সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo

আগে ("গ্রীনহাউস এফেক্ট"-এ) বলা হয়েছে, গ্রীনহাউস এফেক্ট ও বিশ্ব উষ্ণায়নের একটা বড় কারণ বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইড বেড়ে যাওয়া আর সেটা কমানোর দুই প্রধান উপায় ফসিল জ্বালানির ব্যবহার কমানো ও গাছের সংখ্যা বাড়ানো। প্রথমে দেখা যাক, ফসিল জ্বালানি ব্যবহার কীভাবে কমানো যায়।

ফসিল জ্বালানি মানে কয়লা ও পেট্রোলিয়াম-জাত পদার্থ (পেট্রোল-ডিজেল-কেরোসিন ইত্যাদি)। আজকাল কয়লার মূল ব্যবহার তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিদ্যুৎ তৈরিতে। আর পেট্রো-পদার্থ লাগে এরোপ্লেন, জাহাজ, ট্রেন, বাস, মোটর ইত্যাদি যানবাহন চালাতে। কল-কারখানায় অবস্থা অনুযায়ী কয়লা বা পেট্রো-পদার্থ ব্যবহার করা হয়। ফসিল জ্বালানি পুড়িয়ে যে শক্তি হয় তা আধুনিক সভ্যতাকে চালাচ্ছে, কাজেই বললেই তার ব্যবহার কমানো যায় না। এর জন্য চাই এমন বিকল্প শক্তি, যার ব্যবহারে কার্বন ডাই-অক্সাইড তৈরি হয় না।

পৃথিবী সমস্ত শক্তিই সরাসরি বা ঘোরাপথে পায় সূর্যের থেকে। সূর্যের শক্তি সরাসরি আসে মূলতঃ তাপশক্তি হিসেবে। তারই এক ছোট্ট অংশ বহু যুগ ধরে নানা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে জমা হয় ফসিল জ্বালানির মধ্যে। কিন্তু সৌরশক্তির এক বিরাট অংশই আমাদের কোন কাজে লাগে না। ফসিল জ্বালানি গ্রীনহাউস এফেক্ট ও বায়ুদূষণ তৈরি করে। অন্যদিকে, এই জ্বালানির ভাণ্ডার ক্রমে ফুরিয়ে আসছে। বিকল্প শক্তির উৎস হিসাবে তাই বিশ্বের নজর আজ পড়েছে সরাসরি সৌরশক্তি ব্যবহারের দিকে।

solar oven
সৌরশক্তি চালিত উনুন

সৌরশক্তিকে সরাসরি তাপ সৃষ্টির কাজে লাগানো সোজা। প্রথমে লেন্স বা "ডিশ" অ্যানটেনার মতো অধিবৃত্ত (প্যারাবোলা) আকৃতির প্রতিফলক দিয়ে অনেকটা জায়গার রশ্মিকে এক জায়গায় জড়ো করা হয়। সেখানে ধাতুর পাত বা টিউব রেখে তার সাহায্যে ছাদের ট্যাঙ্কের জল গরম রাখা যায়। আবার "সোলার কুকার" -এ এই ঘনীভূত রশ্মি একটা কাঁচের বাক্সের মধ্যে ফেলে রান্নাবান্না করা যায়। কাঁচের বাক্সটা "গ্রীনহাউস এফেক্ট"-এর সাহায্যে সূর্যের বিকিরিত তাপ ধরে রাখে। বিকিরিত তাপ ধরে রাখার জন্য ভেতর দেওয়ালে কালো আচ্ছাদনও দেওয়া হয়। বিভিন্ন প্রয়োগের এ মাত্র দু’টি প্রধান উদাহরণ।

solar panel
সোলার প্যানেল

আধুনিক সভ্যতা অবশ্য বিদ্যুৎনির্ভর। "সোলার সেল"-এর মাধ্যমে সৌরশক্তিকে বিদ্যুৎশক্তিতে পরিণত করে কাজে লাগানো হয়। "সোলার সেল" মূলতঃ "ফোটো-ভোল্টায়িক" সেল, অর্থাৎ আলোকশক্তিকে বিদ্যুৎশক্তিতে পরিণত করার এক ব্যবস্থা। "ফোটো-ইলেকট্রিসিটি" অর্থাৎ আলোকরশ্মিকে বিশেষ ধরণের কতগুলি ধাতুর ওপর ফেলে বিদ্যুৎকণা ইলেকট্রনের বিচ্ছুরণের তত্ত্ব আবিস্কার করে আইনস্টাইন নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। এই তত্ত্ব আজ ডিজিটাল ক্যামেরা থেকে আরম্ভ করে লিফটের দরজা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হওয়া অবধি অজস্র কাজে লাগানো হচ্ছে। মুশকিল এই যে এক একটি "সোলার সেল"-এর শক্তি খুব সামান্য। তাই বাস্তব প্রয়োগের জন্য সারি সারি সোলার সেল বসিয়ে "সোলার প্যানেল" তৈরি করা হয়।

বিভিন্ন দেশে সৌরবিদ্যুৎ রাস্তার আলো, ঘরবাড়ি এমনকি অফিস-কাছারিতেও ব্যবহার হচ্ছে। কিন্তু পৃথিবীর অধিকাংশ জায়গায় সূর্যের জোরালো রশ্মি দিনের বা বছরের অধিকাংশ সময়েই পাওয়া যায় না। তাই সৌরশক্তি বা সৌরবিদ্যুতের বিকল্প রাখতে হয়। তাতে সব মিলিয়ে ফসিল জ্বালানী ব্যবহার বন্ধ না হলেও কমানো যায়। কোন কোন উন্নত দেশে উৎপন্ন সৌর বিদ্যুৎ "গ্রিড" অর্থাৎ জাতীয় বিদ্যুতের ভাণ্ডারে যোগ করার সংস্থানও আছে। অনেক দেশে কুড়ি-তিরিশ শতাংশ বিদ্যুতের চাহিদা সৌরবিদ্যুৎ দিয়ে পুরণ হচ্ছে। ভারতও এব্যাপারে পিছিয়ে নেই, যদিও এই গরমের দেশে এক্ষেত্রে আরো অনেক বেশি করা সম্ভব।


পারমাণবিক ফিশন ও ফিউশনের তফাৎ

আরেক বিকল্প হচ্ছে পারমাণবিক (অ্যাটমিক) শক্তি। যে পদার্থকে ভেঙে একাধিক রাসায়নিক উপাদান পাওয়া যায় না, তাকে বলে মৌলিক পদার্থ বা মৌল। স্বাভাবিক মৌলের সংখ্যা ৯২, এর সাথে যুক্ত হয়েছে কৃত্রিম পদ্ধতিতে তৈরি কিছু মৌল। মৌলের এক প্রবণতাকে সহজ করে বলা যায় – ভারী মৌল ভাঙতে চায় আর হালকা মৌল জুড়তে চায়। প্রথম প্রক্রিয়াকে বলে "ফিশন" আর দ্বিতীয়টাকে "ফিউশন"। ভারী মৌল, যেমন ইউরেনিয়াম বা কৃত্রিমভাবে তৈরি প্লুটোনিয়ামের পরমাণুর "ফিশন"-এ পরমাণু ভেঙে সম্পূর্ণ নতুন দুই মৌল তৈরি হয় আর এই প্রক্রিয়ায় বেরিয়ে আসে বিপুল পরিমাণ শক্তি। এই শক্তি একচোটে বেরিয়ে এলে সেটা হচ্ছে অ্যাটম বোম, যাকে সৃজনশীল কাজে লাগানো অসম্ভব। কিন্তু এই শক্তিকে নিয়ন্ত্রিত করে একটু একটু করে বের করে আনা সম্ভব আর সেটাই করা হয় "নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর" যন্ত্রে। তার থেকে ধীরে ধীরে যে তাপ বেরিয়ে আসে, তার সাহায্যে জল গরম করা হয়। সেই জল বাস্প হয়ে স্টীম টার্বাইন ঘোরায়, যা আবার বিদ্যুৎ তৈরির যন্ত্র জেনারেটর ঘোরায়। এইভাবে পরমাণুর শক্তি থেকে তাপশক্তি, তার থেকে বিদ্যুৎশক্তি তৈরি হয়।

nuclear power plant
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের একটি পারমাণবিক শক্তি উৎপাদন কেন্দ্র

পারমাণবিক শক্তিতে কার্বন ডাই-অক্সাইড দূষণ নেই। তবে রিঅ্যাক্টরে যে "পারমাণবিক বর্জ্য" তৈরি হয়, তাতে শরীরের পক্ষে অত্যন্ত বিপজ্জনক তেজস্ক্রিয়তা থাকে। আর কোন কারণে দুর্ঘটনা ঘটে তেজস্ক্রিয় পদার্থ বাতাসে ছড়িয়ে গেলে তা লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণহানি ঘটাতে পারে, এমনকি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পক্ষেও মারাত্মক হতে পারে। আমেরিকার থ্রি-মাইল আইল্যান্ড ও রাশিয়ার চেরনোবিলের পর জাপানে সাম্প্রতিক ভূমিকম্পের ফলে যে পারমাণবিক দুর্ঘটনা ঘটলো তাতে বিশ্বের সবাই এ ব্যাপারে হুঁশিয়ার হয়ে গেছেন। পারমাণবিক শক্তিকে বাদ দিয়ে এগোন যায় না। তবে এ ব্যাপারে সাবধানতা শিকেয় তুলে মাত্রাছাড়া হওয়ারও উপায় নেই।

হাইড্রোজেন, হিলিয়াম প্রভৃতি "হালকা" মৌলের একাধিক পরমাণু জুড়ে "ফিউশন" -এর সাহায্যেও প্রচুর পরিমাণ শক্তি পাওয়া যায়। সূর্যের অমিত পরিমাণ শক্তির মূলে এই "ফিউশন"। পৃথিবীতে "ফিউশন"-এর সাহায্যে হাইড্রোজেন বোম তৈরি করা হয়, যা শক্তিতে অ্যাটম বা ফিশন বোমের অনেকগুণ বেশি। এই "ফিউশন"কে নিয়ন্ত্রিত করার চেষ্টা চলছে। কিন্তু কোন উপায় এখনও বেরোয় নি এবং অদূর ভবিষ্যতেও বেরোবে কিনা সন্দেহ। সেটা কোনদিন সম্ভব হলে শক্তি সমস্যার দীর্ঘস্থায়ী সমাধান হতে পারে।

hydral power plant
ভারতের সর্দার সরোবর জলবিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প

এই দুই পদ্ধতি ছাড়া "কার্বনহীন" শক্তির অন্যতম উৎস জলবিদ্যুৎ, যা প্রবাহিত নদীর শক্তি কাজে লাগিয়ে তৈরি করা হয়। বাঁধে নদীর জল আটকে উঁচু থেকে একটু একটু করে চাকার ওপর ফেললে চাকাটা ঘোরে। এই চাকা বিদ্যুতের জেনারেটর ঘোরায়। ভারতে উৎপন্ন বিদ্যুতের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ জলবিদ্যুৎ। এই পদ্ধতি দূষনহীন। কিন্তু বাঁধের জলাধার বানাতে অজস্র গাছ কাটতে হয়, অনেক মানুষ বাসস্থান ও জীবিকা থেকে উৎখাত হন। তাছাড়া বাঁধের জল ঠিকমতো নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে সেটা বন্যা দূর করে না, তৈরি করে।

আরো যেসব "কার্বনহীন" শক্তি কাজে লাগানো হচ্ছে তার মধ্যে আছে উইন্ডমিলের সাহায্যে বায়ুশক্তি, উষ্ণ প্রস্রবনের গরম জলের তাপশক্তি, এমনকি জোয়ার-ভাঁটার শক্তি। কিন্তু এর কোনটাতেই নিশ্চিত ও নিয়মিত শক্তি পাওয়া যায় না। তাই অন্য বিকল্পের সাথে এগুলোকে জুড়ে অবিচ্ছিন্ন শক্তিভাণ্ডার তৈরি করতে হয়।

সভ্যতার উন্নতির সাথে সাথে শক্তির চাহিদা দ্রুত বাড়ছে। এই চাহিদা মেটানো, সাথে সাথে ফসিল জ্বালানির ব্যবহার কমানোর কোন ম্যাজিক সমাধান নেই। তাই সব দিকেই চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। কার্বনহীন শক্তির উৎসগুলিকে বিকশিত ও উন্নততর করা আর উন্নততর যন্ত্র ও পদ্ধতি উদ্ভাবন করে শক্তির ব্যয় কমানোর জন্য গবেষণা চালিয়েই যেতে হবে। তোমরা অনেকেই নিশ্চয়ই এই কাজে এগিয়ে আসবে।

কাজ সহজ নয়। কিন্তু কী করতে হবে প্রথমে সেই উপলব্ধি এলে কোন পথে এগোতে হবে, তা কাজের মধ্য দিয়ে ঠিক বেরিয়ে আসবে।


ছবিঃ উইকিপিডিয়া এবং অন্যান্য বিজ্ঞানভিত্তিক ওয়েবসাইট

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনীয়ার ও মুম্বইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চের অবসরপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী অনিরুদ্ধ সেন কলকাতা-মুম্বইয়ের বিভিন্ন সাময়িকপত্র ও ওয়েব ম্যাগাজিনের নিয়মিত লেখক। তাঁর লেখা ও অনুবাদ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়, এবং সংকলিত বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা