অনেকদিন আগের কথা। তখনও কুকুরেরা মানুষের পোষ মানেনি। তারা বনজঙ্গলে থাকত আর দল বেঁধে শিকার করে খেত। এক দিন এরকমই এক হিংস্র বুনো কুকুরের পাল একটা সিংহকে দেখতে পেয়ে তাড়া করল। সিংহ যতই দৌড়ে পালায়, এরাও ততই পিছু পিছু তাড়া করে ছোটে। ঝোপঝাড় বনজঙ্গল পাহাড়-পর্বত খানা-খন্দ পেরিয়ে সিংহ ছুটে চলল, তবু কুকুরেরা তার পিছু ছাড়ে না। ছুটতে ছুটতে শেষটায় সিংহ এতই ক্লান্ত হয়ে পড়ল যে তার শরীরে আর এতটুকুও শক্তি অবশিষ্ট রইল না। এমন সময় হঠাৎ সে দেখতে পেল, জঙ্গলের মধ্যে এক বিরাট বটগাছের তলায় একটা মানুষ বসে আছে। নিরুপায় হয়ে মানুষটার কাছে গিয়ে সে কাতর প্রার্থনা জানাল, "ওহে ভালোমানুষের পো, আমায় বাঁচাও! বুনো কুকুরের পালে আমায় তাড়া করেছে। বহুক্ষণ ধরে ছুটছি, আর পারছি না।”
মানুষটা সঙ্গে সঙ্গে সিংহকে বলল, "শিগগির এই গাছটার পেছনে লুকিয়ে পড়ো।”
কথামতো সিংহ চটপট বটগাছটার পেছনে লুকিয়ে পড়ল।
একটু পরেই ধেয়ে এল সেই বুনো কুকুরের দঙ্গল। মানুষটাকে বটগাছের তলায় বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করল তারা, "ওগো ভালোমানুষের পো, এ পথে একটা সিংহকে ছুটে যেতে দেখেছ?”
"সিংহ!” অবাক হয়ে বলল মানুষটি, "সিংহ দেখলে আমি এখনও নিশ্চিন্তে বসে থাকি এখানে?”
"দেখোনি? এ দিকেই তো দৌড়ে এল সিংহটা!”
"কী জানি! এসে থাকবে! আমি এতক্ষণ চোখ বুজে ধ্যান করছিলাম কিনা, তাই দেখিনি কিছু।”
"শব্দও শোনোনি কোনও?” সন্দেহের সুরে জিজ্ঞেস করল কুকুরের দল।
"শব্দ একটা কানে এসেছিল বটে!” সতর্ক হয়ে বলল মানুষ, "ধুপ ধাপ ধুপ ধাপ দৌড়ে যাওয়ার শব্দ। সে শব্দ তো ওই দূরে পাহাড়ের দিকে মিলিয়ে গেল।”
"আচ্ছা, ধন্যবাদ,” এই বলে কুকুরের পাল মানুষটার দেখিয়ে দেওয়া পাহাড়ের দিকে ছুট দিল।
কুকুরগুলো চলে যেতেই সিংহ হেলতে দুলতে বীরের মতো বটগাছের পেছন থেকে বেরিয়ে এল, আর এসেই চড়াও হল মানুষটার ওপর, লাফ দিয়ে তার ওপর পড়ে থাবার নিচে চেপে ধরল তাকে।
"আরে আরে, করছটা কী!” আর্তনাদ করে উঠল মানুষটি।
"করব আবার কী? তোমায় এবার খাব আমি,” বলল সিংহ।
"তার মানে? তোমার প্রাণ বাঁচালাম আমি, আর তুমি কিনা আমাকেই খাবে?”
"হ্যাঁ, নিশ্চয়ই খাব।”
"কুকুরের পালকে কায়দা করে ওই পাহাড়ের দিকে পাঠিয়ে দিলাম তাই, নইলে তো এতক্ষণে হয়ে গেছিল তোমার!”
"সে তো দেখলাম। ধন্যবাদ আমার প্রাণ বাঁচানোর জন্য। বেশ দয়ালু তুমি। এখন দয়া করে আরেকটিবার আমার প্রাণ বাঁচাতে আজ্ঞা হোক!”
"কীরকম?”
"আমার যে খুব খিদে পেয়েছে! এতক্ষণ ছুটে ছুটে ভয়ানক ক্লান্তও হয়ে পড়েছি, অন্য শিকার ধরে খাবার ক্ষমতা নেই। এক্ষুনি কিছু না খেলে তো আমি বাঁচব না!”
"তাই বলে আমাকেই খেতে হবে? ছাড়ো শিগগির। কৃতজ্ঞতা বলে কি কিছু নেই তোমার? একবার তো তোমায় বাঁচালাম আমি,” কাতর স্বরে বলল মানুষটি।
"আবার বাঁচাবে,” বলল সিংহ, "তখন লুকোতে দিয়ে বাঁচিয়েছিলে, এখন খেতে দিয়ে বাঁচাবে। সহজ ব্যাপার।”
এমন সময় সেখানে এসে হাজির হল একটা খরগোশ। বলল, "ব্যাপারটা কী? এত চ্যাঁচামেচি কীসের? কী নিয়ে এত ঝগড়া তোমাদের শুনি!”
মানুষটি তাকে আদ্যোপান্ত সমস্ত ঘটনা খুলে বলল।
শুনে খরগোশ বলল, "ওহ! এই সমস্যা! এ তো আমি এক্ষুনি সমাধান করে দিতে পারি। কিন্তু, তার আগে একটা কাজ করতে হবে।”
সিংহ আর মানুষ দু'জনেই একসঙ্গে বলে উঠল, "কী কাজ?”
"একটা পলাণ্ডু লাগবে আমার। ভালোমানুষের পো, যাও দেখি, শিগগির মাটির নিচ থেকে একটা পলাণ্ডু তুলে নিয়ে এসো তো আমার জন্য।”
সিংহ সরে দাঁড়াল মানুষের বুকের ওপর থেকে। ছাড়া পেয়ে মানুষটি গেল পলাণ্ডু খুঁজে আনতে।
এখন, পলাণ্ডু মানে যে পেঁয়াজ তা লোকটা জানত না মোটেই। সে ভাবতে লাগল, পলাণ্ডু!! সেটা আবার কী বস্তু! মাটির নিচ থেকে তুলে আনতে বলল যখন নিশ্চয়ই কচু-ঘেঁচু কিছু হবে। এই ভেবে সে একটা কচু তুলে নিয়ে ফিরে চলল বটগাছের কাছে। তাছাড়া সেই জঙ্গলের মধ্যে পেঁয়াজ সে পাবেই বা কোথায়! পেঁয়াজ-খেত তো জঙ্গল ছাড়িয়ে গ্রামের ভেতর।
তা সেই কচু দেখে খরগোশ বলল, "দুত্তোর, বললাম পলাণ্ডু, তুলে আনলে কচু! তোমার দ্বারা কিস্যু হবে না। বেশ, এক কাজ করো। শিগগির আমার জন্য 'য-পলায়তি-স-জীবতি' গাছের একটা ফল পেড়ে নিয়ে এসো। তাহলেই আমি তোমাদের এই সামান্য সমস্যার সমাধান করে দেব।”
লোকটি ফের চলল ফল খুঁজে আনতে। যেতে যেতে ভাবতে লাগল, 'য-পলায়তি-স-জীবতি'! সে আবার কেমনধারা গাছ? সাতজন্মে নাম শুনিনি। তার আবার ফল! তার চেয়ে ওই তো একটা আম গাছ দেখছি, কলামিঠে আম, ভারী মিষ্টি। একটা আমই না হয় পেড়ে নিয়ে যাই, খরগোশ খুশি হবে খুব।
সেইমতো গাছের নিচের এক ডাল থেকে একটা আম পেড়ে নিয়ে ফিরে এল লোকটি, "এই নাও খরগোশ ভায়া, একটা কলামিঠে আম পেড়ে এনেছি তোমার জন্য। খেয়ে দেখ, দারুণ মিষ্টি, রসে একেবারে টইটুম্বুর।”
সেই আম দেখে খরগোশ খুশি হবে কী, তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল একেবারে, "দূর পাগল, আম তোমায় কে আনতে বলেছে? বললাম এক, আর বুঝলে আরেক! যাক গে, এই আম দিয়ে হবে না। যাও, এক্ষুনি 'শীঘ্রভাগো আর্ফিরোনা' গাছের একটা ডাল ভেঙে নিয়ে এসো। আমার কি কাজকম্ম নেই? এক মিনিটের মামলা, তার জন্য বসে আছি কতক্ষণ! এদিকে বেলা বয়ে গেল। দাঁড়িয়ে দেখছটা কী হাঁ করে, জলদি যাও। মনে থাকে যেন, 'শীঘ্রভাগো আর্ফিরোনা' গাছের ডাল।”
সিংহও তালে তাল মিলিয়ে বলল, "হ্যাঁ হ্যাঁ, তাড়াতাড়ি যাও। খিদেয় মরে গেলুম এদিকে।”
মানুষটি আর কী করে! আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতে ফের চলল ডাল খুঁজতে। 'শীঘ্রভাগো আর্ফিরোনা'! সে কেমন গাছ? স্কুলের বইতে কি পড়েছি এমন কোনও গাছের নাম? কী জানি, মনে তো পড়ে না! নিশ্চয়ই কোনও গাছের বৈজ্ঞানিক নাম-টাম হবে। এমন সময় তার চোখে পড়ল সামনেই মাটিতে বাবলা গাছের একটা ছোটো ডাল পড়ে আছে।
'দুত্তোর! কে অত খুঁজতে যাবে! ওদিকে খরগোশ ভায়া আর সিংহ দু'জনেই যে অস্থির হয়ে উঠেছে!' এই ভেবে সেই বাবলা গাছের ডালটা নিয়েই সে ফিরে এল বটতলায়, "দেখো তো খরগোশ ভায়া, চলবে এতে?”
খরগোশ হতাশ হয়ে বলল, "সত্যি! তোমায় নিয়ে আর পারা গেল না!” মনে মনে ভাবল, লোকটা যেমন মূর্খ তেমনি বোকা, তবে সৎ আছে, আর দয়ালুও বটে। সিংহের প্রাণ বাঁচিয়েছে। এর প্রাণ বাঁচানো আমার কর্তব্য। নইলে ব্যাটা বেঘোরে সিংহের পেটে যাবে, সেটা মোটেই উচিত হবে না।
প্রচণ্ড রাগ দেখিয়ে লোম-টোম ফুলিয়ে চোখ লাল করে সে বলল, "এই তোমার বুদ্ধি! এটা 'শীঘ্রভাগো আর্ফিরোনা' গাছের ডাল? বাবলা গাছের ডাল আমি চিনি না ভেবেছো? জঙ্গলে জঙ্গলে ঘোরো আর গাছ চেনো না এখনও! চলো দেখি আমার সঙ্গে।”
তারপর সিংহর দিকে ফিরে বলল, "সিংহ ভায়া, তুমি দু'মিনিট সবুর করো তো। এ লোকটা একেবারে গন্ডমূর্খ! যা বলি কিছুই বোঝে না। ওর একার দ্বারা হবে না কিছু, সঙ্গে যেতে হবে আমায়। ঠিকঠাক জিনিস না পেলে মিটবে না সমস্যাটা। তুমি বোসো, নোড়ো না এখান থেকে। আমরা যাব আর আসব। একটা পলাণ্ডু কিংবা 'য-পলায়তি-স-জীবতি' গাছের ফল অথবা 'শীঘ্রভাগো আর্ফিরোনা' গাছের ডাল – যেটা সামনে পাবো নিয়েই ফিরে আসছি এখানে।”
সিংহ বলল, "বেশ যাও! আমিও তোমাদের সঙ্গে যেতাম, সবাই মিলে বেশ একসঙ্গে খোঁজাখুঁজি করা যেত, কিন্তু আমার ঘুম পাচ্ছে খুব, বড়ো ক্লান্ত। এখানেই বসছি আমি। জলদি ফিরো কিন্তু!”
অতঃপর খরগোশ মানুষটার দিকে চেয়ে বলল, "এসো দেখি আমার সঙ্গে, দেখাচ্ছি তোমায় 'য-পলায়তি-স-জীবতি' কাকে বলে।”
তারা যে সেই গেল তো গেলই। আর ফেরে কখনও?
(বোৎসোয়ানা-র একটি লোককথা অবলম্বনে)
ছবিঃ অনন্যা দত্ত দাস