বিহারের এক প্রত্যন্ত গ্রামের দীন-দরিদ্র মানুষ দশরথ । বৌয়ের নাম সজনী । ছেলেমেয়েও অনেকগুলো । কষ্টেসৃষ্টে দিন কাটে তাদের । গয়ার কাছে গেলহোর গ্রামে থাকে তারা । তিনপুরুষ ধরে জন-মজুরের কাজ করে আসছে দশরথ । কিন্তু গরীব হলেও সে খুব নিষ্ঠাবান ও সৎ তার কাজের প্রতি । আর তার একাগ্রতা এবং কর্তব্য পরায়ণাতা শহরের মানুষকেও তাক লাগিয়ে দেবে । জীবনে তার অনেক দুঃখ কিন্তু দুচোখ ভরে আছে অনেক স্বপ্ন ।
এহেন দীন দরিদ্র দশরথের গ্রামে না আছে বিজলি বাতি না আছে পাকা রাস্তা । এমন কি পানীয় জল আনতেও গ্রামের মেয়েদের প্রতিদিন যেতে হয় আরেক প্রত্যন্ত গ্রামে । গেলহোর গ্রামে পানীয় জল অপ্রতুল । পুকুরের জলে সব কাজ হয় কিন্তু সে জল তো পানের অনুপযোগী । তাই রোজ ভোরেভোর মেয়েরা বেরিয়ে পড়ে জীবনধারণের এই অপরিহার্য উপাদান সংগ্রহ করতে । গেলহোর পাহাড় পেরিয়ে পায়ে হেঁটে মালভূমির পাহাড়ি পথ দিয়ে দিয়ে । কত প্রতিকূলতায় আহরণ করে তারা পাহাড়ী এক ঝোরার পরিস্রুত এই পানীয় জল ।
মেয়েগুলির এই রোজকার লড়াই দেখে দশরথের মনে খুব কষ্ট হয় । এক এক দিন কাজ না থাকলে সজনীকে সেও সঙ্গ দেয় । জল আনার কলসীটা বয়ে দেয় কিছু পথ । গাঁয়ের ঝি-বৌরা পথে জিরোয় দুদন্ড। কত ঠাট্টা মশকরা, তামাশা করে । কেউ আবার গান ধরে দু কলি । এইভাবে প্রখর গ্রীষ্মে, ঝড়ে-বৃষ্টিতে অথবা কন্কনে ঠান্ডায় সব বাধাকেই পোষ মানিয়ে নেয় তারা । কারোর মাথায় মাটীর কলসী, কারো কাঁখে তামার কলসী কারো বা কাঁধে ভিস্তি । থকে যায় মেয়েগুলি । দশরথ মনে মনে ভাবে । দরখাস্ত দেবে বলে ঠিক করে গাঁয়ের অঞ্চল প্রধানকে । পঞ্চায়েতের মিটিংয়েও সে হাজির হয়ে এই কষ্টের কথা কয়ে এসেছে কিন্তু রাজনৈতিক মহলের কোনো হেলদোল নেই এ ব্যাপারে ।
সজনী মুখ ফুটে এই কষ্টের কথা কিছুই জানায়না বাড়িতে । প্রতিনিয়ত এই যুদ্ধের টানাপোড়েনে বিদ্ধত হয়ে যায় সে । কখনো পায়ে খুব যন্ত্রণা করে । অতসী কিম্বা ধুতুরা গাছের পাতার সেঁক দেয় চুপি চুপি । জ্বর এসে গেলে নিশব্দে শিউলিপাতার রস খেয়ে নেয় । পথশ্রমে দুচোখ বুঁজে আসে ঘুমে কিন্তু হাসিমুখে স্বামীর মুখে রাঁধা ভাত তুলে ধরে ।
দশরথের কাজ আরো কষ্টের । দিন মজুর সে । তাকে শহরের দিকে যেতে হয় গাইঁতি, কোদাল, কুড়ুল হাতে । কখনো বাড়িঘর তৈরির কাজ, কখনো নতুন ধান উঠলে থ্রাশিং মেশিনে ধান ঝাড়াই আর কখনো বা রাস্তা মেরামতি । যখন যে কাজের জন্যে ডাক পড়ে মজুরদের । নাম লেখানো আছে । কন্ট্রাকটার যে কাজে ডাকবে সেই কাজেই যেতে হবে । না গেলে দৈনিক পয়সা মারা যাবে । দিন গেলে একশোটা টাকা । কখনো উপরি হলে আরো গোটা তিরিশ টাকা । ফেরার পথে নিজের ঘরের জন্য শুকনো গাছের ডালপালা ভেঙে জ্বালন নিয়েও আসতে হয় । নয়তো ভাত ফুটবে কি করে ? কি করেই বা সেদ্ধ হবে আনাজপাতি ? সেই কাকভোরে দশরথ যায় বৌয়ের হাতে রুটি সবজী খেয়ে । সারাদিন কিছু খাওয়া হয়না । কোমরে বাঁধা থাকে চাড্ডি শুকনো মুড়ি । আর সন্ধ্যেবেলায় ঘরে ফিরে তবেই দুটো ভাতজল । এইভাবে সুখে-দুখে বেশ ক'টা বছর কেটে গিয়েছে তাদের ।
একদিন দশরথ আধবেলার কাজ পেয়েছে । সবদিনতো আর সমান কাজ থাকেনা । মালিক যা কাজ দেবে তেমনি হবে । বাড়ি ফিরে এসেছে মনের আনন্দে তাড়াতাড়ি । ফেরার পথে সেদিনের রোজগারের পঞ্চাশটাকা থেকে কিছুটা খরচ করে বাড়ির জন্যে আলু-বেগুণ কিনে এনেছে খানিকটা । রাস্তায় একটা বেলগাছের নীচে দুটো বেল কুড়িয়ে পেয়েছে । আর কটা ডাঁসা পেয়ারা পেড়ে এনেছে সজনীর জন্যে । মনে মনে ভেবেছে আজ একটু খেয়েদেয়ে গপ্পোসপ্পো করবে ছেলেমেয়েগুলোকে নিয়ে । তার কাঁচা ঘরের নিকোনো উঠোন । সেখানে গোটা দুই খাটিয়া পাতা । বাইরে দিয়ে রাংচিতের বেড়া । বাড়ির লাগোয়া সজনে গাছ । একফালি জমিতে সজনী কিছু শাকপাতা বুনে রাখে অসময়ে কাজে লাগবে বলে । সেদিন দশরথ বাড়ি ফিরে দ্যাখে সজনীর কোনো পাত্তা নেই । পাশাপাশি একে ওকে তাকে শুধালে তারাও বলে জানেনা কিছু । গ্রামের কোনো মেয়েরা নাকি সেদিন তখনো জল নিয়ে ফেরেনি ঘরে । দশরথ মহাচিন্তায় পড়ল । অধৈর্য্য হয়ে ঘরবার করে সে । এদিকে ঘরে একফোঁটা খাবার জল নেই । তেষ্টাতে তার ছাতি ফেটে যাওয়ার উপক্রম । জৈষ্ঠ্যমাসের প্রচন্ড তাত । হা বৃষ্টি! হায় কপাল ! নীল আকাশের দিকে চেয়ে দশরথ বলে মনে মনে । একটুকরো কালো মেঘও নেই আকাশে যে বৃষ্টি হবে । গাঁয়ের লোকে বলা কওয়া করছিল সেদিন টিভির খবরে নাকি বলেছে বিহারে এবার খরা হবে । মানুষ নাকি গাছ কেটে কেটে শেষ করে ফেলছে তাই বৃষ্টি হচ্ছেনা মোটেও । কাছাকাছি কোনো নদীতেও জল নেই । ধূধূ বালির চর । পুকুরেও জল অনেক কমে গেছে । অন্যবার বোশেখে দু তিনটে কালবৈশাখি হয়ে পুকুরে একটু জল হয়ে যায় । এবারে তার কোনো চিহ্নমাত্র নেই ।
কিছুপরে সজনী ফিরল । ঘর্মাক্ত, বিদ্ধস্ত বৌ । দশরথ কিছু জিগেস করার আগেই সে তাকে দেখে ডুকরে কেঁদে উঠল । দশরথ বলল, কি হয়েছে রে তোর সজনী ?
সজনী জানাল তারা যখন জল নিয়ে ফিরছিল, গেলহোর গ্রাম আর ঐ ঝোরার মধ্যিখানে গেলহোর পাহাড়ের যে বিশাল পর্দা পেরিয়ে তাদের যেতে হয় সেখানে বাঁক নিতে গিয়ে সজনীর পাহাড়ের সাথে ধাক্কা লেগে মাটির কলসী ফেটে গেছে । জল তো পড়েই গেছে সেই সাথে এক্ষুণি মাটির কলসী না কিনলে কাল আবার জল আনা হবেনা । তাই সে কাঁদছে । সজনী মাথাতেও খুব ব্যাথা পেয়েছে । পা'টাও খানিক কেটে গেছে পাথর লেগে ।
দশরথ সজনীকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল আজ সে পঞ্চাশ টাকা পেয়েছে কাজ করে । তাই দিয়ে এখুনি হাট থেকে না হয় কলসী কিনে আনবে । কিন্তু মনে মনে ভাবল দশরথ কাল কি হবে? এই খোঁড়া পা আর মাথায় চোট নিয়ে সজনী কি করে যাবে খাবার জল আনতে অতদূরে ?
মনে মনে সে খুব কষ্ট পেল । এর একটা বিহিত করতে হবে । পাহাড় পাহাড় পাহাড় ! এই সর্বনাশা পাহাড়কে হটিয়ে দিলেই এ গাঁয়ের মানুষের আর অতটা ঘুরপথে জল আনতে যেতে হবেনা । যে কথা সেই কাজ । সে ঠিক করে ফেলল প্রতিদিন ভোরে কাজে বেরোনোর সময় একটু একটু করে পাহাড় কাটবে সে । এই ভাবে রোজ যতটুকুনি পারা যায় আর কি ! রাজনৈতিক নেতাদের যখন হুঁশ হলনা সে তো আছে তার গাঁয়ের মানুষের পাশে । তাহলে আর কেমন মানুষ সে ? মানুষের উপকারেই যদি না এল তবে আর সে কেমন মানুষ ?
পরদিন থেকেই হাতুড়ি আর ছেনি নিয়ে পাহাড় কাটার কাজ শুরু করে দিল সে । তার কাজের পথে আসা যাওয়ার সময়ে যতটুকুনি হয় ততটুকুনি সই । দশরথ তার মায়ের কাছে ছেলেবেলায় শুনেছিল তিলে তিলে সঞ্চয় হয় তিলভান্ড। বিন্দু বিন্দু জলকণায় তৈরী হয় বিশাল সমুদ্র। এককণা এককণা করে বালি সঞ্চিত হয়ে মরুভূমি তৈরি হয় । তাহলে একটু একটু করে পাহাড়ে ঘা মেরে কেনই বা সে পারবে না একফালি পথ বের করতে । জীবনতো মোটে একটাই । গাঁওয়ালি বন্ধুর বাড়িতে টিভির ঐ বিজ্ঞাপনটির কথা বড় মনে ধরেছিল তার " কুছ্ কর কে দিখানা হ্যায় " - কিছু করে তাকেও দেখাতে হবে ।
সরকারি সাহায্যের জন্য আবেদন পত্র নিয়ে যখন দশরথ ঘুরেছিল হন্যে হয়ে তখন কিছু মানুষ খুব ঠাট্টা করেছিল আর হেসে বলেছিল ঐ পাহাড় নিয়ে তোমার যদি অত মাথা ব্যাথা হয় তাহলে তুমি নিজেই না হয় ঘা মেরে উড়িয়ে দাও পাহাড়টাকে । দশরথ সেদিন মনে মনে খুব আঘাত পেয়েছিল আজ নিজেই সেই আঘাতের প্রতিশোধ নিতে উদ্যত হল । শুধুমাত্র ছেনি আর হাতুড়ি সাথে । আর রইল পাশে দশরথের বাহুবল ও মনোবল একজোটে । শুরু হল পাহাড় নিধন যজ্ঞ । রোজ একটু একটু করে কাটে সে । কাকডাকা ভোরে বাড়ি থেকে বের হয় কাজে যাবার সময় । কাজ শুরু আটটা নাগাদ । তার আগে যতটা এগিয়ে রাখা যায় । আবার ফেরার পথে বাকিটুকুনি । যতক্ষণ না সূয্যি ডুবে যায় । পাহাড়ে হাতুড়ি মারে । ছেনি দিয়ে কাটে । গর্ত করে । দুদন্ড জিরোয় । তোবড়ানো পলিথিন বোতলে জল ভরা থাকে খাবার জন্যে । চোখেমুখে জলের ছিটে দেয় । একটু চুমুক দেয় সেই জলে । আবার কাটে পাহাড় । সবশেষে পা দিয়ে সরিয়ে দেয় টুকরো গুলো । আবার চলে গন্তব্যস্থলে ।
এইভাবে বাইশ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে সেই গেলহোর পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে দশরথ সাড়ে তিনশো ফুট লম্বা, পঁচিশ ফুট উঁচু আর তিরিশ ফুট চওড়া এক পথ সে বের করে ফেলে । ততদিনে সজনীর মৃত্যু হয়েছে । কিন্তু গাঁয়ের মানুষেরা দশরথের কাছে আজন্ম ঋণি হয়ে গেছে । আর তাদের পানীয় জল আনতে সাত কিলোমিটার বেশী পথ ঘুরে যেতে হয় না । জল আনা কত সহজ করে দিয়েছে দশরথ । মাননীয় নেতারা দশরথকে পুরষ্কার দিয়েছেন । কতবার টিভিতে দশরথের ইন্টারভিউ হয়েছে । ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে দশরথের মৃত্যু ঘটেছে এরপর । আর সরকারীভাবে ঐ রাস্তাটির নাম ঘোষিত হয়েছে দশরথ রোড ।
ছবিঃত্রিপর্ণা মাইতি