নেমন্তন্ন বাড়িতে খাওয়া দাওয়াটা একটু বেশিই হয়ে গিয়েছিল বিল্টুর। আর হবে নাই বা কেন? কুশের পৈতের নিয়মভঙ্গে সব বন্ধুরা মিলে বেজায় হৈ হৈ করে এসেছে। কুশের মা আবার ছেলের বন্ধুদের বেশ যত্ন করে খাইয়েছেন। খাওয়া বলে খাওয়া? ইলিশ মাছের পোলাও, রুইয়ের কালিয়া, চাটনি, চার রকম মিষ্টি, শেষ পাতে দই, আর চলে আসার সময় বন্ধুদের জন্য স্পেশাল আইসক্রিম। ইলিশের পোলাওটা বোধহয় বেশিই খাওয়া হয়ে গেছে, তাই পেট একেবারে ফুলে জয়ঢাক। তাই ঘুম আসাটা একটু মুশকিল হয়ে উঠেছিল।
বিল্টুদের বাড়িটা অনেক পুরনো। বিল্টুর দাদুর বাবা বানিয়েছিলেন, সেই কোন কালে! পুরনো হলেও বেশ মজবুত খিলানওয়ালা বাড়িটা দূর থেকে অনেকটা সমুদ্রের বুকে একলা জাহাজের কথা মনে করিয়ে দেয়। সমুদ্র তো নেই, তার জায়গায় আছে চারিদিকে মনোরম বাগান। নানারকম গাছেরা সবুজ ছায়া মেলে দিনের বেলাতেও সেখানে কেমন যেন ঘোর লাগা মায়াবী পরিবেশ তৈরি করে।
বিল্টুদের বাড়ির একতলায় থাকেন বিল্টুর বাবা ও মা। দোতলায় বিল্টু, আর বিল্টুর দিদি তিস্তা। তিস্তা এতক্ষন বিল্টুর খাওয়া দাওয়ার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ শুনছিল। তারপর নিজের ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। শুধু বিল্টুর চোখে নেই ঘুম। ঘরের আলো নিভিয়ে, মটকা মেরে, বিছানায় শুয়ে ঘুম আনার চেষ্টা করছিল বিল্টু।
দুচোখের পাতা বোধহয় একটু লেগে গিয়েছিল। প্রায় মাঝরাতে হটাত ঘুম ভেঙে গেল। খাওয়া দাওয়া বেশি হয়ে গেলে অনেক জল তেষ্টা পায়। একবুক জলতেষ্টা নিয়ে টেবিল থেকে জলের বোতল আনতে গিয়ে জানলায় চোখ পড়তে বিল্টুর মনে হল, কে যেন জানলার পাশ থেকে সরে গেলো।
বিল্টু এবার সদ্য মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে। এখন ছুটি চলছে। খেলাধুলোয় সে খুবই ভালো। বুকে সাহসও প্রচুর। ভূত টুতে একদম বিশ্বাস নেই।
জানলার দিকে পিছন ফিরে, গলায় জলের বোতল উপুড় করে দুতিন বারে বেশ খানিকটা জল খেয়ে ফেলে বিল্টু। তারপর সাঁই করে জানলার দিকে ঘুরে তাকাতেই জানলার মূর্তি আর সরে যাবার সময় পেল না। খুব ছোটবেলায় একটা খেলা ছিল, যাতে ‘স্ট্যাচু’ বললেই সবাইকে স্থির হয়ে যেতে হত। নড়াচড়া করলেই আউট! জানলার মূর্তিও ঠিক তেমনই স্ট্যাচু হয়ে গেল।
বাইরে চারিদিক জ্যোৎস্নার আলোয় ভেসে যাচ্ছে। অবয়ব দেখে মানুষ বলে মনে হচ্ছে, কিন্তু ঘরের অন্ধকারের দিকে ফিরে আছে বলে তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। বিল্টু চাপা গলায় বলে ওঠে, "কে তুমি? জানলায় কেন?"
সাড়াশব্দ নেই মূর্তির। বিল্টু খাটের পাশে দাঁড় করিয়ে রাখা ক্রিকেট ব্যাট হাতে তুলে নেয় নিঃশব্দে। ছায়ামূর্তি এবার একেবারে লাফ দেয় ঘরের মধ্যে। বিল্টুর বুঝতে বাকি থাকে না – যে ঘরে ঢুকে পড়েছে, সে এক ছিঁচকে চোর ছাড়া আর কিছুই নয়। জানলার গরাদ সরিয়ে দিয়েছে নিশ্চই, নইলে ঘরে ঢুকে পড়ল কী করে?
ঠিক তখনি চোরের গলা গমগম করে বেজে উঠল, "এক পা নড়বে না। নড়েছ কি পেটে সোজা চাকু ঢুকিয়ে দেব।"
বিল্টু একটুও ভয় না পেয়ে সুইচ বোর্ডে হাত বাড়িয়ে আচমকা সুইচ টিপে দিতে, সারা ঘর টিউব লাইটের সাদা আলোয় ঝলমল করে ওঠে। চোর বিল্টুর দিকে তেড়েও আসে না, চাকুও চালায় না। চোখে আলো পড়ে ধাঁধিয়ে ওঠায় থতমত খেয়ে যায়।
আবাক কাণ্ড - লোকটা চাকু চালাবে কী করে, হাতে চাকু থাকলে তো! লোকটার দুটো হাতই খালি। হাতের ব্যাট, হাতেই থেকে যায় বিল্টুর। খালি হাতে ঢুকে পড়া লোকটার উপর ক্রিকেট ব্যাট দিয়ে আঘাত করে কোনও লাভ নেই, সাহসী বিল্টু সেটা মুহূর্তে বুঝে ফেলে। ঠিক তখুনি লোকটা আবার বলে ওঠে, "ব্যাটটা রেখে দাও। তুমি তো খুব সাহসী। আমার হাতে চাকু টাকু কিচ্ছু নেই। ভয় দেখাছিলাম শুধু।"
লোকটাকে জরীপ করে বিল্টু দেখে, লোকটার মাঝারি হাইট, রোগা পাতলা চেহারায় দীনতার ছাপ সেঁটে আছে, কিন্তু তার চোখদুটো অসম্ভব উজ্জ্বল। এবার লোকটা দেঁতো হাসি বার করে, দুই হাত নাড়িয়ে বলতে লাগল, "কিচ্ছু নেই, বিশ্বাস করো। পকেট হাতড়ে দেখাবো? তবে বিশ্বাস করবে? গরাদ বেঁকানোর জন্য একটা লোহার রড এনেছিলাম, সেটাও জানলার উপরেই পড়ে আছে। আসলে এতদিন চুরি করছি, কোনোদিন এমন দেখিনি যে গৃহস্বামী জেগে থেকে চোরকে স্বাগত জানায়।"
লোকটার হলদেটে ছোপের দাঁত দেখার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই বিল্টুর। সে ভাবে, এ কেমন চোর? গলার আওয়াজটা বেশ সম্ভ্রান্ত, কথাবার্তায় শিক্ষার ছাপ। চোর বলে মেনে নেওয়া খানিকটা যেন অসুবিধাজনক। আবার এমনও হতে পারে লোকটা অত্যন্ত ধূর্ত। হয়তো এখনি পকেট থেকে পিস্তল বার করে গর্জে উঠবে, "আলমারির চাবি কোথায় রেখেছিস, বার কর।"
লোকটা এবার আরও স্বাভাবিক গলায় প্রশ্ন করলো, "চেয়ারে বসতে পারি? আপত্তি নেই তো!"
অনুমতির অপেক্ষা না করেই বেমালুম চেয়ার টেনে বসে পড়ে সামনে পা ছড়িয়ে দিয়ে বলল, "তুমিও বসো না... খাটে। বসে কথা বলা যাক। আজ চুরি টুরি মাথায় উঠল। আচ্ছা একটু জল খাওয়াতে পার। তুমি বললাম বলে কিছু মনে করো না বন্ধু। দেখে মনে হচ্ছে তুমি স্কুলে পড়?"
সন্দেহটা মাথা থেকে এখনো যায়নি বিল্টুর। সে চোরটার দিক থেকে নজর না সরিয়ে খাটের উপর বসে পড়ে বলে, "তুমি কী ভেবে আমার ঘরেই চুরিটা করতে এসেছিলে আগে শুনি! মনে হয় ভালো করে খোঁজ খবর না নিয়েই চলে এসেছ সটান।"
বিল্টুর এই কথায় লোকটা বুঝি একটু বিষণ্ণ হয়ে পড়ল। সে বলল, "আরে আমাকে কী আর পাকা চোর ভেবেছ? আমি হচ্ছি ছিঁচকে জাতীয়, মানে নিচু শ্রেণীর চোর। সুলুক সন্ধান করে আসতে গেলে দল তৈরি করে আসতে হয়। আমার হচ্ছে, ওয়ান ম্যান আর্মি। চুরি করে যা পাই, তাই দিয়ে ক’দিন বেশ চলে যায়। তখন আর কাজে যাই না। পয়সা ফুরলে আবার কাজে হাত লাগাই।"
"ঐ সিংহ যেমন পেট ভরা থাকলে শিকার করে না, অনেকটা সেই রকম..."
চোর বাধা দিয়ে বলে, "তুলনাটা বেড়ে হয়েছে। তবে কথা হচ্ছে, একটা চোরকে সিংহের সাথে তুলনা করা... একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেলো না?"
বিল্টু খাটের উপর জমিয়ে পা তুলে বসে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে বলে, "একটা কথা বল, নিচে চুরি করতে না ঢুকে তুমি উপরে এলে কি মনে করে? মানে বুঝতেই তো পারছ, একটা মস্ত ভুল করে ফেলেছ আমার ঘরে চুরি করতে এসে। এখানে ক্রিকেটের ব্যাট বল, কিছু বাজে পড়ার বই, গল্পের বই, মাকড়শা আর আরশোলা ছাড়া কিছুই নেই।"
চোর হতাশ ভঙ্গিতে মাথাটা চেয়ারের পিছনে ঠেলে দিয়ে বলে, "এই ভুলটা জীবনে প্রথম হল। সাধারণত বড় পুরনো বাড়িগুলোয় নিচতলায় গরীব ভাড়াটেই থাকে। উপরে থাকে বড়লোক বাড়িওয়ালা। এসে এখন বুঝতে পারছি, এখানে ব্যাপারটা উলটো। যাক, এই যে মাঝরাতে বসে তোমার সাথে গল্প করছি, তাই বা কম কিসে! সারাটা দিন ঘুমিয়ে কাটাই আর রাতে ঘোরাফেরা করতে হয়। প্রফেশনাল ডিম্যান্ড আর কী!"
এবার বিল্টুর একটু খারাপ লাগে। চোরের গলায় পরিষ্কার ভদ্র ঘরের ছাপ। ওর সামান্য জীবনের আভিজ্ঞতা বলছে, চোরেরা সাধারণত অশিক্ষিত আর গরীব হয়। বইতে তাদের ছবি আঁকা হয় অতি বদখদ প্রকৃতির। এই যেমন, চুল কদম ছাঁট, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, প্যান্ট ভুঁড়ির নিচে, বা লিকলিকে শরীরে ময়লার ছাপ। এই ভদ্রলোকের তো...হ্যাঁ চোরকে এখন ভদ্রলোক ভাবতে আর কোনও অসুবিধাই নেই। এতক্ষন তাকে ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করে চলেছে বলে এবার বেশ কুণ্ঠা হচ্ছে। তাই সুর পালটে বিল্টু বলে, "আপনার বাড়িতে কে কে আছেন? আর আপনার নামটাই বা কী?"
"নাম বলা যাবে না। গুরুর বারণ আছে। তবে বলতে পারি, বাড়িতে কেউ নেই। মানে ছিল একদিন, আজ নেই।", লোকটা ঘরের ছাদের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলো।
লোকটা ওর প্রতি রহস্যের জাল বাড়িয়েই চলেছে। বিল্টুর বেশ মজা লাগলেও, রহস্যের জটটা ঠিক খুলতে পাড়ছে না। তবে এ কথা ঠিক যে লোকটা পোড় খাওয়া মানুষ। সন্দেহ নেই, অন্ধকার জীবনের অলিগলিতে ঘুরে বেড়িয়েছে। লোকটাকে আর একটু সহজ করে দেওয়ার জন্য বিল্টু জিজ্ঞেস করলো, "কিছু খাবেন? খিদে আছে?"
লোকটা মাথা নাড়িয়ে বলল, "কাজের আগে আমি একটু খেয়েই বেরোই। মাঝরাতে এখন আর ইচ্ছে নেই। সেটা ছাড়ো, আমাকে আপনি আজ্ঞে করছ কেন? একটু আগে তো মারতে উঠেছিলে! আর একটু হলে ঐ ক্রিকেট ব্যাটটা আমার মাথায় ভাঙতে। তোমাকে যখন বন্ধু বলেছি, তখন তুমিতেই থাকো না!"
হটাৎ চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে লোকটা জানলার কাছে গিয়ে দূরের দিকে তাকিয়ে কাব্যিক গলায় বলে উঠল, "আজ কী সুন্দর চাঁদ উঠেছে! দিগন্ত ভেসে যায় জ্যোৎস্নায়! একটু বাইরে পায়চারী করে এলে হতো না? কী বল?"
বিল্টুদের বাগানে দুধসাদা নরম চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে। তাদের বাগানটা যে এত সুন্দর জানা ছিল না। যেন এই বাগান তার অপরিচিত। মনে হচ্ছে, গাছেরা জ্যোৎস্নায় ভেসে যেতে যেতে, হাওয়ার দোলায় গা ঢলাঢলি করে হেসে উঠছে।
সাদা একটা পাখি জানলার কাছ দিয়ে সাঁই করে উড়ে চলে গেলো। তার চলে যাবার পথকে অনুসরণ করে বিল্টুর চোখ। কানের কাছে ফিসফিস করে লোকটা বলে ওঠে, "কি দেখলে উড়ে যেতে জানো? ওটা লক্ষ্মী পেঁচা। ছোটবেলায় মা বলতো লক্ষ্মী পেঁচা দেখা সৌভাগ্যের লক্ষণ। আজ চুরি করতে পারিনি ঠিক, তবে বহুবছর পর লক্ষ্মী পেঁচা দেখতে পেলাম।"
বিল্টু বলে, "বলছিলে যে আমরা ঘুরে আসি। চল যাই", বলেই সে হাঁটা দিলো দরজার দিকে। কিন্তু লোকটা জানলার বাইরে পা বাড়াচ্ছে দেখে বিল্টু চেঁচিয়ে ওঠে, "আরে কোথায় চললে? ওদিকে নয়, দরজা এদিকে।"
চোর হেসে বলে, "না আমার রাস্তা এদিকে। যেদিক দিয়ে এসেছি, সে পথেই প্রস্থান করতে হবে। অভ্যেস নেই, বুঝলে কিনা", বলেই লোকটা লাফ দিয়ে সানশেডে বেড়ালের মতো লাফিয়ে পড়ে ড্রেন পাইপ বেয়ে কাঠবিড়ালির চালে পিছনের বাগানে নেমে পড়ে হাতের ইশারায় বিল্টুকে ডাকে। বিল্টু দরজা খুলে সিঁড়ি বেয়ে নিঃশব্দে বাগানে নেমে এসে দেখে ততক্ষণে লোকটা বাইরের রাস্তায়। বিল্টু জোর পায়ে হেঁটে গিয়ে ওকে ধরে ফেলে।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে জ্যোৎস্না ভেজা রাস্তা দিয়ে দুজন অসমান বয়সের মানুষ হেঁটে চলে মাঝরাতে। সাক্ষী হয়ে থাকে আকাশে পূর্ণ চাঁদ আর রাস্তার দুপাশে ঝাপসানো গাছগুলো। চাঁদের আলোয় প্রতিদিনের চেনা পথ, মায়াবী রূপে অচেনা মনে হয় বিল্টুর। কোনোদিন কী এই পথে হেঁটেছিল সে? নাকি লোকটার হাত ধরে চাঁদের দেশে পাড়ি জমিয়েছে আজ?
বিল্টুর হাঁটার শব্দ রাতের নৈশব্দ চিরে দেয়। লোকটা কিন্তু বিড়ালের পদক্ষেপে হেঁটে চলেছে, পায়ের শব্দ পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না। রাতের সৌন্দর্যের মাধুরীতে বুঁদ হয়ে বিল্টুর মুখে কোনও কথা নেই। চুপ করে আছে লোকটিও। পার হয়ে গেলো খেলার মাঠ, বুড়ো শিবতলা, আমবাগান। সমস্ত প্রকৃতি যেন নিঃশব্দে পান করে চলেছে দুধ সাদা চাঁদের আলোর অমৃত।
আমবাগান পার হতেই পথে শুয়ে থাকা একটা কুকুর ওদের দেখে ঘেউ ঘেউ করতে শুরু করলে লোকটা জিজ্ঞেস করলো, "কুকুরে ভয় পেয় না। কুকুরের স্বভাবই এমন। ওকে উপেক্ষা করে হাঁটতে থাকো, ওর সীমানা নির্দিষ্ট - এর বাইরে ও যাবে না"
পিছন পিছন আসতে থাকা কুকুরটার দিকে তাকিয়ে বিল্টু ভাবে - লোকটা জানে না, ও কুকুরে আদৌ ভয় পায় না। সব কুকুরের নির্দিষ্ট সীমানা বাঁধা আছে – সেটা ওরও জানা আছে। একজনের সীমানা শেষ, আর একজনের শুরু। আগের কুকুরটা ছিল কালো, এবারেরটা পাটকিলে রঙের, সাথে সাদার ছোপ লাগানো। বিল্টুর পাশে হাঁটতে হাঁটতে লোকটা বলল, "কোথায় যাচ্ছি জানো? তুমি তো আমার সাথে চলেছ, জানতে চাইলে না কোথায় যাচ্ছি আমরা?"
বিল্টুর একটুও কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। এই মুহূর্তে ওকে ভূতগ্রস্তের মতো দেখাচ্ছে। নিশির টানে কোথায় হেঁটে চলেছে, জানা নেই। পাকা রাস্তা ছেড়ে কাঁচা রাস্তার পথ ধরল ওরা। তালদিঘি - জ্যোৎস্নার আলোয় সামনে টলটল করছে তালদিঘির জল। বাড়ি থেকে অনেক দূরে চলে এসছে বুঝতে পারে বিল্টু। চাঁদের ছায়া পড়েছে জলে। তাল আর সুপুরি গাছের সারি নিচু হয়ে যেন তালদিঘিকে গল্প শোনাচ্ছে।
লোকটা একটা ছোট বেড়ার ঘরের সামনে এসে দাঁড়ায়। টালির চাল দিয়ে ছাওয়া ঘরের দরমার বেড়ার ছিদ্র দিয়ে টিমটিমে আলো জ্বলছে। ঘরের একমাত্র দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বিল্টু একবারের জন্য ভাবল বাড়ি ফিরে যায়। ঠিক তখুনি লোকটা পরম আদরে বলল, "ভিতরে এসো।"
বিল্টুর মনে হল, তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে পা দুটোকে কে যেন টেনে নিয়ে গেলো ঘরের ভিতর। ভিতরে ভ্যাপসা সোঁদা গন্ধ। ফুটি ফাটা মেঝের উপর দুটি খাটিয়া, তার একটাতে এক বৃদ্ধা, গায়ে চাদর। বিল্টুর মনের প্রশ্ন লোকটা বুঝতে পারে। সে বলে, "আমার কেউ হয় না। রাস্তায় ভিক্ষে করত। একদিন মাঝরাতে চুরি করতে গিয়ে দেখি অসুস্থ হয়ে বড় রাস্তার উপর বসে বসে গোঙাচ্ছে। ভাবলাম, আমারও কেউ নেই, ওনারও... সেই থেকে আমার সাথেই আমার মা হয়ে রয়ে গেছে। এখন আর চলাফেরাও করতে পারে না।"
বৃদ্ধা পাশ ফিরে শোওয়ার চেষ্টা করায় শব্দ করে উঠল খাটিয়া। ঠিক তখুনি দীঘির পারে সুপুরি গাছের মাথায় একটা কাক ডেকে উঠল। লোকটা খাটিয়ার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল, "ভোর হয়ে এলো বন্ধু। এবার তুমি ফিরে যাও। আর আমাদের দেখা না হওয়াই ভালো।"
বিল্টু বাঁ হাতের কব্জি উল্টে দেখে, হাত ঘড়িতে সকাল চারটে দশ। চকিতে ওর মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে যায়। গত বছর এই দামী রোলেক্সের ঘড়িটা ছোটমামা বিদেশ থেকে এনে ওকে উপহার দিয়েছিল। আজ যদি চোরটাকে ঘড়িটা দিয়ে দেওয়া যায়, তবে কেমন হয়? বিল্টু হাত থেকে ঘড়িটা খুলে লোকটার দিকে বাড়িয়ে দেয়। সে খুব অবাক হয়ে বলে, "এটা দিয়ে কী হবে?"
"রেখে দাও। বাজারে বেচে দিলে কিছু টাকা পাবে। আজ তো তোমার কোনও রোজগার হল না, তাই..."
ঘড়িটা বিল্টুর হাতে ফিরিয়ে দিয়ে ওর কাঁধে একটা হাত ছুঁইয়ে লোকটা বলে, "চোর হতে পারি, দান নেওয়ার অভ্যেসটা এখনো করে উঠতে পারিনি। কিছু মনে কর না ভাই। তোমার শখের জিনিস, তোমার কাছেই থাক। আজ যাও, সকাল হয়ে গেছে। কালকের রাতটা মনে থাকবে। বিদায় বন্ধু!"
এক লাফে ঘর থেকে বাইরে পা রাখে বিল্টু। পুবাকাশে ছেঁড়া মেঘের গায়ে হালকা আলোর আভাস। চাঁদ ফিকে হয়ে এখনো আকাশের গায়ে ঝুলে আছে। রাতের আঁধার কেটে গিয়ে আকাশের গায়ে রং ধরেছে। তালদিঘির ধারের ঝুঁকে পড়া গাছগুলোর উপর পাখিরা জেগে উঠে কিচির মিচির করতে শুরু করেছে। বাড়ির দিকে জোর পায়ে হেঁটে যেতে যেতে আর পিছন ফিরে দেখে না বিল্টু। কাল রাতটা স্বপ্ন হয়েই থাক। একরাতে অনেকটা বড় হয়ে গেলো সে।
ছবিঃ পার্থ মুখার্জি