গজেনমামা আমার মায়ের খুড়তুতো ভাই। আর আমার মায়ের খুড়োর সংখ্যা নেহাত কম নয়। ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন তারা – কেউ দেশে , কেউ পরবাসে। কেউ পাড়ি দিয়েছেন এই পৃথিবীর খেলা সাঙ্গ করে; যাঁরা আছেন তাঁদের সাথে যোগসূত্রও ক্রমে ঢিলে হয়ে এসেছে। কিন্তু গজেন মামার ব্যাপার অন্য। তিনি সেই পুরনো সম্বন্ধটিকে কখনো মরচে পরতে দেন নি। নিয়মিত যাতায়াত রেখেছেন তিনি। প্রায় যখন তখন 'বুন' বলে ডাক পেড়ে সদর দরজা পেরিয়ে তাঁর আগমন। যদিও এখন আগের থেকে কমে গিয়েছ, বয়েসজনিত কারণে ।
আমরা সব ওপার বাংলার লোক। দেশভাগের পর একে একে সবাই এদিকে আসেন। কেউ আগে – কেউ পরে, কেউ প্রায় এক কাপড়ে । কেউ হয়ত সামান্য কিছু নিয়ে আসতে পেরেছিলেন । গজেনমামা আসেন সবার শেষে । এবং সেটি সত্তর দশকের কথা। মামা সেই সময়ে কোনরকমে প্রাণটিকে হাতে করে নিয়ে- স্ত্রী পুত্র পরিবার সহ চলে আসেন। তখন তাঁর বেশবাস মলিন , পরিশ্রমের চিহ্ন শরীরে , কিন্তু মুখের হাসিটি অমলিন ।
আমাদের ছেলেবেলার গজেনমামার চুল কাঁচাপাকা । কাঁচা বেশি – পাকা কম। আর সেই চুল সজারুর কাঁটার মতন লম্বা এবং খাড়াখাড়া । ধুতি আর পাঞ্জাবি ছাড়া কোনদিন অন্য কোন পোশাকে দেখি নি তাকে। মুখে পান সর্বদা – কিন্তু লাল নয়। তার জন্যে মা পান সাজলে – তাতে খয়ের বাদ পড়ত। সামনের একটা দাঁত অর্ধেকের বেশি ভাঙ্গা। কী করে হল – প্রশ্ন করলে – শুরু হত এক গল্প। এক দুর্ঘটনার পরিণতি দাঁত হারানো। সেটি ঘটেছিল নাকি ওয়ার টাইম এ। গজেন মামার ভাষায় । তিনি নাকি যশোর থেকে বগুড়া যাচ্ছিলেন ট্রাক ভর্তি মাল নিয়ে। পেট্রোল ডিজেল অমিল। কেরোসিন পুরেই নাকি যাত্রা । আর সেখানেই ব্রেক ফেল করে – পরিণতি হাতভাঙ্গা, আর একটা দাঁত । তার এই গল্প – আমরা ভাবতাম ছেলেবেলায় ডাহা গুল। কেরোসিনে তো ল্যাম্প জ্বলে , বা স্টোভে রান্না হয়। একটু আধটু প্রতিবাদ করলে বলতেন- "টেরাকে কেরসিন ঢাইল্যা দাও, দ্যাক ক্যামনই চালাই।" পরে জেনেছি এই ব্যাপারটা 'ওয়ার টাইম' বাস্তবতা।
গজেন মামার পোশাকি নাম জাঁদরেল – গজেন্দ্র মোহন বসু। ওদেশে তিনি নাকি বড় ব্যাবসা করতেন। তিন চারটে ট্রাক তাঁর নামে – যার একটা ভাঙ্গা দাঁতের সাথে জড়িয়ে । এদেশে এসে – যখন তিনি তাঁর যৌবনের অস্তগামী দিনগুলিতে খুব বেশি কিছু করতে পারেন নি, মফস্বল শহরে এটা সেটা করে তিনি শেষমেশ একটা কাপড়ের দোকান দিয়েছিলেন । আর সেই দোকানের মাল কিনতে ঢুঁ মারতেন- হাওড়া হাটে , বড়বাজারের গদিতে – মঙ্গলা হাটে ।
মাঝে সাঝে – গজেন মামার মেজ ছেলে জীবন, আমার থেকে বেশ খানিকটা বড় – আসত । আসলে পরেই মাথায় গাঁট্টা মেরে বলত – চল । সেদিন গজেন মামার গল্প শোনা হত না। জীবন কখন পাশের মাঠে অথবা অধিকাংশ সময় ছাদে গিয়ে গল্প জুড়ত । তার এক ভয়ানক অভ্যাস – যা কাউকে বলাও যেতও না – ছাদের আলসের উপরে বসে উল্টোদিকে পা ঝুলিয়ে বসা। কী করে ওইভাবে অবলীলায় বসে চীনাবাদাম চিবোত , তা আজও মাথায় ঢোকে না । ছাদ তিনতলার – পড়লে হাড়গোড় আস্ত না থাকার সম্ভবানার সম্বন্ধে কোন সংশয়ের অবকাশ নেই।
জীবনের গল্পর সিংহভাগ ছিল হিন্দি সিনেমার। আমাদের কাছে তখন হিন্দি সিনেমা দেখা মানে 'পাপ' । সেখানে জীবন সেই বয়েসেই অনেক 'বই' দেখে ফেলেছে । রসিয়ে রসিয়ে অনেক গপ্প শোনাত – 'কালিয়া'র সেই কুকুর তারা করার সিন, কিংবা 'বারনিং ট্রেন' এর কাহিনী – সব জীবনের জবানিতেই শোনা । সেই সব শুনতাম – আর ভাবতাম আহা আমি যদি জীবন হতাম।
এক ডিসেম্বর মাসে- অ্যানুয়াল পরীক্ষা সবে শেষ হয়েছে । প্রায় দেড় মাসের লম্বা পড়াশুনোহীন সময় সামনে। একদিন সেই না বলে কয়েই গজেন মামা এলেন। এবং উদেশ্য বিহীন ভাগ্নেকে দেখে পেড়েই ফেললেন কথাটা বুনের কাছে … যার সোজা মর্ম হল – ‘ তোর পোলাটারে দু-তিন দিনের জন্যে লয়্যা যাই” । মা নারাজ। গজেন মামাও ছাড়বার পাত্র নন। আর আমার চোখে ভাসছে জীবন আর হিন্দি সিনেমা। পরিত্রাতা হয়ে দেখা দিলেন বাবা। ‘যাক না দু-তিন দিনের জন্যে’ – সেই আশ্বাসে আমার সেই একা প্রথম বেরানো ।
শিয়ালদহ থেকে বিকাল বিকাল গাড়ি চাপা । মাঝে বারাসাতে ট্রেন পাল্টে যখন মামার বাড়ির কাছের স্টেশনে নামলাম তখন চারিদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার। জোনাকি ঘুরে বেড়ায় আসে পাশে। ইলেক্ট্রিসিটি আছে কি নেই বোঝা দায়। স্টেশনের পাশের দোকানে হারিকেনের আলোয় কিছুটা যা দেখা যায়। আরও একটা জিনিস টের পেলাম। গ্রাম বাংলার শীত – ঠাণ্ডাটা বেশ জাঁকিয়ে মাথার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল যেন।
কলকাতায় যেন শীতের সকালে ঘুম ভাঙতে চায় না। এখানে সেই ঘুম ভেঙ্গে গেল – বেশ ভোরেই । সেই প্রথম বাবা -মা কে ছেড়ে রাতে থাকা। রাতের বেলায় মামার ঘর দুটি ছাড়া কিছুই দেখা হয় নি। আলো থাকলেও বাতি গুলো কেমন যেন নিস্তেজ। ভোল্টেজ বোধ হয় কম থাকে। মামীও সাত তাড়াতাড়ি খাইয়ে দিলেন। তাই সকালে উঠে চারদিক একবার চক্কর মেরে এলাম। পাতলা কুয়াশায় ঢাকা চারিদিক – ক্যাঁচর ক্যাঁচর শব্দ করে গরুর গাড়ি চলেছে একের পর এক – বিচুলি বোঝাই করে।
দিনটা হাটবার ছিল মনে হয়। বেশ বেলা করেই কুয়াশা কাটল । ঝলমলে রোদ উঠলো – আমাকেও নতুন জায়গা দেখানোর জন্যে বড়োদাদা সাইকেল করে একপাক ঘুরিয়ে নিয়ে এলেন।
অবশ্য আগেই রাতের বেলায় জীবনের সাথে কথা হয়ে গিয়েছে – 'দশ নম্বরি'। আমাদের টার্গেট । জীবনকে বললাম – আমার কাছে ভাই কিন্তু কোন পয়সা নেই। গজেন মামা স্রেফ বগলদাবা করে আমাকে নিয়ে এসেছেন । জীবনের উত্তর – কয়ি বাত নেহি । ফূর্তিতে থাকলে জীবন হিন্দি বলত। কাল দুপুরে হবে – আমাদের অভিযান ।
দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষে মামী আর দুই দিদি যখন বারান্দায় রোদের ফাঁকে একটু গড়িয়ে নেবে বলে চোখ বন্ধ করেছে, সেই সুযোগে আমি জীবনের হাত ধরে সোজা বাড়ির বাইরে। তখন বাজে দুটো । সকালে দাদার সাথে সাইকেলে যেতে যেতে দেখেছি – দশ নম্বরি – মলিনা – ১-৪-৭ । দুটোর সময় কোথায় চলেছি আমরা।
জীবন রাস্তা ধরল না। ভিতরের না-পথ দিয়ে, কখন কারোর উঠোনের মধ্যে দিয়ে, কখন বা পুকুরের পাশ ঘেঁসে, আমরা চললাম । বলা বাহুল্যও যে জীবনের হাঁটার গতির সাথে তাল রাখতে হিমসিম খেয়ে ফেলেছি। মাঝে মাঝে আবার ছোট খাটো খানা খন্দ জাম্প মেরে পার হওয়াও আছে।
মোটামুটি মিনিট পনেরো এই রকম চলার পর – একটা বড় রাস্তায় এসে পরলাম। সাট করে জীবন একটা রাস্তার পাশের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে পরল। ভাবলাম লজেন্সের জন্যে বুঝি। কিনল দুটো সিগারেট । আর এক ডিব্বা নস্যি। আমি এতক্ষণ মুখে কোন কথা বলি নি । এবার শুধলাম – তুমি সিগারেট খাও নাকি। ইশারায় চুপ করতে বলে সিগারেট টা বুক পকেটে – আর নস্যির ডিব্বা নিজের প্যান্টের পকেটে চালান করে দিল।
জীবনের কীর্তিকলাপ তখন মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছে । মনে হল দুটো সিগারেট কিনল কেন। আমাকেও কি একটা সিগারেট খেতে জোর করবে। তার কীর্তি যে আরও বাকি ছিল – সে তখনও পুরোটা বোঝা হয় নি। আমরা যখন সিনেমা হলের সামনে গেলাম – বলা ভাল পিছনে গেলাম তখন আশে পাশে কেউ নেই। একটা ছোট দরজা সামনে – সেখানে গিয়ে জীবন মিহি গলায় ডাকল,'ও শিলটু দা ' ।
মহামান্য শিলটু দা জীবনের পাড়াতুতো দাদা। মলিনা সিনেমা হলের লাইট ম্যান । জীবনের সিনেমা দেখার পাসপোর্ট তিনি । দাদার বরাদ্দ দুটি জিনিস – পকেট থেকে বেরিয়ে দাদার পকেটে । দাদা আমদের ভিতরের গন্ধ মাখা স্যাঁতস্যাঁতে এক জায়গা দিয়ে নিয়ে গেলেন এক চোরা কুঠুরিতে । জমাট অন্ধকার। একটা নড়বড়ে বেঞ্চ পাতা। জীবন বলল- বস। সামনে তখন মনোজ কুমার।
চারটের পরে যখন বেরলাম – তখন মাথার ভিতরে ঘুরছে – খালি 'দশ নম্বরি' । জীবন-শিস্ দিতে দিতে গাইছে ---"... ম্যায় হু দশ নম্বরি …” । আলো হাল্কা হয়ে এসেছে । ভাবছি আবার খানা খন্দ দিয়ে যেতে হবে। জীবন অবশ্য সোজা রাস্তাই ধরল। জীবনকে বললাম –" ঠিক বুঝা গেল না- বইয়ের প্রথম দিকটা দেখা হল না।" জীবন বলল – "পরশু আসা যাবেখন। আর না দেখলেও কিছু যায় আসে না। হিন্দি বইয়ের যেখান থেকে দেখবি – সেটাই স্টার্ট ।"
সে যাত্রা 'দশ নম্বরি'-এর প্রথম ভাগ দেখা হয় নি। দু দিনের মাথায় বাবার আগমন। মা'র নাকি চিন্তায় ঘুম হয় নি দু দিন। অগত্যা দশ নাম্বারের – প্রথম তিন চার নম্বর অদেখাই রয়ে গেল।
জীবন এখন বাংলা সিরিয়াল – মেগা সিরিয়ালের এপিসোড ডিরেক্টর । ওর কথা গুলো এখনও কানে বাজে – যেখান থেকে দেখবি – সেটাই স্টার্ট ।
গ্রাফিকঃ মিতিল