড়া গাঁ থেকে আসা মানুষের এত গাড়ি ঘোড়া দেখে অবাক হওয়ারই কথা। এ সিনেমা সেই সময়কার কলকাতা শহরকে খুব সুন্দরভাবে ক্যামেরা বন্দী করেছে। এখন তো আর হাওড়া ব্রিজে গরুর গাড়ি চলে না, কিন্তু সিনেমায় তা দেখতে পাবে। কাঞ্চন তো ছোট ছেলে, সে কলকাতার ঢাউস বাড়িঘর, পেল্লায় শহীদ মিনার, এসব খুদে চোখে কীভাবে দেখছে? তা বোঝাতে ঋত্বিক করলেন কী, এক্সট্রিম লো অ্যাঙ্গেল শট নিলেন, মানে ক্যামেরা নীচের দিক থেকে ওপরের দিকে তাকিয়ে, যাতে আমরা কাঞ্চন কী দেখছে তা বুঝতে পারি।
বিয়েবাড়িতে তার পরিচয় হয় মিনির সাথে। সিনেমায় তার ভালো নাম কনক। মনে আছে? শিবরামের গল্পে বলেছিলাম কনক নামের একটা ছেলের কথা? সেখানে বিয়েবাড়িতে দেখা মেয়েটার নাম ছিল মিনি। সিনেমায় ঋত্বিক সেটুকু রেখেছেন, বাকিটা মিলিয়ে দুটো চরিত্রকে একটা চরিত্রে রূপান্তরিত করেছেন। মিনি তার বাবা মায়ের সাথে কাঞ্চনের পরিচয় করায়। তার বাবা তাকে কখনো মারে না। তাদেরকে খুব ভালোবাসে। তিনি কাঞ্চনকে নিয়েও চিন্তিত হন। কিন্তু কাঞ্চনের মায়ের কথা মনে পড়তে সেখান থেকেও পালায় সে। এবার কলকাতা শহরে হরিদাসের মতো, মিনির বাবা-মায়ের মতো ভালো মানুষও যেমন আছে, তেমনি আছে খারাপ মানুষও। তারা বাচ্চা ছেলেমেয়েদের দিয়ে ভিক্ষে করায়। কাঞ্চন তাদের হাত থেকে একটুর জন্য বাঁচে। খিদের চোটে বাজে লোকের পাল্লায় পড়ে কয়লা চুরি করতে যায়, গিয়ে সেখানেও দুজনের কাছ থেকে তাড়া খায়।
এই ছবিটির বিশেষ আকর্ষণ ছবিটির শুরুর টাইটেল কার্ডের সমাহার। ছোট বাচ্চার আঁকার আদলে নড়বড়ে রেখায় ছবি আঁকা এই কার্ডগুলির মধ্যে দিয়ে পুরো ছবিটার গল্প প্রায় ধরা পড়েছে।
পরে বড় হলে তোমরা স্প্যানিশ পরিচালক লুই বুনুয়েলের 'লস অলভিডাদোস' (যার ইংরেজি নাম 'দ্য ইয়াং এন্ড দ্য ড্যামন্ড') সিনেমাটা দেখে ফেলতে পারো। ঋত্বিক বুনুয়েলের কাছ থেকে কিছু আঙ্গিক রপ্ত করেছিলেন। স্বপ্নের দৃশ্যগুলো যেমন। বিশেষ করে ওই সিনেমাটার কথা বললাম, কারণ সেটা বেরোয় ১৯৫০ এ। সেখানেও প্রচুর ছোট বাচ্চা আছে। অন্তঃত কাঞ্চনের কয়লা চুরির দৃশ্যের সাথে সিনেমায় পিটারের জঞ্জাল থেকে জিনিস খুঁজতে গিয়ে তাড়া খাওয়ার দৃশ্যের অদ্ভুত মিল। অনেক সিনেমাবোদ্ধা আক্ষেপ করেন ঠিক তার পরের বছরই মুক্তি পাওয়া ফরাসী পরিচালক ফ্রাঁসোয়া ত্রুফোর 'দ্য ফোর হান্ড্রেড ব্লোজ' সিনেমাটা দেখে, যে তার কপালে যেরকম সম্মান জুটেছিল, ততটা না হলেও এই অসামান্য সিনেমার জন্য ঋত্বিকের অন্ততঃ আরেকটু সম্মানপ্রাপ্তির প্রয়োজন ছিল। ভাবতে পারো, 'বাড়ি থেকে পালিয়ে'এর মতো একটা সিনেমা সেসময়ের মানুষ দেখতেই আসেনি সিনেমাহলে! যে হরিদাসের কথা বললাম, ওই চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন কালী ব্যানার্জী। তার আগে তিনি ঋত্বিকের 'অযান্ত্রিক' ছবিতেও অভিনয় করেন। এটাও বড় হলে দেখে ফেলতে পারো তোমরা। ঋত্বিক ঘটকের জীবন নিয়ে তাঁর স্ত্রী সুরমা ঘটকের লেখা একটা বই আছে, সেখানে জানা যায় 'বাড়ি থেকে পালিয়ে' ফ্লপ হওয়ার পর কালী ব্যানার্জি পরের যে ছবি 'কত অজানারে' তে অভিনয় করছিলেন, সেটা আর শেষ করাই হয়ে ওঠেনি।
এবার তুমি প্রশ্ন করতে পারো, একটা ফ্লপ ছবি কেন দেখবো? এই ছবি এ কারণেই দেখবে কারণ এ ছবি পরে অনুপ্রাণিত করেছিল অসংখ্য ছবিকে। পরবর্তীকালে যেসব সিনেমা বানানোর রীতি সবাই অনুসরণ করেছন, তাদের অনেককিছুই ঋত্বিকদের জানা ছিল না, তাঁরা সেগুলো তৈরি করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে উপহার দিয়েছেন। তরুণ মজুমদারের 'শ্রীমান পৃথ্বীরাজ' এর কথা তো বললামই। কবীর সুমনের বিখ্যাত গান "বাড়ি থেকে পালালেই অরিনোক্কো"তেও ধরা আছে এই ছবির নস্টালজিয়া। ঋত্বিকের অন্য সিনেমার মতোই দেশভাগের যন্ত্রনা 'বাড়ি থেকে পালিয়ে' ছবিরও সংলাপের ছত্রে ছত্রে। আন্তর্জাতিক সব পরিচালকদের সাথে পাল্লা দিয়ে এত কম টাকায়, কম প্রশিক্ষণে কীভাবে সেসময় আমাদের বাংলাতেও এরকম মানের একটা সিনেমা বানানো হল সেটা দেখতেই এটা দেখা দরকার।
ছবিঃ বিভিন্ন ওয়েবসাইট, উইকিপিডিয়া