"দাদা, দে না একটু মাটি লাগাই -"
"চুপ! আগে দড়ি বাঁধতে শেখ!"
বুঝতে পারতাম না অনেক কিছুই। যেমন, বুঝতে পারতাম না, ঐ কাঠের জিনিস গুলো আসত কোথা থেকে। দাদা বলল 'কাঠামো', আমি বললাম টুল ভাঙা। ঐ দিয়েই শুরু, আমার প্রথম হাতে করে কাঠামো তে খড় বাঁধা। বড় বড় খড়ের গাছি নিয়ে নিয়ে মনে মনে হাত পা ভেবে শুরু করা ঐ অবয়ব। আমার ঠিক লাগতো, দাদা সেটা দেখে আরও ঠিক করে দিত। অনেক বার দড়ি টেনে বাঁধতে গিয়ে হাত গেছে কেটেকুটে।
সবাই বিকেলে খেলতে যেতো, আমার মন মেতে থাকত ঐ খড়কুটো নিয়ে।
ঠাকুর গড়ার ইচ্ছেটা কিন্তু আমাদের আচমকা হয়েছিল। মাটি নিয়ে ঘাঁটতে গিয়ে আমার দাদার মনে হয়েছিল, কেন না একটু কিছু গড়ার চেষ্টা করা যায়! সেই শুরু। আমাদের গৃহদেবী মা কালী, এবং তাঁর কৃপায় আমাদের সব, তাই কালী-মূর্তি গড়ার কোন বায়না দাদা নিত না। অবশ্য অন্য দেব-দেবীর মূর্তি এবং মা কালীমূর্তি গড়ায় বিস্তর ফারাক। কালীমূর্তি গড়ার শুরু থেকে শেষ, প্রতিটা কাজেই বহু নিয়ম, এবং সে নিয়ম না মানলে বহু ভয়।
শুদ্ধ আচার, শুদ্ধ সময়, নির্লিপ্ত মনে, অনেক কিছুর মাপকাঠির ওপর নির্ভর করে, করতে হয় সে মূর্তি গড়ার কাজ।
বড় বড় বাড়ির ঠাকুর-ও তৈরি করতে হলে অনেক নিয়ম মানতে হয়ে, যেমন , শুরু করতে হয়ে রথের দিন, বিষ্ণু এবং গনেশ-এর সাথে, যে দেবতা কে মাটির মূর্তি-ভাবে আবাহন করা, তাঁকেও স্মরণ করে শুরু করতে হয়ে কাজ। তবে আমাদের শখের ছোট ঠাকুর বানানোতে এত নিয়ম না মানলেও চলত।
গাড়ি বোঝাই করে আসত বালি মাটি, আসত এঁটেল মাটি, আর শুরু হত কাদা ভেজা সোঁদা গন্ধে মেতে ওঠা দিনগুলো। মাটি মেখে, তাতে পাটের ঝুরো ছড়িয়ে যখন ছাঁচে মাটি বসাত আমার 'ছোটবেলার আমি', মনে মনে খুঁজতাম আমি আমার দাদার ভেতর, 'বড়বেলার আমি'-কে। ভাবতে একটু অসুবিধা হতো, আমার দাদা আমার থেকে ছিল বেশ বড়, তবে ভাবতে ভালো লাগতো।
মাটি লাগানোর পর দিন রাত্রি জেগে থাকা, আকাশকে ডাকা, যেন এই ক'টা দিন বৃষ্টি না হয়। লম্ফ জ্বালিয়ে দিন রাত্রি এক করে করে সেই মাটি শুকিয়ে যখন তাতে প্রথম রঙ পড়ত, মনে হত যেন আজই পূজো। ধীরে ধীরে মূর্তি সেজে উঠত নানা সাজে, রঙ বার্নিশ কাপড় জামা পরে ঠাকুর যখন মৃন্ময়, তখন গভীর রাত্রে আঁকা হত তাদের চোখ, হত দেব দেবীদের চক্ষুদান। আমাদের তো প্রচুর ঠাকুর বানানো হতো, তাই চক্ষুদানের কোন বাঁধাধরা দিন থাকত না। চক্ষুদানের অনেক নিয়ম হয়ে থাকে, কিছু নিয়মে মাঝ-রাত, কিছু নিয়মে ভোরবেলা, কিছু নিয়মে সন্ধ্যায়ে, এবং কিছু নিয়মে মহালয়া-র দিন হয়ে চক্ষুদান। তবে আমাদের এত নিয়ম ছিল না, আমাদের অনেক গুলো মূর্তির, একসাথে চোখ আঁকা হত।
মৃন্ময় হয়ে উঠত চিন্ময়, মৃন্ময়ই হয়ে উঠত চিন্ময়ী! সে অদ্ভূত অনুভূতি শুধু অনুভবই করা যায়। আনন্দ পেতাম, এখনও পাই, নিজেকে বড় ভালো লাগে হঠাৎ। দুঃখ হতো পরের দিন থেকে। একে একে যখন সবাই এসে ওদের তুলে নিয়ে যেতো, সত্যি বলছি তখন আমার ভীষণ কান্না পেত। দাদা কে কখনও কথা বলতে দেখিনি সেদিন, জিজ্ঞেস করলে বলত, "ছেলেরা কাঁদে না"।
এখন আর ঠাকুর গড়ি না।
তবে আজও বিশ্বকর্মা পুজোতে ঘুড়ি নয়, মন বাড়িতে তৈরি কাঠামোগুলোই খোঁজে। পাড়ার পূজোর কার্ত্তিক লক্ষ্মী সরস্বতী অনেক কিছু মনে করায়। দুর্গা আমার কাছে পূজিতা দেবী। বাকিরা একদিন আমার হাতেও তৈরি হতো। হ্যাঁ, মাটি পেত না, তবে বাঁধুনিটা আমারই হাতের ছিল।
খড়, জল, মাটির মূর্তির দিকে তাকিয়ে এখনও মনের ভেতর 'সৃষ্টিকর্তা' কথাটা এক ঝলক দেখা দিয়েই যায়।
ঠাকুর হল মাটি, আর কুমোর- তারা মাটির মানুষ।