এই গল্পের ঘটনাটি ঘটেছিল অনেক অনেক আগে। একদিন এক ঈগল আকাশে ডানা মেলে মনের সুখে উড়ছিল। হঠাৎ নীচে মাটির দিকে তাকিয়ে তার মনে হলো ওখানে কিছু একটা গোলমাল হচ্ছে।
এদিকে হয়েছে কি, এক বেচারা শেয়াল ক্ষিদের যন্ত্রণায় হন্য হয়ে জঙ্গলের ঝোপের ভেতর খাবার খুঁজছিল। সেদিনটা ছিল ভারী সুন্দর। রোদে চারদিক ঝকমক করছিল। যাহোক কিছু একটা খাবারের খোঁজে শিয়াল ঝোপের আরো ভেতরে গিয়ে ঢুকলো। বাতাসে গন্ধ শুঁকে সে যখন চারপাশে খাবার খোঁজাখুঁজি করছিল, তখন বেখেয়ালে হঠাৎ কোনো শিকারির পেতে রাখা ফাঁদে শেয়াল আটকা পড়লো। বিপদে পড়ে শিয়াল কিন্তু একটুও ভয় পেলো না। সে বরং ফাঁদ থেকে নিজেকে ছাড়ানোর জন্য মেলা কসরত শুরু করে দিলো। কিন্তু অনেক টানা হ্যাঁচড়া করেও বেচারী কিছুতেই নিজেকে মুক্ত করতে পারলো না। কারণ ফাঁদটা ছিল বেশ মজবুত ভাবে তৈরি।
অনেক চেষ্টা করেও যখন কোনো ফল পেলো না, শেয়াল তখন সাহায্যের আশায় “বাঁচাও! বাঁচাও! কে কোথায় আছো দয়া করে আমাকে এই ফাঁদ থেকে মুক্ত করো” বলে চেঁচাতে শুরু করলো।
এক বাঘ তখন হেলে দুলে জঙ্গলের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। সে ভাবলো, কে আবার ফাঁদে পড়লো! কৌতূহলী হয়ে কাছে গিয়ে বাঘটা যখন দেখলো এক শেয়াল ফাঁদে আটকা পড়ছে। বাঘ তখন আর সেখানে দাঁড়িয়ে না থেকে সটকে পড়ার মতলব আঁটলো।
“দয়া করে এই ফাঁদ থেকে আমাকে বের হতে সাহায্য করো”, বলে শেয়ালটা তখনও চেঁচিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বাঘটা যেন কানে কিচ্ছুটি শুনতে পেলো না।
তোমরা নিশ্চয়ই জানো, শেয়াল সব সময় অতিরিক্ত চালাকি করে অন্যদের ঠকায় বলে বনের বেশির ভাগ জন্তু-জানোয়ার তাকে খুব একটা পছন্দ করে না। তাছাড়া পাজি শেয়াল সুযোগ পেলেই বনের পশুদের খাবার চুরি করে খেয়ে ফেলতো। অন্যদের নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করতো। বাঘের সাথেও এর আগে অনেকবারই সে চালাকি করেছে। কাজেই তাকে সাহায্য না করে বাঘ সটকাবে না তো কী!
এভাবে একে একে অনেকেই ফাঁদে আটকে পড়া শেয়ালকে দেখতে এলো। কিন্তু কেউই তাকে ফাঁদ থেকে মুক্ত করতে এগিয়ে এলো না। সবাই দেখেটেকে এড়িয়ে চলে গেল। শেয়াল কাতরভাবে মিনতি করতে লাগলো, ভবিষ্যতে সে আর কারো সাথেই আগের মতো ব্যবহার করবে না। আজকের পর থেকে একদম লক্ষ্মী হয়ে যাবে। আর কারো খাবার চুরি করে খাবে না, ইত্যাদি বলার পরও কেউ এসে তাকে ফাঁদ থেকে বের হতে সাহায্য করলো না।
কাঠবিড়ালি এলো সবার শেষে। কাঠবিড়ালি কে দেখে কাতর গলায় শেয়াল বললো-
“কাঠবিড়ালি ভায়া, দয়া করে আমাক এখান থেকে উদ্ধার করো। আজ সারাদিন আমি এখানে আটকা পড়ে আছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই যে শিকারি ফাঁদটা পেতে রেখে গেছে সে এসে পড়বে। আমি নিশ্চিত শিকারি আমাকে মেরেই ফেলবে। দয়া করে আমাকে বাঁচাও ভায়া!”
কাঠবিড়ালি মন দিয়ে শেয়ালের সব কথা শুনেটুনে বললো, “আচ্ছা বেশ, আমি তোমাকে বের হতে সাহায্য করবো, কিন্তু মুক্তি পেয়েই তো তুমি আমার ঘাড় মটকাবে।”
শেয়াল মাথা ঝাঁকিয়ে কাঠবিড়ালির কথার প্রতিবাদ করে বললো--”না না, একদমই ওসব কিচ্ছু করবো না প্রিয় কাঠবিড়ালি ভায়া, বিশ্বাস করো! আমি প্রতিজ্ঞা করছি একদম ভদ্রলোকের মতো ব্যবহার করবো, তোমার ধারে কাছেও যাবো না; এমনকি তোমার মাথার একটা চুলও ছোঁবো না। তুমি যদি আমাকে এখন থেকে মুক্ত করে দাও, তাহলে নাক বরাবর সোজা হেঁটে বাড়ি চলে যাবো। প্রতিজ্ঞা করছি, তিন সত্যি!”
কাঠবিড়ালিটা ছিল ভীষণ দয়ালু, শেয়ালের বেগতিক অবস্হা দেখে তার খুব মায়া হলো। ফাঁদ থেকে শেয়ালকে বের হতে সাহায্য করবে বলে কাঠবিড়ালি রাজি হয়ে গেল। কাঠবিড়ালি ফাঁদটা সরিয়ে একটা গাছের ডাল ছুঁড়ে দিলো, যাতে শেয়াল ফাঁদ ঠেলে বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে।
বুদ্ধি মতো কাজ হলো। ফাঁদ থেকে শেয়ালটা বাইরে বেরিয়ে এলো। বাইরে বেরনোর পরপরই ক্ষিদেতে শেয়ালের নাড়ীভূঁড়ি সব খাবো খাবো করতে শুরু করলো যেন। সারাটা দিন না খেয়ে সে ফাঁদে আটকে ছিল, ক্ষিদের আর দোষ কী! ‘মুক্তি পেয়ে সোজা সে বাড়ির পথে হাঁটা দেবে’-প্রতিজ্ঞা ভুলে গিয়ে সে তখন দয়ালু কাঠবিড়ালিকে খাবে বলে তাকে খপ করে ধরলো।
ওই যে আকাশে ঈগলটার কথা বলেছিলাম মনে আছে তো? হ্যাঁ, সেই ঈগলটা ঠিক তখনই জঙ্গলের উপর দিয়ে চক্কর দিতে দিতে নীচে তাকিয়ে দেখতে পেলো শেয়াল কাঠবিড়ালিকে আক্রমণ করেছে।
শেয়াল কে শিক্ষা দিতে ঈগল তড়িঘড়ি নীচে নেমে এসে শেয়ালের পিঠের উপর বসলো। তার ধারালো থাবা দিয়ে শেয়ালের আক্রমণে ব্যথায় চেঁচাতে থাকা কাঠবিড়ালিটাকে উদ্ধার করলো। শেয়াল আর কাঠবিড়ালি দুজনকে আলাদা করার পর কাহিনিটা কি জানতে চাইল।
কাঠবিড়ালি তখন সবটা খুলে বললো ঈগলকে। ফাঁদে পড়ে শেয়াল সাহায্যের জন্য কাকুতি মিনতি করায় কাঠবিড়ালি তাকে ফাঁদ থেকে বের হতে সাহায্য করে। তবে শর্ত ছিল শেয়াল কাঠবিড়ালিকে কিচ্ছুটি করবে না। শেয়ালও প্রতিজ্ঞা করেছিল সে কিছুই করবে না।
কিন্তু মুক্ত হওয়ার পর শেয়ালের কাণ্ডকীর্তি তো ঈগল নিজের চোখেই দেখেছে।
বুদ্ধিমান ঈগল ব্যাপার বুঝে নিয়ে কায়দা করে বললো, “ঘটনা যা ঘটেছে খুব ভালো হয় যদি তোমরা সেটি আমায় করে দেখাও। আমার পক্ষে তাহলে বুঝতে সুবিধা হবে। তো শেয়াল মশাই, আপনি ফাঁদের নীচে যেভাবে আটকে ছিলেন সে অবস্হায় ফিরে যান। পুরো ব্যাপারটা আবার শুরু থেকে হোক।”
চালাক শেয়ালটা বুঝতে পারলো ঈগলের কথা মতো কাজ না করে তার আর কোনো উপায় নেই। কাজেই সে তড়িঘড়ি ফাঁদের কাছে ফিরে গেল।
ঈগল তখন বেশ ভালো করে শেয়ালকে ফাঁদে আটকে দিলো। পরীক্ষা করে নিতেও ভুললো না ফাঁদের বাঁধন মজবুত হয়েছে কিনা। তারপর শেয়ালকে বললো,
“শেয়াল মশাই, অতি চালাকির শাস্তি হিসেবে তুমি এখানেই বন্দী থাকো আর মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করো। আমার মতে তুমি এমন ব্যবহারেরই যোগ্য। সামান্য একটা প্রতিজ্ঞাও যে রাখতে পারে না বনের কোনো পশু প্রাণীর দয়াই তার প্রাপ্য নয়।”
এরপর ঈগল কাঠবিড়ালিকে তার বাড়িতে পরিবারের কাছে ফিরে যাবার পরামর্শ দিলো, এবং শেয়ালকে তার ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়ে ডানা মেলে আবার আকাশে উড়াল দিলো।
( মূলগল্প: ‘কানিং ফক্স এন্ড ওয়াইজ ঈগল্’ , জাপানের লোককথা)
ছবিঃ শিল্পী ঘোষ