সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo

এক সকালবেলা ইছাবনি গ্রামের আশুদতলা-বাসস্ট্যান্ডের কাছে একটি বছর পঁচিশের পাগল ছেলেকে দেখতে পাওয়া গেছিল। শ্যামলা রঙ, মুখের গড়ন ভালই, চুল দাড়ি গোঁফ কিছুই অনেক দিন কাটা হয়নি তা বেশ বোঝা যাচ্ছিল। মিষ্টির দোকানি সুজয় একটা শাল পাতার ঠোঙাতে করে কিছু মুড়ি, তেলেভাজা আর একটা বোঁদের লাড্ডু দিয়েছিল। সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই নিমেষে সেসব খেয়ে ফেলেছিল। সময়টা হবে সম্ভবত ১৯৮০-র দশকের কথা।

"কোথা থেকে যে সে এসেছে?" "কি ভাবে সে এসেছে সেই গ্রামে?" "কেনই বা সে ইছাবনিতেই এসেছে?" গ্রামের সবার মনেই ছিল এই রকম সব অনেক প্রশ্ন। যে দুটো বাস চলতো, একদিকে মহকুমা সদর শহর থেকে অন্যদিকে জেলা সদর শহর, তাতে এসে থাকলে বাস-ওয়ালারা অবশ্যই জানতো। "নাহ্ সে বাসে আসেনি, তাহলে? হয়তো কোন ট্রাক-ওয়ালা নিয়ে এসে নামিয়ে গেছে রাত্রে। হতে পারে, তাই হয়তো। কিন্তু কেউ তাকে ট্রাক থেকে নামতে দেখেনি।" আবার কেউ কেউ মনে করেছিল হয়তো সে পিয়ারমনি রেল-স্টেশনে নেমেছিল তার পর হেঁটে হেঁটেই চলে এসেছিল ইছাবনি। "কিন্তু সেতো অনেক দূর, প্রায় বিশ পঁচিশ মাইল তো হবেই, এতটা রাস্তা সে কি করে আসল?" সঠিক বোঝা যায় নি, যে সে কিভাবে সেখানে এসেছিল।

কয়েক জন এমনটাও ভেবেছিল "হয়তো সে ইচ্ছে করে পাগল সেজে আছে, হয়তো ডাকাত দলের লোক, আরও কতো কি..." তাই শুনে অন্যরা বলেছিল, "ধ্যাত্, থাম থাম, রাখ এসব আষাঢ়ে-গপ্পো, সেই রকম আগের মত জমিদার অথবা রাজাও নেই আর তাদের প্যালেস লুট করার জন্য শোলে সিনেমার মত ডাকাতের দলও নেই। বাজপুরের কয়েক জন ছিঁচকে চোর আছে যারা ছোটোখাটো চুরি ছিনতাই এসব করে থাকে। তা তাদের তো সব খবরই রাখে পুলিশ থানার লোকেরা ..."

সন্ধেবেলা কয়েকজন ছেলে-ছোকরা তাকে ধরে হাত পা বেঁধে ঠেলা-রিক্সার উপর বসিয়ে পুলিশ আউট-পোস্ট-এ নিয়ে এসেছিল। তাদের দলের লিডার ছিল নতা। সে নিজেকে কিছু একটা মনে করতো। পুলিশ আউট-পোস্ট-এ এসে সে কনস্টেবলদের কাছে জানতে চেয়েছিল, "দারোগা বাবু কোথায়?" কিছুক্ষণ পর একজন কনস্টেবল দারোগা বাবুকে ডেকে এনেছিল। সে আর তার বন্ধুরা দারোগা বাবুকে খুব জোর দিয়ে বলেছিল, "এই লোকটাকে এখুনি লকআপে বন্ধ রাখতে হবে।" দারোগা বাবু বেশ বিচক্ষণ মানুষ, আগে তিনি সেই হাত পা বাঁধা ছেলেটিকে কিছু প্রশ্ন করতে চেয়েছিলেন এবং তারপর তিনি যা ঠিক বুঝবেন তাই করবেন, কারোর কথায় তিনি কিছু করবেন না, নতা আর তার বন্ধুদের তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন।

এবার ছেলেটির হাত পায়ের বাঁধন খুলে দেওয়া হয়েছিল, তারপর দারোগা বাবু আরও দুজন বয়স্ক কনস্টেবলকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। তিন জনা মিলে সেই পাগল ছেলেটির নাম, কোথা থেকে সে এসেছিল, তার বাড়ি কোথায় ছিল, সেখানে তার কে কে থাকে, এই সব জানার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। প্রায় আধ ঘণ্টা বিভিন্ন ভাবে কথা বলার পর যা জানা গেছিল তা হল; তার নাম সম্ভবত তাঙ্গু, হয়তো ডাক নাম, ভাল নামটা সেসময় তার মনে ছিল না, সে হিন্দির কোন বিশেষ ডায়্যালেক্টে বা উপভাষাতে কথা বলছিল, বাংলা মোটেও সে বলছিল না, তার বাড়ি সম্ভবত কোন কয়লা খনি এলাকায়, তার বাড়িতে মা এবং এক ভাই ও এক বোন তাদেরই কিছু কিছু কথা সে কয়েকবার উল্লেখ করেছিল, আর কারো বিষয়ে কিন্তু সে কিছুই বলেনি এবং তার মানসিক ভারসাম্য যে মোটেও স্বাভাবিক ছিল না তাতে তিন জনেই একমত হয়েছিলেন। দু মিনিট ছাড়া ছাড়াই সে খিদে পাওয়ার কথা বলে যাচ্ছিল, আর কিছু না কিছু খাবার চাইছিল। পুলিশদের সব সময় চোর, গুণ্ডা, খুনি, বদমাশ লোকজন নিয়েই কাজ হলে কি হবে, মানুষের শরীর, দয়া মায়া তো থাকেই, তারা তাঙ্গুকে কিছু খেতে দিয়েছিল আর পুরানো কিছু জামা কাপড়ও দিয়েছিল। আশে পাশের লোকেরা বলাবলি করছিল, "কাদের বাড়ির ছেলে, এত বড় ছেলে, সুন্দর স্বাস্থ্য, বলিষ্ঠ চেহারা, যদি সে মজুরি করে, ও রোজগার করে তার নিজের ঘরে নিজের লোকজনের সাথেই থাকতো..."

এই সব ভাবনা গুলোই খুব স্বাভাবিক ছিল, পুলিশ আউট-পোস্ট -এর কাছেই পোস্ট অফিস আর একটু দূরে সারি দিয়ে কোয়ার্টার্স্‌, তাতে স্কুল কলেজের শিক্ষক শিক্ষিকাদের পরিবাররা থাকতেন। আর অন্যদিকে ছিল কিছুটা খালি জায়গা, মাঝে একটা পাতকুয়া, একপাশে কিছু ফল ফুলের বাগান, সামনে ঠিক বিপরীতে খোলা বারান্দা-ওয়ালা হাইস্কুলের ছেলেদের হোস্টেল বিল্ডিং কিচেন হল এই সব। এই পুরো এলাকায় তাঙ্গু ছিল একছত্র রাজা। তার মন যে দিকে চায় সেখানেই সে গিয়ে হাজির হত। তবে যেখানেই সে যেত কিছু না কিছু খাবার চাইত আর সেই চাওয়াটাও বেশ মজার সুর করে করে, "হালুয়া লাও, পুরি লাও, সবজি লাও, মিঠাই লাও, ঘর মে সে লাও, জলদি জলদি লাও।" বিভিন্ন সব খাবারের নাম সে মুখস্থ বলে যেত। গ্রামের অনেকেই তা শুনে মনে করেছিলেন হয়তো সে ময়রা বাড়ীর ছেলে, তাই এতসব খাবারের নাম তার মনে ছিল। ছোট হলেও ইছাবনি গ্রামে স্কুল কলেজ অনেকগুলি, চার চারটে হোস্টেল সুতরাং তাঙ্গুর খাওয়ার অভাব মোটেও ছিল না। তিন চার মাস তাঙ্গু বহাল তবিয়তে ইছাবনিতেই ঘুরে বেড়াচ্ছিল। রাত্রে ঘুম আসলে কোন না কোন স্কুল বা কলেজের বারান্দায় শুয়ে পড়ত।

সন্দেহ-গ্রস্ত মানুষদের মনে কিন্তু তাঙ্গুকে নিয়ে সন্দেহ করাটা বরাবরই ছিল। সেসময়টা গরমের ছুটি। তিনটে হস্টেলেরই ছেলে মেয়েরা তাদের বাড়ি চলে গেছিল। শুধু টেকনিক্যাল কলেজের হোস্টেলই চালু ছিল। একদিন হঠাৎ সন্দেহ-বাতিক লোকেরা আবিষ্কার করেছিল- "তাঙ্গু গা ঢাকা দিয়েছে, তাঙ্গুকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা।" পুলিশ-থানাতেও খবর হয়েছিল যথারীতি। খোঁজ খোঁজ পড়ে গিয়েছিল ইছাবনি আর তার আশে পাশের সাত পাড়ায়। যখন পুরো দুদিন তাঙ্গুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না, সন্দেহ রোগ ইছাবনির অন্য কয়েক জন কেও সংক্রমিত করেছিল। তৃতীয় দিন ডাক বিলি করে পোস্ট অফিসের পিওন টিচার-ট্রেনিং-কলেজের প্রিন্সিপালের অফিস থেকে ফিরে আসছিল। সেটা গরমের ছুটির সময়, সব কেমন যেন থম থমে হয়ে যায় এদিকটা, কারণ এই কলেজটি ছিল ইছাবনির সব থেকে বাইরের দিকে- কাছেই ছিল বড় বড় শাল, পিয়া-শাল, চাকলতা, বহেড়া এই সব গাছের বিশাল জঙ্গল। ছাত্র ছাত্রীরা তো কেউই ছিলনা, এমনকি কাজের লোকেরাও অনেকেই তাদের বাড়িতে গিয়েছিলেন গরমের ছুটিতে। সেই নিস্তব্ধ পরিবেশে পোস্টম্যান স্পষ্ট শুনতে পেয়েছিল, "আম্মা পানি দেও না, আম্মা, হমার ভুক লাগি হৈ।" সেও চিনতো তাঙ্গুর গলার স্বর। ইছাবনির প্রায় সবাই তাকে চিনে গেছিল। সে তাড়াতাড়ি গিয়ে দেখে, তাঙ্গু একটি হোস্টেলের বারান্দার কোণে শুয়েছিল। তার গায়ে হাত দিয়ে বুঝতে পারে যে তার জ্বর হয়েছিল। এই খবরটা দিতে, পোষ্টম্যান আবার ফিরে গেছিল প্রিন্সিপালের অফিসে। সেই অফিস থেকে ফোন করে হাসপাতালে জানান হয়েছিল। এর পর হাসপাতালের লোকেরা তাঙ্গুকে নিয়ে গিয়েছিল। তারপর তাঙ্গু পুরো তিন দিন হাসপাতালে থাকার পর একদম সুস্থ হয়ে উঠেছিল। আর অদ্ভুত ভাবে সেই সময় হাসপাতালের এক জন নার্সকে কয়েক বার সে "আম্মা" বলে ডেকেও ছিল। এই কথা শুনে ইছাবনির কেউ কেউ মনে করেছিল হয়তো তাঙ্গুর মা হাসপাতালের নার্স। কোথায় কোথায় যে তিনি তাঁর ছেলেকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন কে জানে। কিন্তু কে বলে দেবে তার বাড়ীর ঠিকানা?

কদিন হাসপাতালে থাকার পর আবার তাঙ্গু উন্মুক্ত, সে যেখানে খুশি সেখানেই হাজির হত। ইছাবনি আর তার আশে পাশের সাত পাড়ায় তার অবাধ গতিবিধি। বাস স্ট্যান্ডের কাছাকাছি বেশ কয়েকটি দোকানেও সে খাবার পেত। ইছাবনির প্রায় সবারই কাছে সে যেন সেই গ্রামেরই এক জন, শুধু সন্দেহ-গ্রস্তরা ছাড়া।

একদিন সকালে খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। দারোগা বাবু লক্ষ্য করেছিলেন তাঙ্গু কিভাবে একটি ছেঁড়া প্যান্টকে একটি বড় পাথরের উপর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আছাড় মারছিল ঠিক যেন নিপুণ কোন ধোপা, আর তার সাথে সাথে সে তার নিজের উপভাষায় কোন একটা গান বেশ সুর করে গেয়ে যাচ্ছিল। এটা সবার কাছে খুব অদ্ভুত লেগেছিল যে কিভাবে সেই গানের কথা গুলি তাঙ্গুর মনে ছিল। কি বিচিত্র মানুষের মন! দারোগা বাবু থানার ভিতরের দিকের বারান্দা থেকে পাশেই পোস্ট অফিসের পোস্ট মাস্টার মশাইকে ডেকেছিলেন এবং আরও কয়েকজনকেও ডেকেছিলেন। তারা সকলে মিলে দেখছিলেন তাঙ্গুর সেই আনন্দোচ্ছল কাপড় কাচার দৃশ্য। অনেকেই তখন মনে করেছিলেন, সে নিশ্চয়ই ধোপা বাড়ীর ছেলে। নাহলে এতো সুন্দর করে, ঠিক নিপুণ ধোপাদের মত করে কাপড় আছাড় মারতে পারতো না। যাই হোক, অন্যদিকে খোলা বারান্দায় হোস্টেলের ছেলেরাও জড়ো হয়েছিল সেই একই মজার দৃশ্য দেখার জন্য। তাঙ্গুকে দেখে ছেলেদের হোস্টেলের হোস্টেল-সুপার, যিনি হাইস্কুলের সংস্কৃতের মাস্টার-মশাই, মুচকি হেসে বলেছিলেন, "আবার একবার তাঙ্গুটাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে দেখছি, নির্ঘাত সর্দি জ্বর বাধাবে আবার।"


ছবিঃ ত্রিপর্ণা মাইতি

চান্দ্রেয়ী ভট্টাচার্য্যের বাড়ি ও জন্মস্থান বাঁকুড়া জেলার মন্দির-নগরী বিষ্ণুপুর শহর। বাবার কর্মসূত্রে সূত্রে গুজরাতে আসা। আর তার জন্যই স্কুল কলেজের পড়াশুনা গুজরাতের কাঠিয়াবাড় প্রান্ত থেকে। বর্তমানে ফার্মাকোলজি নিয়ে পোস্ট গ্রাজুয়েশনের ফাইনাল ইয়ারে। মাতৃভাষা বাংলার সাথে শিশু অবস্থা থেকে কখনই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়নি। নিজের পড়াশুনোর মাধ্যমে ইংরেজি, হিন্দি এবং গুজরাতি শেখার সাথে সাথেই বাংলা বইও পড়তে ভালো লেগেছে বরাবরই।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা