আরেকটি ট্রাক, একটি দৈত্যাকার ট্রাক, যা বায়ু-শক্তি ইনস্টলেশনের অবিশ্বাস্য-রকমের বড় ফ্যান উপরে চাপিয়ে, হাইওয়েতে ধীরে ধীরে চলছে দেখা গেলো। ততদিনে স্থানীয় লোকজন বায়ু-শক্তির ফ্যান এর সাথে বেশ পরিচিত হয়ে উঠেছে। এবং কিছু লোকজন যাদের কাছে বড় জমি আছে তারা, ইতিমধ্যে তাদের জমি ভাড়া দিয়ে, প্রচুর অর্থ উপার্জনও শুরু করে দিয়েছে।
আগে সেসব জমির দাম অকল্পনীয়ভাবে কম ছিল, কিন্তু এখন, একের পর এক শিল্প আসছে। এ যেন দেবী মা লক্ষীর কৃপায় হঠাৎ করে তাদের জীবনে উন্নতি হয়েছে।
করসণ বসল তার 'খাটে', যেটা একটা ঢালাই করা স্ক্র্যাপ-লোহার পাইপের ফ্রেমের তৈরি খাট, দড়ির-জাল দিয়ে বাঁধা। তার বয়স প্রায় পঞ্চাশ বছর, মাঝারি উচ্চতা, রোদে ঝলসে যাওয়া চামড়া এবং সাধারণ কাচ্ছি মালধারীদের মতো গোঁফ তার। পূর্বপুরুষরা ছিলেন গবাদি পশুপালক। তারা বহু শতাব্দী ধরে পশুপালনে নিয়োজিত। সামনে ফাঁকা আকাশ আর বিস্তীর্ণ বৃক্ষহীন জমির দিকে তাকিয়ে স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে চিৎকার করে সে বলল, "কী ব্যাপার, কী হয়েছে? আজ সকালে চা পাবো কি?"
তার আশেপাশের অন্য লোকদের তুলনায়, করসণের কাছে গবাদি পশু সংখ্যায় কম ছিল, যার মধ্যে ছাগল, ভেড়া, গরু, ঘোড়া এবং দুটি উট ছিল। কয়েক সেকেন্ড পরে, তাদের 'ভুঙ্গা'-র* ভিতর থেকে চিনি নেই জানিয়ে স্ত্রীর উত্তর এলো।
বিরক্ত হয়ে করসণ মন্তব্য করল, "কেন কাল সন্ধ্যায় কিনিস নি? ভালো মানুষ কাল তো বাজারে অনেক কিছু কিনলি?"
কিছু অস্বস্তিকর মুহূর্ত কেটে গেল। আবার একবার উত্তর এল, "টাকা থাকলে চিনি কিনতাম।"
এই কথা শুনে, এবার করসণ আরামের সেই খাট থেকে নিজের শরীরটা বের করল । তার পা স্লিপার-গুলোর কাছে পৌঁছে গেল, প্রতিবার নীচে না তাকিয়েই এইটা সে করে। তারপর ধীরে ধীরে রাস্তার দিকে এগিয়ে গেল। ঘন ঘন হাঁটার ফলে ঘাস পায়ের তলায় মাড়া হয়েছে এবং একটি সাপের আকারের পায়েচলা পথ তৈরি হয়েছে যা হাইওয়ের পাশে ছোট ছোট দোকানগুলির একটির কাছে শেষ হয়েছে।
ওই এলাকার আশেপাশে বসবাসকারী কয়েকজনের কাছে নিয়মিত দুধ বিক্রি করতো করে। তার একটি সেকেন্ডহ্যান্ড মোটরসাইকেল ছিল, যা সে কেরোসিন দিয়ে চালায়। এবং এর জন্য প্রচুর ধোঁয়া নির্গত হয়। কিন্তু, তার এক বন্ধু, একজন মেকানিক, করসণকে তার বাইক মেরামতে মাঝে মাঝেই সাহায্য করে ।
রাস্তার পাশের তিনটি দোকানও ছিল তার খদ্দের।
সে একটি চায়ের দোকানের মালিক মহেশের কাছে কিছু অগ্রিম টাকা চাওয়ার পরিকল্পনা করল। মহেশ একজন পাতলা এবং লম্বা মানুষ, কচ্ছের বাইরে থেকে এসেছে, খুব কথাবার্তা বলে সে। প্রায়ই করসণ তার সাথে যোগাযোগ করে। কখনও কখনও, তাদের কথাবার্তা অনেকক্ষণ ধরে চলত।
করসণ জানত যে মহেশ তাকে টাকা ধার দেবে কারণ তারা একে অপরকে বিশ্বাস করে। সে প্রায়ই অন্যান্য দোকান মালিকদের সম্পর্কে মহেশের সাথে কথা বলতো এবং অবসর সময় উপভোগ করতো।
"করসন-ভাই, তুমি কি ওই লোকটাকে চেন, যার নাম জেমস, যে এই জায়গার ওই শেষের দিকে গ্যারেজ চালায়, সে সুদূর দেশ দক্ষিণ ভারতের কেরালা থেকে এসেছে?" মহেশ প্রায়ই এভাবে কথাবার্তা শুরু করতো।
করসণের ভূগোল জ্ঞান মোটেও যথেষ্ট ছিল না, কারণ সে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বাইরে পড়াশোনা করেনি এবং জেলা সদরের বাইরে কখনও ঘুরতেও যায় নি। সে খালি দৃষ্টিতে মহেশের দিকে তাকাতো এবং "হুম... হুম..." শব্দ করতো।
তাদের কথা বলার জন্য বিষয়ের কোনো অভাব ছিল না। এবং 'সময়' অজান্তেই, সেকেন্ড থেকে মিনিটে এবং মিনিট থেকে ঘণ্টায় বয়ে চলে যেতো।
এক রবিবার সকালে দোকানদার মহেশের এক বন্ধু এল। সেই বন্ধু একজন হস্তরেখাবিদ হওয়ার ভান করেছিল। এবং রসিকতা করে, সে করসণ-ভাইয়ের হাতের রেখাগুলি দেখে অনেক মন্তব্য করেছিল। তার সেই অভিনয় ছিল খুবই নিপুণ। কিন্তু করসণ তা মোটেও জানতো না।
করসণের সেই সমস্ত ভবিষ্যদ্বাণীমূলক মন্তব্য খুব কমই মনে ছিল কিন্তু একটি কথা তার খুব ভাল মনে ছিল। সেই কথাটা হলো, "প্রত্যেকের জন্য জীবিকা উপার্জনের ঈশ্বর কোন না কোন উপায় দেখান।"
একদিন সন্ধ্যায় করসণ কোম্পানির গেট থেকে খুব দূরে রাস্তার পাশে বেশ কয়েকটি গাড়ি পার্ক করা দেখতে পায়। মহেশকে জিজ্ঞেস করে, এতক্ষণ গাড়ি গুলো রাস্তার পাশে রাখা আছে কেন? মহেশ তাকে বলে, "করসন-ভাই, ওই গাড়িগুলো বাইরের লোকের, ওরা এই কোম্পানির কর্মচারী নয়। তারা কোম্পানির অফিসে কোনো না কোনো কাজে এখানে আসে ।"
করসণ আর কিছু আলোচনা করল না। কিন্তু সে মনে মনে ভাবছিলো, "যদি একটি নিরাপদ জায়গা থাকে, আমার মনে হয়, এই লোকেরা তাদের গাড়ি সেই জায়গায় রাখতে পারে, তাই না?"
আর ঠিক সেই মুহুর্তে সে একটা পরিকল্পনা করল।
তার ছোট ভাই জীভা, যে অবিবাহিত থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, বেশিরভাগ সময় গ্রামের বাইরে মন্দিরের সীমানায় থাকতো। সে মাঝে মাঝে করসণের পরিবারের সাথে দেখা করতে আসতো, তবে সে খুব পরিশ্রমী ব্যক্তি।
বাড়িতে পৌঁছে করসণ তার স্ত্রীকে জানাল - যেমনটা সে প্রায়ই করে থাকে, বাইরে থেকে চিৎকার করে বলে দিল, “আমি জীভার সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। দেরি করে আসতে পারি। চিন্তা করবে না। দুপুরের খাবারের সময় আমার জন্য অপেক্ষা করবে না।" এবং তারপরে সে তার প্রিয় লাঠিটি নিয়ে হাঁটতে শুরু করল, কারণ সে নিশ্চিত ছিল যে, ভিতর থেকে কোনও উত্তর আসবে না।
তার ভাই জীভা তখন মন্দিরেই ছিল। করসণ তাকে তাড়াতাড়ি আসতে বলল।
করসণ বললে, "আমাদেরকে একটা ভাল কুড়াল নিতে হবে এবং কিছু অকেজো কেব্ল্ তার সঙ্গে নিতে হবে। আর আমাদেরকে 'গ্যান্ডো বাবুল' গাছের কিছু শক্ত ডাল কিংবা গাছের গুঁড়ি কেটে ফেলতে হবে। তাড়াতাড়ি চল, যাই।" জীভা কিছু না জিজ্ঞেস করেই দাদার সাথে কাজে যোগ দিলো। শালটা কাঁধে রেখে বড় ভাইকে পিছন পিছন অনুসরণ করতে লাগল।
পরের তিন দিন ধরে, দুই ভাই খুব পরিশ্রম করে, হাইওয়ের এক্কেবারে কাছে, একটি খুব বড় জমির চারপাশে, একটি ভাল বেড়া তৈরি করল। করসণ জীভাকে একটি সাইনবোর্ড বানিয়ে তার উপর লিখতে বলল, ‘আপনার গাড়িটি এখানে সাবধানে রাখুন। আপনার গাড়ি নিরাপদ থাকবে’।
দাদার নির্দেশ অনুসারে, সাইনবোর্ডটি একজন চিত্রকরকে দিয়ে তৈরি করা হল। সেই চিত্রকর জীভাকে ভালভাবে জানত। তাই সে সেই কাজের জন্য ন্যূনতম পারিশ্রমিক নিল।
শীঘ্রই বর্ষা আমাদের দেশের পশ্চিম প্রান্তের এই ভূখণ্ডে পৌঁছে গেলো। করসণ আশেপাশের নার্সারী থেকে বেশ কিছু নিম গাছের চারা সংগ্রহ করে প্লটের চারপাশে লাগিয়ে দিলো ।
প্রতিদিন সকালে সে মহেশকে জিজ্ঞাসা করতো, "কোন গাড়ির মালিক কি আমার জমিতে তার গাড়ি নিরাপদ রাখার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল?" কিন্তু, প্রতিবারই সে মাথা নাড়ত, এবং বলত, "না।"
তবু সে করসণকে আশ্বস্ত করে বলল, "যখনই এমন কেউ কাস্টমার আসবে, আমি তাকে তোমার বাড়ি নিশ্চই দেখাবো, চিন্তা করো না, করসন ভাই।"
বেশ কয়েকদিন পর মহেশের এক বন্ধু তাকে বলল যে সাইনবোর্ডে তো গুজরাটি লেখা আছে, বাইরের মানুষ গুজরাটি লেখা কীভাবে পড়তে পারবে?
করসণ এমনটা কখনো ভাবেনি। তার মনে পড়ে গেলো কিছুদিন আগের এক বিকেলের কথা, যখন একটা বড় ট্রাভেলর গাড়িতে করে অনেক লোক চা-নাস্তা করতে এসেছিল। তাদের কাছে নগদ টাকা ছিল না। সেদিন এই লোকটি দৌড়ে এসে গ্যারেজওয়ালা জেমসের কাছ থেকে তার QR কোড কার্ড নিয়ে এসেছিল। মহেশের এই বন্ধু, সে আবার মহেশকে বোঝাল যে, ব্যবসার সুবিধার জন্য QR কোড প্রিন্ট, অনলাইন মানি ট্রান্সফার, এসব ব্যবহার শুরু করা ভাল।
করসণ সময় নষ্ট করেনি, সে সঙ্গে সঙ্গে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের সঙ্গে যোগাযোগ করে। আর সেখানে সাইনবোর্ডের 'ক্যাপশন' ঠিক কী হবে সেটা স্থির করা হয়। উপরে ইংরেজিতে বড় বড় অক্ষরে লেখা থাকবে, 'আপনার গাড়ি এখানে পার্ক করুন; নিশ্চিন্তে থাকুন ' এবং অন্যান্য বিবরণ তার নীচে ছোট অক্ষরে লেখা হবে।
শীঘ্রই পুরানো গুজরাটি সাইনবোর্ড-এর জায়গায় নতুন ইংরেজি সাইনবোর্ড রাখা হলো।
প্রতিদিন সকালে, করসণ তার গ্রাহকদের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে। গাড়ির হর্ন শোনার জন্য সে খুব সতর্ক থাকতো।
তার স্ত্রী মজা করে বলতো, আমরা বধির নই, আমরা খুব ভালো শুনতে পাই।
কিছুদিন পরে, এক সন্ধ্যে বেলা, সে কোনো একটা আওয়াজ পেয়ে ছুটে যায় রাস্তার দিকে, আলো আঁধারিতে গিয়ে দেখে, একটা উটগাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। তার স্ত্রী খুব হেসেছিল, এইটা জানার পর। সেও খুব লজ্জা পেয়েছিল।
মহেশ তাকে বলেছিল, তোমার ছেলেকে ডেকে নাও, এই কাজে তোমাকে সাহায্য করবে। কিন্তু সে বলেছিলো, শহরে সে যে কাজ করছে করুক, ঈশ্বর প্রত্যেকের জন্য জীবিকা উপার্জনের কোন না কোন উপায় দেখান, তাকেও দেখাবেন । সে কচ্ছি ভাষাতে আবার বলে , “ঈশ্বর মড়েয়লায়, কোই না কোই কাম করে লায়, রাস্তো বাতায় তো”। সে মহেশ কে বলেছিল তার ছেলে সরকারি নিষাড়ে* পড়াশোনা করে।
এবং তারপর, একদিন সকালে, চারপাশে প্রচুর কুয়াশা ছিল সেদিন, তারা শুনতে পেল, একটি গাড়ির হর্ন। সঙ্গে সঙ্গে করসণ বেরিয়ে এল। দেখে একজন সর্দারজী বসে আছে, কারের ভিতরে, কোনোরকমে ওই অচেনা ব্যক্তির সঙ্গে, হিন্দিতে কথা বলতে পেরেছে সে।
অবশেষে, প্রথম গাড়িটি ধীরে ধীরে তাদের পার্কিং এলাকায় প্রবেশ করল।
কয়েক বছর কেটে গেল। যথারীতি করসণ, মহেশের সাথে তার দোকানে দেখা করতো। করসণের ভাই জীভা এখন, সেই পার্কিং -এর জায়গার ভিতরে, একটি ছোট বাড়িতে থাকতো যাতে সে গ্রাহকদের সাথে লেনদেন করতে পারে। করসণ ও মহেশ অন্তহীন কথাবার্তা বলতো, যেমনটা তারা আগেও করত। তাদের কথা বলার জন্য, বিষয়ের কোন অভাব ছিল না। আর 'সময়'? সে তো, নদীর জলের মতো বয়ে যেত, সেকেন্ড থেকে মিনিটে এবং মিনিট থেকে ঘণ্টায়, তাদের অজান্তে।
কয়েক বছর পর, এক রবিবার দোকানদার-মহেশের সেই বন্ধু আবার এল। সে ভিন্ন ধরণের পোশাক পরেছিল, কারণ সে সম্প্রতি চাকরি পরিবর্তন করেছে।
করসণ তার পুরানো মোটরসাইকেলে চড়ে, দোকানের সামনে দুধ পৌঁছে দিতে এল, যেমনটা প্রতিদিন সে করতো। এখন আর তার গাড়ি কেরোসিন দিয়ে চলে না। সে নিঃশব্দে দুধের ক্যানটা মহেশের হাতে তুলে দিয়ে, অন্য গন্তব্যে চলে গেল।
মহেশ তার বন্ধুকে জিজ্ঞেস করল, "যে দুধওয়ালা এইমাত্র এসেছিলো তাকে দেখেছ? তুমি আলাদা পোশাক পরেছ বলে সে তোমাকে চিনতে পারেনি। তবে, তুমি কি তাকে চিনতে পেরেছ? সে সেই একই করসন-ভাই, তার হাতের তালুর রেখাগুলো তুমি দেখেছিলে। তুমি মজা করে কিছু বলেছিলে। তোমার কি মনে আছে?"
মহেশের বন্ধু একেবারে হতবাক হয়ে বলল, "ওই ঘটনার পর সে কি আমার কথাগুলো সিরিয়াসলি নিয়েছে?
"হ্যাঁ বন্ধু, খুব সিরিয়াসলি নিয়েছে, এবং আজকাল সে প্রতিদিন, খুব ভাল পরিমাণ টাকা-পয়সা উপার্জন করছে। একটা সময় ছিল, যখন সে আমার কাছ থেকে টাকা ধার করতো, কিন্তু এখন আমার বিশেষ প্রয়োজন হলে, আমি তাকে জিজ্ঞেস করি। আর তুমি কি জানো, এসব কীভাবে হলো? সে হাত তুলে তর্জনী দিয়ে ইশারা করে দেখাল আর বললো, ওই সুন্দর পার্কিং এরিয়াটা দেখো, ওটাতে এখন একটা সুন্দর প্রাচীর আছে; তুমি কি জানো কীভাবে এটি শুরু হয়েছিল? অতি সাধারণ, অতি ছোট্ট চেষ্টা, কিছু পুরানো অকেজো কেবল তার এবং গাছের খুঁটি নিয়ে।
বন্ধু, আরো একটা কথা, বিশেষ করে জানা দরকার, ওর ছেলে আমেদাবাদ আই আই এম থেকে এম বি এ করেছে।"
____________________
* ভুঙ্গা - ছোট-পরম্পরাগত-কাচ্ছি-ঘর
* নিষাঢ় - গুজরাতি ভাষায় স্কুল
ছবিঃ মিতিল