“তিরিয়ো। তার মানে আড়বাঁশি।
আড়বাঁশি বেজে উঠল নদীধারে। আখের বিলে। আড়বাঁশি বেজে উঠল বনের ভিতর। সীতানালা খালধারে। আড়বাঁশি বেজে উঠল করণতলার বিলে। উদারডাঙায়।”
বইটা শুরু হচ্ছে এক অদ্ভুত মায়াবী গদ্যে। তারপর প্রথমেই তোমাদের পরিচয় হবে মঙলুর সঙ্গে। সে এই বইয়ের মুখ্য চরিত্র। ঠিকানা কুসুমগাঁ। মঙলুর কথা পড়তে পড়তে তোমাদের রাডিয়ার্ড কিপলিং এর ‘দ্য জাঙ্গল বুক’ এর মোঙলির কথা মনে পড়তেই পারে। শুধু নামেই মিল নয়, স্বভাবেও খানিকটা মিল আছে দুজনের। সে ছিল অরণ্যশাবক। আর এই মঙলু অরণ্যে বড় না হলেও প্রকৃতির খুব কাছাকাছি থাকে। তার একটা মোষ আছে। সারাক্ষণ তার পিঠে চড়ে মঙলু জায়গায় জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। মোষকে মঙলু ‘মোষ’ বলে না, বলে ‘কাডা’। আর মঙলুকে লোকে ‘মঙলু’ বলে না, বলে ‘কাডা হপন’। মানে ‘মোষের ছানা’।
ভাবছ বোধহয়, এ আবার কী ভাষা? লেখক নলিনী বেরার জীবনের শুরুর দিনগুলো কেটেছিল সুবর্ণরেখা নদীর তীরে লোধা-ভুঁইঞা-ভূমিজ-কাম্হার-কুম্হার-সাঁওতালদের একটা গ্রামে। তিনি তাঁর অনেক গল্প উপন্যাসেই তাঁদের ভাষায় লেখেন। রাজু, তেলী, সদগোপ, করণ, কৈবর্ত, খন্ডায়েৎ- সব হাটুয়া লোকেদের ভাষা। ‘হাটুয়া’ বা ‘কেরা বাংলা’। মজার ব্যাপার, যে ‘ভদ্র’ বাংলায় তুমি কথা বলো, যে ভাষায় এই বইটা লেখা; সেটাই এই বইয়ের চরিত্রদের কাছে ‘দিকু’ বা বিদেশীদের ভাষা। মহাশ্বেতা দেবীর লেখা যদি পড়ো, দেখবে আসলে ‘দিকু’ কথার অর্থ ‘শত্রু’। সাঁওতালরা ১৮৫৫ সালে বাঙালি জোতদার, মহাজন শ্রেণির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন। ‘উলগুলান’ বা বিদ্রোহের গান গেয়েছিলেন তাঁরা - ‘দিকু জাতি দুকু দাসা আতুতান দিসুম’। বড়ো হয়ে যদি কোনোদিন হাঁসদা সৌভেন্দ্র শেখরের লেখা ‘আদিভাসি উইল নট ডান্স’ পড়ো তাহলে দেখবে কীভাবে বাঙালিরা নিজেদের সংস্কৃতি দিয়ে ওদের সংস্কৃতিকে গ্রাস করছে। তাই বাঙালিরা এখনো কিছু জায়গায় ওনাদের কাছে ‘দিকু’। এতকথা দিকুদের নিয়ে বললাম কারণ ‘তিরিয়ো আড়বাঁশি’ বইতে কানাইসর পাহাড়ে পাহাড়পুজোর গল্প আছে। সেখানে ‘দিকু’দের প্রবেশ নিষেধ। নিজে চোখে সেখানে গিয়ে দেখতে না পাও, এখানেই পড়তে পারবে বিচিত্র সব দেবতা ‘মারাঙবুরু’, ‘মঁড়েকা তুরুইকো’, ‘জাহের এরা’, ‘গোঁসাই এরা’, ‘বিরবোঙা’, ‘বাঙুৎবোঙা’, ‘জমসিমবোঙা’ দের নিয়ে গপ্পো। এদেরকে মানুষ ভয় পায়। আছে প্রচুর ‘পরব’ বা ‘উৎসব’ এর গপ্পো। শুধু দারিদ্রই নয়, জীবনে পদে পদে অনিশ্চয়তা। এই যেমন ‘দিশম সেঁদরা’ বা শিকারে যাওয়ার সময় বাড়ির পুরুষরা বউদের হাতের নোয়াশাঁখা খুলে নেন। ধরেই নেন, তাঁরা আর বেঁচে ফিরবেন না। তাই যে কদিন মানুষ বাঁচেন, আনন্দ করে নেন। ওনাদের গানেই কথা আছে ‘নওয়া হাসা হড়ম বারসিঞ লাগিৎ’ – ‘এই মাটির শরীর দুদিন বৈ তো নয়’।
চরিত্র এ বইয়ে তেমন একটা নেই। বেশিটা জুড়ে আছে মঙলু আর ‘লায়া’ কুলাই টুডু। এছাড়াও আছে মঙলুর বাপ শুকচাঁদ আর মা যদুমণির কথা। আছে কুমোরদের পড়ুয়া ছেলে সুবল, বীরলি মুর্মুর ছেলে রাবণ, ভুজু, ডিবরা, পিথো, গুরা, সনাতন, লায়াবুড়ির মতো ছোট ছোট চরিত্ররা।
গপ্পো এগোয় ঋতুচক্র মেনে। যে ঋতুতে যে পরব। ‘ঝেট’ বা জ্যৈষ্ঠ মাসের তেরো তারিখে আউশ ধান বোনা হয়েছিল। ‘ভাদর’ বা ভাদ্র মাসে তা পাকতে আরম্ভ করে। ফাল্গুনে হয় ‘বাহা’ পরব। মানুষ কাল গণনা করেন প্রকৃতিকে দেখে। তার সঙ্গে এসে আবার মেশে লৌকিক বিশ্বাসের গল্প। পাহাড়পুজোয় বলির রক্ত বা ‘লোহু’তে লাল হয়ে ওঠে পাহাড়। সে পাহাড় দেবতাকে নিয়ে নানা কথা শোনা যায়। আবার ‘বাহা’তে মঙলু আর ওর বন্ধুদের উপর ভর করে ‘দ্যাবতা’রা। কী হয় তারপর? ‘দেহুরির থানে’ কেন পুজো শুরু হল তার পিছনে আছে ‘দ্যাবতা’র বাঘ মেরে খাওয়ার গপ্পো। পুরোহিতের নিজে চোখে দেখা ঘটনা। কী দেখেছিলেন তিনি? ‘দিশম সেঁদরা’য় মঙলু কী শিকারে যায়? সে তো এখনো ‘ডাঙুয়া কাডা’, অর্থাৎ তার বিয়ে হয়নি। আর শিকারে না গেলে তার যে বিয়ে হবে না। বাকিটা বলবো না। প্রশ্নগুলোর উত্তর পাওয়ার জন্য অবশ্যই পড়ে ফেলতে পারো লেখক নলিনী বেরার লেখা বই ‘তিরিয়ো আড়বাঁশি’। যুধাজিৎ সেনগুপ্তর আঁকা অসাধারণ ছবি আর তেলকাগজে ছাপা কার্ডবোর্ড বাঁধাই করা বইটা দেখলে বোঝা যায় প্রকাশক প্রতিক্ষণ বেশ যত্ন করে বের করেছেন। তারপরেও দু এক জায়গায় অনেকগুলো নাম পরপর লেখার সময়ে ‘কমা’ ছাপা হয়নি। তবে সেটার জন্য পুরো বই পড়ার ক্ষেত্রে তেমন একটা অসুবিধা হয় না। আপাতত শুধু ক্যুইজের প্রশ্ন হিসেবেই জেনে রাখতে পারো, এই বইয়ের লেখক নলিনী বেরা নিজের জীবনের ঘটনা নিয়ে লিখেছিলেন ‘সুবর্ণরেণু সুবর্ণরেখা’ নামের একটা উপন্যাস, যার জন্য ২০১৯ সালে আনন্দ পুরস্কার পান তিনি। সে বই তো না হয় তোমরা বড় হলে পড়বে, কিন্তু তার আগে পড়ে ফেলতেই পারো ওনারই লেখা ‘তিরিয়ো আড়বাঁশি’ নামের ৬০ পাতার এই রঙচঙে ছোট্ট বইটা।
তিরিয়ো আড়বাঁশি
নলিনী বেরা
প্রকাশকঃ প্রতিক্ষণ
দামঃ ১০০ টাকা (২০১৫)