সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
রিয়ার দুপুর

রিয়াদের বাড়ির ঠিক সামনের ফুটপাথে থাকে লোকটা। দুপুর বেলা রিয়া যখন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে নিজের জানলাটার কাছে এসে বসে, তখনিসে বসে বসে খাবার খায়। দুপুরবেলা বাড়িতে রিয়ার বাবা মা কেউ থাকেন না। থাকেন একমাত্র রিয়ার ঠাকুমা। তিনি রিয়ার খাওয়া হয়ে যাবার পর নিজের ঘরে গিয়ে একটু দু চোখের পাতা এক করে নেন। এই সময়টা রিয়ার একেবারে নিজস্ব। জানলার পাশের রাস্তা গিয়ে মিশেছে তিনমাথার ব্যস্ত মোড়ে। দুপুরের এ রাস্তাটা অপেক্ষাকৃত ফাঁকা থাকে। লোকজনের যাতায়াত কম থাকে বলেই বোধহয় লোকটা উবু হয়ে বসে, ঠিক এইসময়ে মনোযোগ দিয়ে খাবার খায়। রিয়া জানলার গরাদের পাশে বসে ওর খাওয়া দেখে।
লোকটার গায়ে ছেঁড়া প্যান্ট আর একটা জহর কোট। মাথায় উসকো খুস্কো জটা পাকানো ময়লা চুল। দেখে মনে হয় কোনদিন স্নান করে নি। সাবান না লাগানো গায়ের রঙ বেজায় কালো। হাতে পায়ে খড়ি ওঠা। রিয়া তাকে আপনমনে বিড়বিড় করতে দেখলেও অন্য কারো সাথে কোনদিন কথা বলতে দেখে নি। খেতে খেতে মানুষটা রিয়ার জানলার দিকে মাঝেমধ্যে তাকায়। ও তাকালেই রিয়া মুখটা ঘুরিয়ে নেয়। মা বলে লোকটা পাগল। তাই রিয়া ওকে ভয় পায়।
একদিন স্কুল থেকে ফিরে রিয়া তার প্রিয় জানলার ধারে চেয়ারে বসে রাস্তা দেখতে দেখতে যখন খাবার খাচ্ছে, ঠিক সেই সময় লোকটা কোথা থেকে একগাদা খবরের কাগজ এনে বসল গিয়ে ঠিক রিয়ার জানলার পাশটিতে। রিয়া জানলা থেকে একটু সরে দেখতে লাগল লোকটার কান্ড কারখানা। লোকটা খবরের কাগজ পেতে তার উপর বসে কাঁধের ঝোলা ব্যাগটা থেকে বার করল পাউরুটির প্যাকেটে মোড়া, ছেঁড়া দুটো রুটি। আর সেই ঠাণ্ডা রুটি দুটো শুধু শুধুই চিবাতে লাগল। চিবাতে চিবাতে জানলার কাছে বসে থাকা রিয়ার সাথে হয়ে গেল চোখাচোখি। লোকটা যেন একটু মুচকি হাসল বলে মনে হল। এবার রিয়া ভয় পেল। নোংরা মাথার লোকটা হটাত চলে এল রিয়ার জানলার কাছে। রিয়া আরও ভয় পেল। এজন্যই মা ওকে দুপুরে জানলার পাশে বসতে বারন করে।

- একটু গুড় হবে খুকী? লোকটা জানলার ওপাশ থেকে ম্রিদুস্বরে বলে উঠল।
এবার একটু সাহসে ভর করে রান্নাঘর থেকে একদলা গুড় এনে জানলার এপাশ থেকে লোকটার দু হাতের পাতায় ঢেলে দিল রিয়া। লোকটা পরমানন্দে গুড় দিয়ে রুটি দুটো খেয়ে রাস্তার পাশে জলের কল থেকে জল খেয়ে, খবরের কাগজের উপর দিব্যি শুয়ে ঘুম লাগালো।
এরপর থেকে রিয়ার ভয় আস্তে আস্তে কমতে লাগল। একটা খেলা শুরু হয়ে গেল। পাগল লোকটাকে মাঝে মধ্যে একটু গুড় বা একটু তরকারি দিলে ও বড্ড খুশি হত। কদিন বাদে দুজনের বেশ বন্ধুত্বও হয়ে গেল। আসলে বাড়ি ফিরে দুপুরে ওর ঘুম আসে না, আর কথা বলারও কেউ থাকে না। তাই যেদিন লোকটা রিয়াকে জিজ্ঞাসা করল, 'তুমি কোন ক্লাসে পড়ো?' , সেদিন থেকে রিয়ার স্কুলের যত রাজ্যের গল্প, সব পাগল লোকটি খুব মন দিয়ে শুনতে লাগল।
- 'তোমার কোন সাবজেক্ট ভাল লাগে খুকী?'
লোকটারগলায়সঠিকইংরাজী উচ্চারন শুনে রিয়া একটু অবাক হল'।
- 'ইতিহাস আর ভূগোল'।
- 'অঙ্ক ভাল লাগে না, অঙ্ক?'
- 'ভাল লাগে না তা নয়, তবে নম্বর ওঠে না যে!'
- 'উঠবে উঠবে। বুঝতে না পারলে আমাকে একটু আধটু দেখাতে পার। আমি অঙ্ক জানি'।
এবার রিয়া আরও অবাক হয়ে গেল। যে লোকটাকে ও এতদিন পাগল বলে ভাবত, সে কি না বলে অঙ্ক জানে!
- 'তুমি অঙ্ক জানলে কি করে? তুমি পড়াশুনো করেছ নাকি?'
- 'হ্যাঁ, করেছি তো। আমি কলেজে পড়াতাম। কাউকে আবার বলে দিও না যেন!'
- 'ধুর, তুমি তো পাগল। সবাই তোমাকে পাগল বলে ডাকে। তুমি প্রলাপ বকছ'।
- 'আচ্ছা আচ্ছা, না হয় বিশ্বাস নাই করলে। এবার একটু ঘুমিয়ে নাও দেখি। বিকেলে পড়তে বসতে হবে না?'

রিয়া বেজার মুখে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে। পাগল লোকটার কথা ভাবে। যদি সত্যি হয়! হতেও তো পারে, মানুষটি একসময়ে কলেজে পড়াত! এমন একটা গল্প যেন কোথায় পড়েছিল আগে।

***
রিয়ার দুপুর

দিন কাটে, মাসও কেটে যায়। রিয়া, আর যাকে সবাই পাগল বলে, সেই লোকটার মধ্যে বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। মানুষটা মাঝে মধ্যে রিয়াকে পড়াশুনো দেখিয়ে দেয়। সব সেই জানলার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। কখনো নানা দেশের গল্প বলে। শুধু 'বাড়ি কোথায় ছিল সে কথা আর বলে না। মাঝে মাঝে যখন সে নিজের সাথে কথা বলে, তখন রিয়ার খুব অদ্ভুত লাগে। দু চোখের দৃষ্টিতে ঘোর লাগা শূন্যতা যেন। রিয়ার দিকে নজরও পড়ে না তখন। এ সময়ে রিয়ার মানুষটার জন্য খুব মন খারাপ করে।
একদিন হটাত লোকটি বলে বসে, খানিকটা আপন মনেই, 'আমি ঠিক তিনশো দিনের মাথায় চলে যাব এখান থেকে'।
রিয়া জিজ্ঞাসা করে, 'কোথায়?'
- 'জানি না। তবে যাবই'।
- 'তাহলে আমাকে গল্প শোনাবে কে শুনি? জানো, আমাকে কেউ গল্প শোনায় না।
- 'কেন? ঠাকুমা?'
- 'ধুর। ঠাকুমা বলেই না। শুধু টিভি দেখে আর বলে 'বিরক্ত কর না। আমি গল্প জানি না, পড়িও না'। বাবা মায়ের তো সময় নেই। ৩০০ দিন পর তুমি কোথায় যাবে?'
- 'জানি না তো। আগে কোথায় ছিলাম তাও জানি না'।
- 'তুমি আমাদের বাড়িতে থেকে যেতে পার না। আমি বাবা কে বললে ঠিক রাজী হয়ে যাবে দেখ!'
- 'তুমি মহাভারত পড়েছ খুকী?', মানুষটি আগ্রহ নিয়ে বলে ওঠে।
- 'ছোটদের জন্য লেখা, পড়েছি'।
- 'তোমাকে আজ মহাভারতের একটা গল্প শোনাই শোন। আসল মহাভারত অনেক বড়। যখন তুমি অনেক বড় হয়ে কলেজে পড়বে, তখন পড়ো। মহাভারতের গল্প মানে শুধুই যুদ্ধ নয় কিন্তু। মহাভারতে অনেক সুন্দর সুন্দর গল্প আছে। গল্প বলিয়েদের জীবন থেকে নেওয়া শিক্ষার ভিত্তিতে গড়া সেই গল্প আমাদের কতই যে শিক্ষা দেয়!'

মানুষটি রিয়াদের জানলার গরাদ ধরে শুরু করল, 'এক দেশে এক সুন্দর গাছগাছালি ঘেরা মনোরম এক নিল হ্রদের ধারে এক বিশাল বট গাছে থাকত এক কুচকুচে কালো কাক। জমিদারবাড়ির বাবুরা তাকে অনেক মণ্ডা মিঠাই, ঘিয়ে ভাজা সুস্বাদু পোলাও আর মাছ মাংস খেতে দিত। বাবুদের যত্ন আত্মিতে কাক গায়ে গতরে বেশ খানিকটা বেড়ে গেল। জমিদার বাবুরা অন্য কাকেদের পাত্তাই দিত না, তাড়িয়ে দিত। শুধু এই কাকটি তাদের খাবার দাবার খেয়ে বট গাছে শুয়ে হ্রদের ঠাণ্ডা হাওয়ায় ঘুমাত'।
'হটাত একদিন শীতের শুরুতে একঝাক পরিযায়ী পাখী ভিনদেশ থেকে উড়তে উড়তে এসে আশ্রয় নিল বট গাছটাতে। তাদের গায়ের রঙ ছিল সাদা আর গলায় সুন্দর সুন্দর রঙের নেকলেসের মত গোল গোল চক্র। তাদের দেখে কাকের খুব হিংসা হল। সে তাদের বলল, 'আমি দশরকম ভাবে উড়তে জানি। পারবে তোমরা এমন উড়তে?' সেই শুনে পাখিদের দলপতি বলল, 'আমরা যে শুধু একরকম ভাবেই উড়তে জানি গো! তোমার মত পারি না। সে কথা শুনে কাকের নিজ গর্বে বুক উঠল ফুলে'।
'তারপর শীত শেষ হল। পরিযায়ী পাখিরা বিদায় নিতে এল কাকের কাছ থেকে। কাক বলল, চল তোমাদের আমি দশ রকম ভাবে উড়ে দেখাই'। এই বলে সেও পাখিদের দলের সাথে উড়তে উড়তে, নানা কসরত দেখিয়ে বিচিত্র রকম ভাবে উড়তে লাগল। কিছুদূর যাবার পর সমুদ্র দেখা গেল। কাক তো আর কোনদিন সমুদ্র দেখেনি। তাই মনের আনন্দে পাখিদের দলের সাথে মিশে সমুদ্র পার হতে লাগল। একসময় তার ডানায় নেমে এল ক্লান্তি। শরীর হল অবসন্ন। সে চীৎকার করে পাখিদের কাছে সাহায্য চাইল। ঠিক যখন কাক সমুদ্রের জলে পড়ে যাবে যাবে করছে, তখনি পাখিদের একজন ঠোঁট দিয়ে কাকের ডানা কামড়ে ধরে অনেক উচুতে নিয়ে গিয়ে তাকে বাঁচাল। সমুদ্র তীরে এক নারকেল গাছের মাথায় তাকে ছেড়ে দিয়ে সবাই দলবেঁধে আবার উড়ে চলল শীতের দেশে। যাবার সময় বলে গেল, 'ভাই, আমরা যে যেমন, তেমন ভাবেই থাকা উচিত। অন্যকে নকল করতে গেলে নাকাল হতে হয়'।
গল্প বলা শেষ করে পাগল মানুষটি বলে উঠলেন, 'আমি যেমন আছি, তেমন থাকি, তোমাদের বাড়ি গিয়ে উঠলে ঐ কাকের দশা হবে'।
বলেই সে দাড়ি চুলকাতে চুলকাতে রাস্তা দিয়ে তিন মাথার মোড়ের দিকে হনহন করে হাঁটা দিল।
পরদিন রিয়া স্কুল থেকে ফিরে দেখল ফুটপাথ ফাঁকা। মানুষটা বেমালুম উধাও। তার জন্য অপেক্ষা করতে করতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হল। মানুষটার দেখা আর পাওয়া গেল না। পরদিনও তাকে পাওয়া গেল না, কোনদিনই না। কারণ,যেদিন সে রিয়াকে মহাভারতের গল্প শুনিয়ে গিয়েছিল, সেদিন তার তিনশো দিন সম্পূর্ণ হয়ে গেছে।

ছবিঃ তৃষিতা মিত্র

 

জন্ম নৈহাটি। পদার্থ বিদ্যা নিয়ে পড়াশুনো প্রথমে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে, পরে দিল্লী আই.আই.টিতে।বর্তমানে দিল্লীতে প্রায় তিন দশক ধরে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন একটি গবেষণাগারে বৈজ্ঞানিক পদে কর্মরত। কাজের অবসরে একটু আধটু লেখালেখি ও বাংলা সংস্কৃতি চর্চা।

More articles from this author

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা