পশ্চিম আকাশকে লাল রঙে রাখিয়ে সূর্য অস্ত গেছে, কিন্তু তার আলোর সবটুকু এখনও মুছে যায়নি, চারপাশ এখনও দিব্যি দেখা যায়। তবে সেও আর কতক্ষণ? সন্ধ্যে নামছে দ্রুত, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আশপাশ ডুবে যাবে ঘন কালো অন্ধকারে। ভাগীরথীর দু পাড়ে পল্লীগুলোর বাড়িতে বাড়িতে জ্বলে উঠবে আলো।
ভাগীরথীর বুকে আগু পিছু করে ভেসে চলেছে দুটি বড়ো নৌকো। তার যাত্রী সংখ্যাও কিছু কম নয়। প্রথম নৌকায় রয়েছেন দুর্গাচরণ হালদার, তাঁর স্ত্রী সুলোচনা, তাঁদের দুই পুত্র এবং এক কন্যা। মেয়েটি একেবারেই ছোটো, কয়েক মাসের মাত্র। দ্বিতীয় নৌকোয় আছে তিনজন দাস দাসী এবং নানান প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। দু নৌকোতেই দুজন করে জনা চারেক লেঠেল আছে। নিরস্ত্র অবস্থায় এ পথে পাড়ি দেওয়ার কথা কেউ কল্পনাও করতে পারত না। তবে দুর্গাচরণের তেমন চিন্তা নেই, তাঁর ভাই তাঁর রাত্রিবাসের সুবন্দোবস্ত করেছেন।
দুর্গাচরণ কর্মসূত্রে বহুকাল বাংলার বাইরে। এবার এলেনও প্রায় পাঁচ বছর বাদে। সুলোচনার দাদার মেয়ের বিয়ে, সেই উপলক্ষ্যেই এসেছেন। যাচ্ছেনও সেখানেই, বর্ধমানে। দুর্গাচরণের পৈত্রিক ভিটে বাগবাজারে, এসে সেখানেই উঠেছিলেন।
ভাই বললেন, "দাদা বর্ধমান কী এখানে? নৌকো করে যেতে সময় লাগবে, পথঘাট ভালো নয়, ডাকাতের উপদ্রব লেগেই আছে, তার ওপর তোমাদের সঙ্গে টাকাকড়ি, গয়নাগাটিও কম নেই।"
দুর্গাচরণ হেসেই উড়িয়ে দিয়েছিলেন, বললেন, "চারজন লেঠেলকে তো সঙ্গে নিচ্ছি, তার মধ্যে আবার হনুমন্ত আর দেওকিনন্দন তাগড়াই পালোয়ান, আমাদের সঙ্গে গোটা রাস্তা এল, ওরা সঙ্গে থাকলে কেউ কিচ্ছুটি করতে পারবে না। ওদের হাতের এক চাপড় খেলেই সবাই মুচ্ছো যায়!"
ভাই কিন্তু মানলেন না, বললেন, "এত দিন বাইরে বাইরে থেকে তুমি এদিককার কথা কিছুই জানো না। এখানকার ডাকাতরা যে কী ভীষণ তা তোমার ধারণাই নেই। তোমার ওই দেওকি আর হনুমন্ত ওদের কিছুই করতে পারবে না, উলটে তোমাদের বাঁচাতে গিয়ে ওরাই না বেঘোরে প্রাণ হারায়!"
দুর্গাচরণের জেঠতুতো দাদা ওখানে উপস্থিত ছিলেন, তিনিও ছোটো ভায়ের কথায় সায় দিলেন, বললেন, "ও ঠিকই বলছে, এখানকার ডাকাতদের কথা তুই জানিস না, কেউ তাদের কিছু করতে পারে না, ধরতেও পারে না, এমন কী কোম্পানির সাহেবরা অবধি নাকানি চোবানি খাচ্ছে! বিশেষ করে ওই গুপ্তিপাড়া, ডুমুরদহ, জিরাট, বলাগড় – ও অঞ্চল তো একেবারেই নিরাপদ নয়, লোকে দিনের বেলাতেও যেতে ভয় পায়, দল না বেঁধে পথ চলে না। তোরা যাবিও তো ওদিক দিয়েই। না না তুই শুধু তোর ওই পালোয়ানদুটোর অপর ভরসা করে থাকিস না, শেষে বিপদ হবে।"
এরপর দুর্গাচরণও আর কিছু বলতে পারলেন না, সত্যি কথা সঙ্গে স্ত্রী, ছেলেমেয়ে থাকবে, মূল্যবান জিনিসপত্র থাকবে – হঠকারিতা করা উচিত হবে না। তাই ভায়ের ব্যবস্থাই মেনে নিলেন। ভাই অতি বিচক্ষণ, ডুমুরদহে তাঁর পরিচিত এক ব্যক্তির বাড়িতে রাত্রিবাসের ব্যবস্থা করে দিলেন।
"তুমি ঘোষমশায়ের বাড়িতে রাতটা কাটিও, বৌঠান, ছেলেমেয়েদেরও কোনও অসুবিধে হবে না, ওঁর বাড়িতে থাকলে জানবে নিরাপদ। ঘোষমশাই লোক পাঠিয়ে তোমাদের নিয়ে যাবেন। ওঁরা ওখানকার বাসিন্দা, বর্ধিষ্ণু পরিবার, অতি সদাশয় মানুষ।"
তাই মাঝি যখন বলল, "বাবু, সাঁঝ লেগে গেল, এখন নৌকো কোথায় ভিড়াই? এ অঞ্চলটা তো ভালো নয়, ডাকাতের বড়ো উপদ্রব, ওই দেখেন কামারডাঙার খাল, ও খালেও ডাকাতি হয়" তখন দুর্গাচরণ বললেন, "তোরা অল্পেতেই বড়ো ভয় পাস, বলছি না আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে এই ডুমুরদহেই, মাধব ঘোষের বাড়িতে। তিনি নিজে এসে আমাদের নিয়ে যাবেন। আমার ভাই সব ব্যবস্থা করেছে।"
হনুমন্ত আর দেওকি এতক্ষণ অলসভাবে বসে বসে ভাগীরথীর শোভা দেখছিল, তারা উত্তর প্রদেশের লোক, এই প্রথম বাংলায় এসেছে, যা দেখে তাই তাদের চোখে অন্যরকম লাগে, এখন মাঝি মাল্লাদের চোখে মুখে ভয়ের চিহ্ন দেখে নিজেদের লাঠিগুলো হাতে তুলে নিল।
এমন সময় দেখা গেল খাল দিয়ে তীর বেগে একখানা ছিপ নৌকো আসছে, মাঝিমাল্লারা শঙ্কিত হয়ে উঠল।
দুর্গাচরণ ধমকে উঠলেন, "দেখছিস ছিপে মাত্র একজন লোক, ডাকাত হলে এরকম একজন আসত কখনও?"
সত্যি কথা। ডাকাত কি কখনও দলবল ছাড়া আসে? নিরস্ত্র হয়ে? তাছাড়া ছিপ নৌকোর মানুষটিকে দেখলে ভদ্র বলেই মনে হয়।
ছিপ নৌকোটা প্রথম নৌকোর কাছে এল, ভদ্রলোককে ভালো করে দেখা গেল, বয়স হয়েছে, পঞ্চান্ন ছাপ্পান্নর কম কিছুতেই নয়, পরণে ধোপ দুরস্ত জামাকাপড়, দু হাতের আঙুলে গোটা চারেক সোনার আংটি, বেশ অবস্থাপন্ন বোঝা যায়। ভদ্রলোক দুর্গাচরণকে জিজ্ঞেস করলেন, "আপনি কি বাগবাজারের দুর্গা হালদার মশাই?"
দুর্গাচরণ হ্যাঁ বললতেই তিনি জোড় হাতে বললেন, "অনুমান ঠিকই করছিলাম। অধমের নাম মাধব ঘোষ, আজ আমার কুটিরেই আপনাদের রাত্রিবাসের ব্যবস্থা হয়েছে, অনুগ্রহ করে আমার পেছন পেছন আসুন। চিন্তা করবেন না, মা লক্ষ্মী আর ছেলেমেয়েদের কোনও কষ্ট হবে না।"
মাধব ঘোষকে দেখে দুর্গাচরণ অত্যন্ত খুশী হলেন। মুখে যতই প্রকাশ না করুন, মাঝিমাল্লাদের কথা শুনে মনে মনে তাঁরও যে একটু একটু ভয় করছিল না তা নয়। আসতে আসতে কত যে রোমহর্ষক ডাকাতির বিবরণ শুনেছেন আর এ তল্লাটের নামেই যে লোকজনের মুখ শুকিয়ে যায় সেও নিজের চোখেই দেখেছেন। ভাইয়ের বিচক্ষণতার প্রশংসাও না করে পারলেন না, রাতটা নিরাপদে কাটানোর ব্যবস্থা তো সেই করে দিয়েছে।
ছিপ নৌকোর পেছন পেছন দুর্গাচরণদের নৌকোদুটোও খালে প্রবেশ করল। যথেষ্ট বড়ো এবং গভীর খাল, সাধারণ নৌকো ছেড়ে মহাজনী ভড়ও অনায়াসে যাতায়াত করতে পারে।
খালের ধারে এক ঘাটে নৌকোগুলো ভিড়ল, দুর্গাচরণরা নামলেন। এক রাতের ব্যপার, তেমন জিনিসপত্র সঙ্গে নেওয়ার তো দরকার নেই, রান্নাবান্নার জন্যে যেটুকু যা দরকার তা মাঝিমাল্লারাই বয়ে আনবে, তাছাড়া মূল্যবান জিনিসপত্র তো ওঁদের সঙ্গেই আছে। মাধব ঘোষ আগে আগে "আসুন আসুন, এদিক দিয়ে, সাবধানে" বলে বলে পথ দেখাতে লাগলেন। ঘাটের পর থেকেই বেশ ঝোপ জঙ্গলে ঘেরা পথ। মাধব ঘোষ এক জায়গায় থেমে গেলেন।
"কী হল?" দুর্গাচরণ জিজ্ঞেস করলেন, "আপনার ভদ্রাসন কোথায়? এ তো খালি বন বাদাড়ই দেখছি।"
"আস্তে আস্তে হালদারমশাই, আস্তে বলুন। এসব জায়গা একেবারে ভালো নয়, ডাকাতের বড়ো উপদ্রব, শোনেননি? আর এ হল পাড়া গাঁ, এ কী বড় শহর যে চওড়া চওড়া পথ ঘাট থাকবে? এ পথেই আমার ভিটেতে তাড়াতাড়ি যাওয়া যায়। কিন্তু সে নাহয় হল, আমি যে লেঠেলদের থাকতে বলেছিলাম এখানে, পালকিও থাকার কথা, ব্যাটারা সব গেল কোথায়?"
"লেঠেলদের থাকতে বলেছিলেন?"
"আপনারা অতিথি, অতিথি হলেন দেবতা, আপনাদের ওপর বিপদের এতটুকু আঁচও পড়ুক তা আমি চাই না," বললেন মাধব ঘোষ, "এক কাজ করুন, আপনি মা লক্ষ্মী আর ছেলেমেয়েদের নিয়ে এখানেই দাঁড়ান, আমি একটু ওদিকে গিয়ে দেখি তারা গেল কোথায়। চিন্তা করবেন না, আমি এই গেলাম আর এলাম।"
"না না চিন্তা কীসের?" দুর্গাচরণ বললেন, তিনি একটুতেই ভয় পাওয়ার মানুষ নন, তাছাড়া হনুমন্ত আর দেওকি রয়েছে তাঁদের সঙ্গে। বাকী দুজন লাঠিয়াল নৌকোতে মাঝিদের কাছে আছে, দুর্গাচরণই থাকতে বলেছেন।
অন্ধকার ক্রমশ গাঢ় হয়ে আসছে, সুলোচনা উশখুশ করতে লাগলেন, বললেন, "কোথায় দাঁড় করিয়ে চলে গেলেন উনি? ডাকাত না হোক এই বন বাদাড়ে ভয় তো আরও আছে নাকি! ছেলেপুলে নিয়ে এ কোথায় এসে পড়লাম!"
সেই সময় দূরে অল্প আলোর আভাস দেখা গেল, দুর্গাচরণ বললেন, "ওই তো আলো দেখা যাচ্ছে, নিশ্চয়ই ঘোষমশাই আসছেন লোকজন নিয়ে।"
তাঁর কথা শেষ হতে না হতে কোথা থেকে বিকট আওয়াজ করে কয়েকজন লোক ঘিরে ফেলল তাঁদের। হনুমন্ত আর দেওকি কিছু করারই কোনও সময় পেল না, মাথায় লাঠির মোক্ষম বাড়ি খেয়ে মূর্চ্ছিত হয়ে পড়ে গেল। দুর্গাচরণ বুঝলেন ডাকাতের পাল্লায় পড়েছেন তাঁরা। আশপাশে ঝোপঝাড়ের আড়ালে এতক্ষণ যেন তারা মিশিয়ে ছিল, এখন একেবারে রে রে করে ঘিরে ফেলেছে। ভীষণ তাদের চেহারা। সবাই যেন একেবারে দৈত্যাকৃতি, গায়ে যে অসুরের বল তা দেখলেই বোঝা যায়, মাথায় ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া বাবরি চুল, কপালে লাল তিলক, তাদের কারুর হাতে মোটা লাঠি, কারুর হাতে বা টাঙ্গি, দা, বল্লম, তাদের একবার দেখলেই হৃদকম্প হয় মানুষের। ঘাটের দিক থেকেও মাঝিদের করুণ আর্তনাদ ভেসে এল, ডাকাতদের দল কাউকেই ছাড়েনি, মাঝি মাল্লাদেরও আক্রমণ করেছে।
দুর্গাচরণ বুঝলেন আজ আর রেহাই নেই, সুলোচনা বাচ্ছা মেয়েকে বুকে জড়িয়ে তাঁর পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন, ছেলেরা তাঁর ওপাশে, দুর্গাচরণ ছেলেদুটোকে কাছে টেনে নিয়ে বললেন, "যা আছে সব নিয়ে যাও, প্রাণে মেরো না শুধু।"
দুর্গাচরণের সামনে যে তাগড়াই লোকটা ছিল সে অট্টহাসি হেসে উঠল, তার চোখের ইশায়ার পেছন থেকে একজন লাঠির ঘা দিল দুর্গাচরণের মাথায়। তিনি মাথা চেপে ধরে পড়ে গেলেন। ছেলেদুটো আতঙ্কে থরথর করে কাঁপছিল, গলা দিয়ে আওয়াজ বার করার শক্তিও যেন তাদের আর অবশিষ্ট ছিল না। একজন এসে তাদের টানতে টানতে নিয়ে বনের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। সুলোচনা অস্ফূট আর্তনাদ করে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়লেন।
মাধব ঘোষ যখন পালকি আর তাঁর লোকজনদের নিয়ে ফিরলেন তখন যা হওয়ার হয়ে গেছে। কাজ শেষ করে দস্যুদল অদৃশ্য। যেমন ভোজবাজির মতো একেবারে হঠাৎ করে উদয় হয়েছিল তেমন আবার মিলিয়েও গেছে। মাধব ঘোষ দেখলেন সুলোচনা চৈতন্যহীন অবস্থায় মাটিতে পড়ে, পাশে মেয়েটা, কিন্তু দুর্গাচরণ, তাঁর ছেলেদের বা পালোয়ানদুটোর কোনও নামগন্ধ নেই।
মাধব ঘোষ কপালে করাঘাত করে হাহাকার করে উঠলেন, "ওরে এ কী হল রে! আমি এত ব্যবস্থা করা সত্ত্বেও এ অনর্থ হয়ে গেল, আমি কিছুই করতে পারলাম না! এখন আমি কী মুখ দেখাব রে, কী বলব!"
তারপর আকাশের অবস্থা দেখে বললেন, "ওরে হাঁ করে দাঁড়িয়ে কী দেখছিস? তোল তোল, মা লক্ষ্মী আর বাচ্ছাটাকে তোল যত্ন করে। আর তো কাউকে দেখছি না, এঁদেরই নিয়ে যাই। তাড়াতাড়ি কর, এক্ষুণি জল শুরু হল বলে!"
বাস্তবিক আকাশের অবস্থা খারাপ। ঘন কালো মেঘ গোটা আকাশকে যেন গ্রাস করে ফেলেছে।
অচেতন দুর্গাচরণ, হনুমন্ত আর দেওকি পড়ে রইলেন কিছুটা দূরে ঘন বনের মধ্যে, ডাকাতরাই তাঁদের সেখানে ফেলে চলে গেছে।
ডুমুরদহে ভাগীরথীর পাড়ের ওপর এক বড়ো দোতলা কোঠা বাড়ি। তার ছাদ থেকে ভাগীরথীর বহু দূর অবধি দেখা যায়। বাড়ির একতলার এক ঘরে বসে বাড়ির মালিক বিশ্বনাথ রায় তামাক খাচ্ছেন আর কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলছেন। বিশ্বনাথের চেহারা যেমন অতি বলিষ্ঠ তেমন তাঁর সঙ্গীরাও সব তাগড়াই জোয়ান। এমন সময় একজন মিশমিশে কালো ভয়ঙ্কর চেহারার লোক এসে দরজার গোড়ায় দাঁড়াল। বিশ্বনাথ তার দিকে ফিরে বললেন, "কী রে পেল্লাদ?"
প্রহ্লাদ ঘরে ঢুকে বিশ্বনাথের কানের কাছে মুখ নিয়ে অতি নিম্ন স্বরে কী যেন বলতে লাগল। সেসব শুনতে শুনতে কখনও বিশ্বনাথের মুখে বিস্ময়ের ছাপ পড়ল, কখনও রোষের, কখনও বা ঠোঁটের আগায় মৃদু হাসি ফুটে উঠল, কখনও বললেন, "বটে?" কখনও যেন কৌতুক অনুভব করে বললেন, "তবে তো দেখতে হচ্ছে রে!"
কথা শেষ করে প্রহ্লাদ বলল, "তাহলে হুকুম দিন সর্দার, নিয়ে আসি?"
বিশ্বনাথ বললেন, "সে আর বলতে, তবে সাবধানে নিয়ে আসিস, কেউ যেন দেখতে না পায়।"
"কাক পক্ষীতেও টের পাবে না আজ্ঞে!" আকর্ণ দন্ত বিকশিত করে প্রহ্লাদ বলল, তার ধবধবে সাদা দাঁতগুলো লন্ঠনের আলোতেও ঝকঝক করে উঠল।
প্রহ্লাদ বিশ্বনাথ রায়ের এক অতি বিশ্বস্ত অনুচর। তাঁর নির্দেশ পেলে করতে পারে না হেন কাজ নেই!
একতলায় অতিথিশালার একটা ঘর প্রস্তুতই ছিল, প্রহ্লাদ এক অচেতন ব্যক্তিকে কাঁধে করে নিয়ে এসে সে ঘরের বিছানায় শুইয়ে দিল।
"লাঠির ঘা পড়েছে সর্দার, অনেক রক্ত বেরিয়েছে, জ্ঞান ফিরতে সময় লাগবে," প্রহ্লাদ বলল।
"তাই দেখছি, আর দুটোর কী অবস্থা?" গম্ভীর মুখে বিশ্বনাথ বললেন।
"আরও খারাপ সর্দার, পাশে ঘরে রেখেছি।"
"যা করবার কর, দেখ যেন বেঁচে যায়।"
"আজ্ঞে" বলে প্রহ্লাদ তার সঙ্গী সাথীদের নিয়ে কাজে লেগে গেল। তারা গ্রামের মানুষ, কোন পাতার রসে রক্তপড়া বন্ধ হয়, কোন গাছগাছড়ার ব্যথা কমানোর গুণ আছে এসব তাদের নখদর্পণে। না জানলে চলে না, সব গ্রামে কি বদ্যি পাওয়া যায় না সবাই তাদের ডাকতে পারে?
বিশ্বনাথ সে রাতে নিজের ঘরে গেলেন না, অতিথিশালাতেই থেকে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে প্রহ্লাদকে ডেকে বললেন, "আমি ভালো বুঝছি না, মনে হয় কবরেজ ডাকতে হবে। তুই যা, ডেকে নিয়ে আয় আর কী করে নিয়ে আসবি সে কী আর বলতে হবে?"
প্রহ্লাদ এক গাল হেসে বলল, "কী যে বলেন সর্দার, এত কাল কাজ করে এইটুকুও জানব না!"
মুহূর্তের মধ্যে সে তার কয়েকজন সঙ্গীকে নিয়ে বেরিয়ে গেল।
তারক কবিরাজের বাড়ি বিশ্বনাথের বাড়ি থেকে খুব দূরে নয়। মাঝ রাতে যখন তাঁর দুয়োরে ঘা পড়ল, তিনি কাঁপতে কাঁপতে উঠে বসলেন। না ডাকাতের ভয়ে নয়, তাঁর এমন কিছু সম্পত্তি, জমিজমা নেই যে ডাকাত পড়বে তাঁর বাড়িতে, গরীব মানুষের চিকিৎসা করেন তিনি, যা পান তা সামান্যই, সব সময় যে তারা কিছু দিতে পারে তাও নয়। তাও মাঝরাতে এরকম ডাকাডাকি হলে আজকাল ভয় করে, চারদিকে যা সব কাণ্ডকারখানা চলছে!
দরজার কাছে এসে কোনওরকমে তারক কবিরাজ জিজ্ঞেস করলেন, "কে বাবা? কোথা থেকে আসা হচ্ছে? এত রাতে কী দরকার?"
"আজ্ঞে আমি পেল্লাদ কবরেজমশাই, এক্ষুণি একবার যেতে হচ্ছে, সর্দারের হুকুম।"
প্রহ্লাদ কে, কোন সর্দারের সে অনুচর – এসব কথা শুধু ডুমুরদহ নয়, আশেপাশের পাঁচটা গ্রামেও কারুর অজানা নয়। আর কার ঘাড়ে ক’টা মাথা আছে যে প্রহ্লাদের সর্দারের হুকুম এক কথায় মান্য করবে না? তবে শুধু ভয়ে নয়, কৃতজ্ঞতা বোধেও তারক কবিরাজ বিশ্বনাথের কথা অমান্য করতে পারেন না। অমন ভালো বাড়িতে নিজের মেয়ের বিয়ে কী দিতে পারতেন যদি বিশ্বনাথ না থাকতেন? অযাচিতভাবে সাহায্য করেছিলেন বিশ্বনাথ তখন, বলেছিলেন, "পয়সাকড়ির জন্যে আপনি চিন্তা করবেন না, আপনি নিশ্চিন্ত মনে সব জোগাড়যন্তর করুন।" সে উপকার তারক ইহজীবনে ভুলতে পারবেন না।
প্রহ্লাদ পালকি নিয়ে এসেছিল, তারক কবিরাজের বয়স হয়েছে, যদি হাঁটাহাঁটি করতে না পারেন? তার ওপর বৃষ্টিরও যেন বিরাম নেই, ঝরেই যাচ্ছে। তারকের পালকিতে ওঠার অপেক্ষা শুধু, বেহারারা মুহূর্তের মধ্যে পালকি কাঁধে তুলে চলতে শুরু করল।
বিশ্বনাথ অতিথিশালাতেই অপেক্ষা করছিলেন তারক কবিরাজের জন্যে, তিনি আসতেই, "আসুন কবরেজমশাই, আসুন আসুন’ বলে ভেতরের ঘরে নিয়ে গেলেন। বিছানায় শায়িত ব্যক্তিকে দেখিয়ে বললেন, "এর জন্যেই আপনাকে এই মাঝ রাতে দুর্যোগের মধ্যেও ঘুম থেকে তুলে দেকে আনা। একে সুস্থ করে দিতে হবে। অবশ্য শুধু এ নয়, আরও দুজন আছে।"
তারক কবিরাজ বললেন, "এ তো ভালো ঘরের সন্তান বলে মনে হচ্ছে, অবস্থাপন্নও। অথচ কী দুর্দশা দেখো! নারায়ণ নারায়ণ!"
তারক কবিরাজ অসুস্থ মানুষটিকে দেখে ওষুধ বিষুধ যা দেওয়ার দিলেন, বললেন, "চিন্তা নেই, জ্ঞান ফিরে আসবে, সুস্থও হয়ে যাবে, তবে সময় লাগবে।"
অন্য দুজনেরও চিকিৎসা করলেন, বললেন, "ঠিক সময়ে ওষুধ পড়েছে, দেখাশোনা হয়েছে তাই এ যাত্রা সংকট কেটে গেল। আচ্ছা বাবা, এবার আমি আসি, আজ্ঞা দাও।"
বিশ্বনাথ বেশ কিছু টাকা তারকের হাতে গুঁজে দিয়ে বললেন, "আপনি এখানে যা দেখলেন শুনলেন তা কি......"
"কিছুই দেখিনি, কিছুই শুনিনি বাবা, তাহলে কীই বা মনে রাখব আর কাকেই বা কী বলব?" বিশ্বনাথের কথার মাঝেই বলে উঠলেন তারক।
"তাহলে এই মাঝ রাতে আমার বাড়িতে এসেছিলেন কেন? কার জন্যে?" মৃদু হেসে বিশ্বনাথ জিজ্ঞেস করলেন।
"তোমার ওই বুড়ো চাকরটা, কী যেন বেশ নাম, তিন কুলে কেউ নেই, তার হাঁপের টানটা বড়ো বেড়েছে। অমাবস্যা আসছে, তার ওপর বয়সও কম নয়, হাঁপের টান চাগিয়ে উঠবে এ আর বেশী কথা কী? তাকে দেখতেই এসেছিলাম। ক’দিন আগেও তো এলাম বাবা। ছোটোবেলায় তোমাকে কোলে পিঠে করে বড়ো করেছে, তুমি যে তাকে এখনও ফেলতে পারোনি সে কথা কে না জানে বাবা!"
তারক কবিরাজের উত্তর শুনে বিশ্বনাথ অট্টহাস্য করে উঠলেন, কবরেজের বুদ্ধি আছে!
"ওরে পেল্লাদ যা কবরেজমশাইকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আয়।"
"যে আজ্ঞে" বলে প্রহ্লাদও তারক কবিরাজকে নিয়ে চলে গেল।
ডাকাতরা দুর্গাচরণের দুই ছেলে দুলাল আর গোপালকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চলল। এতক্ষণ দু ভাই চুপ করে ছিল, শুধু থেকে থেকে ফুঁপিয়ে উঠছিল, এবার দুলাল "বাবা, ও বাবা, মা, মা" করে জোরে কেঁদে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে এক ডাকাত রুক্ষ স্বরে বলল, "চুপ, একদম চুপ, মুখ দিয়ে একটা আওয়াজ বের করবি তো কেটে এইখানেই পুঁতে রেখে যাব!"
দুলাল শিউরে উঠে চুপ করে গেল, গোপাল দাদার জামাটা খামচে ধরল, আরেক ডাকাত সবলে তার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে তাকে কোলে তুলে নিল। বেচারা দুলাল আর গোপাল! কত আর বড়ো তারা? দুলাল এই সবে দশ বছরে পরেছে আর গোপাল বছর সাতেকের।
বনের মধ্যে একখানা পোড়ো বাড়ি। তবে বাইরে থেকে দেখে তার অবস্থা যত খারাপ বলে মনে হয় ভেতরে ঢুকলে বোঝা যায় তা নয়। দু একখানা ঘর বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, মেঝেতে মলিন বিছানা পাতা, এখানে যে মানুষের নিয়মিত যাতায়াত আছে তা স্পষ্ট। দুলাল আর গোপালকে সেখানেই নিয়ে এল ডাকাতরা। ঘরে একটা লন্ঠন রাখা, তার টিমটিমে আলোয় ঘরখানাকে ভূতুড়ে লাগছে, ঘরের এক কোণে একটা জলের কুঁজো।
দুটো চটা ওঠা কাঁসিতে খানিকটা মুড়ি নিয়ে এসে একজন ডাকাত বলল, "নে মুড়িক’টা খেয়ে শুয়ে পড়। ওইখানে কুঁজোয় জল আছে, তেষ্টা পেলে খাস। আমি বাইরেই আছি, দরকার হলে দরজার কাছে এসে আস্তে আস্তে করে ডাকবি। চেঁচামিচি করলে একেবারে মেরে ফেলব!"
দু ভাই জড়াজড়ি করে বসে কোনওরকমে মুড়ি খেল, তারপর জল খেয়ে শুয়ে পড়ল। গোপাল ফোঁপাতে ফোঁপাতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল। দুলালের আর ঘুম আসে না। মা, বোন কোথায়? ওখানেই ওরকম ভাবে পড়ে আছেন? বাবাকে......... মনে পড়তেই শিউরে উঠল দুলাল। বেশ যাচ্ছিল বিয়ে বাড়ি আর শেষে পড়ল এইরকম নৃশংস ডাকাতদের কবলে! গোপাল অঘোরে ঘুমোচ্ছে, ঘুমের ঘোরেই মাঝে মাঝে "মা মা" বলে ডেকে উঠছে। দুলালও আর পারল না, রাজ্যের ঘুম তার দু চোখের পাতায় নেমে এল।
ভোরবেলা এসে একটা লোক খাবার দিয়ে গেল। ওদের ঘরে কেউ না থাকলেও আশেপাশে পাহারা আছে, পালাবার কোনও উপায় নেই, ধরা পড়ে যাবে।
দুপুরবেলা দুলালের মনে হল ঘরে কাছেই কারা যেন কথা বলছে। ও আস্তে আস্তে দরজার কাছে এল। দরজাটা খুব যে শক্তপোক্ত তা নয়। পাল্লায় ফুটোফাটাও আছে। দুলাল এরকমই একটা ফুটোতে চোখ রাখল। ওপাশে তিনজন বসে, বসে বসে ভাত খাচ্ছে আর গল্প করছে। দিনের বেলাতেও লোকগুলোকে দেখে ভয় করে।
"আর মোটে দুটো দিন। আজ আর কাল, পরশু দিনই অমাবস্যা। এই দুটো দিন ছেলেদুটোকে সামলেসুমলে রাখতে পারলেই হল। অমাবস্যাতেই তো মায়ের কাছে বলি চড়ানো হবে। তার পর আমরা বেরোব ছিপ নিয়ে, সর্দারের তেমনই হুকুম," একজন বলল।
"সামলেসুমলে রাখার আর কী আছে? দেখছিস না কীরকম যেন হয়ে গেছে? চোখের সামনে বাপকে এক ঘায়ে পড়ে যেতে দেখেছে!" দ্বিতীয়জন বিকট স্বরে হেসে উঠল।
দুলাল সরে এল, তার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। এরা বলি দেবে ওদের! সেই জন্যেই ধরে এনে এখানে রেখেছে! কী করবে ও? এই দুদিনের মধ্যে ভাইকে নিয়ে পালাতে না পারলে বেঁচে থাকার আর কোনও আশা নেই। গোপালকে সব বলাও যাবে না, বললে ভয় পেয়ে যাবে। মা, বাবা, ছোট্ট বোনটার মুখ ওর মনে পড়ল, আর কি কোনওদিন সবার সঙ্গে দেখা হবে? বাবার কী অবস্থা? হনুমন্তভাইয়া আর দেওকিভাইয়া কি বেঁচে আছে? বুক ঠেলে কান্না এল দুলালের। অতি কষ্টে নিজেকে সামলাল ও। বিপদের সময় ভেঙে পড়লে চলবে না, মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। ভাবতে হবে কী করে এখান থেকে পালানো যায়। এই বন থেকে বেরিয়ে ডুমুরদহে যেতে হবে, সেখানে মাধব রায়ের খোঁজ করতে হবে, তাঁর বাড়িতে পৌঁছতে পারলেই নিরাপদ। তারপর তিনি নিশ্চয়ই কিছু ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু এখান থেকে বেরোবে কী করে? সব সময় যে কেউ না কেউ পাহারা দিচ্ছে, এক মুহূর্তও চোখের আড়াল হচ্ছে না। দেখতে দেখতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হল, এক সময় রাতও হল। দুলাল পালাবার কোনও সুযোগই পেল না। যা করার কাল করতেই হবে, নাহলে... দুলাল ভয়ে চোখ বুঝে ফেলল।
ভোরে একটা লোক এসে দুটো পাত্রে খানিকটা পান্তাভাত দিয়ে গেল। দুলাল আর গোপালকে জড়োসড়ো হয়ে এক কোণে বসে থাকতে দেখে কিছু বলল না, তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে চলে গেল। দুলালের মনে হল দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ করেনি লোকটা। ও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল, তারপর দরজার ফুটোয় চোখ লাগাল। না বাইরে তো কেউ আছে বলে মনে হচ্ছে না। আস্তে করে দরজার একটা পাল্লা ঠেলল, পাল্লাটা অল্প ফাঁক হল। ঠিকই বুঝেছিল দরজা খোলা! এই সুযোগ। ও তাড়াতাড়ি গোপালের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলল, "ওঠ ভাই, আমাদের এখান থেকে পালাতে হবে, যত তাড়াতাড়ি পারি, ওঠ, তারপর বাবা, মাকে খুঁজতে হবে।"
গোপালও বিনা বাক্য ব্যয়ে উঠে পড়ল। দু ভাই আস্তে আস্তে বাড়ির বাইরে এল। দুলাল সন্তর্পনে এদিক ওদিক দেখল, না কেউ নেই। আর এক মুহূর্তও দেরি করল না, ভায়ের হাত ধরে দৌড় লাগাল। যত তাড়াতাড়ি পারে এই বনের বাইরে বেরোতে হবে, লোকালয়ে যেতে হবে। বেশ খানিকটা দৌড়নোর পর দু ভাই হাঁফিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। এদিকটা বন বেশ পাতলা, মনে হয় যেন আর কিছুটা গেলেই শেষ হয়ে যাবে। ওরা দাঁড়িয়েই ছিল, এমন সময় একজনকে আসতে দেখল। তাকে ওই ডাকাতগুলোর মতো দেখতে নয়, অল্প বয়স্ক, বেশ ভালো জামা কাপড় পরা, দেখে ভদ্র ঘরের ছেলে বলেই মনে হয়।
দুলাল ভাইকে নিয়ে আবার দৌড়ল, যুবকটির কাছে গিয়ে বলল, "শুনুন আমাদের খুব বিপদ!"
যুবক আশপাশ দেখে সন্দিগ্ধ স্বরে বলল, "কী হয়েছে? কী বিপদ?"
দুলাল হাঁফাতে হাঁফাতে সবে বলতে শুরু করেছে কী করেনি, কতগুলো লোক হইহই করে একেবারে দৌড়ে এল, এরা সেই ডাকাতগুলো।
যুবক তাদের দিকে ফিরে বলল, "দুটো বাচ্ছা ছেলেকে আটকে রাখতে পারিস না আর তোরা যাবি ডাকাতি করতে! তোদের ওপর ভরসা করে না আমিই ডুবি!"
"খুব ভুল হয়ে গেছে সর্দার, আর হবে না, এবারের মতো মাপ করে দেন," একজন ডাকাত বলল আর বলেই দুলালের হাত ধরে এক হ্যাঁচকা টান মারল, "চল ব্যাটা, খুব সাহস বেড়েছে না? আমাদের চোখে ধুলো দিয়ে পালাবি? কোথায় পালাবি? এই গেরামে কে তোদের রক্ষে করবে?"
দুলাল দু চোখ ফেটে জল এল, বুঝল কী ভুল করেছে ও। যাকে ভালো মনে করে সাহায্য চেয়েছিল সেই আসলে ডাকাতের সর্দার! আর কোনও আশা নেই, আর কোনওদিন বাবা, মা, বোনের সঙ্গে দেখা হবে না!
এবার আর ডাকাতরা কোনওরকম ঝুঁকি নিল না। ওই পোড়োবাড়িতে নিয়ে এসে দুলাল আর গোপালের হাত পা ভালো করে বাঁধল, কাপড় দিয়ে মুখও বেঁধে দিল, যাতে কোনও আওয়াজ না করতে পারে। সর্দার নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সব দেখাশোনা করল। তারপর দুলালের দিকে তাকিয়ে বলল, "ভয় পাস না, ভয় পাস না, ভয়ের কিচ্ছু নেই। কাল খাঁড়ার এক কোপে দেখবি সব ভয় ডর উধাও হয়ে গেছে!" বলে হা হা করে হেসে উঠল।
সে হাসিতে ওরা কেঁপে উঠল। কী নিষ্ঠুর এরা! পারে না হেন কাজ নেই।
সূর্য মাঝ আকাশে, পোড়া বাড়ির সামনে দুজন ডাকাত মোটা মোটা লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে, সর্দার আবার এসেছে খবর নিতে। কাল বলি হয়ে গেলেই নিশ্চিন্ত হওয়া যায়। তার আগে যেন আর কোনও গোলমাল না হয়। মন্দির তো এই বাড়িরই এক অংশে, কাল কোনওরকম ছেলেদুটোকে নিয়ে গিয়ে পুজোর জায়গায় ফেলতে পারলেই হল। খাঁড়ার এক এক কোপে সব সাবাড়। জোড়া বলি পেয়ে মা খুব খুশী হবেন।
সর্দার সব খবর নিয়ে চলেই আসছিল এমন সময় দুজনকে দেখতে পেয়ে দাঁড়িয়ে গেল। দুজন বেদে, বেতের ঝাঁপি নিয়ে সাপ খুঁজে বেড়াচ্ছে।
"সর্দার তেনাদের বাস তো এ বাড়িতেও আছে। গেল বচ্ছর এমন ছোবল মারল লখনাকে, অত বড়ো তাগড়াই লোকটা ছটফট করতে করতে মরে গেল! ওঝা অবধি কিচ্ছু করতে পারল না। এদের একবার দেখালে হত না, কেউ থাকলে ধরে নিয়ে যেত?" এক ডাকাত বলল।
"মন্দ বলিসনি, বেশ ডাক দেখি," সর্দার বলল।
বেদেরা এল, "পেন্নাম হই কত্তা" বলে তাদের কাজে লাগল, একজন গিয়ে ঢুকল ঘরে। হঠাৎ "ও কী ও কী" বলে একটা ডাকাত চেঁচিয়ে উঠল। তার পায়ের কাছে ফণা তুলে এক কাল কেউটে তাকে ছোবল মারতে উদ্যত হয়েছে, ডাকাতটা আর দাঁড়াল না, বাপ রে মা রে করে দৌড় দিল। ক্রমে দেখা গেল, একটা নয়, আরও তিন চার খানা গোখরো ঘুরে বেড়াচ্ছে, তার একটা দ্বিতীয় ডাকাতকে ছোবল মারল, সে আর্তনাদ করে দেখানেই পড়ে গেল।
"আপনি কত্তা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকুন এখানেই, একদম নড়বেন না, তাহলেই কিচ্ছু হবে না," এক গাল হেসে একজন বেদে বলল, "এনারা হলেন গিয়ে মা বিষহরির সন্তান, সাক্ষাৎ যম, এনাদের একটু মান্যি গণ্যি করতে হয় বৈকি কত্তা!"
সর্দারের অবস্থা অবর্ণনীয়, এদিকে রাগ যে একেবারে হচ্ছে না তা নয়, কিন্তু ভয় করছে তার থেকে কয়েক গুণ বেশী।
ওদিকে দ্বিতীয় বেদে ততক্ষণে ঘরে ঢুকে দুলাল, গোপালদের হাত পায়ের বাঁধন খুলে ফেলেছে।
"ভয় নেই গো খোকাবাবুরা, চলো এখান থেকে।"
"কোথায়?" ক্ষীণ স্বরে দুলাল জিজ্ঞেস করল।
"বাবার কাছে। যাবে না বাবার কাছে?"
বাবার নামেই দুলাল, গোপালের মনে আবার সাহস ফিরে এল, ওরা বেদের সঙ্গে ঘরের বাইরে এল।
কী অদ্ভুত কায়দায় আরেকটি বেদে সব সাপকে আবার ঝাঁপিতে ভরে ফেলেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সর্দার কিছুই করতে পারছে না। কারণ? কারণ কোত্থেকে কে জানে প্রহ্লাদ এসে হাজির হয়েছে ওখানে, সঙ্গে দুজন লেঠেল।
"একবার তো সর্দারের সঙ্গে দেখা করতে হয়। সর্দার তেমনই হুকুম দিয়েছেন যে," হাতের টাঙ্গিখানাকে নাড়াচাড়া করতে করতে প্রহ্লাদ বলল, চোখের দৃষ্টি সর্দারের মুখের ওপর স্থির, "সর্দার বললেন, ‘দেখিস পেল্লাদ, যদি ভালো কথায় চলে আসে তাহলে কোনও জোরজার খবরদার করবি না আর না এলে কী করতে সে তো তুই জানিসই।’ তা আমি বলি কী, জোরজারে কী দরকার? এই তো পথ, আমিও চিনি, তুমিও চেনো, সুখ দুঃখের কথা বলতে বলতে চলে যাই।"
উপায় নেই, কোনও লোকজন নেই, সঙ্গে একখানা লাঠি অবধি নেই, থাকলেও অবশ্য তেমন কিছু সুবিধে হত না, কারণ প্রহ্লাদের সঙ্গের দুজন লেঠেলকে বাগে আনতে অনেক লোক লাগে, তারা এমন লাঠি খেলায় যে সামনে কেউ টিঁকতে পারে না, তাছাড়া প্রহ্লাদ নিজে তো আছেই। রাগে দাঁত কিড়মিড় করতে করতে সর্দার রামের সঙ্গে চলল।
ওদিকে মাধব ঘোষেরর বাড়ির সামনে একটি পালকি দাঁড়িয়ে। সুলোচনা মেয়েকে কোলে করে নিয়ে এসে পালকির সামনে দাঁড়ালেন।
মাধব ঘোষ চোখ মুছে বললেন, "কী ভেবেছিলাম আর কী হল! সবই কপালের লিখন মা লক্ষ্মী। এখন আপনাকে নিরাপদে আপনার শ্বশুরবাড়িতে পৌঁছে দিতে পারলেই আমি নিশ্চিন্ত হই।"
সুলোচনা কিছু বললেন না, দীর্ঘশ্বাস ফেলে পালকিতে উঠে বসলেন। বেহারারা পালকি কাঁধে তুলে নিল। মাধব ঘোষও সঙ্গে সঙ্গে চলেছেন। পালকি ঘাটের কাছে আসার আগেই কয়েকজন লেঠেল সামনে এসে হেঁকে বলল, "পালকি ঘোরাও, সর্দারের বাড়ি যাবে এ পালকি।"
"কোথাকার সর্দার এসেছে রে যে তার হুকুম মানতে হবে?" মাধব ঘোষ খিঁচিয়ে উঠলেন।
এক লেঠেল লাঠি ঠুকে বলল, "ওরকম করে বোলো না, বিপদ হবে। তোমার ছেলেও তো এখন সেখানেই রয়েছে, আমাদের সর্দারের বাড়িতে, দেখা করবে না ছেলের সঙ্গে?"
মাধব রায়ের মুখ শুকোল, কোনওরকমে বললেন, "যা যা নিয়ে যা..."
বেহারারা তো ভয়ে কাঁপছিল, মাধব রায়ের কথা শোনা মাত্র তারা লেঠেলদের পেছন পেছন চলতে শুরু করে দিল।
সুলোচনা পালকির ভেতর থেকে চেঁচিয়ে উঠলেন, "কারা তোমরা? কোথায় নিয়ে যাচ্ছ আমাকে?"
লেঠেল একজন নরম গলায় বললেন, "ভয় পাবেন না মা ঠাকরুণ, কোনও বিপদ হবে না আপনার। মনে করুন বিপদ থেকে মুক্ত হলেন এইবারে!"
বিশ্বনাথ রায়ের বাড়ি।
অতিথিশালায় প্রবেশ করে দুলাল আর গোপাল কয়েক মুহূর্ত হাঁ করে দুর্গাচরণের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল ওঁকে। আবার যে বাবার সঙ্গে দেখা হবে সে আশাই ছাড়তে বসেছিল তারা, দুর্গাচরণও ভাবেননি যে আবার ছেলেদের দেখতে পাবেন। অনতিবিলম্বে সুলোচনার পালকিও এসে পৌঁছল। পুরো পরিবার আবার একত্রিত হল। সকলের চোখে আনন্দাশ্রু।
অদূরে দাঁড়িয়ে বিশ্বনাথ এই দৃশ্য দেখছেন আর মৃদু মৃদু হাসছেন।
"আপনি আমাদের সকলের প্রাণ রক্ষা করেছে, কোথা থেকে জানি না কিন্তু আমাদের স্ত্রী এবং আমার পুত্র, কন্যাদেরও উদ্ধার করে এনে দিয়েছেন। আপনার ঋণ আমরা কোনও দিনই পরিশোধ করতে পারব না," করজোড়ে বললেন দুর্গাচরণ।
বিশ্বনাথ কোনও উত্তর দেওয়ার আগেই দুলাল বলে উঠল, "বাবা, কাল অমাবস্যায় ডাকাতরা আমাদের বলি দিত!"
শুনে দুর্গাচরণ, সুলোচনার মুখ শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেল, শুধু বিশ্বনাথ কৌতুক তরল কন্ঠে বললেন, "তাই তো আজই তোমাদের ছাড়িয়ে আনলাম।"
"কী ভয়ঙ্কর ডাকাত! ঘোষমশায়ের আসতে একটু দেরি হল আর তাতেই ওরা এত কাণ্ড করে ফেলল!" দুর্গাচরণ বললেন।
আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে হেসে উঠলেন বিশ্বনাথ, বললেন, "ডাকাত তো ঘোষমশাইই, এখন ওঁর বড়ো ছেলে ডাকাতি করতে শুরু করেছে। কাল আপনার ছেলেদের বলি দিয়ে ছিপ নৌকো করে ডাকাতি করতে বেরোত ঘোষমশায়ের ছেলে!"
দুর্গাচরণ বাকশক্তি রহিত। কিছুক্ষণ পরে সুলোচনা বললেন, "কিন্ত আমাকে তো তিনি তাঁর বাড়িতে নিয়ে গেছিলেন, যত্ন করে রেখেছিলেন, আজ নৌকো করে বাগবাজারে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন......"
"বাগবাজারে না, মাঝ নদীতে ডুবিয়ে মারার ব্যবস্থা করেছিলেন। তবে এর পেছনে আপনার ভাইয়ের হাত আছে, তিনিই তো মাধব ঘোষের বাড়িতে আপনার থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন না?" বিশ্বনাথ দুর্গাচরণকে জিজ্ঞেস করলেন।
দুর্গাচরণ কোনওরকমে ঘাড় হেলালেন, কথা বলার শক্তি মনে হয় এখনও ফিরে পাননি।
"আপনার ওই বৈমাত্রেয় ভাই সম্পত্তির জন্যে এসব করেছেন। তিনি একবার তাঁর এক বন্ধুর সঙ্গে এ পথে এসেছিলেন। তাঁর বন্ধুটি মাধব ঘোষের গুরু বংশের ছেলে, তাই মাধব ঘোষ তাঁদের খাতির করে নিজের বাড়িতে নিয়ে গেছিল, সেবা যত্ন করেছিল। আপনার ভাই তাকে বলেছিলেন যে আপনার এ পথ দিয়ে যাওয়ার কথা আছে, ঠিক সময়ে তিনি জানাবেন। মাধব ঘোষ নিজের কাজ করুন, তাহলে ওঁরও লাভ হয়।"
"এত কথা আপনি জানলেন কী করে?" এতক্ষণে দুর্গাচরণ অতি কষ্টে কথা বলতে পারলেন।
"আমার গুপ্তচর আছে, নাহলে আপনার ছেলেদের কোথায় রেখেছে, আপনার স্ত্রী, মেয়েকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছে এসবও কি জানতে পারতাম?"
"আর ওই বেদেদুজন?" দুলাল জিজ্ঞেস করল।
"তারাও আমার দলের লোক," বিশ্বনাথ বললেন।
"পালকি যারা নিয়ে এল তারা সর্দার সর্দার বলছিল, ঘোষমশাই মনে হল ভয় পেয়েই......" সুলোচনার কথার মাঝেই বিশ্বনাথ হেসে উঠলেন, "আমাকে ভয় পায় না রকম মানুষ আছে নাকি এ তল্লাটে?" তারপর এক মুহূর্ত থেমে বললেন, "আমিও ডাকাত, বিশ্বনাথ ডাকাতের নামে কলকাতা থেকে যশোর অবধি লোকজন কাঁপে!"
দুর্গাচরণরা অবাক হয়ে বিশ্বনাথকে দেখছিলেন! কীরকম মানুষ এ? নিজের মুখেই বলে যে সে ডাকাত, তার ভয়ে লোকে কাঁপে! আবার লোকের উপকারও করে! তাঁদের তো কারুরই বাঁচার কোনও আশা ছিল না! এই বিশ্বনাথই তাঁদের উদ্ধার করলেন, শুশ্রুষা করে সুস্থও করলেন।
"মাধব ঘোষের সঙ্গে আমার পুরোনো শত্রুতা, আমরাও কিছু নিয়ম মেনে চলি, কিন্তু ও আর ওর ছেলেরা...... যাক গে এসব কথা থাক, ও আপনারা বুঝবেন না। কাল অমাবস্যা, কালকে বেরোবেন না, একদিন বিশ্রাম করুন, তাছাড়া যাতায়াতের পক্ষে দিনটা ভালো নয়। পরশু সকালে আমি আপনাদের যাওয়ার ব্যবস্থা করব। আপনাদের মাঝিমাল্লাদের তো কোনও খোঁজ নেই, কোথায় ভেসে গেছে তার ঠিক নেই, নৌকোদুটো অবশ্য এখনও ঘাটে বাঁধা আছে। চিন্তা করবেন না, আপনাদের সঙ্গে আমার লোক যাবে ছিপ নৌকোয়। তারা থাকতে আপনাদের ধারে কাছে ঘেঁষার সাহস হবে না কারুর।"
ডুমুরদহ ত্যাগ করার আগে বিশ্বনাথ একটা পুঁটলি দুর্গাচরণের হাতে দিয়েছিলেন, বলেছিলেন, "নিন, এ আপনাদেরই জিনিস। মাধব ঘোষ যা লুঠ করেছিল তার অনেকটাই উদ্ধার করা গেছে।"
দুর্গাচরণরা সে যাত্রা নিরাপদেই বর্ধমানে পৌঁছেছিলেন। ডাকাত হলেও বিশ্বনাথ রায়ের নাম তাঁরা আজীবন কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করতেন।
ছবিঃ পার্থ মুখার্জি