২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে একটি খবর চোখে পড়েছিল। একটি প্রথমসারির টেলিভিশন চ্যানেল ছাড়াও, অনলাইন একাধিক সংবাদপত্রে খবরটি প্রকাশিত হয়। খবরের কেন্দ্রে ছিল একটি ছোট ছেলে। তার নাম যশবীর আলম ইসলাম। যশবীর গুয়াহাটির ডন বস্কো স্কুলের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র। গতবছরের শেষে, একটি বিশেষ সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আসামের সাধারণ মানুষ প্রবল প্রতিবাদে শামিল হন। এই প্রতিবাদ চলাকালীন প্রচুর মানুষ আহত হন, কিছু মানুষ মারা যান। সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবনে ছন্দপতন হয়। এমনই এক সময়ে, একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে, যশবীরের সামনেই রাস্তার ওপরে প্রতিবাদ, মারামারি হয় এবং পুলিশের গোলাগুলি চলে। এই অভিজ্ঞতার পরে দশ বছরের যশবীর আলম ইসলাম ঠিক করে যে সে সরাসরি রাষ্ট্রসঙ্ঘের মহাসচিবকে ইমেইল করে তার রাজ্যের কথা,তাদের সমস্যার কথা জানাবে।
এমন সিদ্ধান্ত যশবীর কেন নিল? কারণটা তো তার স্কুলের বইতেই রয়েছে। সেখানে সে রাষ্ট্রসঙ্ঘ, রাষ্ট্রসঙ্ঘের কাজ সম্পর্কে জেনেছে। সে জানে, সারা পৃথিবীর যেকোনোও জায়গাতে সামগ্রিকভাবে মানুষের জীবনে সমস্যা দেখা দিলে, রাষ্ট্রসঙ্ঘের কছে সমাধানের জন্য অনুরোধ জানানো যায়। তাই যশবীর তার মায়ের সাহায্য নিয়ে রাষ্ট্রসঙ্ঘের মহাসচিবকে চিঠি লেখে।সে লেখে, আমার মাতৃভূমি আসাম পুড়ছে, দেখে আমার মন ভেঙে যাচ্ছে... আমাদের কথা কেউ শুনছে না... আমি আবার আনন্দের জীবনে ফিরে যেতে চাই, সপ্তাহের শেষে সিনেমা দেখতে যেতে আই, মা-বাবার সঙ্গে কে এফ সি তে খেতে যেতে চাই -- নিজের আশেপাশের মানুষদের তরফ থেকে আশেপাশের মানুষদের কথা ভেবে, রাষ্ট্রসঙ্ঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেজকে এমনই এক ইমেইল করে যশবীর।
এই গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম কেন বলতো ? কারণ একটাই, আমরা বড়রা চাই বা না চাই, আমাদের চারপাশে ঘটে চলা প্রতিটি ঘটনা - সেগুলি ভালো হোক বা মন্দ, ঠিক হোক বা ভুল - আমাদের আশেপাশের ছোটদের মনেও ছাপ ফেলে। আমরা বড়রা সবসময়ে সেটা বুঝি না, বা বুঝলেও গুরুত্ব দিই না। আবার অনেক সময়ে এমন ও হয়, যে আমরা বড়রা ভেবেই পাই না, ছোটদের সব প্রশ্নের উত্তর কেমন করে দেব। হাতে হাতে মোবাইল ফোন এসে যাওয়ার দৌলতে,আমাদের সবার চোখের সামনে এসে ভীড় করছে কত ঘটনা, কত খবর। সেগুলির কিছু খুব সত্যি, কিছু ডাহা মিথ্যে। সেসব নিয়ে ইচ্ছামতীও আমাকে নানারকমের প্রশ্ন করে, আমিও চেষ্টা করি তার সব প্রশ্নের উত্তর দিতে। কারণ প্রশ্ন করা, আর উত্তর জানতে চাওয়া কোনোও অপরাধ নয়। সত্যি আর মিথ্যের ফারাক করতে জানতে পারাটাও অন্যায় নয়। " তুমি এখন ছোট, তাই তুমি বুঝবে না" কিংবা " এমন সব কথা ছোটদের শুনতে নেই, জানতে নেই, বলতে নেই -" এমন সব কথা ছোটরা মোটেও পছন্দ করে না। আর এমন সব কথা বলার দিন ফুরিয়েছে। সেটা তো তুমিও জানো, ইচ্ছামতীও জানে, আমিও জানি।
এই যেমন ইচ্ছামতী আমার কাছে জানতে চেয়েছে, চারদিকে ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনা পড়া নিয়ে এতকথা হচ্ছে কেন? টিভিতে বা ফেসবুকে কিংবা হোয়াটস্যাপে দেখা যাচ্ছে, ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে, দলে দলে মানুষ একত্রিত হয়ে, এক সঙ্গে ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনা পাঠ করছেন। রাত জেগে বসে আছেন ছোট ছোট শিশুদের নিয়ে মা-দিদিমারা, কলেজের ছাত্রছাত্রীরা।কোথাও কোথাও দেখা গেছে ইচ্ছামতীর সমবয়সী বন্ধুদেরকেও। বড়রা আর ছোটরা একসঙ্গে গান করছেন, কবিতা বলছে্ন, স্লোগান বলছেন। তাদের সবার মুখে একটাই কথা- ভারতীয় সংবিধানের সম্মানহানি তাঁরা হতে দেবেন না। তাঁরা আরও বলছেন, এই দেশের মাটিতে, এই দেশের প্রত্যেকটি নাগরিকের সমান অধিকার, তাঁরা সবাই সমান সম্মান আর স্বাধীনতা নিয়ে বসবাস করতে পারবেন- এমনই কথা বলে আমাদের সংবিধান।
এর মধ্যে, মাত্র দুই দিন আগেই আমরা জানতে পারলাম, মহারাষ্ট্র সরকারের তরফে জানানো হয়েছে যে, এই ২৬শে জানুয়ারি থেকে, মানে ভারতের ৭১ তম প্রজাতন্ত্র দিবস থেকে, মহারাষ্ট্রের সমস্ত স্কুলে ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনা পড়া বাধ্যতামূলক করা হল। তাই ইচ্ছামতী সিদ্ধান্ত নিল, আমরাও আজ সবাই মিলে আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনা পড়ব।পড়ে এই প্রস্তাবনার অর্থ বোঝার চেষ্টা করব, জানতে চেষ্টা করব কেন এত মানুষ দলে দলে একসঙ্গে ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনা পড়ছেন। যদি বুঝতে না পারি, তাহলে বড়দের জিজ্ঞাসা করব। আর শুধু জেনেই থেমে থাকব না, নিজেদের প্রতিদিনের জীবনে প্রয়োগ ও করার চেষ্টা করব।
এইখানে রইল ভারতার সংবিধানের প্রস্তাবনার অনুবাদ। মূল প্রস্তাবনার ছবিটি এই চিঠির একবারেই ওপরে রয়েছে।
আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
আমাদের, এই দেশের প্রতিটি নাগরিকের ভুলে গেলে চলবে না, ভারত পৃথিবীর সব থেকে বড় গণতন্ত্র। আর আমাদের এই দেশের অভিনবত্বই হল বিবিধের মিলন। বাবাসাহেব আম্বেদকরের নেতৃত্বে আমাদের পূর্বপ্রজন্মের জ্ঞানীগুণীজনেরা, আমাদেরই জন্য এই সংবিধান তৈরী করে আমাদেরই হাতে তুলে দিয়েছেন। তাই এই সংবিধানের সম্মান বজায় রাখাটাও আমাদের প্রত্যেকের কর্তব্য। আমাদের আশেপাশের সমস্ত মানুষ যেন ন্যায়বিচার পায়, স্বাধীনভাবে জীবন যাপন করতে পারে, একে অপরকে সম্মান করতে পারে এবং নিজেদের মধ্যে সুন্দর বন্ধুত্ব বজায় রাখতে পারে, এমন চেষ্টা আমরা সবাই সচেতনভাবে করব। আর 'সমস্ত মানুষ' মানে শুধু পাশের বাড়ি, নিজের পাড়া বা স্কুলের বন্ধু নয়; সমস্ত মানুষ মানে সেই সব মানুষ, যাঁদের আমরা হয়ত চোখেও দেখিনি, যাঁদের জীবনযাপন সম্পর্কে আমরা কিছুই জানিনা - সেই সমস্ত আদিবাসী, দলিত, নানা জনজাতির মানুষ, বনে-জঙ্গলে-মরুভূমিতে-পাহাড়ে গভীরে থাকা মানুষ; গাছ-পাথর থেকে শুরু করে বিরাট মূর্তি কিংবা নিরাকার ঈশ্বরের উপাসনা করা মানুষ।
ভারত সরকারের নতুন কিছু সিদ্ধান্ত এই দেশের এই সমস্ত সাধারণ মানুষের জন্য ঠিক না বেঠিক, সেটা সময় বলবে। সেটা নিয়ে কোনোওরকম আলোচনা ইচ্ছামতী আর চাঁদের বুড়ি করবে না। কিন্তু ইচ্ছামতী আর চাঁদের বুড়ি, দুজনেই চায়, আমাদের এই বিরাট, সুন্দর দেশটা যেন সমস্ত তুচ্ছ হিংসা-ভেদাভেদ ভুলে, সারা পৃথিবীর সামনে গর্ব করার মত একটা দেশ হয়ে থাকে। এই দেশের প্রতিটা মানুষ - তার ধর্ম,ভাষা, পোষাক , খাবার- সব পছন্দ বজায় রেখেই শান্তিতে, স্বাধীনভাবে থাকতে পারে। প্রতি বছর ২৬শে জানুয়ারির সকালে, দিল্লির রাজপথে যে বিরাট কুচকাওয়াজ আর শোভাযাত্রা হয়, যার শুরু থেকে শেষ অবধি ভারতের বিবিধতার জয়গান, যা দেখে আমাদের বুক গর্বে ভরে ওঠে -- সেই গর্ব যেন একদিন, কয়েকঘন্টার জন্য না হয়ে সারাবছর, প্রতিদিন বজায় থাকে।
আজ ইচ্ছামতীতে অন্যান্য কিছু লেখার সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছে সরোজ দরবারের কলমে একটি বিশেষ রচনা , অবশ্যই পড়ে দেখো কিন্তু।
সবার সঙ্গে, সবাইকে সাথে নিয়ে সর্বদা ভালো থেকো।
সংবিধানের প্রস্তাবনার ছবি এই সাইট থেকে পাওয়া