সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
   ময়ূরপুচ্ছ বেড়াল

পিকুদের পোষা বেড়াল পুষিটা খুব পাজি। সারাক্ষণ বাড়ির পেছনের বাগানে পাখি ধরার মতলবে ঘোরে। তবে পাখিরা তাকে বিলক্ষণ চেনে, তাই দেখলেই উড়ে পালায়। পুষি যেখানেই লুকিয়ে থাকুক না, পাখিরা ঠিক বুঝতে পেরে যায়। টুনটুনি পাখিটা তাকে সবার আগে দেখতে পায়। এমনকি ঘন ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে থাকলেও ঠিক টের পেয়ে যায়, আর সঙ্গে সঙ্গে রিনরিনে গলায় চিৎকার করে ওঠে –

'খুব হুঁশিয়ার বন্ধুসব
ঝোপের আড়ালে
লুকোয় বেড়ালে
নিশ্চয়ই আছে কুমতলব!'

...আর সেই হুঁশিয়ারি শোনামাত্র বাগানের ঘাসজমিতে শস্যদানা বা পোকা খুঁজতে আসা সমস্ত পাখিরা একসঙ্গে আকাশে উড়ে ওঠে। পুষি তখন ব্যাজারমুখে ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে আকাশের দিকে চেয়ে একটা মস্ত হাই তোলে আর দেখে ছোট্ট টুনটুনি পাখিটা কামিনী ফুলগাছের ডালে বসে ঘাড় কাত করে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
    
পুষির থাবাগুলো খুব নরম তুলতুলে। হাঁটাচলার সময় টুঁ শব্দটিও হয় না। কিন্তু যতই সন্তর্পণে সে বাগানে আসুক না, পাখিরা সবসময় জানতে পেরে যায়, আর নিজেদের মধ্যে কিচিরমিচির শুরু করে – 'ওই একটা বেড়াল আসছে, সাবধান!!'
    
পাড়ার অন্য বেড়ালেরা পুষির সঙ্গে মশকরা করে, "ওরে বোকা, পাখি ধরা কি অতই সোজা? থাক না ওরা নিজের মতন, তোর তো কোনও ক্ষতি করছে না! বাড়িতে কি খেতে পাস না নাকি?"
    
কিন্তু কথায় বলে স্বভাব যায় না ম'লে? পুষি তাই চুপ করে বসে বসে মতলব ভাঁজে কী করে একটা পাখি ধরবে।
    
পিকুর একটা খুব সুন্দর টুপি ছিল, পাখির পালকের তৈরি, হলদে সবুজ পাখির পালক, সামনে আবার তিনটে ময়ূরপালক লাগানো। পিকুর জেঠু মণিপুর না নাগাল্যান্ড কোথা থেকে যেন পিকুর জন্য নিয়ে এসেছিলেন। পিকুর খুব প্রিয় ছিল টুপিটা। মাঝেমধ্যেই সেটা মাথায় চাপিয়ে সে বাড়ির ভেতর ঘোরাঘুরি করত।
    
একদিন পিকু যখন স্কুলে গেছে তখন তার ছড়ানো খেলনাপাতির মধ্যে টুপিটাকে দেখতে পেল পুষি। দেখেই তার মাথায় একটা দুর্দান্ত বুদ্ধি গজাল, 'আরে! এই টুপিটা থেকে কয়েকটা পালক ছিঁড়ে যদি আমার ল্যাজে বাঁধি তো কেমন হয়? তারপর বাগানের মাঝখানে শুয়ে ল্যাজটা উলটিয়ে পিঠের ওপর রাখলে শরীরটা ঢাকা পড়ে যাবে আর আমায় ঠিক একটা পাখির মতো দেখাবে!'
    
যতই ভাবে ততই পুষির মনে হয়... উফ্ফ্, সাংঘাতিক এক ফন্দি এঁটেছি বটে! অতএব সে টুপিটা থেকে আটটা রঙচঙে পালক ছিঁড়ে নিয়ে বাগানের দিকে দৌড় দিল। তারপর মালির ঘর থেকে একটা সুতোর গুলি চুরি করে পালকগুলো নিজের ল্যাজ বরাবর সুন্দর করে সুতো দিয়ে বেঁধে ফেলল। উফ, পুষিকে তখন যা বিচিত্র দেখাচ্ছিল না, কী বলব!
    
এইবারে পুষি তার লম্বা পালকের ল্যাজ নিয়ে বাগানে নামল, একেবারে মধ্যিখানে গুঁড়ি মেরে বসে রঙবেরঙের ল্যাজটা উলটিয়ে পিঠের ওপর ফেলে শরীরটা ঢেকে ফেলল যাতে ঠিক তাকে একটা পাখির মতো দেখায়। চুপটি করে তেমনিভাবে বসে রইল সে।
    
একটু পরেই টুনটুনি পাখিটা উড়ে এসে বাগানের বেড়ার ওপর বসল। ঘাড় কাত করে কিছুক্ষণ পুষিকে জরিপ করে কিচিরমিচির করে উঠল, "আরে দেখ দেখ, এটা আবার কোন পাখি! আগে তো দেখিনি কখনও! ময়ূর না মাছরাঙা? নাঃ, তাও তো নয়! তাহলে?"
    
টুনটুনির ডাকে অন্য পাখিরা উড়ে এসে বাগানে নামল। তারাও কিছুতেই দেখে উদ্ধার করতে পারল না এই রঙচঙে পালকের পুঁটলিটা কী বস্তু! এ নিশ্চয়ই নতুন কোনও পাখি হবে! তিড়িং তিড়িং লাফাতে লাফাতে আরেকটু কাছে এল তারা। চড়ুইপাখিগুলো এদিকওদিক ঘাড় বাঁকিয়ে অনেকক্ষণ পর্যবেক্ষণ করল। কিম্ভূত পাখিটা কিন্তু একটুও নড়াচড়া করছে না! আশ্চর্য!!
    
ছাতারে পাখিরা সবাই মিলে কিচকিচ করে বলল, "অত গবেষণা করে কী হবে? সোজা সামনে গিয়ে জিগ্যেস করলেই তো হয়, তুমি কোনদেশী পাখি ভাই? আমরা তো বাপু সাতজন্মে এরকম পাখি দেখিনি!"
    
পুষি খুব খুশি হল। এতদিনে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ আসতে চলেছে! আসুক না কাছে বাছাধনেরা, একলাফে আজ একেবারে পাঁচ-ছ'টা পাখি ধরে ফেলবে পুষি।

এমনসময় বাগানের বেড়ার ওপর উদয় হল পাশের বাড়ির হুলোটা। প্রথমেই তার চোখ পড়ল বাগানের ঠিক মধ্যিখানে অদ্ভুত পালকের পুঁটলিটার ওপর। খুব আশ্চর্য হল সে, তাই ভালো করে দেখার জন্য লাফিয়ে বাগানে নেমে পুষির দিকে এগিয়ে এল।

সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত পাখিরা জমি ছেড়ে উড়াল দিল। টুনটুনি তার রিনরিনে গলায় চিৎকার করে উঠল – 'সব্বাই খুব সাবধানে, বেড়াল এল বাগানে।'

   ময়ূরপুচ্ছ বেড়াল

পুষি তার মাথা ঢেকে রাখা পালকের ল্যাজের ফাঁক দিয়ে দেখতে পেল হুলোকে। কী আপদ! হুলোর জন্যই পাখিগুলো সব উড়ে পালাল তবে! সে ভাবল, 'ঠিক আছে, আমি যদি নড়াচড়া না করে চুপ করে বসে থাকি, নিশ্চয়ই হুলো চলে যাবে। তখন পাখিরা ফের আসবে কাছে।'

সুতরাং পুষি একদম নট-নড়নচড়ন হয়ে চুপটি করে বসে রইল, তার ল্যাজে বাঁধা পালকগুলো শুধু হাওয়ায় অল্প অল্প নড়তে লাগল।

হুলো কাছে বসে খুব খানিক মন দিয়ে দেখল, কিন্তু কিছুতেই বুঝে উঠতে পারল না এটা ঠিক কোন ধরণের পাখি। সে বাগানের অন্য পাশের বাড়ির বেড়াল পুঁটির উদ্দেশে ডাক ছাড়ল, "পুঁটি, তুমি আর তোমার দুই ছানাছেনি ট্যাপা আর টেপি মিলে একবার বাগানে এসো তো দেখি। দেখে যাও কী অদ্ভুত একটা জিনিস!"

পুঁটি তার ছেলেমেয়ে ট্যাপা-টেপিকে নিয়ে হাজির হল বাগানে। চারটে বেড়াল সেই অল্প অল্প নড়তে থাকা পালকের পুঁটুলিটার চারদিকে ঘিরে বসে তুমুল গবেষণা শুরু করল।

"এরকম পাখি দেখেছ আগে তোমরা?" জিগ্যেস করল হুলো।
"এর তো কোনও মাথাই নেই দেখছি!" বলল ট্যাপা।
"হ্যাঁ, পুরোটাই ল্যাজ!" টেপি ঘাড় নাড়ল।
পুঁটি সাবধানি গলায় বলল, "পাখিই যদি হবে তবে আমাদের দেখে একটুও ভয় পাচ্ছে না কেন? উড়ে পালাচ্ছে না যে বড়ো!"
হুলো গম্ভীরভাবে বলল, "হুম, আরেকটু কাছে গেলে মনে হয় উড়ে পালাবে!"
ট্যাপা ফিসফিস করে বলল, "সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়ে পাখিটা ধরলে কেমন হয়? নড়ছে না তো একটুও, মনে হয় ঘুমোচ্ছে! একবার চেষ্টা করা যেতে পারে!"
"ঠিক বলেছিস," বলল হুলো, "চলো সবাই, আমি তিন গোনার সঙ্গে সঙ্গে ওটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ি... এক – দুই – তিন!"

চারটে বেড়াল মিলে একসঙ্গে লাফিয়ে পড়ল বেচারি পুষির ওপর। পুষি এটা আন্দাজই করতে পারেনি। স্বজাতির চার বন্ধু যে ওকে আক্রমণ করে বসবে সেটা সে আন্দাজ করবে কীভাবে? সে তো আর সত্যি সত্যি পাখি নয়! ওদিকে চার বেড়াল মিলে তখন তাকে আঁচড়ে কামড়ে অস্থির করে তুলেছে। ট্যাপা একটা কান কামড়ে ধরেছে, টেপি পিঠের ওপর চড়ে খামচাচ্ছে!
    
"ওরে ছাড় ছাড়, হতচ্ছাড়ার গুষ্টি!" ক্যাঁওম্যাঁও করে চিৎকার করে উঠল পুষি, হাত-পা ছুঁড়ে প্রাণপণে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু জাঁদরেল এক পাখি শিকারের উত্তেজনায় চার বেড়াল তখন এতই আত্মহারা যে পুষির আর্তনাদ তাদের কানেই ঢুকল না, যথেচ্ছ আঁচড় কামড় চলতে থাকল। পুষির ল্যাজ থেকে খসে পড়ে পাখির পালকগুলো বাগানময় উড়ে বেড়াতে লাগল।

"থাম, থাম, ওরে আমি পাখি নই, আমি তোদের পুষি," আর্তনাদ করে ওঠে পুষি, "ছাড়, ওরে ছেড়ে দে আমায়।"
বিস্ময়ে হতবাক হয়ে হুলো, পুঁটি, ট্যাপা, টেপি একলাফে চার হাত পিছিয়ে যায়।

"হা ভগবান!! এ যে আমাদের পুষি!" হুলো বলে।
"তুমি ওরকম কিম্ভূতকিমাকার ছদ্মবেশ নিয়েছিলে কেন?" টেপি বলে।
"এটা নিশ্চয়ই নতুন কোনও খেলা হবে, তাই না? গো অ্যাজ ইউ লাইক-এর মতো?" ট্যাপার সিদ্ধান্ত, "কিন্তু খামোখা ওরকম পুঁটুলির মতো বসে ছিলে কেন?"
"আরে ধুত্তোর, গন্ডমূর্খের দল!" আঁচড়-কামড়ের ক্ষতগুলো জিভ দিয়ে চাটতে চাটতে পুষি বলে, "পাখি ধরব বলে ওরকম সেজে বসেছিলাম। দিলি তো সব ভন্ডুল করে! ঘটে যদি একছটাকও বুদ্ধি থাকে তোদের। উফফ, আঁচড়ে একেবারে ফালাফালা করে দিয়েছে গো! যা ভাগ বলছি! দূর হ আমার চোখের সামনে থেকে। ফের যদি আমাদের বাগানে তোদের একটাকেও দেখেছি তবে হুলুস্থুলু হয়ে যাবে, এই বলে দিলাম।"

চার বেড়াল ফ্যাক ফ্যাক করে হাসতে হাসতে চলে গেল। কামিনী গাছের ডালে বসে ঘাড় কাত করে টুনটুনি এতক্ষণ সব দেখছিল। রিনরিনে গলায় সে বলে ওঠে, "ঠিক হয়েছে, বেশ হয়েছে! কেমন মজা? তোমরা যখন আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আঁচড়ে দাও তখন আমাদের কেমন লাগে বুঝতে পারলে এখন?"

পুষি একটু অপ্রস্তুত হল। তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিয়ে ফের গম্ভীরভাবে বাগানে পায়চারি শুরু করল। ভাবখানা এমন, যেন কিছুই হয়নি!

এমন সময় বাগানে ঢুকল পিকু। প্রথমেই তার নজর পড়ল বাগানের চতুর্দিকে উড়ে বেড়ানো পালকগুলোর ওপর। ভীষণ রেগে গেল সে।
"আমার টুপি! ও, বুঝেছি! পুষি, তুইই তবে আমার শখের টুপিটার এই হাল করেছিস! দাঁড়া, দেখাচ্ছি মজা। পাজি, বদমাশ বেড়াল কোথাকার!" এই বলে পিকু উত্তমমধ্যম ঠ্যাঙাল পুষিকে।
মিউ মিউ করে পরিত্রাহি কাঁদতে কাঁদতে পুষি ছুটে পালাল। সে তখন লুকোবার জায়গা পেলে বাঁচে। পিকুও সহজে ছাড়ার পাত্র নয়, সেও ছুটল পেছন পেছন।

টুনটুনি উড়ে এসে বাগানের বেড়ার ওপর বসে অন্য পাখিদের চিৎকার করে ডাকতে থাকল,

'ভারী মজা! ভারী মজা!
ওরে তোরা যা দেখে যা
বোকা পাজি বেড়ালটা
কেমন হল নাকালটা
কিরে পুষি! বল দেখি
আবারও ধরবি পাখি?'

 

বাগানের সমস্ত পাখি এসে টুনটুনির সঙ্গে সেই কোরাস গানে যোগ দিল।

বেচারি পুষি! নাহ্, আর কোনওদিন সে পাখি ধরার চেষ্টা করেনি।

 

(এনিড ব্লাইটনের লেখা 'দ্য ক্যাট উইথ এ ফেদারি টেইল' অবলম্বনে)

ছবিঃ বৃষ্টি প্রামাণিক

পেশায় ইঞ্জিনিয়ার তাপস মৌলিক ছোটদের জন্য লিখছে গত কয়েক বছর ধরে। জনপ্রিয় বিভিন্ন ওয়েব পত্রিকা এবং কাগুজে পত্রিকায় নিয়মিত লেখালিখি করেন তিনি। লেখালিখির পাশাপাশি গানবাজনা এবং ভ্রমণে তিনি সমান উৎসাহী ।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা