সকালবেলা। মাঠের পাশের বটগাছটায় পাখিদের স্কুল 'কলকাকলি প্রাথমিক বিদ্যালয়'-এর ক্লাস বসেছে। একেবারে নিচের দুটো ডালে নার্সারি আর ক্লাস ওয়ান, তার ওপরে টু আর থ্রি, আর একদম মগডালে ক্লাস ফোর। সবে ফার্স্ট পিরিয়ড চলছে।
কাগাদের ক্লাস ওয়ানে দোয়েল দিদিমণি বাংলা পড়াচ্ছেন। কাগা বসেছে সবার পেছনে, খুব মন দিয়ে পড়া শুনছে। এমনসময় হেডমিস্ট্রেস মিস কাকাতুয়া হঠাৎ উড়ে এসে দোয়েল দিদিমণির পাশটিতে বসলেন।বললেন, "শোনো সবাই, তোমাদের একটা ভালো খবর দিতে এলাম। সামনের শুক্কুরবার আমাদের স্কুলে একটা ছবি আঁকার কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছে। সারাদিন তোমরা শুধু ছবি আঁকবে সেদিন। আর তোমাদের ছবি আঁকা শেখাতে সেদিন আমাদের মধ্যে উপস্থিত থাকবেন উড়িষ্যার শিল্পী ভারতবিখ্যাত আঁকিয়ে মিস্টার ময়ূর ভঞ্জ। তোমরা কে কী রকম ছবি আঁকো ঘুরে ঘুরে দেখবেন উনি, একটুআধটু দেখিয়ে দেবেন। তারপর যার যার ছবি ভালো হবে সেগুলো নিয়ে স্কুলে একটা প্রদর্শনী করব আমরা, সামনের সরস্বতী পুজোর সময়। এই ক'দিন মন দিয়ে আঁকা প্র্যাকটিস করো সবাই।"
ছবি আঁকা? সারাদিন? কাগার তো ফুর্তি আর ধরে না! সব ক্লাসের চেয়ে ছবি আঁকার ক্লাসটাই কাগার সবচেয়ে ভালো লাগে। আঁকতে পেলে সে আর কিছু চায় না। আঁকার দিদিমণি অবিশ্যি কাগাকে খুব একটা পাত্তা-টাত্তা দেন না, বলেন সে নাকি খালি হাবিজাবি আঁকে। তাতে কাগার কিছু যায় আসে না। সে যে যথেষ্ট ভালো ছবি আঁকে সে বিষয়ে কাগার নিজের কোনও সন্দেহই নেই।
স্কুল ছুটি হতেই কাগা উড়ে চলল বন্ধু বগাদার কাছে।
"বগাদা, জানো, আমাদের স্কুলে আঁকার ওয়ার্কশপ হবে। সারাদিন শুধু ছবি আঁকা শুক্কুরবার।"
"তাই নাকি? বাঃ বাঃ। খুব ভালো।"
"উড়িষ্যা থেকে শিল্পী ময়ূর ভঞ্জ আসছেন আঁকা শেখাতে।"
"ময়ূর আসছে? বাঃ, খুব বড়মাপের শিল্পী ময়ূর। মন দিয়ে আঁকিস।"
"সে তো আঁকব। কিন্তু বগাদা, কী আঁকা যায় বলো তো? পোরট্রেট না ল্যান্ডস্কেপ?"
"যা মনে আসবে আঁকবি। অত চিন্তার কী আছে?"
"ধুর, আমি তো সেরকমই আঁকি, যা মনে আসে তাই। কিন্তু আমার ছবি কেউ বুঝতেই পারে না! দিদিমণি বলেন আমি নাকি শুধু হিজিবিজি আঁকি, কোনও মাথামুন্ডু নেই," মুখ ভার করে বলে কাগা।
"ওরকম হয়। অনেক বড়ো বড়ো শিল্পীর আঁকাও সাধারণ লোকে বুঝতে পারে না, শিল্পীকে সে জন্য ছবির নিচে লিখে দিতে হয় সেটা কিসের ছবি। তুইও সেরকম করতে পারিস। ছবি এঁকে তলায় ক্যাপশন দিয়ে দিবি, মানে ছবিটার একটা নাম লিখে দিবি। তাহলেই দেখবি সবাই দিব্যি বুঝতে পারছে।"
বগার কথায় খানিক নিশ্চিন্ত হল কাগা। বাসায় ফিরে তাড়াতাড়ি খাওয়দাওয়া সেরে আঁকার খাতা নিয়ে প্র্যাকটিস করতে বসল।
শুক্কুরবার। কাগাদের স্কুলে সেদিন সাজো সাজো রব। ছাত্রছাত্রী দিদিমণি সবাই ভোরবেলাই চলে এসেছে। যে যার বাসার আশেপাশের ফুলগাছ থেকে নানারঙের ছোট ছোট ফুল তুলে নিয়ে এসেছে, তাই দিয়ে সবকটা ক্লাসঘর সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। স্কুল একেবারে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন, ঝকঝক তকতক করছে।
কাগা তো এসেছে সবার আগে। অন্যদিন সে পেছনে বসে, আজ এসেই ক্লাসের একেবারে সামনের দিকের একটা সিট দখল করে বসেছে। আঁকার খাতা খুলে, স্কেচ পেন, ক্রেয়ন, রঙ পেন্সিল, জল রঙ, তেল রঙ সব চারদিকে সাজিয়ে একেবারে তৈরি।
একটু পরেই ক্লাসে এলেন আঁকার দিদিমণি বুলবুলি আন্টি, খুব সেজেগুজে এসেছেন আজ। ক্লাসে ঢুকেই সামনে কাগাকে দেখে চোখ বড়ো বড়ো করে বললেন, "এ কী! তুই যে আজ বড়ো সামনে বসেছিস? যা, পেছনে গিয়ে বোস!"
কাগা ঘাড় গোঁজ করে বলল, "না দিদিমণি, আজ আমি সামনে বসব।"
বুলবুলি আন্টি রেগে গেলেন।
"ঈশ! অন্যদিন তো সবার পেছনে বসিস! আজ একেবারে সামনে? আঁকিস তো যত কাগের ঠ্যাং বগের ঠ্যাং, ল্যাজামুড়ো কিছু বোঝা যায় না! মাছরাঙা কী সুন্দর পদ্মফুলের ছবি আঁকতে পারে, বাবুই কী ভালো খেজুরগাছ আঁকে, চড়ুই কী দারুণ ঘরবাড়ি আঁকে, তুই পারিস সে সব? যাও, পেছনে যাও। আর, আজ অন্তত একটু মন দিয়ে আঁকার চেষ্টা করিস বাবা, নইলে স্কুলের বদনাম হয়ে যাবে।"
কাগা আর কী করে! অগত্যা খাতাপত্র গুটিয়ে নিয়ে মুখ ভার করে পেছনে গিয়ে বসল।
এমন সময় বড়দিদিমণির ডাক শোনা গেল।
"কই, তোমরা সবাই এসো। প্রেয়ার হবে। ময়ূরবাবু চলে এসেছেন।"
ওমনি সমস্ত ক্লাসের যত পাখপাখালির ছানা সারি দিয়ে ডালে ডালে বসে পড়ল। ময়ূরবাবুকে নিয়ে বড়দিদিমণি মিস কাকাতুয়া বসলেন মগডালে, সেখান থেকে সব্বাইকে দেখা যায় কিনা!
কাগা তো ময়ূরবাবুর দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারে না। কী রূপ তাঁর! মেলে ধরা পেখমে উজ্জ্বল নীল, সবুজ, তুঁতে আর সোনালি রঙের বাহারে যেন রামধনু খেলে যাচ্ছে।
ছাত্রছাত্রীরা সবাই একবার মাথা নিচু করে প্রণাম করে সমস্বরে বলে উঠল, "গুড মর্নিং স্যার।"
উত্তরে ময়ূরবাবুও মিষ্টি হেসে বললেন, "গুড মর্নিং।"
এরপর শুরু হল সমবেত কন্ঠে স্কুলের প্রভাতী প্রার্থনা সঙ্গীত, অর্থাৎ প্রেয়ার –
পাখি মোরা পাঠশালে লিখি পড়ি গান গাই
দোয়েল, শালিক, কাক, মাছরাঙা, পাপিয়া
হাঁড়িচাচা, খঞ্জন, বাবুই, ফিঙে, টিয়া
ময়ূর, ধনেশ, চিল, হরিয়াল ও পায়রা
তিতির, বটের, ঘুঘু, প্যাঁচা আর শিকরা
জলপিপি, কাদাখোঁচা, সারস, বক, ডাহুক
একসাথে হাসি খেলা মজায় দিন কাটুক।।
প্রার্থনা শেষে সবাই ফের যে যার ক্লাসে গিয়ে বসল। শ্রী ময়ূর ভঞ্জ বড়দিদিমণির সঙ্গে ক্লাসে ক্লাসে ঘুরতে বেরোলেন। প্রথমে ক্লাস ফোর, তারপর থ্রি আর টু হয়ে অবশেষে কাগাদের ক্লাস ওয়ানে এলেন। বললেন, "শোনো, কী আঁকতে হবে আমি কিন্তু কিচ্ছু বলে দেব না। তোমরা সবাই যে যার নিজের ইচ্ছেমত আঁকবে। সারাদিন যত খুশি ছবি আঁকো, যেমন খুশি রঙ দাও, তারপর আমি এসে দেখব সবার ছবি। বড়দিদিমণিকে আমি বলেছি, সবার ছবিই যেন প্রদর্শনীতে থাকে। আমি জানি তোমরা সবাই ভালো ছবি আঁকো। আঁকায় কোনও ফার্স্ট সেকেন্ড হয় না। এটা যার যার নিজের পছন্দ। আমার যে ছবি দেখে দারুণ লাগল, তোমার সেটা পছন্দ না-ই হতে পারে। তাই আমি কোনও নম্বর-টম্বর দেব না কাউকে। তবে যাদের ছবি আমার ভালো লাগবে তাদের স্পেশাল একটা স্মাইলি দেব। কেমন স্মাইলি সেটা সারপ্রাইজ, যখন দেব তখন দেখবে। এখন মন খুলে প্রাণ ভরে আঁকো।"
ময়ূরবাবুর কথায় মনখারাপ কেটে গিয়ে কাগার মেজাজটা ফুরফুরে হয়ে গেল। যাক বাবা, বাঁচা গেল, যেমন খুশি আঁকলেই হবে তাহলে। খাতা খুলে সে শুরু করল ছবি আঁকা।
ছাত্রছাত্রীরা আঁকতে থাকল। ওদিকে টিচার্স রুম, মানে দিদিমণিদের ডালে বসে তাঁদের সঙ্গে নানা আলাপ-আলোচনা খোশগল্পে মেতে উঠলেন শ্রী ময়ূর ভঞ্জ। তাঁর জন্য ভালোমন্দ খাওয়াদাওয়ার আয়োজন করা হয়েছে। সে সবের সদ্ব্যবহার করে টিফিনের পর তিনি আবার বেরোলেন ক্লাসে ক্লাসে টহল দিতে। ক্লাস ফোর আর থ্রিতে অনেক সময় চলে গেল, উঁচু ক্লাস বলে কথা! কাগাদের ক্লাস ওয়ানে যখন ফের এলেন তিনি তখন প্রায় স্কুল ছুটির সময় হয়ে গেছে। বুলবুলি আন্টিও সঙ্গে এলেন।
কাগা একমনে এঁকে চলেছে। তিনটে ছবি আঁকা হয়ে গেছে তার, চার নম্বর চলছে। সামনের দিকে যারা বসেছিল ময়ূরবাবু কিছুক্ষণ তাদের সামনে দাঁড়ালেন, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আঁকা দেখলেন, বাবুইয়ের খেজুরগাছের ছবির খুব প্রশংসা করলেন, মাছরাঙার আঁকা পদ্মফুল দেখেও বললেন, "বাঃ বাঃ, খুব ভালো।" তারপর ধীরে ধীরে টহল দিতে দিতে একেবারে পেছনে কাগার সামনে এসে দাঁড়ালেন। কাগা ততক্ষণে চার নম্বর ছবি শেষ করে ফেলেছে, তাড়াতাড়ি নিচে ছবির নাম লিখে দিল।
"কই দেখি, কী কী আঁকলে তুমি?" ময়ূরবাবু বললেন।
কাগা ছবিগুলো পরপর সামনে বিছিয়ে রাখল, "এই যে, চারটে ছবি এঁকেছি।"
"বাঃ বাঃ, একটা একটা করে দেখাও।"
পাশ থেকে বুলবুলি আন্টি হঠাৎ বলে উঠলেন, "এ ছেলেটা যে কী ছাইপাঁশ আঁকে কিছুই বোঝা যায় না, আবোলতাবোল যত কাণ্ড। স্যার, আপনি বরং আসুন চড়ুই-এর ছবি দেখবেন। চড়ুই ঘরবাড়ি, ঘুলঘুলি, বারান্দা এসব খুব ভালো আঁকে।"
"দাঁড়ান না দেখি ও কী এঁকেছে! চড়ুই-এর ছবিও দেখব, সবার ছবিই দেখব।"
কাগা সাহস করে বলে, "স্যার, সবাই যাতে বুঝতে পারে তাই আমি ছবির নিচে ছবির নাম লিখে দিয়েছি।"
"হ্যাঁ হ্যাঁ, দেখাও। প্রথম ছবি কোনটা? এইটা? কী নাম দিয়েছ দেখি? বাঘ?"
ছবিটা একঝলক দেখে বুলবুলি আন্টি বললেন, "এটা বাঘের ছবি কোথায় রে পাগল? এ তো দেখছি একটা সিনারি! পাহাড় থেকে ঝরনা নেমে নদী হয়ে বয়ে যাচ্ছে।"
"হ্যাঁ, আর নদীর ওপারে গভীর জঙ্গল দেখা যাচ্ছে," কাগা বলে।
"আর বাঘ? বাঘ কই?" ময়ূরবাবু বললেন।
"ওই তো! ওই যে জঙ্গলের মধ্যে একটা বিরাট গাছ, তার তলায় বসে আছে, ছোট্ট দেখাচ্ছে," কাগা ব্যাখ্যা করে।
"ওই কালো-হলুদ পুটকিটা? এই গাছটার নিচে? এত ছোট্ট? বোঝাই তো যাচ্ছে না!"
"হ্যাঁ, ওটাই তো! দূর থেকে এঁকেছি তো! নদীর এপার থেকে। তাই ছোট্ট দেখাচ্ছে।"
"কিন্তু বাবা, তুমি এত দূর থেকে আঁকলে কেন বলো তো? কাছ থেকে আঁকলে তো বাঘ বলে চেনা যেত, তলায় আর লিখে দিতে হত না।"
"বা রে! কাছে গেলে যদি হালুম করে কামড়ে দেয়? তাই তো দূর থেকে আঁকলাম।"
বুলবুলি আন্টি প্রাণপণে হাসি চাপার চেষ্টা করেন। ময়ূরবাবু কিন্তু গম্ভীর। বলেন, "বাঃ, বেশ, বেশ। তারপর? পরের ছবি?"
"এই তো! ছবির নাম 'মেলা'।"
বুলবুলি আন্টি বলেন, "এটা মেলার ছবি? এ তো দেখছি পাতাজুড়ে কালো কালো একগাদা ডিম, কিছু আবার সাদা ডিমও আছে, কয়েকটা অর্ধেক কালো অর্ধেক সাদা। এর মানে কী? মেলায় তো কত লোকজন থাকে, দোকানপাট থাকে!"
ময়ূর ভঞ্জ বললেন, "একটু বুঝিয়ে দাও তো বাবা।"
কাগা বলে, "মেলাই তো! আমাদের গ্রামে নদীর ধারে পৌষ সংক্রান্তিতে যে মেলা হয় সেই মেলা। কত লোক নদীতে স্নান করতে আসে! বাবার সঙ্গে গতবার আমি সেই মেলার ওপর দিয়ে উড়ে গেছিলাম, এটা তার ছবি।"
"কালো কালো ডিমের মতো এগুলো কী?"
"কেন? মানুষের মাথা? সাদা মাথা মানে টাক পড়ে গেছে, আর অর্ধেক কালো অর্ধেক সাদা হল কিছুটা চুল কিছুটা টাক। ওপর দিয়ে উড়ে যেতে যেতে তো এরকমই দেখেছি!"
"ঠিক ঠিক! ওপর থেকে তো এরকমই দেখাবে! অগুন্তি মানুষের মাথা। বেশ, বোঝা গেল। তারপর? পরের ছবি?"
"এই যে। তিন নম্বর ছবি - মাকড়সা।"
"এটা মাকড়সার ছবি বুঝি? কিরকম মাকড়সা এটা? আমি তো দেখছি একটা ছোট ডিম, তার পেছনে আরেকটা বড়ো ডিম।"
"হ্যাঁ, সামনেরটা মাকড়সার মুন্ডু, পেছনেরটা ধড়।"
"কিন্তু কাগা, মাকড়সার যে আটটা পা থাকে? সেগুলো কোথায় গেল?"
"পা'গুলো অতটা ইম্পরট্যান্ট নয়। ধড় আর মুন্ডুটাই আসল," গম্ভীরভাবে বলে কাগা।
"তা বললে চলবে কেন বাবা? পা'গুলো না আঁকলে মাকড়সাটা চেনা যাবে কী করে?"
"কেন চেনা যাবে না? আমাদের পাড়ার মোড়ে একটা শহীদ বেদি আছে, তার ওপরে একটা মানুষের মূর্তি আছে। শহীদ ক্ষুদিরাম বোসের মূর্তি। সেই মূর্তিতে তো শুধু মানুষটার পেটের ওপর থেকে বুকটা আর মুন্ডুটা – এইটুকুই আছে। পা নেই, পেট নেই, এমনকি কাঁধের থেকে হাতগুলোও নেই। সেটা কি মানুষ বলে চেনা যায় না? দিব্যি চেনা যায়। ক্ষুদিরাম বোস বলেই চেনা যায়। মূর্তির তলায় বেদিতে অবশ্য নাম লেখা আছে। আমিও তো ছবির তলায় লিখে দিয়েছি – 'মাকড়সা'।"
"তা বটে! তা বটে! এতক্ষণে বোঝা গেল। তুমি বুঝিয়ে দিলে বলেই বুঝলাম। জানো তো, আমার অনেক ছবিও এমনি অনেকে বুঝতেই পারে না, আমাকে বুঝিয়ে দিতে হয়। তুমিও আমারই মতো। বেশ, তারপর? পরের ছবি?"
"এই যে। এটাই শেষ ছবি। আরও আঁকতে পারতাম, কিন্তু আপনি এসে পড়লেন!"
"দেখি? ওরে বাবা, এ তো দেখছি অ্যাবস্ট্রাক্ট – মানে বিমূর্ত ছবি! ছবির নাম কী? ভূত?"
"হ্যাঁ স্যার, ভূত।"
পাশ থেকে দেখে বুলবুলি আন্টি বলে উঠলেন, "ভূত না মুন্ডু! এটা ভূতের ছবি? ভূত তো কালো হয়, কিম্বা সাদা আলখাল্লা পরা থাকে, লম্বা লম্বা লিকপিকে হাত-পা, ড্যাবা ড্যাবা চোখ, ওদের পায়ের পাতা নাকি গোড়ালি থেকে পেছনদিকে ঘোরানো থাকে। এরকম পাতা জুড়ে সবুজ ছোপ ছোপ, ফাঁকে ফাঁকে কোথাও লাল, কোথাও হলুদ, ওপরে আবার নীলের ছোপ – বললেই হল এটা ভূত?"
কাগা গম্ভীরভাবে বলল, "আন্টি, আপনি ভূত দেখেছেন?"
"না, দেখিনি। তাতে কী হল? তুই দেখেছিস?"
"না, আমিও দেখিনি। স্যার, আপনি দেখেছেন?"
ময়ূর ভঞ্জ মাথা-টাথা চুলকে বললেন, "উঁহু, আমিও দেখিনি। এমনকি কাউকেই বলতে শুনিনি দেখেছে। সবাই বলে অমুকে দেখেছে, তমুকে দেখেছে, অথচ সে নিজে দেখেনি।"
কাগা বলল, "আমিও তো কতজনকে জিগ্যেস করেছি, কেউ দেখেনি। ভূতের ছবি তো সবাই কল্পনা থেকেই আঁকে, আমিও তাই এঁকেছি।"
বুলবুলি দিদিমণি বললেন, "বা রে! যা খুশি একটা কল্পনা করলেই হল নাকি?"
ময়ূরবাবু গম্ভীর হয়ে বুলবুলি আন্টির দিকে ফিরে বললেন, "না দিদিমণি, কাগা তো ভুল কিছু আঁকেনি! ওর কল্পনায় ভূত যেরকম সেরকম এঁকেছে! অন্য সবাই ভূতকে যেভাবে কল্পনা করে কাগাকেও তেমনি করেই কল্পনা করতে হবে কেন? ও নিজের মতো করে ভেবেছে। আমরা সবার কল্পনাকেও একই ছাঁচে ঢালাই করে ফেলার চেষ্টা করি, ওদের পড়াশুনোর মতন, কেরিয়ারের মতন। ভুলটা তো আমাদেরই। আপনি বরং ওদিকে ওই চড়ুই-এর কাছে যান, আমি কাগার সঙ্গে আরেকটু কথা বলে এক্ষুনি আসছি।"
বুলবুলি আন্টি চলে গেলেন। ময়ূরবাবু কাগার আরও কাছে সরে এসে মিষ্টি করে বললেন, "খুব ভালো এঁকেছ ছবিটা। বড়ো বড়ো শিল্পীরা এরকম ছবির নাম দেন 'কম্পোজিশন'। আচ্ছা, এবার আমায় চুপিচুপি একটু বুঝিয়ে বলো তো, ভূতের ছবিটা তুমি এরকম করে আঁকলে কেন? ভূত বলতে কি তোমার এরকম ছবি মনে পড়ে?"
"হ্যাঁ তো!"
"কেন বলো তো?"
কাগা একটু চুপ করে থেকে আস্তে আস্তে বলল, "আমি যখন আরও ছোট ছিলাম, এক্কেবারে ছোট্ট, তখন রোজ ভোরবেলা আমার দিদা নিজের বাসা থেকে আমাদের গাছে উড়ে এসে আমায় ঘুম থেকে ডেকে দিত। আমাদের বাসার বাইরে বসে সুর করে ছড়া কাটত –
কাগা সোনা, ঘুমিও না, উঠে পড় চটপট
চোখ মেলো, বেলা হল, রোদ্দুর খটখট
ওমনি আমার ঘুম ভেঙে যেত। বাসার বাইরে মুখ বার করে গাছের ঘন সবুজ পাতার ফাঁক দিয়ে দেখতাম নিচে টুকটুকে লাল ভোরের সূর্য উঠছে, তার চারপাশের আকাশটা উজ্জ্বল সোনালি রঙের আভায় ঝলমল করছে, আর ওপরে ঝকঝকে নীল আকাশ। তারপর একদিন দিদা আর এল না, তার পরের দিনও এল না। মা বলল, দিদা আর আসবে না। দিদা মরে গেছে। বুড়ি হয়েছিল তো! একদিন ইলেকট্রিকের তারে বসে ঝিমোচ্ছিল, পা ফসকে দুটো তারে ছোঁয়া লেগে শক খেয়ে মরে গেছে। দিদা তো তাহলে এখন ভূত হয়ে গেছে! ভূতের কথা মনে হলেই তাই আমার এই দৃশ্যটা মনে হয়। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে লাল সূর্য উঠছে, ওপরে নীল আকাশ। অনেকে বলে ভূতেরা নাকি খারাপ, সবার অনিষ্ট করে। আমার মোটেই তেমন মনে হয় না। মনে হয় ওরা আড়াল থেকে আমাদের দেখেশুনে রাখে। খুব ভালো ওরা।"
"আচ্ছা, বুঝলাম। তুমি বড়ো হয়ে খুব বড়ো শিল্পী হবে কাগা। এসো তোমার এই ভূতের ছবিটায় আমি নম্বর দিয়ে দি।"
"আপনি যে বললেন কাউকে কোনও নম্বর-টম্বর দেবেন না?"
"দেখই না কী করি! ম্যাজিক!"
এই বলে ময়ূরবাবু কাগার আঁকা ভূতের ছবিটা নিয়ে প্রথমে ঘড়ির কাঁটার উল্টোদিকে নব্বই ডিগ্রি ঘুরিয়ে রাখলেন। ছবির নিচে যেখানে 'ভূত' লেখা আছে সেটা তখন তাঁর ডানহাতে। সেখানে 'ভূত' লেখাটার ওপরে ছোট্ট একটা লাইন টেনে লাইনের নিচে লিখলেন দশ, তারপর ওপরেও লিখলেন দশ।
"কী হল বলো তো কাগা?"
কাগা খুশি হয়ে বলল, "ওরেব্বাস! দশে দশ?"
"হ্যাঁ, এইবারে দ্যাখো। ম্যাজিক!"
নম্বরের চারদিকে গোল করে একটা বৃত্ত এঁকে ময়ূর এবার ছবিটা সোজা করে দিলেন।
"এবার কী হল?"
কাগা দেখল, মাঝবরাবর লাইনটা যেন একটা নাকের মতো দেখাচ্ছে, আর ওপরে দশ নিচে দশ লেখাটা যেন নাকের দু'পাশে দু'টো চোখ হয়ে গেছে। বাইরের গোল বৃত্তটা নিয়ে যেন একটা মুখ। এবার নাকটার নিচে ময়ূর একটা হাসি হাসি ঠোঁট এঁকে দিতেই মুখটা একটা স্মাইলি চিহ্ন হয়ে গেল।
"স্মাইলি? এটাই সেই স্পেশাল স্মাইলি?" কাগা উত্তেজিত হয়ে বলে।
"হ্যাঁ, ম্যাজিক স্মাইলি। এই স্মাইলির মধ্যে যে দশে দশ নম্বর দেওয়া আছে সেটা কিন্তু কেউ জানে না, কেউ দেখে বুঝতেও পারবে না। কাউকে বোলো না।"
"কাউকে না? বগাদাকেও বলব না?"
"না, কাউক্কে না। ওটা শুধু তুমি জানো আর আমি জানি।"
স্কুল ছুটির পর কাগা ঊর্ধ্বশ্বাসে উড়ে এল বিলের ধারে বগার কাছে।
"বগাদা, আমি ছবি এঁকে স্মাইলি পেয়েছি। এই দ্যাখো। স্মাইলিটার মধ্যে আবার একটা ম্যাজিক আছে, সেটা অবশ্য তোমাকে বলা যাবে না!"
ছবিঃ ত্রিপর্ণা মাইতি