অনেক কাল আগে এক ছোট্ট শিশু ছিল। তার চুলটা ছিল সাদা। তা সাদা বলে সাদা ... এক্কেবারে বরফের মত ক্রীমের মত আদ্দির মত ধবধবে সাদা। এক ঝকঝকে উজ্জ্বল দিনে তার জন্ম হয়েছিল। তার বাবামা এত্ত খুশী হয়েছিলেন যে ওঁদের হাসি আর থামছিলই না। আর সবাই খুব গদগদ হয়ে নানান মন্তব্য করে যাচ্ছিলেন যে ওঁদের সন্তান কী ভীষণই না সুন্দর দেখতে।
স্যানাটোরিয়াম থেকে তাকে যখন বের করে আনা হলো সূর্যের আলোয় তার মুখটা ঝলমল করে উঠল। আর তা দেখে মা বাবাকে বলে উঠলেন-
- দ্যাখো ঠিক যেন দেবদূত এক!
- হ্যাঁ দুনিয়ার সবচেয়ে সুন্দর বাচ্চা- চকচকে মুখে বাবা উত্তর দিলেন। তার সাদা, ধবধবে সাদা চুলের জন্য গর্বিত, সুখী আর প্রিয়পাত্র হয়ে এভাবেই এসেকিয়েল বেড়ে উঠছিল ।
পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত মাঠে ঘাটে থাকত সে। সেখানেই সে জন্তু জানোয়ারদের সঙ্গে খেলতে খেলতে, মুরগী ও তার ছানাপোনাদের খাবার দিতে দিতে বড় হয়ে উঠল সে। এমনকী শুধুমাত্র তার জন্যই বাবার উপহার দেওয়া ছোটখাট ঘোড়াটার ওপর চড়তেও শিখেছিল সে। সেটার নাম দিয়েছিল "বেঁটে পেতিসো"। ঘোড়াটা তার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু হয়ে গিয়েছিল।
এক তারা ভরা রাতে, এসেকিয়েল শুনতে পেল বসবার ঘরে তার বাবামার কথোপকথন। ওঁরা কথাবার্তায় খুব চিন্তিত ও মগ্ন ছিলেন, তাই সে পা টিপে টিপে কাছে এগিয়ে গেল। বাবামা তাকে দেখে বললেন রাত হয়ে গেছে তার অবশ্যই ঘুমাতে চলে যাওয়া উচিৎ। এসেকিয়েল এত কৌতূহলী হয়ে উঠেছিল যে শোনবার জন্য সে দরজার পেছনে লুকিয়ে পড়ল। কী বিস্ময় উপস্থিত হল তার কাছে!!! বাবা মা বাড়িবদলের বিষয় আলোচনা করছিল। বাড়িবদল? হ্যাঁ! অন্য জায়গায় থাকবার জন্য যাওয়া, শহরে যাওয়া, তার থেকে বেশিও নয় কমও নয়। গোটা বিষয়টা হল এসেকিয়েলকে ইস্কুলে ভর্তি হতে হবে। ওরা যেখানে থাকত সেখানকার কাছাকাছি কোন ইস্কুল ছিল না। কী মজা! শহর চেনা নতুন বন্ধুদের চেনা! এসব তো মজাই মনে হল। এভাবেই ওরা সব মালপত্র জড় করে শহরে একটা সুন্দর বাড়িতে চলে গেল যেখানে কাছেই একটা ইস্কুল ছিল যার দেওয়াল জোড়া রংবেরঙের ছবি আঁকা। যে ছবিগুলো বাচ্চারা তাদের শিক্ষকদের সঙ্গে হাত লাগিয়ে এঁকেছিল।
এসেকিয়েল এত উৎসাহে টগবগ করছিল যে শান্ত হয়ে থাকতে পারছিল না। মার সঙ্গে ডাস্ট কোট কিনতে গেল আর সঙ্গে ইস্কুলের অন্যান্য জিনিষপত্র। সে তার পছন্দের ছবি লাগানো সব জিনিষ কিনল। এত উত্তেজিত ছিল যে সে রাতে সে প্রায় জেগেই কাটাল। তারপর বহু প্রত্যাশিত সেই দিনটা এল তার ইস্কুলে যাবার প্রথন দিন! এসেকিয়েল খুব ভোর ভোর ঘুম থেকে উঠে পড়ল, খুশি খুশি ভাব সঙ্গে সামান্য নার্ভাস ও। মুখ ধুল দাঁত মাজল তার সাদা খুউউব সাদা চুলগুলোকে আঁচড়াল।
জীবনে সেই চুল ছিল তার বিশেষ বৈশিষ্ট্য। সেই চুল যাতে তার মা রোজ রাতে ঘুমোবার আগে হাত বুলিয়ে দিত, তার বরফের মত সুন্দর চুল, তারা বাবা তাকে এমনই বলতেন। বাবামায়ের হাত ধরে সে ইস্কুলে এল। ঢোকবার মুখে তাকে চুমু খেলেন ওনারা। আর এসেকিয়েল দৃঢ় পদক্ষেপে ইস্কুলের মাঠে প্রথম শ্রেণীর ছাত্রদের সারির কাছে এগিয়ে গেল। সেখানে তার অস্বস্তি করতে লাগল। সব ছেলেরা তার দিকে চাইল। শুধু যে তার শ্রেণীর ছেলেপুলে তা নয় বিশাল মাঠে দাঁড়ানো সব ছেলেরাই তাকে চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগল, আর এসেকিয়েল-এর কেন কে জানে মনে হতে লাগল মাটি যেন তাকে শুষে নেয়।
দ্রুত একটি ছেলে তার কাছে এসে জিজ্ঞেস করল-
- এই ছেলে তোর চুলটা এমন কেন রে?
এসেকিয়েল কোন উত্তর দিল না। সে জানত না এর উত্তরে কী বলতে হবে। অবাক মনে তার প্রশ্ন জাগল- এরকমই তো। কেন? সুন্দর না? বরফের মত সাদা। এসেকিয়েলের নীরবতার সামনে সবাই তার দিকে চেয়ে রইল। কেউ কেউ হাসতে শুরু করল, অন্যরা ভার নিল চিৎকার করে বলবার
- ক্রীমের মত মাথা, কাগজের মত মাথা, চিনির মত মাথা!
এসেকিয়েল তার চারপাশে তাকাল। আর অবাক বিস্ময়ে দ্রুততায় আবিষ্কার করল যে সেখানে কারো মাথাই তার মত এমন সাদা বরফের মত সাদা নয়। আর সেটাই ইস্কুলের বাচ্চাদের খারাপ লাগছে। নিঃশব্দে কাঁদল সে। যেন নিজের ভেতরেই, সে আর ইস্কুল ভালবাসতে পারছে না। খারাপ লাগছে তার। বাড়ি ফিরতে চাইছে সে।
ক্লাস টিচার একজনের পর একজনকে চুমু দিতে লাগলেন। তারপর সবাইকে নিয়ে প্রথম শ্রেণীর ক্লাসঘরে এলেন। ঘরটা ছিল ভীষণ সুন্দর। দেওয়ালে সব ছাত্রের নাম লেখা, ছবি আঁকা, সংখ্যা লেখা, অক্ষর লেখা। কিন্তু এসেকিয়েলের মনে এতই দুঃখ ছিল যে সে তার ক্লাসঘর যে কতটা সুন্দর তা নজর করতে পারছিল না। তার শুধু কান্না পাচ্ছিল আর সে দৌড়ে বেরিয়ে যেতে চাইছিল সেখান থেকে।
একা বসল সে। তার পাশে কেউ বসতে চাইল না। কারণ তার চুলের রঙ দেখে সবাই তাকে অদ্ভুত বাচ্চা ভাবছিল। ক্লাসটিচার মারিয়া লুস, তিনি সবাইকে বললেন যে রোল কল করতে যাচ্ছেন যাতে করে যাঁদের নাম তিনি ডাকবেন তারা ওনার চেয়ারের পাশে এসে দাঁড়াতে পারে। মারিয়া লুস শুরু করলেন- যারা যারা লম্বা তারা উঠে দাঁড়াও। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছেলেরা তাঁর দিকে তাকাল। তিনি বললেন- চলো চলো লম্বা ছেলেরা দাঁড়িয়ে পড়। লম্বা ছেলেরা তাই করল।
ক্লাসটিচার বলে চললেন- এবারে বেঁটেরা, লাল চুলের ছেলেরা, যারা চশমা পরে তারা, কালো চুলের ছেলেরা, ফ্যাকাশে রঙা ছেলেরা, যাদের যাদের ক্রাচ বা অন্য কিছু পরে থাকতে হয়, যারা সাদা চুলের তারা, যারা বাদামী চুলের, যাদের ছোট্ট দাঁত, বড় বড় দাঁতওয়ালারা, যাদের আচার ব্যবহার ভাল, যারা বদ আচরণের, সরল বাচ্চারা, লাজুক ছেলেরা, বাচাল ছেলে পুলে, ভীষণ শান্তশিষ্ট ছেলেরা, এভাবেই তালিকা চলতেই লাগল অন্তহীন।
বাচ্চারা দাঁড়িয়ে পড়া, বসে পড়া ফের দাঁড়িয়ে পড়া ছাড়া আর কিছুই করে নি। কারণ সকলে, সবাই সব্বাইকে বারবার নাম ধরে ডাকা হয়েছিল। কেউ ছিল খুব বেঁটে, কেউ বাচাল, কেউ হলদে চুলো, আর কখনো কখনো বদ স্বভাবের ছেলেরাও। অন্যেরা ছিল শান্ত, লম্বা, ছোট দাঁতওয়ালা, সরল। সবাইকে এতবার উঠে দাঁড়াতে হচ্ছিল যে তারা ক্লান্ত হয়ে পড়ল।
কিন্তু একজন বাকী ছিল। মারিয়া লুস তাকে বললেন- এখন তারা দাঁড়াবে যারা আনন্দ করতে চায়, যারা শিখতে চায়, যারা বন্ধুত্ব পাতাতে চায়, যারা খেলাধুলো করতে চায়, যারা হাসতে চায়। আর কল্পনা কর কি ঘটে গেল। হ্যাঁ!!! সব্বাই উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। সবাই চেঁচাতে লাগল- আমি আমি আমি লুস ম্যাডাম। তখন মারিয়া লুস বললেন- আমাদের মধ্যে ফারাক কী আছে তাতে কিছু যায় আসে না। আমাদের সবাইকে এক সাথে নিজেদের সম্মান করতে হবে, ভাবতে হবে যাতে সবার ভালো হয়। এসেকিয়েল কান্না থামিয়ে দিয়েছিল। আবার তাঁর মন খুশি হয়ে গেল আর সে ইস্কুলে থেকে যেতে চাইল।
দ্রুত তার কাছে একটা ছেলে এগিয়ে এল। বললে সে তার পাশে বসতে চায়, বসতে দেবে কি? এসেকিয়েল হ্যাঁ বলল। এখান থেকেই আমরা এই গল্পটায় দেখতে পাই যে এসেকিয়েল অনেক কিছু করল, অনেক বন্ধু পাতাল, আর অন্য আর এক বিষয় ওরা আমায় বলল যে যখন খ্রীস্টমাসের সময় সান্তাক্লজ সেজেছিল ওরা সব সময় ওরা এসেকিয়েল কেই নির্বাচন করত। যাতে করে সে গর্বিত হয় তার সাদা চুলের সাদা, এক্কেবারে ধবধবে সাদা চুল।
মূল গল্পঃ Me gusta como soy
লেখক পরিচিতিঃ
সোনিয়া আলমাদাঃ আর্জেন্টিনায় বসবাসকারী এই শিশু মনস্তত্ববিদ শিশুদের গল্প লেখেন ।
ছবিঃ পার্থ মুখার্জি