ব্যস্ত রাস্তা, গাড়ির সারি, ধুলোধোঁয়ার আস্তরণ, মানুষের ভিড় এসবের মধ্যেই হঠাৎ ছুটি নিয়ে কয়েকঘণ্টার জন্য জঙ্গলে পৌঁছে যেতে চাও? তেমন ব্যবস্থা আছে কলকাতা শহরের প্রায় গা ঘেঁষেই। চিন্তামণি কর বার্ড স্যাংচুয়ারি। বন্যপ্রাণীদের পাওয়া যাবে না ঠিকই, কিন্তু সবুজের সান্নিধ্যে আর বিভিন্ন প্রজাতির পাখি আর প্রজাপতিদের ওড়াউড়িতে চোখ আর মনের আরাম হবেই।
নরেন্দ্রপুরের এই জায়গাটি আগে পরিচিত ছিল 'কয়ালের বাগান' নামে। এর 'অভয়ারণ্য' স্বীকৃতি প্রাপ্তির নেপথ্যে রয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা, যাঁদের মধ্যে বিশিষ্ট ভাস্কর চিন্তামণি করও ছিলেন। ২০০৫ সালে পাখিরালয়টি তাঁর নামে নামাঙ্কিত করা হয়। বর্তমানে এটি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অধীন।
নাম শুনেছি অনেকদিন আগেই, যাওয়া হয়নি নানা কারণে। গত বড়দিনের সকালে ঠিক করেই ফেললাম, আর দেরি নয়, এবার যাওয়া যাক। ঋদ্ধি আর তার দুই বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে জনাছয়েকের দল পৌঁছে গেলাম পাখিরালয়ের প্রবেশদ্বারের সামনে।
টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকেই মনে হল, বাহ্! রাস্তার পাশেই, অথচ গাড়ির আওয়াজ তেমন আসছে না তো! আসলে আসছে ঠিকই, কিন্তু পাখিরালয়ের মধ্যে ঘন হয়ে থাকা গাছেদের পাতায় বাতাস চলাচলের শব্দ, ঝিঁঝিঁ বা আরও কোনও নাম না জানা পোকার ডাক, নানা ধরনের পাখির কিচিরমিচির, এসবের ভিড়ে যে গাড়ির হট্টগোল কীভাবে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে, বোঝাই যাচ্ছে না।
গেট দিয়ে ঢুকেই রাস্তাটা ভাগ হয়ে গেছে দু'দিকে, কোনও একটা ধরে এগোলেই হল। আমরা এগোলাম বাঁদিকের রাস্তা ধরে। একটু গিয়েই একটা খোলা চত্বর, একটা কুঁড়েঘর, লাগোয়া দাওয়া, ইতিউতি কয়েকটা বড় গাছের গোড়ায় বাঁধানো বেদি। এগোলাম আরও, এরপরেই ঘন বাগানের শুরু। বাগানই, তবে এতই বড়, যে, ছোটখাটো জঙ্গল বলে ভেবে নেওয়া যেতেই পারে!
কয়েক পা এগোতেই নজরে এল মাঝেমধ্যে মাটিতে বাঁধানো গর্ত, তাতে জল রাখা। বুঝলাম পাখিদের জল খাওয়ার জায়গা। গুটিকয়েক কাক আর মুনিয়াকে ঝপাঝপ গা ভিজিয়ে নিতেও দেখা গেল সেখানে। গাছের ছায়ার ফাঁক গলে গায়ে এসে পড়ছিল মিঠে রোদ্দুর, ঋদ্ধি আর তার বন্ধু মিশকা, জুন মহানন্দে দৌড়ে বেড়াচ্ছিল বাগানের পায়ে-চলা পথ ধরে। পাখিদের কলতানে মিশে যাচ্ছিল এদের তিনজনের কলতান!
পায়ে চলা পথ বাগানের মাঝে এঁকেবেঁকে চলেছে নানাদিকে শাখা বিস্তার করতে করতে। আমরাও সেসব পথের হাত ধরে চললাম এদিক-ওদিক। এযাবৎ আমার ধারণা ছিল গাছগাছালি আমি বেশ ভালোই চিনি। সে ধারণা নস্যাৎ হয়ে গেল এখানে এসে। আম, কাঁঠাল, বট, নারকেল, কলা, তেঁতুল, এই কয়েকটি গাছ ছাড়া আর কোনও গাছই চিনে উঠতে পারলাম না। আরও কত যে অজস্র গাছ চারিদিকে ছড়িয়ে আছে! কোনও গাছের গা বেয়ে একসময় বেড়ে উঠেছে অন্য কোনও সদ্যোজাত গাছ, তারপর সে আশ্রয়দাতা গাছকেই দৈর্ঘ্যে এতটা ছাড়িয়ে গেছে যে মূল গাছটিকে আর খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না। কোনও গাছের কাণ্ডকে প্রায় ঢেকে ফেলেছে নানা বিচিত্র আকৃতির ছত্রাক। কোথাও বা আবার আকাশকে ছুঁয়ে ফেলতে চাইছে উচ্চাকাংক্ষী গাছপালারা। এমন সব নিদর্শনের দর্শন পাওয়া সব মিলিয়ে এক বিচিত্র অনুভূতির জন্ম দিচ্ছিল। নীরস ইঁটকাঠের মধ্যে হঠাৎ পাওয়া এই ঐশ্বর্য, তায় আবার কানে কানে ফিসফিস শব্দে কীসব বলে যাওয়া বাতাসের দল, আর কোন গাছের কোন পাতার আড়াল থেকে ভেসে আসা কোকিলের ডাক, এককথায় অভিভূত হয়ে পড়ছিলাম। এতটাই, যে, কোকিলটাকে খুঁজতে খুঁজতে একবার হোঁচট খেয়ে প্রায় পড়েই যাচ্ছিলাম! ঋদ্ধি আর তার বাবাও দেখলাম প্রজাপতি ধরতে গিয়ে বা অচেনা গাছের পাতা দেখতে গিয়ে বারদুয়েক হোঁচট খেলো। হোঁচট যে কেবল নুড়িপাথরেই খাচ্ছিলাম তা নয়, অনেক গাছের শেকড় মাটির নিচে দৈর্ঘ্যবিস্তার করে রাজত্ব বাড়িয়েছে, তারা তো আর জানে না মাটির ওপরে পায়ে চলা পথ, পথের মাটি ফুঁড়ে মাঝেমধ্যে সে শেকড়ের সিকিভাগ উঁকি দিয়েছে। যেই না তুমি অন্যমনস্ক হবে, অমনি, ব্যস, ধপাস!
পাখিরালয়ে রয়েছে নানা প্রজাতির অজস্র পাখিদের বাস। ওখান থেকে পাওয়া একটি তালিকা থেকে মোটামুটি আন্দাজ পাওয়া যায় কত প্রজাতির পাখিদের বাসস্থান এই ক্ষুদ্র অরণ্যটি। আমরা পাখি দেখেছি অনেক, তবে আমার পাখি চেনার দৌড়ও গাছপালা চেনার মতোই, তাই খুব মন দিয়ে খুঁজেও বুলবুল, বেনেবউ, ফিঙে, মুনিয়া, কাঠঠোকরা, কোকিল, বাঁশপাতি, এছাড়া আর পাখি চিনতে পারিনি। তাও বাঁশপাতি পাখির নামটা জেনেছি বাড়ি ফিরে, উইকিপিডিয়ায় খুঁজেটুজে! চুপিচুপি বলে রাখি, আমাদের বাড়ির ছাদ থেকে কাছেই একটা গাছে একজোড়া বাঁশপাতির ঘরকন্না দেখছি আজ বেশ কিছুদিন, এতদিনে জানলাম ওঁদের পরিচয়।
পাখি দেখার জন্য চোখ কান খোলা রাখা আর মনে কিঞ্চিৎ ধৈর্য হলেই চলে, কিন্তু তাদের গতিবিধি ক্যামেরাবন্দি করতে হলে চাই সময় এবং অধ্যবসায় সহকারে নিঃশব্দ অপেক্ষা। আমাদের দলে তিন ক্ষুদে বন্ধু ছিল, তারা আর যাই করুক, নিঃশব্দে অপেক্ষা করার মানুষ নয়। তাই পাখিদের ছবি তোলার ইচ্ছে মনেই রেখে দিয়ে জঙ্গল ঘুরে দেখায় মন দিলাম। তোমরা যদি পাখি দেখবে বলে এখানে যেতে চাও, তবে বাগানে ঢুকে হইচই, দৌড়োদৌড়ি, এসব এক্কেবারে করা যাবে না। চুপটি করে চোখ মেলে কান খাড়া করে পাখিদের গতিবিধি নজর করতে হবে। মনে থাকবে তো? পাখি চেনার জন্য গাইডের সাহায্য নিতে হলে যোগাযোগ কোরো গেটের কাউণ্টারে।
বাগানটি বেশ। কৃত্রিম সৌন্দর্য তেমন নেই, যা আছে, তাতে মানুষের শৈল্পিক চেতনার আভাস নেই, সবটাই প্রকৃতিরই সাজানো। গাছেদের ঘন ভিড়ে একেকটি গাছ চোখে পড়ে, যারা সম্ভবত বিগত আমফানের চিহ্ন বহন করছে। পায়ে চলা পথের শাখা-প্রশাখা মাঝেমাঝেই বাধা পায় পথ জুড়ে শুয়ে থাকা শুকনো গাছের শরীরে, আবার কোথাও বা পথের শেষে হঠাৎই দৃশ্যমান হয় একটা পুকুর আর তার পাড়ের ঢালু জমি। পুকুরের পাড়গুলোয় যদি কোনও বেড়া বা সীমারেখা দেওয়া থাকতো, জায়গাটা ছোট্ট বন্ধুদের জন্য আরেকটু নিরাপদ হতে পারতো।
বাগান, নাকি জঙ্গলের অলিগলিতে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎই আবার এসে পড়লাম সেই কুঁড়েঘরের সামনে। বেদিবাঁধানো গাছের পাশ দিয়ে চলে গেছে আরেকটা রাস্তা, গিয়ে থেমেছে আবার একটা পুকুরের ঢালু পাড়ের কাছে। সেখানে পায়ের নিচে পাতা কৃত্রিম ঘাসের কার্পেট, রাখা আছে একটা বেঞ্চি, একটু দূরে কংক্রিটের একটা গোল ছাউনি। ঘোরাঘুরি করে ক্লান্তি এলে একটু বসে জিরিয়ে নেওয়া যায়, আবার এমনি এমনিই চুপ করে বসে পাখিদের ঘরকন্নার দিকে নজর রাখা যায়। পুকুরের অন্য পাড়েও একইরকম কৃত্রিম ঘাসের কার্পেট আর বেঞ্চ পাতা দেখলাম। এখানেও অবশ্য সেই একই ভয়, ঢালু পুকুরপাড়ে কোনও বেড়া পাঁচিল ইত্যাদি নেই। সজাগ না থাকলে জায়গাটা একটু বিপজ্জনকই বটে!
মন খারাপ হল জনসাধারণের বদভ্যাসের উদাহরণ দেখে। পরিবেশ দূষণ এড়ানোর জন্যই সম্ভবত, পাখিরালয়ের ভেতরে কোনও খাবারের দোকান নেই। সঙ্গে করে আনা বাইরের খাবার অবশ্য খাওয়াই যায়, জঞ্জাল ফেলার জন্য দুটি ডাস্টবিনের ব্যবস্থাও করা আছে। কিন্তু তবুও আমাদের মতোই কিছু মানুষ ওই গোল ছাউনিতে বসে বিশ্রাম নিয়েছেন, প্যাকেটের চিপ্স, ডালমুট ইত্যাদি খেয়েছেন, এবং ফিরে যাওয়ার আগে পরিবেশ রক্ষার কথাটথা ভুলে গিয়ে যত্রতত্র প্লাস্টিকের প্যাকেট ছড়িয়ে ফেলে গেছেন। 'যা ইচ্ছে হয় খাও, খেয়ে জঞ্জাল ডাস্টবিনে ফেলো!' এই ছোট্ট একটা নিয়ম মানতে কি খুব কষ্ট হয়?
এই হল 'চিন্তামণি কর বার্ড স্যাংচুয়ারি'। ফোটোগ্রাফার এবং বার্ড ওয়াচারদের জন্য বেশ লোভনীয় স্থান অবশ্যই। তবে এসব কিছু না হয়ে যদি নিছক প্রকৃতিপ্রেমীই হও, নিরিবিলিতে কয়েক ঘণ্টা কাটিয়ে আসতে চাও, এখানে এসে তোমার ভাল লাগবে।
পাখিরালয়ের ঠিকানাটা এখানে বলে রাখি। কলকাতার কাছে নরেন্দ্রপুরে, রথতলা বাসস্টপের কাছে। গড়িয়া কাজি নজরুল মেট্রো স্টেশনে নেমে নরেন্দ্রপুরের অটোয় উঠে রথতলা স্টপ। ট্রেনে যেতে হলে সোনারপুর বা নরেন্দ্রপুর স্টেশনে নেমে কামালগাজির মোড় হয়ে যাওয়া যাবে। গাড়িতে এলে ইস্টার্ন মেট্রোপলিটন বাইপাস ধরে কামালগাজি ফ্লাইওভার থেকে নেমে সোজা রাস্তা।
পাখিরালয় খোলা থাকে সকাল সাতটা থেকে বিকেল চারটে পর্যন্ত। প্রবেশমূল্য জনপ্রতি একশো কুড়ি টাকা। প্রবেশমূল্য যথেষ্ট বেশির দিকে বলেই মনে হয়েছে, টিকিটের দাম যখন চড়া, তখন পাখিরালয়ের রক্ষণাবেক্ষণের দিকে আরেকটু যত্ন আশা করাই যায়। ভবিষ্যতে তেমনটা দেখতে পাওয়া যাবে, আশা রাখি।
সবশেষে বলে রাখি, কোভিড-আতঙ্কে প্রায় দুই বছর ঘরবন্দি থাকার পর যখন বাড়ির কাছেই এমন এক লোভনীয় স্থানের খোঁজ পেলাম, তখন কি আর সেখানে একদিন গিয়ে আশ মেটে? তাই প্রথমবার যাওয়ার একদিন বাদেই ঋদ্ধির আরও দুই বন্ধু আর তাদের মায়েদের সঙ্গে আবার পৌঁছে গিয়েছিলাম সেখানে, ঋদ্ধি, ঋধিমা আর ঋষাণের হাত ধরে প্রকৃতিপাঠ নিতে, আবার ঘণ্টাদেড়েক কাটিয়ে এসেছিলাম ঐ নির্জনতার মাঝে।
ছবিঃ ধূপছায়া মজুমদার, রঞ্জিতা শীল, সুরজিৎ সিং