কথায় বলে বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। সারা বছর ধরেই নানারকমের ধর্মীয় এবং সামাজিক অনুষ্ঠান লেগেই রয়েছে। তা এই নানান পার্বণের সঙ্গে জুড়ে থাকা গল্পগুলি সাথে আমরা তো অনেকটাই পরিচিত। আজকেও সেইরকম এক পার্বণের দিন। আজ কার্তিকপুজোর দিন। যদিও মা-দুর্গার বাকি ছেলেমেয়েদের – লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশের পুজো নিয়ে বাঙালিরা সর্বজনীনভাবে যতটা হইচই করে, কার্তিক ঠাকুরের পুজো নিয়ে সেরকম বিরাট হইচই সর্বত্র হয়না, কিন্তু তাহলেও, জেনে নি কার্তিক ঠাকুর সম্পর্কে দু-চার কথা।
কার্তিকঠাকুর আসলে কে ?
কেউ তাঁকেে বলে স্কন্দ, কেউ বলে মুরুগন আবার কেউ ডাকে সুব্রহ্মণ্য বলে। তিনি আসলে দেব সেনাপতি, যুদ্ধের দেবতা । আমাদের কাছে জনপ্রিয় কার্তিকেয় বা কার্তিক নামে, শিব ও পার্বতীর পুত্র রূপে। দেবলোকে যেখানেই যুদ্ধ হয় সেখানেই কার্তিকের ডাক পড়ে।
পুরাণ অনুসারে হলুদবর্ণের কার্তিকের ছটি মাথা। তাই তাঁর অপর নাম ষড়ানন। যুদ্ধের দেবতা বলে নাকি তাঁর ছটি মাথা। চারিদিক থেকে তাঁর লক্ষ্য অবিচল। পাঁচটি ইন্দ্রিয় অর্থাত চোখ, কান, নাক, জিভ ও ত্বক ছাড়াও একাগ্র মন দিয়ে তিনি যুদ্ধ করেন। । তাঁর হাতে থাকে বর্শা-তীর-ধনুক।
আবার কারো মতে মানব জীবনের ষড়রিপু- কাম(কামনা), ক্রোধ (রাগ), লোভ(লালসা),মদ(অহং), মোহ (আবেগ), মাত্সর্য্য (ঈর্ষা)কে সংবরণ করে দেব সেনাপতি কার্তিক যুদ্ধক্ষেত্রে সদা সজাগ থাকেন। এই ষড়রিপু মানুষের জীবনের অগ্রগতির বাধা তাই জীবনযুদ্ধে জয়লাভ করতে গেলেও কার্তিকের মত সজাগ ও সচেতন থাকতে হবে।
পুরাণমতে তিনি তরুণ সদৃশ, সুকুমার, শক্তিধর এবং সর্বসৈন্যের পুরোভাগে অবস্থান করে । তাই মাদুর্গার যুদ্ধযাত্রায় এমন শৌর্যবীর্য সম্পন্ন পুত্র সঙ্গী না হয়ে যায় কোথায় !
বলতো কেন কার্তিকের বাহন ময়ূর?
স্কন্দঃ অষ্টম শতকের ভাস্কর্য
কার্তিকের বাহন আমাদের জাতীয় পাখী আলস্যহীন ময়ূর । ময়ূরের পায়ে একটি সাপ অর্থাত অহংবোধ ও কামনা বাসনা বলি দিয়ে তিনি যুদ্ধ করতে ব্যস্ত। ময়ূর অত্যন্ত সজাগ এবং কর্মচঞ্চল পাখী । সৈনিক কার্তিকের সবগুণগুলি সে বহন করে ।
কোনো কোনো মতে রণ-দেবতা কার্তিক হলেন আকুমার ব্রহ্মচারী। আবার কোনো কোনো পুরাণ মতে কার্তিকের পত্নী হলেন ইন্দ্রের কন্যা দেবসেনা বা লক্ষ্মীরূপিণী ষষ্ঠী।
তাঁর নাম কার্তিক কেন ?
কৃত্তিকা নক্ষত্রে তাঁর জন্ম হয়েছিল এবং ছয় কৃত্তিকার দ্বারা তিনি পুত্ররূপে গৃহীত ও প্রতিপালিত হন বলে তাঁর নাম কার্তিকেয় বা কার্তিক। তাঁর আরো অনেক নাম আছে যেমন গুহ, পাবকি, মহাসেন, ষন্মুখ,কুমার, কুমারেশ, গাঙ্গেয়, বিশাখ, মহাসেন, কুক্কুটধ্বজ, নৈগমেয়।
কেন তাঁকে আমরা পুজো করি জানো?
ব্রহ্মার বরে মহাবলী তারকাসুরের নিধনের জন্যই নাকি অমিতবিক্রম যোদ্ধা কার্তিকের জন্ম হয়েছিল। কেউ বধ করতে পারছিলনা তারকাসুরকে। তার অত্যাচারে দেবকুল অতিষ্ঠ । আর দৈববলে অজেয় শক্তি সম্পন্ন এই দেবশিশু কার্তিকেয় তারকাসুর নিধন করেছিলেন ।
আর এই তারকাসুর নিধন করে দেবকুলে কার্তিক গেলেন দেবসেনাপতি। তাই কার্তিকের পুজো হয় মহাসমারোহে।
দেবতারূপে কার্তিক একসময়ে সারা ভারতীয় উপমহাদেশেই খুব জনপ্রিয় ছিলেন। ভারতীয় পুরাণগুলির মধ্যে স্কন্দ পুরাণে কার্তিকের বিষয়ে সবিস্তারে লেখা আছে। তাছাড়াও মহাভারতে এবং সঙ্গম তামিল সাহিত্যে কার্তিকের নানা বর্ণনা রয়েছে। আমাদের জাতীয় যাদুঘরে ( ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামে) বারোটি হাত যুক্ত কার্তিকের একটি অভিনব মূর্তি রক্ষিত আছে।
তামিলদের পূজ্য মুরুগন
কিন্তু সময়ের সাথে সাথে উত্তর ভারতে কার্তিকের প্রভাব কমে আসে। আরাধ্য দেবতা রূপে কার্তিক উত্তর ভারতীয়দের থেকে অনেক বেশি জনপ্রিয় দক্ষিণ ভারতে। তামিলদের কাছে তিনি মুরুগন নামে, আর অন্ধ্রপ্রদেশ ও কর্ণাটকে তনি সুব্রহ্মণ্য নামের পুজিত হন। তামিলদের কাছে মুরুগন প্রধান আরাধ্য দেবতাদের মধ্যে একজন। ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলির মধ্যে যেখানেই তামিলদের সংখ্যা বেশি, যেমন শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, মরিশাস- সেখানেই মুরুগন পরিচিত এবং সাড়ম্বরে পুজিত হন।
আধুনিক বাঙালিদের মধ্যে কার্তিক ঠাকুর পুজো নিয়ে খুব বেশি হইহুল্লোড় হয় না। দুর্গাপুজোর পরেপরেই কিছুদিনের মধ্যেই কার্তিকমাসের সংক্রান্তিতে হয় কার্তিকের পুজো। কোন কোন প্রাচীন পরিবারে ধারাবাহিকভাবে, এবং এক-দুটি বিশেষ অঞ্চলে খুব হইচই করে এই পুজো হয়; কিন্তু সর্বজনীন পুজো হিসাবে কার্তিকপুজো বাঙালি সমাজে এখন আর সেরকম জনপ্রিয় নয়।
সেই কমে আসা উৎসাহ থেকেই সম্ভবতঃ মুখে মুখে তৈরি হয়েছে এই ছড়া -
"কার্তিক ঠাকুর হ্যাংলা,
একবার আসেন মায়ের সাথে,
একবার আসেন একলা।"
এটা কিন্তু খুব অন্যায়। একলা কার্তিকই খালি দুবার আসেন নাকি? মা-দুর্গার বাকি ছেলেমেয়েরাও কি আলাদা করে আরেকবার আসেন না?
ছবিঃউইকিপিডিয়া