তুমি তো অনেক ছড়া পড়েছো । সেই ছড়াটা মনে আছে ? 'এক যে আছে মজার দেশ সব রকমে ভালো, রাত্তিরেতে বেজায় রোদ, দিনে চাঁদের আলো।...' । কিংবা সেই ছড়াটি ' দাদখানি চাল, মুশুরির ডাল / দুটি পাকা বেল, সরিষার তেল...' । ছোটদের এইসব মজার মজার ছড়াগুলো কে লিখেছিলেন সেটা বোধহয় তোমার আর মনে নেই । তবে শুধু তুমি কেন, অনেক বড়রাও বোধহয় তাঁকে ভুলে গেছেন। বেশ, আজ তাঁর কথাই বলি । তাঁর নাম যোগীন্দ্রনাথ সরকার। গত ২৮শে সেপ্টেম্বর , ২০১৬ তাঁর জন্মের দেড়শো বছর পূর্ণ হল ।
যোগীন্দ্রনাথের জন্ম এখনকার দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার ডায়মন্ড হারবারের কাছে নেত্রা বা ন্যাতড়া নামের এক গ্রামে, ১৮৬৬ সালে । পিতার নাম নন্দলাল সরকার আর মায়ের নাম থাকোমণি । তাঁর দাদা ছিলেন সে কালের বিখ্যাত চিকিৎসক । ডাক্তার নীলরতন সরকারের নাম তুমি নিশ্চয়ই শুনেছো । কলকাতায় তাঁর নামে হাসপাতাল আছে । দাদা ডাক্তার হলে কি হবে, ভাই যোগীন্দ্রনাথের উচ্চশিক্ষায় কোন আগ্রহ ছিল না । দেওঘর থেকে দশ ক্লাসের প্রবেশিকা পরীক্ষা পাশ করে কলকাতার সিটি কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন । কিন্তু কলেজ শিক্ষা শেষ না করে সিটি কলেজিয়েট স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন ।
এই সময়ে থেকেই যোগীন্দ্রনাথ ছোটদের জন্য লেখালিখি শুরু করেন। 'সাথী' (পরে 'সখা ও সাথী') , 'মুকুল', 'সন্দেশ' ইত্যাদি ছোটদের পত্রিকাতে তিনি নিয়মিত লিখতে থাকেন। সারা জীবন মূলতঃ ছোটদের জন্যেই লিখে গেছেন তিনি। সেই সময়ে নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হচ্ছে ছোটদের জন্য বেশ কিছু পত্রিকা। কিছু কিছু বড়রা বুঝতে পারছেন, ছোটদের জন্য শুধুই স্কুলে পড়ার বই লিখলে চলবে না।তাদের মনে হাজার প্রশ্ন, হাজার কৌতূহল। সেই প্রশ্ন, সেই কৌতুহল মেটানোর অফুরন্ত রসদ চাই। সেই সময়ে ছোটদের জন্য লিখছেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, যিনি যোগীন্দ্রনাথের থেকে মাত্র তিন বছরের বড় ছিলেন। সুকুমার রায় তখন মাত্র চার বছরের শিশু । আরো লিখছেন প্রমদাচরণ সেন, শিবনাথ শাস্ত্রী, জগদীশচন্দ্র বসুর মত মানুষেরা।
যোগীন্দ্রনাথ সেইসব হাতেগোনা মানুষদের মধ্যে ছিলেন, যাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন ছোটদের বইতে শুধুই নীতিকথা গোছের গল্প থাকলে চলবে না; সেখানে থাকতে হবে হাসি-মজায় ভরা উদ্ভট কল্পনায় ভরা ছড়া, দেশ-বিদেশের জানা অজানা সব গল্প; আর থাকতে হবে মন মাতানো ছবি, কারণ ছোটরা ছবি দেখলে তার সাথে সংযুক্ত অনেক তথ্য সহজেই মাথায় রাখতে পারে।
এইসব ভাবনা মাথায় নিয়েই ১৮৯১ খ্রীষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে তিনি প্রকাশ করে ফেলেন ছোটদের জন্য তাঁর প্রথম বই 'হাসি ও খেলা'। বইয়ের শুরুতেই তিনি জানিয়ে দেন, "আমাদের দেশে বালক-বালিকাদের উপযোগী স্কুলপাঠ্য পুস্তকের নিতান্ত অভাব না থাকিলেও গৃহপাঠ্য ও সচিত্র পুস্তক একখানিও দেখা যায় না। এই অভাব কিয়ৎ পরিমাণে দূর করিবার জন্য 'হাসি ও খেলা' প্রকাশিত হইল"। 'হাসি ও খেলা'- লেখায় ছবিতে ভরপুর বইটিকে বাংলায় শিশুদের জন্য সর্বপ্রথম বই বলা যেতে পারে। সে সময়ে এই বইয়ের দাম ছিল দশ আনা।এই বইয়ের সমালোচনা করতে বসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেনঃ
"বইখানি ছোটো ছেলেদের পড়িবার জন্য। বাংলা ভাষায় এরূপ গ্রন্থের বিশেষ অভাব ছিল। ছেলেদের জন্য যে-সকল বই আছে তাহা স্কুলে পড়িবার বই; তাহাতে স্নেহের বা সৌন্দর্যের লেশমাত্র নাই; তাহাতে যে পরিমাণে উৎপীড়ন হয় সে পরিমাণে উপকার হয় না...
...শিক্ষা দিতে হইলে শিশুদের হৃদয় আকর্ষণ করা বিশেষ আবশ্যক; তাহাদের স্বাভাবিক কল্পনাশক্তি এবং কৌতূহল প্রবৃত্তির চরিতার্থতা সাধন করিয়া তাহাদিগকে জ্ঞানের পথে অগ্রসর করিতে হইবে; বর্ণমালা প্রভৃতি চিহ্নগুলিকে ছবির দ্বারা সজীব এবং শিক্ষণীয় বিষয়গুলিকে ভালো ভালো চিত্রের দ্বারা মনের মধ্যে মুদ্রিত করিয়া দিতে হইবে। অর্থাৎ, একসঙ্গে তাহাদের ইন্দ্রিয়বোধ কল্পনাশক্তি এবং বুদ্ধিবৃত্তির অনুশীলন সাধন করিতে হইবে। সেইরূপ করা হয় না বলিয়াই অধ্যাপনার জন্য শিশুদিগকে বিভীষিকার হস্তে সমর্পণ করিতে হয়। বালকদিগের অনেক বালাই আছে; সবচেয়ে প্রধান বালাই পাঠশালা। ...
... হাসি ও খেলা বইখানি সংকলন করিয়া যোগীন্দ্রবাবু শিশুদিগের এবং শিশুদিগের পিতামাতার কৃতজ্ঞতাভাজন হইয়াছেন। বইখানি যেমন ভালো বাঁধানো, তেমনি ভালো করিয়া ছাপানো এবং ছবিতে পরিপূর্ণ। নিঃসন্দেহে গ্রন্থখানি অনেক ব্যয়সাধ্য হইয়াছে। আশা করি, যাহাতে প্রকাশককে ক্ষতিগ্রস্ত না হইতে হয় সেজন্য বাঙালি অভিভাবক মাত্রেই দৃষ্টি রাখিবেন।
সবার পরিচিত হাসিখুশির প্রথম পাতা
তুমি একদম শৈশবে অ আ ক খ শিখেছো তাঁর বই পড়ে । শুধু তুমিই বা কেন আমরা এখন যারা বয়সে তোমার দাদুর মত হয়ে গেছি তারাও এই একই বই পড়ে অ আ ক খ শিখেছি ।
আমটি আমি খাবো পেড়ে
ইঁদুর ছানা ভয়ে মরে
ঈগল পাখি পাছে ধরে ।
- মনে পড়ছে নিশ্চই । বইটার নাম 'হাসিখুসি'* । দুটি ভাগে প্রকাশিত হয় ১৮৯৭ সালে। আজ প্রায় একশো কুড়ি বছর ধরে, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বর্ণপরিচয়-এর পাশাপাশি, আমরা বাংলা অক্ষর শিখছি যোগীন্দ্রনাথের এই ছবিতে ভরা বই 'হাসিখুসি' পড়ে । মা-বাবা যেন খেলনার মত তাঁদের সন্তানের হাতে তুলে দেন 'হাসিখুসি' আর 'টিয়াপাখির ঠোঁটটি লাল/ঠকুরদাদার শুকনো গাল' - এমন অপরূপ ছন্দ-তালে সেই কচি মন চলে যায় তার কল্পনার উদ্ভট জগতে । শুনলে অবাক হবে, 'হাসিখুসি' -র হিন্দী এবং অসমিয়া সংস্করণ ও পরে প্রকাশিত হয়েছে।
অথবা 'হারাধনের দশটি ছেলে'? সে এমন এক ছড়া, যেটা শুধুই মজায় ভরা অদ্ভূত কল্পনার জগতে নিয়ে যায় না, সাথে সাথে এক থেকে দশ গোনা এবং একটু একটু করে সরল যোগ-বিয়োগ ও শিখিয়ে দেয় !
১৮৯১ থেকে ১৯৩৭, এই ৪৬ বছর ধরে যোগীন্দ্রনাথ শিশু-কিশোরদের জন্য লিখে গেছেন, ভেবে গেছেন। ছোটদের জন্য ছন্দমেলানো মজাদার ছড়া, কবিতা, জীবজন্তুর কথা, বনজঙ্গলের গল্প, পুরাণের গল্প, জানা-অজানা নানা বিষয়ে তথ্যমূলক লেখার সাথে সাথে লিখেছেন গল্প আর উপন্যাসও। কিন্তু শুধু নিজে মৌলিক লেখা লিখেই থেমে থাকেন নি। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বই থেকে যেসব লেখাকেই মনে হত বাংলার ছেলেমেয়েদের জন্য প্রয়োজনীয়, বা তাদের ভাল লাগবে- সেই সমস্ত লেখা সংগ্রহ করে এনে নানা সংকলনে উপস্থাপন করতেন যোগীন্দ্রনাথ। তাঁর এই কাজে আনন্দের সাথে যুক্ত ছিলেন প্রমদাচরণ সেন, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, যোগেন্দ্রনাথ বসু, নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্য প্রমুখ সেই সময়ে শিশুসাহিত্যে উৎসাহী বিশিষ্ট মানুষেরা। লেখালেখির সাথে সাথে 'মুকুল' পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন যোগীন্দ্রনাথ; সাথে সহ-প্রণয়ন করতেন 'জ্ঞান-মুকুল' নামে একটি পত্রিকা। এছাড়াও জানা যায়, তিনি বঙ্গ এবং মাঝেমধ্যে বিহার এবং ওড়িশার শিক্ষা অধিকর্তার অনুমোদনের আওতায় কিছু সচিত্র বিদ্যালয় পাঠ্য পুস্তক সংকলনের দায়িত্ব ও পালন করেন।
তিনি ছোটদের জন্য প্রায় তিরিশটি বই লিখেছেন এবং সংকলন সম্পাদনা করেছেন, যার মধ্যে আছে 'হাসিখুসি','খুকুমণির ছড়া','হাসিরাশি', 'হাসি ও খেলা', 'ছড়া ও ছবি', 'রাঙাছবি', 'গল্পসঞ্চয়', 'শিশু চয়নিকা', 'হিজিবিজি' প্রভৃতি । এছাড়াও শিশুমনের উপযোগী একুশটি পৌরাণিক কাহিনীর বই এবং 'শিক্ষা মুকুল', 'শিক্ষা প্রবেশ', 'শিক্ষাসঞ্চয়' প্রভৃতি অনেকগুলি স্কুলপাঠ্য বইও রচনা করেছিলেন ।
যোগীন্দ্রনাথ শুধু যে নিজেই লিখেছেন ছোটদের জন্য তা নয় । ছোটরা যাতে আরো বেশি বেশি গল্প, কবিতা,ছড়া এইসব পড়তে পারে তার জন্য ১৮৯৬ সালে 'সিটি বুক সোসাইটি' নামে একটা বই প্রকাশের সংস্থা খুলেছিলেন। সেখান থেকে সুন্দর ছবি এবং হরফ দিয়ে নানান রকম ছোটদের বই ছাপা হত । উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর প্রথম বই 'ছেলেদের রামায়ণ' এখান থেকেই প্রকাশিত হয় ।
বাংলার ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা পড়াশোনার সাথে সাথে দেশ-বিদেশ থেকে আহরণ করে আনা জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হোক, সৎ, পরিশ্রমী মানুষ হোক, ঠিক-ভুল-সত্য-মিথ্যার তফাৎ করতে শিখুক, এমন আশা নিয়েই সারা জীবন ধরে ছোটদের জন্য নিরলস ভাবে সাহিত্য সৃষ্টিতে মগ্ন ছিলে এই মানুষটি।
১৯২৩ সালে ৫৩ বছর বয়সে যোগীন্দ্রনাথ পক্ষাঘাত রোগে আক্রান্ত হন; সেই অবস্থাতেও তিনি ছোটদের বই প্রকাশ করেছেন, জীবনের অন্তিম পর্ব পর্যন্ত শিশুমনের খোরাক জুগিয়ে গেছেন তিনি অজস্র লেখায় । ১৯৩৬ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর শেষ সংকলন 'গল্প সঞ্চয়'।
১৯৩৭ সালের ২৭শে জুন (মতান্তরে ২৬শে জুন) ৭১ বছর বয়সে মৃত্যু হয় অবিস্মরণীয় শিশু সাহিত্যিক যোগীন্দ্রনাথ সরকারের । বাংলা শিশুসাহিত্যের জগৎ যাঁকে সর্বদা জানাবে বিনম্র প্রণাম।
তুমি হয়তো আগে পড়েছো, তবু আর একবার পড়ার জন্য যোগীন্দ্রনাথের একটা ছড়া, 'কাজের ছেলে' রইল ইচ্ছামতীর মঞ্জুষা বিভাগে; এ ছড়া পড়ে হাহা করে না হেসে উপায় নেই !
(* হাসিখুসি - মূল বানান অপরিবর্তিত)
প্রতিকৃতিঃ পার্থ মুখার্জি অন্যান্য ছবিঃ ক্যালকাটাওয়েব, বাংলারকবিতা, উইকিমিডিয়া