বেশ কিছু দিন ধরেই আমার ও বাবার পায়ের তলায় বেড়ানোর জন্য সেই অদম্য সুরসুর, কুরকুর করা শুরু হয়েছে। ফলে আর বিলম্ব না করে ক্যালেন্ডার দেখা শুরু হয়ে গেল। আসলে আমার এই বেড়াই-বেড়াই রোগটা উত্তরাধিকার সূত্রে বাবার থেকেই পাওয়া। কথায় বলেনা, "বাপ কা বেটা, সিপাহিকা ঘোড়া/ কুছ হোগা নেহি তো হোগা থোরা থোরা।" কিন্তু সময় কম অনেক ভেবেচিন্তে মাত্র দুটি দিন ঠিক করা গেলো। এত কম সময়ে তো দূরে যাওয়া যাবেনা, তাই ঘরের কাছেই কোথাও যেতে হবে। এটাসেটা ভাবতে ভাবতে হটাৎ মুকুটমণিপুর নামটা মাথায় এলো। ব্যাস, আর কী! কম্পিউটার খুলে বসে পরলাম গবেষণা করতে।
ভ্রমণে যাওয়ার সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ও মাথা ব্যথার কারণ হল অভিষ্ঠ দিনে ট্রেনের টিকিট পাওয়া ও মাথা গোঁজার জায়গা খুঁজে পাওয়া। অতএব আবার গুগল দেবতার শরণাপন্ন হলাম। গুগল আমাদের নিরাশ করল না। আমাদের অভীষ্ট দিনের রাতের চক্রধরপুরে টিকিটও পেয়ে গেলাম। আমাদের প্রথম দিন ঠিক হয়েছে মুকুটমণিপুর ও বাঁধের চারপাশ ভ্রমণ করব এবং পরের দিন মুকুটমণিপুর কেন্দ্রিক একটু দূরের জায়গাগুলো ঘুরতে যাবো।
গুগল ম্যাপ দেখে বুঝতে পারলাম যে যুব আবাসের থেকে ভালো থাকার জায়গা আর হতে পারে না। মুকুটমণিপুরের ‘যুব আবাস’ বুক করতে গিয়ে বিনা মেঘে ব্রজ্রপাতের মতো পেমেন্ট লিংক বিদ্রোহ করে জানিয়ে দিল যে সে এখন ভেঙে পড়েছে তাই লেনদেন করতে অক্ষম। আমাদের মনের মধ্যে একটা দুশ্চিন্তার বাতাবরণ তৈরি হলেও "বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী" মনোভাব নিয়ে পরের দিন সকাল সকাল হাজির হলাম মৌলালি যুব কেন্দ্রে। এখানে অবশ্য খুব সুন্দর ভাবেই বুকিং সমাপ্ত হতেই আমার ও বাবার মুখে যুদ্ধ জয়ের হাসি। অতএব আর কি এবার যাওয়ার দিনের জন্য অপেক্ষা করা।
নির্দিষ্ট দিনে নির্ধারিত সময়ের থেকে তিরিশ মিনিট দেরিতে আমাদের ট্রেন ছেড়ে পরের দিন ভোররাতে ছোট্ট সুন্দর সাজানো ছাতনা স্টেশনে নামিয়ে দিল। তখনও ভোরের আলো ফোটেনি, আলো ফোটা অবধি অপেক্ষা করব ঠিক করে চা খেতে লেগে পরলাম। একটু পরে একটা গাড়ি ঠিক করে আমরা রওনা দিলাম আমাদের গন্তব্য কাঁসাই ও কুমারী নদীর সম্মিলিত কংসাবতী জলাধারের দিকে, আমরা যাকে মুকুটমণিপুর নামে চিনি। বলাই বাহুল্য রাস্তা একদম মাখনের মত। যাত্রাপথে ছাতনা বাজারে মিনিট দশেকের জন্য পেঁড়ার বিরতি দেওয়া হল। মুকুটমণিপুরে আমাদের বাসস্থান ‘যুব আবাস’ পৌঁছে সামনে সবুজ পাহাড় ঘেরা দিগন্ত বিস্তৃত ঘন নীল জল, পেছনে সবুজ পাহাড়ের ঢাল ও কেয়ারটেকার গেনু বাবুর সাদর অভ্যর্থনায় ‘দিল একদম গার্ডেন গার্ডেন’ হয়ে গেল। মুকুটমণিপুরে পৌঁছে সামগ্রিক উন্নয়ন দেখে খুবই খুশি হলাম। চারদিকে ঝকঝকে রাস্তা, ধারে সুন্দর করে বসানো গাছ, রঙিন নকশা করা বাঁধানো বাঁধ,হকারদের জন্য সুনির্দিষ্ট নবনির্মিত দোকানঘর। পূর্বপরিকল্পনামত সুতান, ঝিলিমিলি-তালবেরিয়া লেক যাওয়ার জন্য গাড়ির খোঁজখবর করতেই দারুণ ভাবে সক্রিয় গেনু বাবু বচ্চনদার বোলেরো পাঠিয়ে দিলেন। মোড়ের কাছে সুপর্ণা হোটেলে গরম গরম লুচি, আলুর দম খেয়ে আর দুপুরে কী খাব বলে দিয়ে এগিয়ে গেলাম আমাদের প্রথম লক্ষ্য তালবেরিয়া লেকের দিকে। প্রত্যন্ত গ্রামের মধ্যে দিয়ে রাস্তা হওয়ার কারনেই ছাগল, মুরগি, গরুর পাল আমাদের পথ রোধ করছে, তাদের সরিয়ে আবার এগিয়ে চলা। ঘণ্টা খানেক এই রকম চলার পর পৌঁছে গেলাম তালবেরিয়া লেকে। অসাধারণ রকমের সুন্দর, পান্না সবুজ জল আর তাতে আশেপাশের টিলাগুলির ছায়া প্রতিফলিত হচ্ছে। লেকের বাঁধ বরাবর সুন্দর রঙবেরঙের বসার জায়গা করে দিয়েছে সরকার থেকে। এখানে বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে আর মন ভরে ক্যামেরা খিছিক খিছিক করার পর পাহাড়ি ঘন জঙ্গল ঘেরা পথ ধরে সুতানের দিকে চললাম। পথে চলতে চলতে চোখে পড়ল যে এটা হাতি যাতায়াতের রাস্তা। রাস্তার ধারে নজরমিনার দেখে দাঁড়িয়ে পড়ে, একটু মিনারে উঠে সবুজ চাদরে গা ঢাকা দিয়ে থাকা ছোট বড় পাহাড়গুলিকে মনের ও গলায় ঝোলানো ক্যামেরাতে বন্দি করে আবার চললাম সুতানের দিকে।
সুতানে পৌঁছে মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। সুতানের অত্যন্ত সুন্দর বন বাংলো রাজনৈতিক লড়াইয়ের শিকার হয়েছিল। তার চিহ্ন এদিক সেদিক তখনও দেখা যাচ্ছে। কিন্তু বাকি জায়গাটা খুবই সুন্দর। সুতান ভ্রমণ সুন্দর ভাবে সমাপ্ত করে আবার ফিরে এলাম মুকুটমণিপুরে। মধ্যাহ্ন ভোজন শেষ করে পড়ন্ত বিকালে একটা নৌকা নিয়ে নৌকা বিহারে বেরিয়ে পড়লাম। বিকালের মিষ্টি রোদ জলে পড়াতে মনে হচ্ছে যেন গলানো সোনা কেউ ঢেলে দিচ্ছে। একে একে আমরা দেখে নিলাম পরেশনাথ পাহাড়ে পরেশনাথ শিব মন্দির, মুসাফিয়ানা পার্ক, বনপুকুরিয়া মৃগদাব। শীতের বিকালে ফিরতে ফিরতে অন্ধকার হয়ে গেল, জল থেকে আলোকিত মুকুটমণিপুর ও পূর্ণিমার চাঁদ দেখতে দেখতে অচিরেই ঘাটে নামিয়ে দিল। সারা সন্ধ্যে যুব আবাসের ছাদে বসে গল্প করে, চাঁদ দেখে কাটিয়ে দিলাম। এর মধ্যে গেনু বাবুর থেকে ভালো খেজুর রসের ঠেকের সন্ধান পাওয়া গেল।
পরের দিন কাকভোরে উঠে গেনু বাবু দেখানো পথে চলে পৌঁছে গেলাম রসের ঠেকে, কিন্তু সে গুড়ে বালি, ঠেক ফাঁকা কেউ নেই। ইতিউতি এদিক ওদিক ঘুরে কাউকে দেখতে না পেয়ে বিফল মনোরথ হয়ে ফিরব ফিরব করছি তখন দেখি দুজন মানুষ সাইকেলে করে জেরিক্যানে চাপিয়ে আসছেন। মনের মধ্যে ক্ষীণ আশা দেখে দাঁড়িয়ে গেলাম, দেখি যে রস আসছে। পুলকিত চিত্তে দাঁড়িয়ে পরে গ্লাসের পর গ্লাস রস খেয়ে আমরা রসাসিক্ত হয়ে গেলাম, এবার আর কত গ্লাস খেলাম তার হিসাব থাকলো না ফুচকা খাওয়ার মতই।
আমাদের পরিকল্পনাই ছিল যে দ্বিতীয় দিনটা শুধু ড্যাম দেখে কাটিয়ে দেব। সেই মত সারাদিনটাই গেনু বাবুর সাথে গল্প করে আর যুব আবাসের ওপরের বারান্দায় বসে বসে জলাধার দেখেই কাটিয়ে দিলাম।
সন্ধ্যা হতেই পর্যটকের ভিড় চলে গেলো চারদিকে এক অপার্থিব নিস্তব্ধতা নেমে এলো। এই নিস্তব্ধতা অনুভব করার জন্য বাঁধের ওপর দিয়ে খানিক হাঁটাহাঁটি করলাম। চারদিকে চাঁদের আলোর বন্যা বয়ে যাচ্ছে, এদিক ওদিক দু একজন স্থানীয় মানুষ জটলা করে গল্প করছেন। খানিকক্ষণ বাঁধের ওপর বসে মনে মনে বললাম আবার আসব এখানে ফিরে।
পরের দিন সকাল ৯ টা নাগাদ মুকুটমণিপুর ও সদাহাস্যময় গেনু বাবুকে বিদায় জানিয়ে ফিরতি পথ ধরলাম।
মুকুট্মণিপুরে তোলা ছবির অ্যালবাম এখানে রইল তোমার জন্য।
কী করে যাবেঃ হাওড়া থেকে চক্রধরপুর ফাস্ট ট্রেনে করে বাঁকুড়া বা ছাতনা নেমে গাড়ি ভাড়া করে যাওয়া যায়। আবার বাঁকুড়া থেকে বাস এ খাতরা সেখান থেকে মুকুটমণিপুরের বাস পাওয়া যাবে।
কোথায় থাকবেঃ আমার মতে সেরা থাকার জায়গা যুব আবাস। অনলাইন কিংবা মৌলালি যুব কেন্দ্র থেকেও বুক করা যাবে।
কোথায় কোথায় ঘুরবেঃ নৌকা করে কুমারী ও কংসাবতী নদীর মিলন স্থল, বনপুকুরিয়া মৃগদাব, পরেশনাথ শিব মন্দির, মুসাফিয়ানা পার্ক। গাড়ি করে ঘুরে দেখতে পার রানিবাঁধ, তালবেরিয়া, সুতান-ঝিলিমিলি। হাতে সময় থাকলে ঘুরে দেখা যাই টেরাকোটা শহর বিষ্ণুপুর ও শুশুনিয়া পাহাড়।