দক্ষিণ ভারতের কোনো এক বিশেষ গ্রামে বিদামুন্ডন নামে এক ধূর্ত বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ বাস করত। তার নামের বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায় "দেব না"। এঁকে আমরা "দেব-না-মশাই" বলে ডাকব। সে প্রতিদিন গ্রামের দরজায় দরজায় ঘুরে ভিক্ষা চেয়ে বেড়াতো আর এমন ভান করত যেন সেই ভিক্ষান্ন দিয়ে সে প্রচুর ব্রাহ্মণভোজন করাবে। গাঁয়ের সহজ-সরল মানুষজনও তার কথায় বিশ্বাস করে বাড়িতে চাল-ডাল তরিতরকারি যা কিছুই থাকত তাকে সব দিয়ে দিত। এরপর সেই ধড়িবাজ ব্রাহ্মণ ভিক্ষান্ন নিয়ে বাড়িতে ফিরে এসে বউকে ফেনিয়ে ফেনিয়ে নিজের শয়তানীর গপ্পো শোনাতো। কীভাবে সে কার বাড়িতে গিয়ে কাকে বোকা বানিয়েছে, কার কাছ থেকে সে কতবার ভিক্ষা পেয়েছে তারই লম্বা ফিরিস্তি শোনাত এবং নিজের জন্য সেই চাল ডালের প্রয়োজনীয় অংশটুকু রেখে বাকিটা বাজারে বিক্রি করে নগদ টাকার অর্থমূল্য রোজগার করত।
কোনো দরিদ্র ব্রাহ্মণ যদি সত্যি সত্যি তার এই গালগপ্পো শুনে তার বাড়িতে এসে হাজির হত, তাহলে বিভিন্ন অজুহাত দিয়ে সে তাকে খালি হাতেই বাড়ি পাঠিয়ে দিত।
এভাবেই দিব্যি হেসেখেলে দেব-না-মশাইয়ের দিন কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু মুশকিল হল পাশের গ্রামের এক ব্রাহ্মণকে নিয়ে। এর নাম আবার কোদামুণ্ডন। যার বাংলা দাঁড়ায় "যাব না"। আমরা একে "যাব না মশাই" বলবো। এর স্বভাব এমনই আশ্চর্য ছিল যে তাকে যদি কেউ বাড়ি থেকে চলে যেতে বলে তাহলে সে যতক্ষণ না কিছু পাচ্ছে ততক্ষণ সেই বাড়ির পিছু ছাড়ে না। কোনো জায়গা থেকে একে বিদায় করা ভীষণ কঠিন কাজ।
একদিন হল কী, দেব-না-মশাইয়ের ব্রাহ্মণভোজন করানোর গালগপ্পো শুনে যাব-না-মশাই খাওয়ার ধান্দায় এসে হাজির হল তার বাড়িতে। বিদামুন্ডন সাফ জানালো সেদিনকার মতো দশজন ব্রাহ্মণকে খাওয়ানোর কথা বলা হয়ে গেছে, কোদামুন্ডন যদি পরের দিন আসে তবে সে তাকে নিশ্চিত খাওয়াবে।
যাব-না-মশাই একথা শুনে সেদিনকার মতো বিদায় নিল।
বলা বাহুল্য, দেব-না-মশাই সব ভোজনপ্রার্থী ব্রাহ্মণকে যে অজুহাত দেয় যাব-না-মশাইয়ের বেলাতেও তাই করেছিল। কিন্তু যাব-না-মশাই অন্য জিনিস। সে এসব শুনে বোকা হওয়ার পাত্র নয়। পরের দিন ঠিক যে ঘটিকায় তার উপস্থিত হওয়ার কথা তখনই গিয়ে সে গৃহস্বামীর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইল। দেব-না-মশাই তো দরজা খুলে অবাক! এর আগে সে কোনোদিন কাউকে তার মুখের কথা শুনে পরের দিন ফিরে আসতে দেখেনি। সেও তৎক্ষণাৎ ঠিক করে ফেলল, আরো শক্তপোক্ত কোনো অজুহাত দিয়ে এ ব্যাটাকে এখান থেকে তাড়াতে হবে। সে অতি কাঁচুমাচু ভাব করে বিশুদ্ধ ভাষায় তাকে জানালো, "মহাশয়, আমার ধর্মপত্নী কল্য রজনী হইতে বিষম জ্বরে কাহিল। এরূপাবস্থায় আমাকে 'সমারাধনা' বা ব্রাহ্মণ ভোজনের পুণ্যকার্য কিয়ৎ দিবসের তরে স্থগিত রাখিতে হইয়াছে। ফলতঃ আমাদিগের দুরাবস্থা বিচারপূর্বক দিনকয়েক বিলম্বে আপনার আগমন প্রত্যাশা করি।"
যাব-না-মশাই খুব অনুতাপভরা মুখ নিয়ে, অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে দেব না মশাইয়ের কথাগুলো শুনল। তারপর খুব বিচলিত স্বরে উত্তর দিল, "মহাশয়, আপনার ধর্মপত্নীর অসুস্থতার সংবাদ শ্রবণপূর্বক আমি অত্যন্ত দুঃখ বোধ করিতেছি, কিন্তু তদুপলক্ষে ব্রাহ্মণভোজন রদ করা মহাপাপকার্য রূপে বিবেচিত হইবে। বিগত দশ বর্ষ যাবৎ আমি রন্ধনপ্রণালী বিষয়ক শিক্ষা লাভ করিয়াছি। এক্ষণে আমি শত ব্রাহ্মণকে ভোজন করাইতেও সিদ্ধহস্ত। ফলতঃ আমি আপনার সমারাধনায় সানন্দে সহায়তা করিতে পারি।"
দেব-না-মশাই এই প্রস্তাবে "না" করতে পারল না বটে কিন্তু মনে মনে তৎক্ষণাৎ ছকে ফেলল যে একে দিয়ে এখন রাঁধিয়ে নেব ঠিকই কিন্তু খালি পেটেই একে এখান থেকে বিদায় করতে হবে। মুখে বলল, "অতি উত্তম প্রস্তাব। আপনার এ সহৃদয়তায় আমি কৃতার্থ। আসুন, একত্রে রন্ধন করি।" এই বলে গৃহস্বামী যাব-না-মশাইকে রান্নাঘরে নিয়ে গেল এবং স্ত্রী তার নির্দেশে অসুস্থ হওয়ার ভান করতে লাগল।
দেব-না-মশাই খাদ্যরসিক ছিল, ফলে অল্পক্ষণের মধ্যেই যাব-না-মশাইকে দিয়ে অনেক সুস্বাদু পদ রাঁধিয়ে নিল। কিন্তু মুশকিল হল, একে বিদায় করার সময়ে। হাজার হোক, এ বাড়ি থেকে খালি হাতে ব্রাহ্মণ বিতাড়নের ঐতিহ্য তো নষ্ট করা চলে না! তাই রান্না শেষ হতেই যাব-না-মশাইয়ের হাতে একটা তামার মুদ্রা বা 'কাসু' ধরিয়ে দিয়ে দেব-না-মশাই যাব-না-মশাইকে বাজার থেকে কিছু কলাপাতার থালা কিনে আনতে বলল। এই সময়টুকুর মধ্যে দেব-না-মশাই তার বউকে নির্দেশ দিল,
" ওগো, তোমাকে তো রান্নার হাত থেকে আজ মুক্তি দিলাম, যাতে এই বুদ্ধুটাকে দিয়ে রান্না করিয়ে নিতে পারি। এখন তাকে বাজার থেকে কলাপাতা আনতে পাঠিয়েছি। এবার যদি দরজা বন্ধ করে তাকে ঢুকতে না দিই বা তাকে তাড়িয়ে দিই সেটা তো আর ভালো দেখায় না! তাই আমাদের এমন কিছু করতে হবে, যাতে ও নিজেই এখান থেকে সরে পড়ে। আমার মাথায় এক ফন্দি এসেছে। যে মুহূর্তে ও আমাদের বাড়ির চৌকাঠে পা দেবে, তক্ষুনি তুমি আমার সঙ্গে তুমুল ঝগড়া শুরু করবে। তখন আমি তোমাকে, মানে তোমার পাশের মাটিতে খুব জোরে জোরে আঘাত করবো আর তুমি প্রচন্ড চিৎকার করে কান্নাকাটি করবে। এসব দেখে অতিথি বিরক্ত হয়ে এই বাড়ি থেকে চলে যাবে।"
দেব না মশাই এসব বলা সবে মাত্র শেষ করেছে, দেখে যাব-না-মশাই আসছে। কথামতো তার বৌ চিৎকার করে দেব-না-মশাইকে ব্রাহ্মণভোজনের নামে টাকা নষ্ট করার জন্য দোষারোপ করতে লাগল। সে বলল, "তুমি যদি এভাবেই দিনের পর দিন পেটুক ব্রাহ্মণদের খাওয়ানোর জন্য সব টাকা উড়িয়ে দাও তাহলে আমাদের দিন চলবে কী করে? এতটুকু লজ্জা করে না? এমনকি আমার অসুস্থ্যতার সময়েও তোমার বিলাসিতার ব্রাহ্মণভোজন চালিয়ে যেতে হবে?" এরকম আরো অনেক কথাই বউ বলে চললো। প্রথমে মনে হল, দেব না মশাই যেন সেগুলোয় কান দিচ্ছে না, কিন্তু শেষমেষ রেগে গিয়ে সে মেঝেতে বারবার আঘাত করতে লাগল। প্রত্যেকবার আঘাতের পরেই- "ওরে মেরে ফেললে গো...কারো প্রাণে দয়া থাকলে আটকাও গো..." ইত্যাদি বলে চিৎকার করে তার বউ মড়াকান্না জুড়ে দিল। এদিকে যাব-না-মশাই উঠোন থেকে এসব কান্ডকারখানা দেখে ঠিক করেছিল এখন গিয়ে স্বামী স্ত্রীর ঝগড়ায় নাক গলাবে না। পরে এসব ব্যাপার স্যাপার মিটলে গিয়ে দেখবে'খন। ঝগড়ার সাক্ষী হিসেবে পাছে আদালতে ডাক পড়ে, তাই ভয়ে ভয়ে সে গিয়ে বাড়ির চিলেকোঠায় উঠে ঘাপটি মেরে বসে রইল।
কিছুক্ষণ পর দেব-না-মশাই বাড়ির বাইরে এসে দেখল অতিথি নেই। চারপাশ ভালো করে খুঁজেও যখন তার টিকির পর্যন্ত দর্শন পাওয়া গেল না, তখন ভাবল, "যাক! আপদ বিদেয় হয়েছে!" এরপর সে ধীরে সুস্থে দরজায় খিল দিল। তার বউ নোংরা ছেঁড়া কাপড় ছেড়ে একটা পরিষ্কার কাপড় পড়ল। তারপর সে বউকে বলল, "যাক, শেষ অব্দি লোকটাকে তাড়ানো গেছে ! তোমার নিশ্চয়ই এতক্ষণে খুব খিদে পেয়ে গেছে? চলো আমরা খেতে বসি।"
গোটা খাবারটা দুটো পাতে সমানভাগে ভাগ হতে লাগল। ইতিমধ্যে যাব-না-মশাই বসে বসে সব কথাবার্তা শুনছিল। তার নিজেরও খুব খিদে পেয়েছিল, তাই সে কেবল সঠিক সময়ের অপেক্ষায় ওৎ পেতে ছিল।
সে শুনল দেব না মশাই গর্ব করে বলছে,
"ওগো, আমি তোমার গায়ে হাত না তুলেই কী প্রচন্ড মারধোর করিনি?"
একথার উত্তরে তার গিন্নী বলছে, "ওগো, চোখের জল না ফেলেই কী আমি আমি প্রচন্ড কাঁদিনি?"
এবার আর যাব-না-মশাই চুপ থাকতে পারে না। "ওগো, খাবার না খেয়ে যে আমি যাব না একথা কী তোমরা বোঝনি?" উপর থেকে জবাব দেয়। আর একথা বলেই ঝপাং করে লাফিয়ে নেমে নিজের পাতা নিয়ে খেতে বসে যায় সে। অগত্যা আর কী করে, মনে মনে চটে গেলেও যাব-না-মশাইকে খেতে না দিয়ে দেব-না-মশাইয়ের আর উপায় থাকে?
ছবিঃ প্রিয়াঙ্কা অগ্রওয়াল
এই গল্পটিকে তামিল ভাষায় তিনটে প্রবাদবাক্যের উৎস বলে মনে করা হয়।
◆ নোভামাল আদিত্তেন - মেরেছি কিন্তু লাগেনি
◆ ওয়ামাল আলুদেন - কান্না কিন্তু থামাই নি
◆ পোকামাল বন্দেন - বিদায় না নিয়েই এসে গেছি
এই তিনটি প্রবাদবাক্য তামিলে যথাক্রমে স্বামী ও স্ত্রীয়ের মধ্যে, স্ত্রী ও স্বামীর মধ্যে এবং অতিথি ও গৃহস্বামীর মধ্যে আপাত মধুর সম্ভাষণ বোঝাতে ব্যবহার হয়।