সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
ভবিষ্যতের দ্বীপে
(১)

"বলছেন ছেলে তিনজন কিডন্যাপ হয়েছে? কিন্তু ওরা তো ক্লাসফ্রেন্ড আর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কী করে বুঝলেন, নিজেরা প্ল্যান করে বাড়ি পালায়নি?" বললেন ইনস্পেকটর বসাক।
"প্ল্যান করে পালালে কি তিনজন ভিন্ন দিনে, ভিন্ন সময়ে হারিয়ে যায়?" বললেন শিক্ষিকা তৃপ্তি ঘটক।
"হয়তো একত্রে পালাতে গেলে চোখে পড়ে যেতে পারে দেখে আলাদা আলাদাভাবে বেরিয়ে কোথাও গিয়ে মিলেছে। তারপর দেখুন, প্রত্যেকেই তো প্রায় একই বয়ানে আলাদা আলাদা চিঠিতে লিখে পাঠিয়েছে যে বাবা-মা যেন চিন্তা না করে, লকডাউনের বন্দি জীবন আর একঘেয়ে অনলাইন ক্লাস অর্থহীন হয়ে ওঠায় সে লকডাউন সামান্য শিথিল হতেই কিছু কাজের কাজ করার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ছে। হাতের লেখাগুলোও তো ছেলেদের বলেই বাবা-মা'রা শনাক্ত করেছেন।"
"তার থেকে বোঝায়, যারা ওদের দিয়ে জোর করে ওগুলো লিখিয়ে নিয়েছে তারা একই দলের লোক। উঁহু, আমি ওদের ক্লাস টিচার আর ছেলেগুলোকে ভালোভাবেই চিনি। ওরা বাড়ি পালানো ছেলে নয়, পড়াশোনায় মনোযোগী, অন্তর্মুখী। ওরা প্রত্যেকেই বিজ্ঞান বলতে পাগল। এই তো লকডাউনের কিছুদিন আগে একটা ইন্টার স্কুল সায়েন্স এক্সিবিশনে ওদের চারজনের টিমের এক্সিবিটটা উচ্চ প্রশংসিত হল।"
"চারজনের?" ইনস্পেকটর বসাককে উৎসুক দেখাল, "চতুর্থজন কে? সে হারায়নি?"
"না। জয়, উদয়ন আর দেবলকে পাওয়া যাচ্ছে না। ওরা সবাই ক্লাস নাইনের ব্রাইট স্টুডেন্ট। কিন্তু চতুর্থ জন অর্থাৎ সত্যেন শুধু ভালো নয়, ফার্স্ট বয়। ঐ তিনজনের সাথে সত্যেনেরও গভীর বন্ধুত্ব। তবে সত্যেনদের আর্থিক অবস্থা তত ভালো নয়। ওর নিজের মোবাইল না থাকায় যেদিন বাবার মোবাইলটা পায় সেদিন অনলাইন ক্লাস করতে পারে, অন্য দিনগুলোতে নয়।"
"তাহলে তো ব্যাপারটা স্পষ্ট। পালাতে গেলে মালকড়ি লাগে। অন্য তিনজন বড়লোকের ছেলে, ম্যানেজ করেছে। সত্যেন টাকা জোগাড় করতে পারেনি দেখে আটকে গেছে।"
"কিন্তু ছেলেদের বাবা-মা'রা বলেছেন, কোনও টাকা হারায়নি।"
"বড়লোকের ছেলেদের ঢালাও হাতখরচ দেওয়া হয়। তার থেকে জমিয়ে পালাবার টাকা জোগাড় করা তেমন ব্যাপার নয়।"
"এমনও তো হতে পারে, সত্যেনের মুক্তিপণ দেবার ক্ষমতা নেই দেখে কিডন্যাপারদের নজর তার দিকে যায়নি?"
"কিন্তু প্রায় এক সপ্তাহ হয়ে গেল, কেউ তো এখনও মুক্তিপণ চায়নি।"
"তাহলে হয়তো উদ্দেশটা অন্য — যদি অর্গান ট্রান্সপ্লান্ট হয়? উঃ, আমি আর ভাবতে পারছি না। আপনারা শিগগিরই কিছু একটা করুন, ইনস্পেক্টর।" তৃপ্তি দু'হাতে মুখ ঢাকলেন।
"শান্ত হোন, মিস ঘটক।" ইনস্পেকটর বললেন, "তেমন মতলব থাকলে তো সম্বলহীন ছেলেটিকেই আগে তোলার কথা, যার কিছু হলে তেমন শোরগোল হবে না। আর আমরাও বসে নেই, সব চেষ্টাই করছি। তবে আবার বলছি, ছেলেগুলো পালিয়ে গেছে। ওদের আমরা ঠিক খুঁজে পাব।"
"তাই যেন হয়। কিন্তু আমার মন কেন যেন কুডাক ডাকছে। আচ্ছা ইনস্পেক্টর, ওদের মোবাইল লোকেশন ট্রেস করা হয়েছিল?"
"অবশ্যই। এখন লকডাউনের বাজারে স্কুলের বাচ্চারা তো বাড়ি থেকে বিশেষ বেরোয় না। ওদের দুজন বেরিয়েছিল খাতাপত্র ইত্যাদি টুকিটাকি কিছু কেনার অজুহাতে, তৃতীয়জন পার্কে গিয়ে হাঁটবে বলে। কেউ বেরিয়েছিল দুপুরে, কেউ সন্ধে নাগাদ। যদ্দুর ট্রেস করা গেছে, বাড়ি থেকে কিছুদূরে যাওয়ার পর ওদের সিগনাল অফ হয়ে যায়। তারপরে তা আর অন হয়নি।"
"কিছুদূরে মানে, কোনও বড় রাস্তায়? তাহলে তো সেখানে কী ঘটেছিল সে ব্যাপারে কোনও সাক্ষী  থাকতে পারে।"
"অতটা নিখুঁতভাবে তো লোকেশন ট্রেস করা যায় না। তবে অনুমান কোনও বড় রাস্তায় নয়, গলিতেই ওরা মোবাইল অফ করে দিয়েছিল। লকডাউনের বাজারে অলিগলিতে লোকজন তো তেমন থাকে না।"
"অর্থাৎ কেউ ওদের ওপর নজর রাখছিল। যখনই ছেলেগুলোকে নিরালায় পেয়েছে, উঠিয়ে নিয়ে গেছে।"
"একটু অদ্ভুত শোনাচ্ছে না, ম্যাডাম? জনবিরল রাস্তায় দিনের পর দিন কেউ চব্বিশ ঘণ্টা নজর রাখছে একটা ছেলে কখন বেরোবে আর কখন তাকে একা পাওয়া যাবে। অথচ লোকটা কারও নজরে পড়ল না। আর এভাবে একজনকে নয় তিন তিনজনকে আলাদা আলাদা জায়গা থেকে তুলে নিয়ে গেল?"
"হুঁ, অনেক কিছুই ধোঁয়াশায়। তবু আমার মন বলছে ছেলেগুলি বিপদে পড়েছে, ভীষণ বিপদ। আর সত্যেনও সেই বিপদের আওতার বাইরে নয়।"
"আমার ধারণাটা অবশ্য অন্য। তবে আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে সত্যেন তিন বন্ধুর ব্যাপারে কিছু জানলেও জানতে পারে। ভাবছি একবার ওকে ডেকে পাঠাব।"
"তার আগে আমিই একবার —" তৃপ্তি বললেন, "ঠিক আছে, এখন উঠি।"

(২)

"আসুন, টিচার।" সত্যেনের বাবা জগদীশ বাবু সসঙ্কোচে তৃপ্তিকে অভ্যর্থনা জানিয়ে বললেন, "সত্যেন একটু দোকানে গিয়েছে, এক্ষুণি ফিরবে।"
"ও কি প্রায়ই এমন বেরোয়?"
"হ্যাঁ। আমি কাজে বেরোই, ওর মা ঘরে বসে সারাদিন সেলাই মেশিন চালায়। তাই কেনাকাটা, আরও কিছু ঘরসংসারের কাজ ও-ই করে।"
"আচ্ছা, আপনি জানেন যে ওর ক্লাস ফ্রেন্ড জয়, উদয়ন আর দেবলকে পাওয়া যাচ্ছে না?"
"সে কী টিচার, ওদের পাওয়া যাচ্ছে না?" তৃপ্তি দেখলেন, কাঁধে থলি ঝুলিয়ে সত্যেন ঘরে ঢুকছে, তার মুখ শুকিয়ে গেছে।
"আশ্চর্য, তুমি জানো না?"
"না। আসলে এখন তো স্কুল বন্ধ, তাই ফোনেই ওদের সাথে যেটুকু যোগাযোগ। আমি সব অনলাইন ক্লাস করতে পারি না দেখে মাঝে মাঝে ফোন করে পড়াগুলো জেনে নিই। কিন্তু গত ক'দিন ধরে ওদের ফোনে পাচ্ছি না দেখে ভাবছিলাম —"
"তোমাকে ওরা বলেনি কোথাও যাবার প্ল্যান আছে?"
"না তো।"
"গত সাতদিনে ওদের সাথে কোনও যোগাযোগ হয়নি?"
"না। ফোন তো আমি রোজ করি না। দিন দশেক আগে জয়কে ফোন করেছিলাম, তখন ও পড়াশোনা ছাড়া অন্য কোনও ব্যাপারে কথা বলেনি। আবার দিন চারেক আগে দেবলের কাছে একটা পড়া জানার দরকার ছিল। ওর ফোন সুইচড অফ দেখে ফোন করি জয়কে আর তারপর উদয়নকে। কাউকে না পেয়ে ভাবছিলাম কী হল, তারপর আজ আপনার কাছ থেকে ব্যাপারটা জানলাম। আচ্ছা টিচার, ওদের কোনও বিপদ হয়নি তো?"
"আশা করছি, কোনও বিপদ ঘটার আগেই ওরা ফিরে আসবে।" চিন্তিতমুখে বললেন তৃপ্তি, "আচ্ছা, সাধারণভাবে পড়াশোনা ছাড়া তোমাদের মধ্যে কোনও বিষয়ে আলোচনা হয় না?"
"হয় তো!" সত্যেনের বিষাদাচ্ছন্ন মুখ মুহূর্তে উজ্জ্বল হয়ে উঠল, "আমরা সবাই যে বড় হয়ে বিজ্ঞানী হব। তাই বিজ্ঞান নিয়ে আমাদের মধ্যে প্রায়ই আলোচনা হয়। এটাওটা বানাবার চেষ্টাও করি।"
"তোমরা সায়েন্স এক্সিবিশনেও তো একটা প্রজেক্ট করেছিলে?"
"হ্যাঁ, গ্রীন বা দূষণহীন এনার্জির ওপর। ভারতে সৌরশক্তি অঢেল পাওয়া যায়। তার সাহায্যে জল বাষ্পীভূত করে তার থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা আর তারপর আধুনিক প্রযুক্তি 'গ্রাফিন'এর সাহায্যে সস্তায় শক্তিশালী ব্যাটারি তৈরি করে সেই বিদ্যুৎশক্তি ধরে রাখার একটা 'হাইব্রিড' সিস্টেম আমরা মডেল বানিয়ে দেখিয়েছিলাম। সেটা 'ওয়ার্কিং মডেল' ছিল না, তাই কোনও প্রাইজ পাইনি। কিন্তু বিচারকরা আমাদের আইডিয়ার খুব প্রশংসা করেছিলেন, বিশেষ করে বিদেশ থেকে আসা প্রধান বিচারক।"
"ওখানে কি কেউ তোমাদের ঠিকানা চেয়েছিল?"
"না। তবে আমাদের চারজনের ফোন নম্বর অর্গানাইজারদের কাছে ছিল।"
চিন্তিতভাবে তৃপ্তি বললেন, "জগদীশ বাবু, সত্যেনকে ক'দিন একটু সাবধানে রাখবেন। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া যেন বাইরে না যায়।"
"অবশ্যই চেষ্টা করব।" কুণ্ঠিত জগদীশ বললেন, "আমার বাবা ছিলেন একজন ছাত্রদরদী, জ্ঞানান্বেষী বিজ্ঞান শিক্ষক। বিজ্ঞানীদের নাম অনুসারে তিনি ছেলের নাম দিয়েছিলেন জগদীশ আর নাতির নাম সত্যেন। আমি তো সেই নামের মর্যাদা রাখতে পারিনি। এক বেসরকারি অফিসের সামান্য মাইনের চাকুরে আমি। তবু আমার স্ত্রী সারাদিন সেলাই করে বাড়তি রোজগার করে দেখে ছেলেকে মোটামুটি ভালো স্কুলে পড়াতে পারছি, যাতে ও বাবার আশা পূর্ণ করে বিজ্ঞানী হয়। ও পড়াশোনায় এত ভালো। তবু ওকে সবকিছু কিনে দিতে পারি না। ঘরের কাজে ওর সময় নষ্ট হয়। এই লকডাউনের বাজারে ওকে একটা ফোন বা ট্যাবলেট কিনে দিলে সুবিধে হত। কিন্তু —"
"আঃ বাবা, থামো। আমার কোনও অসুবিধা হচ্ছে না, তোমার ফোনেই দিব্যি পড়াশোনার কাজও চালিয়ে যাচ্ছি। টিচার, আপনি চিন্তা করবেন না, আমি সাবধানে থাকব।"
"তোমার সঙ্গে কি ইদানীং কোনও অচেনা লোকের দেখা হয়েছিল? কেউ কিছু জিগ্যেস করেছিল?"
"না তো।"
শুনে জগদীশ একটু ইতস্তত করে বললেন, "তবে আমার সঙ্গে — একদিন সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরছি, হঠাৎ জনা তিনেক অচেনা লোক একটা গাড়ির থেকে নেমে সামনে দাঁড়াল। একজন আমার হাত শক্ত করে ধরে তারপর আমার মুখের দিকে চেয়ে বলল, ধ্যুৎ, রঙ নাম্বার। এ তো দেখছি বুড়ো ভাম। তারপর আমাকে ছেড়ে আবার গাড়ি হাঁকিয়ে চলে গেল।"
"আপনার পুলিশে রিপোর্ট করা উচিত ছিল।"
"এই সামান্য ব্যাপারে — হয়তো অন্য কাউকে খুঁজতে এসেছিল।"
"কী গাড়ি, মনে আছে?"
"মানে, আমি তো গাড়ির মডেল ঠিক চিনি না। তবে দামি গাড়ি নয়।"
চিন্তিত মুখে কিছুক্ষণ কী ভাবার পর তৃপ্তি বললেন, "সত্যেন, তুমি তো বিজ্ঞানে বিশ্বাসী, আমিও একজন বিজ্ঞান শিক্ষক। তবু তোমার কল্যাণকামনায় আমি একটা জিনিস দিচ্ছি, তুমি না কোরো না।" বলে তিনি একটা কালো সুতোয় বাঁধা তাবিজ বের করে ছাত্রের হাতে বেঁধে দিলেন।
"এটা কোনও অবস্থাতেই হাত থেকে খুলবে না। শুধু স্নানের সময় ছাড়া, কারণ এতে জল লাগানো নিষেধ।"
"আমি যদিও — তবু আপনি আমার কল্যাণকামনায় বিশ্বাস করে এটা দিয়েছেন। সেই বিশ্বাসের মর্যাদা দিতে আপনার আদেশ আমি অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলব।"
আসার আগে তৃপ্তি জগদীশের নম্বরটা সেভ করে নিলেন আর বললেন ছেলেগুলোর কোনও খবর পেলেই তিনি জানাবেন।

(৩)

দু'দিন পর তৃপ্তি এক অজানা নম্বর থেকে কল পেলেন। তুলে শুনলেন ওপাশ থেকে জগদীশের বিধ্বস্ত কণ্ঠস্বর, "টিচার, সত্যেনকে পাওয়া যাচ্ছে না।"
"সে কী, আপনি পুলিশে খবর দিয়েছেন?"
"না, আগে আপনাকেই জানালাম — ভাগ্যিস আপনার নম্বরটা ডায়েরিতেও লেখা ছিল!"
"কিন্তু এই নম্বরটা তো আপনার নয়।"
"না। আসলে আমার স্ত্রীর সেলাইয়ের কাজের কিছু জিনিস তাড়াতাড়ি দরকার ছিল। তাই আমি আমার ফোনটা সত্যেনের কাছে রেখে ওকে বলে এসেছিলাম পাড়ার দোকানে দেখতে, না পেলে আমাকে অফিসে ফোন করে জানাতে। ও বেলা এগারোটা নাগাদ বেরিয়েছিল। কিন্তু দু-তিন ঘণ্টার মধ্যেও না ফেরায় আমার স্ত্রী উদ্বিগ্ন হয়ে পড়শির ফোনে আমাকে খবর দেয়। আমি আমার মোবাইল নম্বরে ফোন করে দেখলাম, সুইচড অফ। সাথে সাথে বাড়ি ফিরে পাড়ায়, কাপড়ের দোকানে খোঁজ করলাম, কেউ সত্যেনকে দেখেনি। এখন ঐ পড়শির ফোন থেকেই আপনাকে জানাচ্ছি। কী হবে, টিচার?"
"আগে আপনি পুলিশে ডায়েরি করুন। এক্ষুণি বেলেঘাটা থানায় চলে আসুন। আমিও আসছি।"

(৪)

গাড়িটা তিরবেগে ভি আই পি রোড ধরে উত্তরমুখে ছুটছে। সত্যেন চুপচাপ বসে, তার দুই কাঁধে দুই বলিষ্ঠ হাত।
একটু আগে সে মা'র জন্য খয়েরি কাপড় আর সুতো আনতে দোকানে যাচ্ছিল। গলি থেকে বড় রাস্তায় পা দেবে, একটা গাড়ি নিঃশব্দে এসে তার পাশে থামল। তার থেকে দুজন বলশালী ব্যক্তি নেমে তার দু'পাশে দাঁড়াল। সত্যেন টের পেল তার পিঠে ঠেকানো একটা ধাতব নল।
"গাড়িতে উঠে এস, খোকা। তুমি বুদ্ধিমান, বুঝতেই পারছ ট্যাঁ-ফোঁ করে লাভ নেই। তাছাড়া, তোমার বাবা-মা — তোমার বাড়িতেও আমাদের নজর আছে।"
সত্যেনের বুক হিম হয়ে গেল — বাড়িতে মা একা। সে বিনা প্রতিবাদে গাড়িতে উঠে বসল। গাড়ি স্টার্ট দিল। একজন ওর পকেট থেকে মোবাইলটা নিয়ে সুইচ অফ করে দিল।
"একে তুলতে পারছিলাম না দেখে তো স্যার আমাদের চাকরি খেতে যাচ্ছিলেন। এটাই নাকি সবচেয়ে বুদ্ধিমান। দেখে তো মনে হয় না।" একজন বলল।
"তুমি নাকি বিজ্ঞানে বিশ্বাসী। তা, এটা কী পরেছ?" আরেকজন সত্যেনের হাতে বাঁধা তাবিজটা দেখিয়ে বলল।
সত্যেন রাগতভাবে বলল, "আমিও এসবে বিশ্বাসী নই। শুধু একজন আমার মঙ্গলকামনায় এটা বেঁধে দিয়েছেন। তাঁর স্নেহের মর্যাদা দিতেই এটা পরছি।"
"ভয় নেই, তোমার বা তোমাদের কোনও অমঙ্গল আমরা করব না। যেখানে যাচ্ছ, খুব আরামে আর নিরাপদে থাকবে। এখনও লম্বা রাস্তা বাকি, যেতে যেতেই সব শুনবে। আর যদি বিশ্বাস না হয় —"
বলেই লোকটা তার মোবাইলে একটা ভিডিও কল করল। একটু পরেই ওপাশে দেখা গেল দেবলের মুখ।
"সত্যেন, তুইও আসছিস!" দেবল উচ্ছ্বাস প্রকাশ করল। কিন্তু সত্যেন দেখল, তার চোখে ভয়ের ছাপ।
"চলে আয়। এখানে আমরা এক জেঠুর কেয়ারে ফ্যান্টা আছি। খাওয়াদাওয়া, সাইটসীয়িং, সাথে পড়াশোনা সবই দারুণ চলছে। আমাদের বাবা-মা'দের খবর পাচ্ছি, তাঁরা ভালো আছেন। তোর বাবা-মা'ও ভালো থাকবেন। কোনও ঝামেলা না করে চলে আয়।"
দেবলও সেই ইঙ্গিত দিল — কোনও ঝামেলা করলে এবার বাবা-মা'র বিপদ। কিন্তু 'বাই' বলার আগে দেবলের হাতটা কি একটু কেঁপে গেল? ক্যামেরা ওর মুখ থেকে ঘুরে ঘরের টেবিলে, জানালায়, কয়েক সেকেন্ড পর আবার দেবলের মুখে।
তার মধ্যেই অবশ্য সত্যেন যা দেখার দেখে নিয়েছে — হোটেলের মেনু কার্ডের হেডিংয়ে একটা নাম আর জানালার বাইরে উন্মুক্ত সমুদ্রের দৃশ্য। তারপর একটু ভেবেই বুঝতে পেরেছে সে কোথায় চলেছে!
কিন্তু কী লাভ? সেটা তো কাউকে জানাবার সুযোগ হবে না! এসব ভেবে বিমর্ষ হয়ে বসে আছে। এমন সময় একজন অপহরণকারী একটা কাগজ আর পেন এগিয়ে দিয়ে বলল, "নাও, একটা নোট লিখে ফেলো। শুনলে তো, তুমি খুব ভালো থাকবে। তাই বাড়িতে সবাই যাতে অযথা চিন্তা না করেন তাই হুবহু যা বলছি, লিখে দাও। গাড়ি স্লো করে দিচ্ছি। এই বোর্ডটার ওপর রেখে হাত স্থির করে লেখো, যাতে মা-বাবা তোমার হাতের লেখা চিনতে পারেন।"
সুযোগ থাকে না, তাকে তৈরি করে নিতে হয়, ভাবল সত্যেন!

"Dear Parents,

Forgive me. Don't worry. Fed up with lockdown and online classes, I'm leaving home to join my friends and work for some meaningful purposes. We'll be fine and will contact you when appropriate.
Love and kiss. So here all day we enjoy endless pleasure.

Yours loving
Satyen"

"আজকালকার বাঙালি, দু'কলম বাংলা লিখতে পারে না। তাই স্যার ইংরেজি ড্রাফটটাই আগে দেখাতে বলেছিলেন।"
"আমি কিন্তু ইস্কুলে বাংলা, ইংরেজি দুটোতেই গাড্ডু ছিলাম।" আরেকজন হেসে বলল।
"কিন্তু তুমি পাকামো করে শেষে ঐ লাইন দুটো জুড়লে কেন?" প্রথমজন সন্দিগ্ধ ভঙ্গীতে বলল।
"কারণ, আমি সব সময়েই বাবা-মা'কে কোনও মেসেজ পাঠালে ঐ 'লাভ অ্যান্ড কিস' জানিয়ে তার সাথে কিছু জুড়ে শেষ করি। ওটা না থাকলে তারা বুঝে যাবে যে চিঠিটা আমি নিজের ইচ্ছেয় লিখিনি।"
"কী সব আংরেজি মিডিয়াম ছেলেমেয়ে, বাপ-মাকে প্রণাম না জানিয়ে লাভ অ্যান্ড কিস জানায়!"
"আমার মা-ই ছোটবেলা থেকে অমন বলতে শিখিয়েছে।" সত্যেন রেগেমেগে বলল।
"ভালো। তোমার 'লাভ অ্যান্ড কিস' আর ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তোমার বাবা-মা'র কাছে পৌঁছে যাবে। কিন্তু একটু পরেই একটা কঠিন পরীক্ষা। কেউ জিগ্যেস করলে আমরা যা যা শিখিয়ে দিচ্ছি ঠিক তেমনটাই বলবে। নইলে, বুঝেছ তো?"
সত্যেন ঘাড় নাড়ল। আর ভাবতে লাগল, চিঠিটা বাবা-মা'র কাছ থেকে তৃপ্তি ম্যাডামের হাতে যাবে তো? ওঁর ওপর সত্যেনের অগাধ ভরসা। চিঠিটা পেলেই উনি ঠিক —

(৫)

"ফোন, ঐ ফোনটাই সর্বনাশের মূলে!" উত্তেজিতভাবে বলছিলেন তৃপ্তি, "অন্যদের ফোন ছিল বলে তারা কিডন্যাপ হয়েছিল। সত্যেনের নিজস্ব ফোন ছিল না। কিন্তু যেই সে তার বাবার ফোন নিয়ে রাস্তায় পা দিল, অমনি ধরা পড়ল। ইস, আমি যদি একটু আগে ব্যাপারটা বুঝতে পারতাম!"
"হ্যাঁ, ঐ ফোনটা হাতে পেয়েই ছেলেটা বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করে কেটে পড়তে পারল।" বললেন ইনস্পেকটর বসাক।
"ব্যাপারটা আদৌ তা নয়। আসলে কিডন্যাপাররা ওদের চারজনের ফোন নম্বরগুলো জোগাড় করে সেগুলো 'হ্যাক' করে তাতে আড়ি পাতার সফটওয়্যার বসিয়েছিল। তার সাহায্যে লোকগুলো সারাক্ষণ ছেলেদের লোকেশন ট্রেস করে গেছে। তারপর কাছেপিঠের কোনও ডেরায় বসে অপেক্ষা করেছে আর যেই দেখেছে ওরা রাস্তায় অমনি নিরালা কোনও জায়গায় এসে তুলে নিয়ে গেছে। সত্যেনের নম্বরটা ওর বাবার। তাকেও একদিন রাস্তায় ধরেছিল, তারপর ভুল বুঝতে পেরে ছেড়ে দেয়।"
"বলেন কী, এ তো তবে সাংঘাতিক টেক-স্যাভি গ্যাং! এত নিখুঁতভাবে পজিশন ট্র‍্যাকিং করা — আমাদের প্রত্যেকের প্রাইভেসিই তো তবে বিপন্ন।"
"বিপন্ন নয়, অস্তিত্বহীন। আমরা যে মুহূর্তে স্মার্টফোন হাতে নিচ্ছি, আমাদের অবস্থান সহ অজস্র তথ্য একরকম স্বেচ্ছায় নানা সংস্থার হাতে তুলে দিচ্ছি। কোনও ক্রিমিনাল বা স্পাই গ্যাংয়ের সেসব হাতানো শুধু সময়ের অপেক্ষায়।"
"মাথা বটে একখানা আপনার! সরি মিস ঘটক, অ্যাদ্দিন আপনাকে আন্ডারএস্টিমেট করেছিলাম। কিন্তু এখন তবে কী উপায়? ছেলেটা আমাদের নাকের ডগা দিয়ে এভাবে পাচার হয়ে যাবে?"
"বুনো ওলের মোকাবিলায় বাঘা তেঁতুল আছে না?" তৃপ্তি মৃদু হেসে বললেন, "সত্যেনের হাতে আমি একটা 'তাবিজ' বেঁধে দিয়েছি। ওতে একটা ইলেকট্রনিক চিপ আছে, যা জিপিএসে কানেক্ট করে প্রতি মুহূর্তে সত্যেনের লোকেশন ইনফর্মেশন পাঠাবে। আমার মোবাইলে একটা অ্যাপ ইনস্টল করে নিয়েছি। তাতে সত্যেনের পজিশন অনবরত রেকর্ড হয়ে যাচ্ছে। যন্ত্রটার ব্যাটারি হাতের নড়াচড়ায় রিচার্জড হয়, তাই চলবেও বহুদিন। "
"সর্বনাশ, এ মাল তো খোলা বাজারে মেলে না। আপনি কি তবে ওটা —"
"না, চোরবাজার থেকে নয়, পেয়েছি আমার দাদা 'স্পেশাল এজেন্ট' উপমন্যু ঘটকের কাছ থেকে।"
"আপনি উপমন্যু ঘটকের বোন?" বসাক চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন, "তাই এমন গোয়েন্দা ব্রেন!"
"আপনি দাদাকে চেনেন?"
"ইয়েস, ম্যাডাম।" বসাক দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন, "ইয়োরস ট্রুলি কম্যান্ডো ট্রেনিংয়ে আপনার দাদার ব্যাচমেট ছিল। তারপর একটা অ্যাকসিডেন্টে আমার পায়ে একটা ছোট্ট খুঁত হয়ে গেল। ফলে কম্যান্ডো না হয়ে এই বেলেঘাটা থানার দায়িত্বে।"
"খুঁত? আপনার চলাফেরা দেখে তো বোঝা যায় না।"
"তা যায় না। কিন্তু এগারো সেকেন্ডে একশো মিটার টানা যায় না, পাঁচ ফুট হাইজাম্পও করা যায় না, তাই — সে যাক, এখন কী করণীয়, বলুন তো?"
"আমার 'বাগ' সত্যেনের লোকেশন কীভাবে ট্র‍্যাক করছে, দেখা যাক। আপনি একটু হেল্প করবেন? আসলে গাড়ি নেই তো, তাই জিপিএসটা ঠিক —"
"শিওর।" তারপর দু'জন তৃপ্তির মোবাইলের ওপর ঝুঁকে পড়লেন।
"ভি আই পি রোড ধরে, উত্তর দিকে — মাই গড, এ তো এয়ারপোর্ট! ওখানে গিয়ে একটু পরেই সিগনাল হারিয়ে গেছে। তাহলে এবার? তারা কোথায় উড়েছে কিছুই তো বোঝার উপায় নেই।" বললেন বসাক।
"কিন্তু ফ্লাই করতে গেলে তো আই-ডি লাগে। সাথে কোভিড নেগেটিভ রিপোর্ট। সেসব পাবে কোথায়?"
"তা বটে। দাঁড়ান, একটা জিনিস দেখে নিই।" বলে কিছুক্ষণ কী দেখে বসাক কাকে যেন ফোন করলেন। তারপর বললেন, "যা ভেবেছি। ওরা প্রাইভেট চার্টার্ড জেটে গেছে। ওখানে ওঠার আগে মালপত্র চেক হয়, আই-ডির অত কড়াকড়ি নেই। আর যারা এত মালদার, তাদের কাছে একটা কোভিড নেগেটিভ রিপোর্ট জোগাড় করা তো জলভাত।"
"ওখান থেকে কোথায় কোথায় প্লেন গিয়েছে জানা যায় না?"
"সে তো অনেক জায়গায়ই গিয়েছে। তার মধ্যে —" বলতে বলতেই ইনস্পেকটর দেখলেন, সত্যেনের বাবা জগদীশ ঢুকছেন।
"একটু দেরি হয়ে গেল।" রিপোর্ট লেখাতে লেখাতে তিনি বললেন, "বেরোবার সময় সত্যেনের এই চিঠিটা পোস্টবক্সে পেলাম কিনা। তাই ওর মা'কে দেখাতে গিয়ে —"
ওঁরা চিঠিটার ওপর ঝুঁকে পড়লেন। তৃপ্তি জিগ্যেস করলেন, "এটা সত্যেনেরই হাতের লেখা তো?"
"হ্যাঁ। কিন্তু ও কীসব উল্টোপাল্টা লিখেছে, 'লাভ অ্যান্ড কিস'! ওর মাথার গোলমাল হয়ে যায়নি তো, টিচার?"
শুনেই তৃপ্তি চিঠির ওপর ঝুঁকে পড়ে আবার কী দেখলেন আর তাঁর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বললেন, "জগদীশ বাবু, সত্যেনের মতো বিপদে স্থিরবুদ্ধি ছেলে বিরল। আপনি বাড়ি যান, আমরা সর্বশক্তি দিয়ে ওকে খুঁজে বের করব।"

"বললেন তো, কিন্তু এবার করবেনটা কী?"
"তার সূত্র আমার তীক্ষ্ণবুদ্ধি ছাত্র দিয়ে গেছে। অন্য তিন ছাত্রের পাঠানো চিঠির বয়ান আপনার মনে আছে?"
"হ্যাঁ। প্রায় হুবহু এক। শুধু —"
"শুধু শেষের এই দু'লাইন বাড়তি, "Love and kiss. So here all day we enjoy endless pleasure." এর মধ্য দিয়েই সত্যেন কিছু ইঙ্গিত দিয়েছে। দাঁড়ান, ভালো করে দেখি।"
দুজন মন দিয়ে দেখতে লাগলেন। একটু পরেই তৃপ্তি উদ্ভাসিত মুখে বললেন, "আরে, এ তো ভীষণ সোজা। প্রতিটি ওয়ার্ডের প্রথম লেটারটা নিন, কী দাঁড়াল?"
"Lakshadweep!" বসাক অবাক বিস্ময়ে বললেন, "ধন্য সেই ছেলে, যে বিপদের মুখে চটজলদি এমন দুটো নির্দোষ লাইন মাথা থেকে বের করে ক্লু হিসেবে পাঠাতে পারে। ও তাহলে কোনওভাবে জানতে পেরেছে ওকে কিডন্যাপাররা লাক্ষাদ্বীপ নিয়ে যাচ্ছে। দাঁড়ান, খোঁজ করে দেখি কোন প্রাইভেট জেট ওদিকে ফ্লাই করেছে।"
একটু নেট ঘেঁটেই বসাক পরপর কয়েকটা ফোন করলেন। তারপর বললেন, "লাক্ষাদ্বীপের নিকটতম এয়ারপোর্ট কেরালার কোচি। ওখানে কোনও প্রাইভেট জেট যায়নি। কাছাকাছির মধ্যে একটা ফ্লাইট একটু আগে গেছে ভাইজাগ। বোধহয় ওখানে ব্রেক নিয়ে ওরা কাল ভোরে আবার কোচি ফ্লাই করবে। সেখান থেকে প্লেনে বা বোটে লাক্ষাদ্বীপ।"
"তাহলে এবার আমাদের নড়েচড়ে বসতে হয়।"
"হ্যাঁ। ব্যাপারটা আমাদের গোয়েন্দা বিভাগকে জানিয়ে ভাইজাগ, কোচি আর লাক্ষাদ্বীপের পুলিশকে সত্যেনের ছবিসহ অ্যালার্ট পাঠাচ্ছি। কালকের মধ্যেই ওরা অপরাধীদের গ্রেফতার করে সত্যেনকে মুক্ত করবে।"
"পাগল হয়েছেন! তাহলে অন্য তিনজনের কী অবস্থা হবে বুঝতে পারছেন? তাছাড়া, ওরা নিশ্চয়ই ছেলেগুলোর বাড়ির লোকের ক্ষতি করার হুমকি দিয়ে ওদের এত সহজে নিজেদের ইচ্ছেমতো কাজ করাতে পেরেছে। তাই প্রথমে চারজনের বাড়িতে পুলিশ প্রোটেকশন দিতে হবে। তারপর আমাদের ওদের ফলো করে যেখানে অন্য ছেলেগুলোকেও রেখেছে সেখানে পৌঁছতে হবে।"
"আমাদের মানে, পুলিশদের। আপনি কিন্তু এরপর এরমধ্যে নেই।"
"উপমন্যু ঘটকের বোন কি এমন বিপদের মধ্যে প্রিয় ছাত্রদের ফেলে নির্বিকার থাকতে পারে? আমাকে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে প্রথমে কোচি, তারপর লাক্ষাদ্বীপ যেতে হবে।"
"শুনুন উপমন্যুর আধা-গোয়েন্দা বোন, এই কোভিড সিচুয়েশনে যাই বললেই আপনি যেতে পারবেন না। প্রতিটি গাঁটে আটকে যাবেন। আর লাক্ষাদ্বীপে স্পেশাল পারমিশন ছাড়া ঢুকতেই পারবেন না।"
"সেসব ব্যবস্থা আপনি বলেকয়ে করে দেবেন। আর সব জায়গায় পুলিশকে একটু জানিয়ে রাখবেন।"
"হ্যাঁ, সবাই তো আমার গুরুঠাকুর। বললাম আমার পরিচিত এক টিচার অ্যাডভেঞ্চার ট্রেইলে যাচ্ছে আর তারা সব ব্যবস্থা করে দিল! তা নয়, আমাকেও সঙ্গে যেতে হবে।"
"আপনি? বেলেঘাটা থানার তবে কী হবে?"
"বেলেঘাটা এখন শান্ত। আমার ডেপুটিকে দায়িত্ব বুঝিয়ে আমি দিন দু-তিনের জন্য কেটে পড়ব। তবে এ যা কেস বুঝছি আমি বললে বা থাকলেও হবে না, এখানে উঁচু মহলের ঠেকা দরকার। তাই উপমন্যুকে কন্টাক্ট করতে হবে।"
তৃপ্তি অসহায় ভঙ্গীতে বললেন, "কিন্তু দাদা কোথায় তো আমরা জানি না। অপারেশনে বেরোলে ওকে সরাসরি কন্টাক্ট করা যায় না। তেমন ইমার্জেন্সিতে অফিসে ফোন করে —"
"দেরি হয়ে যাবে, অত সময় হাতে নেই। তবে", বসাক মৃদু হেসে বললেন, "এই ওল্ড ব্যাচমেটকে উপমন্যু এখনও রেয়াত করে, তার সাথে একটা সিক্রেট হট লাইনও মেইনটেইন করে। নিতান্ত ফিল্ডে অ্যাকশনে না থাকলে তাকে ধরতে পারব।"

তারপর কিছুক্ষণ ঝড়ের বেগে ঘটনা ঘটতে থাকল। ঘণ্টাখানেক পর বসাক হাঁফাতে হাঁফাতে বললেন, "সবই তৈরি। এবার শুধু আমাদের যাওয়ার পালা। কাল সকাল সাতটায় কোচির ফার্স্ট ফ্লাইট। হপিং ফ্লাইট, পৌঁছোতে পৌঁছোতে দুপুর।"
"একটু দেরি হয়ে যাবে না? যদি ওরা তার আগেই চলে যায়?"
"তাহলেও ওদের লাক্ষাদ্বীপে গিয়ে ধরব। তবে বলছেন যখন, দেখি।"
একটু পরে বসাক করুণ হেসে বললেন, "তবে উপমন্যুর সুপারিশেও তো আর আমরা চার্টাড ফ্লাইট অ্যাফোর্ড করতে পারব না। একটা উপায় আছে, কার্গো ফ্লাইট। এখান থেকে রাত একটায় ছেড়ে হায়দ্রাবাদে সাড়ে তিনটে নাগাদ পৌঁছবে। সেখান থেকে ভোর ছ'টার কমার্শিয়াল ফ্লাইট ধরে আটটার মধ্যে কোচি পৌঁছে যাব।"
"কার্গো ফ্লাইট, মানে মালবাহী প্লেন? আমাদের উঠতে দেবে?"
"সে ব্যবস্থা হয়ে যাবে। তবে মালের সঙ্গে গাদাগাদি করে যেতে হবে।"
একটু ইতস্তত করে তৃপ্তি বললেন, "আচ্ছা দেখি, সত্যেনের তাবিজ আর কোনও সিগনাল দিল কিনা।" তারপর দুজনে অ্যাপ খুলে দেখলেন, আবার সিগনাল আসছে। আর সেটা যেমন ভাবা গিয়েছিল, ভাইজাগের এয়ারপোর্ট থেকে শুরু হয়ে এক জনবহুল এলাকায় স্থির হয়েছে।
"ওরা সম্ভবত কাল ভোরে আবার রওনা দেবে। তাহলে বেলা দশটার মধ্যে কোচি পৌঁছবে। পরেরটা লাক্ষাদ্বীপের কোথায় যাবে তার ওপর।"
"তাহলে আমরা মালের সাথে গাদাগাদি করেই যাব। ওদের আগেই পৌঁছে ওদের ফলো করতে হবে।"
"তবে আর কী, এবার বাড়ি গিয়ে চটপট ব্যাগ গুছিয়ে নিন। আপনার ঠিকানাটা মেসেজ করুন, আমি আপনাকে তুলে নেব।"
"একটা ব্যাপার বাকি রয়ে গেল।" তৃপ্তি একটু সঙ্কুচিতভাবে বললেন, "আমার বারবার মনে হচ্ছে, ঐ সায়েন্স এক্সিবিশনে এই কেসের মূল সূত্রটা লুকিয়ে রয়েছে। অর্গানাইজার কারা, জাজই বা কারা ছিলেন আর তাঁদের অতীত বৃত্তান্ত কী, এগুলো জানার খুব দরকার ছিল। চিফ অর্গানাইজারের নম্বর আমার কাছে আছে, সময় পেলে সব বের করে ফেলতাম। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি —"
"আপনি না পারলেও আমরা পারব। নম্বরটা দিন।"
এরপর তিনি চটপট দু-তিন জায়গায় ডায়াল করলেন।

রাতের অন্ধকারে পুলিশ জিপ এয়ারপোর্টের দিকে ছুটে চলেছে। একরাশ উত্তেজনা বুকে নিয়ে বসে আছেন তৃপ্তি। একটু আগে এক্সিবিশনের সংগঠক ও বিচারকদের সম্বন্ধে সব খবর পাওয়া গেছে আর তৃপ্তি বিহ্বল হয়ে ভাবছেন। সবকিছু ঠিক ছকে মিলছে না।

ভবিষ্যতের দ্বীপে
(৬)

সত্যেন এক বিলাসবহুল হোটেলের ঘরে বসে। জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে সীমাহীন নীল জল। লোকগুলো বলে গেছে, একটু পরেই 'স্যার' এসে তার সাথে কথা বলবেন।
এই দুদিন বিদ্যুৎগতির ঘটনাস্রোতে সে দিশেহারা হয়ে পড়েছে। চার্টার্ড প্লেনে ভাইজাগ, সেখানে হোটেলে কিছু বিশ্রামের পর আবার সেই প্লেনেই কোচি। তারপর আবার হোটেলে বিশ্রামের পর রাতের বোটে লাক্ষাদ্বীপের রাজধানী কাভারতি। সেখানে এসে এক হোটেলের বিলাসবহুল কক্ষে।
লোকগুলি কিন্তু তাকে বন্দি করা ছাড়া কোনও অযত্ন করেনি। প্রথম রাতে হোটেলে আর দ্বিতীয় রাতে বোটের কেবিনে ভালো ঘুমোনোর ব্যবস্থা ছিল। খাওয়াদাওয়াও রাজসিক। এখন স্নানটান করে সে অপেক্ষায় আছে, গ্যাংলীডার 'স্যার' কখন দেখা দেন।
একটা আশার কথা, কোচিতে বোটে ওঠার সময় যাত্রীর ভিড়ে সে সম্ভবত তৃপ্তি ম্যাডামকে দেখেছে। তিনি অবশ্য অন্য একটি বোটের লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন। তবে সত্যেনের দৃঢ় বিশ্বাস, তার চিঠির মর্মোদ্ধার করতে পেরে তিনি ঠিক জায়গায় চলেছেন আর কিছু একটা করবেন।

দরজা খুলে গেল। তিনি ঢুকলেন। আর সত্যেন অবাক বিস্ময়ে বলে উঠল, "আপনি!"
"চিনতে পেরেছ তাহলে?"
"আপনি তো প্রফেসার জয়ন্তকুমার মল্লিক, বিখ্যাত আমেরিকান বিজ্ঞানী ও শিল্পপতি। সায়েন্স এক্সিবিশনে আপনিই চিফ জাজ ছিলেন।"
"ঠিক ধরেছ। তবে আমি আমেরিকান নই, ভারতীয়। বহু দশক আমেরিকাবাসী হয়েও আমি ভারতের নাগরিকত্ব ছাড়িনি।"
"আপনি আমাদের কেন ধরে এনেছেন?"
"ধীরে বন্ধু, ধীরে। নামী কলেজ বা কম্পানিতে নতুন ব্যাচ এলে তাদের সংস্থার সঙ্গে পরিচিতির জন্য 'ওরিয়েন্টেশন' বলে একটা অনুষ্ঠান করা হয়। এই মুহূর্তে আমরাও মিলিত হয়েছি তোমাকে আমার সংস্থা ও তার উদ্দেশ্য সম্বন্ধে 'ওরিয়েন্টেশন' দেওয়ার জন্য। একদিন এই সংস্থা হয়তো তোমাদেরই হবে।
সভ্যতার ইতিহাসে বিভিন্ন যুগ বিভিন্ন বস্তু ও সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তিকে ঘিরে গড়ে উঠেছে। কখনও সেটা ছিল তামা বা লোহা, কখনও কয়লা ও স্টিম, আবার বিংশ শতাব্দীতে তা পেট্রোলিয়াম, প্লেন, স্যাটেলাইট। এই মুখ্য বস্তু আর প্রযুক্তি যখন যার কব্জায় তখন সে পৃথিবীর রাজা।
আর আজ একবিংশ শতাব্দী কীসের যুগ, বলো তো?"
"কম্পিউটার আর ইন্টারনেটের।" সত্যেন নির্দ্বিধায় বলল।
"ঠিক। কিন্তু বলতে পারো, এই প্রযুক্তির অগ্রভাগ বা 'কাটিং এজ' কী?"
সত্যেন একটু ভেবে বলল, "আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, রোবোটিকস।"
জয়ন্ত হেসে বললেন, "অধিকাংশ প্রযুক্তি সচেতন মানুষ এটাই বলবে। কিন্তু এটা বড়জোর অর্ধসত্য। এ-আই, রোবোটিকস সব প্রযুক্তিই দাঁড়িয়ে আছে কতগুলি ক্ষুদ্র বস্তুখণ্ডের ওপর, যার নাম মাইক্রোচিপ। এই ভিত নড়বড় হলে গোটা আই-টি সাম্রাজ্যই তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়বে। সেমিকন্ডাক্টরের যাদু এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র 'মাইক্রোচিপ'এর এক একটার আজ যে ক্ষমতা, এককালে তা একটা ঘরজোড়া কম্পিউটারের ছিল না। স্বয়ংক্রিয় খেলনা, ঘরোয়া গ্যাজেটের রিমোট কন্ট্রোল থেকে শুরু করে কম্পিউটার, স্মার্টফোন, গাড়ি-প্লেন-স্যাটেলাইটের ইলেকট্রনিকস, সবকিছুই বিভিন্ন সূক্ষ্ণতার মাইক্রোচিপ নিয়ন্ত্রিত। কোনও কারণে এই মাইক্রোচিপের জোগান ব্যাহত হলে বিশ্বজোড়া মানবসভ্যতার ভিতটাই ভূমিকম্পের আঘাতের তীব্রতায় টলে উঠবে।
অথচ আশ্চর্য, পৃথিবীর উন্নত মাইক্রোচিপের শতকরা সত্তরভাগই তৈরি হয় তাইওয়ান ও দক্ষিণ কোরিয়ার দুটি কম্পানিতে। একবার ভাবো, যদি যুদ্ধ, মহামারী বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ঐ দেশ দুটো বিপর্যস্ত হয়, পৃথিবীর কী হবে?"
"আপনি তাই এবার মাইক্রোচিপ ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে নামবেন?"
"বলতে পারো। তবে আমি যা করছি তা শুধু আমার বা আমার কম্পানির জন্য নয়। আমি বিশ্বপর্যটক। কিন্তু দেশ আমার একটাই আর তার নাম ভারত।
এককালে ভারত তথা এশিয়া সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র ছিল। প্রযুক্তির রথে চড়ে সেই কেন্দ্র চলে গিয়েছিল পাশ্চাত্যে। আজ চিন, জাপান, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুরের হাত ধরে সেই প্রযুক্তির কেন্দ্র আবার এশিয়ায় ফিরে আসতে চলেছে। আমি মাইক্রোচিপের ভিত্তিতে ভারতকে দৃঢ়ভাবে সেই কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠিত করব।"
"ভারত সরকার তো বিদেশি কম্পানিদের মাইক্রোচিপ বানাবার জন্য অনেক সুবিধা দেবে বলছে।"
"কিস্যু হবে না। উন্নত মাইক্রোচিপ কমপ্লেক্স এক এলাহি ব্যাপার — তার জন্য চাই বিরাট বিনিয়োগ, চব্বিশ ঘণ্টা অবিচ্ছিন্ন জল ও বিদ্যুৎ আর সম্পূর্ণ ধূলিহীন পরিবেশ। ভারতের মাটিতে এই মুহূর্তে এত কিছু হওয়া প্রায় অসম্ভব। বড়জোর অতিচালাক কিছু কম্পানি সরকারি সুবিধা আত্মসাৎ করে কিছু অনুন্নত চিপ তৈরি করবে, যা দিয়ে হয়তো সস্তা খেলনা-ফেলনা হবে।"
"তাহলে আপনি কী করতে চাইছেন?"
জয়ন্তর চোখে যেন স্বপ্নের ছোঁয়া। বললেন, "যুগে যুগে দ্বীপের বিচ্ছিন্নতা মানুষকে উৎকৃষ্ট সভ্যতা গড়ে তুলতে প্রেরণা দিয়েছে। ছোট্ট 'শ্বেতদ্বীপ' বৃটেন এককালে বিশ্ব শাসন করেছে। জাপান বহুযুগ ধরেই এশিয়ায় এক মহাশক্তি। অধুনা তার সাথে যূক্ত হয়েছে তাইওয়ান, হংকং, সিঙ্গাপুরের প্রতাপ।"
"আপনি কি লাক্ষাদ্বীপে উন্নত মাইক্রোচিপ কমপ্লেক্স বসাবার প্ল্যান করেছেন?"
"না। তার জন্য আমি ইজারা নিচ্ছি আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়া উপকূলের কয়েকটি দ্বীপ।"
"সিশেলস আর সলোমন আইল্যান্ডসে?"
জয়ন্ত খুশি হয়ে বললেন, "তোমার ভূগোলের জ্ঞানও তো চমৎকার। হতেই পারে। তবে এই ভারতীয় দ্বীপখণ্ডেই থাকবে আমার কন্ট্রোল সেন্টার। এখান থেকেই সব নিয়ন্ত্রিত হবে। এছাড়াও এখানে থাকবে একটি উন্নত শিক্ষাকেন্দ্র যেখানে বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ ও তোমাদের মতো সম্ভাবনাময় ছাত্ররা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সর্বাধুনিক জ্ঞান লাভ করবে আর নিজেদের উদ্ভাবনীশক্তির বিকাশ ঘটাতে পারবে।"
"কিন্তু ঐসব নিরালা দ্বীপ যেমন দূষণ, মহামারী মুক্ত তেমন ওখানে সভ্যতার দান বিদ্যুৎ, জলেরও তো আকাল।"
জয়ন্ত হেসে বললেন, "গুড পয়েন্ট। জল পাব দ্বীপের চারপাশের অফুরন্ত সমুদ্রের জল উন্নত রিভার্স অসমোসিস পদ্ধাতিতে শোধন করে। আর বিদ্যুতও ওখানেই তৈরি হবে — কিন্তু কয়লা, পেট্রোলের ধোঁয়া ছড়িয়ে নয়, প্রকৃতির অফুরন্ত দান রোদ, বাতাস ও সমুদ্রশক্তিকে কাজে লাগিয়ে। আজ 'গ্রীন এনার্জি' শুধু মানুষের বাঁচার জন্যই নয়, তার সেবাদাস অত্যাধুনিক যন্ত্রাংশগুলিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যও অপরিহার্য।"
"তাহলে কি আপনি আমাদের 'গ্রীন এনার্জি'র ব্যাপারে উৎসাহ দেখেই —"
"স্রেফ সেটুকুর জন্যই নয়। 'গ্রীন এনার্জি' তো এখন একটা হুজুগ হয়ে গেছে। এ নিয়ে হাজারো লেখালেখি, প্রজেক্ট। কিন্তু সবই বড় বাঁধাধরা, গতানুগতিক। তোমাদের প্রস্তাবে অনেকদিন পর আমি দেখলাম ছকভাঙা, সুদূরপ্রসারী ভাবনা। আসলে সব গবেষণাই তো উন্নত শীতপ্রধান দেশগুলিকে কেন্দ্র করে। অথচ গ্রীষ্মপ্রধান দেশগুলিতে সূর্যালোক ছাড়া সূর্যের তাপও অপর্যাপ্ত, কিন্তু তার সদ্ব্যবহারের প্রযুক্তি অবহেলিতই থেকে গেছে। এটাকে তোমরা তুলে ধরেছ। আবার যেহেতু সূর্য সব সময় থাকে না তাই এই সৌরশক্তিকে ব্যাটারিতে 'ব্যাক-আপ' করা অপরিহার্য। তার জন্য তোমরা যে অত্যাধুনিক 'গ্রাফিন' প্রযুক্তির কথা ভেবেছ, ইন্ডাস্ট্রি তাকে অত্যন্ত ব্যয়সাপেক্ষ বলে অচ্ছুৎ করে রেখেছে। কিন্তু সর্বাধুনিক ব্যাটারির উপাদান লিথিয়াম এক বিরল খনিজ। শিগগিরই তার ভাণ্ডারে টান পড়বে। অন্যদিকে, গ্রাফিনের উপাদান কার্বনের জোগান অফুরন্ত। তাই অদূর ভবিষ্যতে মানুষ এই প্রযুক্তির গবেষণায় অঢেল অর্থব্যয় করে খরচকে ধরাছোঁয়ার সীমায় নিয়ে আসবে।
তোমাদের চিন্তা রোম্যান্টিক, কিছুটা অবাস্তব। সেটা তারুণ্যেরই ধর্ম। কিন্তু তোমাদের রয়েছে এক অসাধারণ ভবিষ্যৎদৃষ্টি বা ভিশন, যার সাহায্যে একদিন তোমরা নতুন ইতিহাস তৈরি করতে পারবে।
আমার প্রকল্প রূপায়িত করবেন একদল ইঞ্জিনীয়ার, বিশ্বমানের কিছু বিজ্ঞানী-গবেষক আর অজস্র কর্মী। কিন্তু তোমাদের মতো প্রতিভাই আমার ভবিষ্যৎ। তাই আমার দুর্লভ সময়ের একাংশ আমি ব্যয় করি তরুণ প্রতিভা সন্ধানের কাজে। তাদের এখানে এনে তত্ত্ব ও প্রয়োগের মধ্য দিয়ে ক্ষুরধার করে তোলা আমার শিক্ষাকেন্দ্রের অন্যতম লক্ষ্য। তাদের সাহায্যেই আমার ভবিষ্যতের স্বপ্ন বিকশিত হবে। আবার জগৎসভায় উঠে দাঁড়াবে তোমার-আমার দেশ ভারত।"
"কিন্তু আপনার উদ্দেশ্য যতই মহৎ হোক, আপনার উচিত ছিল আমাদের অভিভাবকদের সেসব বুঝিয়ে রাজি করানোর চেষ্টা করা। তা না করে আমাদের বেআইনিভাবে তুলে আনলেন কেন?"
"হাসালে। তুমি কি মনে করো তোমাদের অভিভাবকরা রাজি হতেন?"
"হতেও তো পারতেন। সন্তান আর দেশের ভালো তো তাঁরাও বোঝেন। সে যাক, যা হওয়ার হয়েছে। এখন প্লীজ আমাদের বাড়ি ফিরে যেতে দিন।"
"তোমাদের তো আমি ফেরত পাঠাবার জন্য এত কষ্ট করে নিয়ে আসিনি। এনেছি আরও অনেক উদীয়মান প্রতিভার সাথে আমার তত্ত্বাবধানে রেখে তোমাদের উদ্ভাবনীশক্তির উন্মেষ ঘটাবার জন্য।"
"কিন্তু এভাবে আমাদের ধরে রেখে কি আপনার লক্ষ্য পূর্ণ হবে? মুক্ত বনের পাখি মনের আনন্দে যে গান গায়, খাঁচায় বন্দি করলে কি সে তা গাইতে পারবে? যে পরিবেশে আমাদের দেহমনের বিকাশ হয়েছে, জোর করে তার থেকে বিচ্ছিন্ন করলে কি আমাদের উদ্ভাবনীশক্তি অটুট থাকবে?"
"ভুল করছ। তোমরা এতদিন মুক্ত ছিলে না, ছিলে একটা ছোট্ট খাঁচায় বন্দি। তার থেকে তোমাদের আমি বড়জোর একটা অনেক বড় খাঁচায় নিয়ে এসেছি। ভারতে কি মুক্তচিন্তার বিকাশের জায়গা আছে? বৃটিশরা শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করেছিল তাদের গোলাম তৈরি করার জন্য। আর স্বাধীন ভারতের শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি হচ্ছে তোমাদের নম্বর পাওয়ার যন্ত্রে পরিণত করে ইঞ্জিনিয়ার, এমবিএ বানিয়ে কোনও বহুজাতিক কম্পানির গোলাম বানাবার জন্য। তার মধ্যেও মুষ্ঠিমেয় যারা উদ্ভাবকের মনন ধরে রাখতে পারে, তারা বিদেশে পালিয়ে বাঁচে। কিন্তু সেখানে গিয়ে তারা ভারতকে ভুলে সেখানকারই একজন হয়ে যায়।"
"গোটা দেশের কথা তো বলতে পারব না।" সত্যেন বিনীতভাবে বলল, "তবে আমরা যে পরিবেশে মানুষ, সেখানে এমন শিক্ষাগুরুদের পেয়েছি যাঁরা আমাদের স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে শিখিয়েছেন আর তার সাথে দেশকেও ভালোবাসতে শিখিয়েছেন। আমার আদর্শ হচ্ছেন আমার দাদু সুধাংশু দত্ত। তিনি আমাকে বড় বিজ্ঞানী হতে আর নিজের মর্যাদায় বিশ্বের দরবারে দাঁড়িয়ে ভারতের মুখ উজ্জ্বল করতে অনুপ্রাণিত করেছেন। তাই তিনি আমার নাম দিয়েছিলেন সত্যেন। তিনি শুধু আমার নন, আমাদের চারজনেরই আদর্শ।"
"সুধাংশু দত্ত — কী আশ্চর্য!" জয়ন্ত অস্ফুটস্বরে বললেন, "ঐ নামেরই একজন মানুষ আমাকেও নতুন জীবন দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন বেলেঘাটার একটি স্কুলের শিক্ষক। তাঁর ছবি আমি এখনও সঙ্গে বয়ে বেড়াই।" বলে তিনি ওয়ালেট থেকে এক বিবর্ণ সাদাকালো ফটো বের করলেন আর সত্যেন বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে বলে উঠল, "দাদু!"

"তুমি মাস্টারমশাইর নাতি! ছি ছি, আমি এত খবর নিলাম আর এটা জানতে পারলাম না। আমি এ কী মহাপাপ করেছি!"
"আপনি কি দাদুর ছাত্র ছিলেন?"
"ছিলাম, তবে বিনি পয়সার। আমি তাঁর স্কুলে পড়তাম না। কিন্তু পাড়ায় ভালো ছাত্র হিসেবে আমার নাম ছিল দেখে তিনি বাড়ি বয়ে এসে কঠিন বিষয়গুলি আমাকে বুঝিয়ে দিতেন। স্কুলে চমৎকার রেজাল্ট করে আমি এক নামী কলেজে ভর্তি হলাম। সেখানেই আমার রাজনীতিতে হাতেখড়ি। দেশের প্রকৃত মুক্তির নেশায় আমি মেতে উঠলাম। তারপর এক সময় পাড়ায় প্রতিদ্বন্দ্বী দলের সঙ্গে আমাদের সংঘর্ষ শুরু হল। একদিন তারা হঠাৎ আমাদের এলাকা দখল করে নিল। পালাতে না পেরে আমি উদভ্রান্তের মতো অলিতে গলিতে ছুটোছুটি করছিলাম। খুনই হয়ে যেতাম। কিন্তু দেখতে পেয়ে মাস্টারমশাই হাত ধরে বাড়িতে নিয়ে গেলেন। অনেক ঝুঁকি নিয়ে দুদিন আমাকে লুকিয়ে রেখে তারপর রাতের অন্ধকারে নিরাপদে বের করে দিলেন। বাড়িতে থাকার সময় শুধু বলেছিলেন, তোমাদের রাজনীতি নিয়ে ভালোমন্দ কিছু বলা আমার সাজে না। শুধু বলছি, তোমার প্রতিভা বিজ্ঞানে। দেশকে ভালোবেসে থাকলে বিজ্ঞানকে অবহেলা কোরো না।
বাবার অর্থাভাব ছিল না। কিছুদিনের মধ্যেই আমাকে বিদেশে পাঠিয়ে দিলেন। সেখানে অনেক প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করে আমি কোথায় পৌঁছেছি দেখছ। কিন্তু মাস্টারমশাইর কথা শিরোধার্য করে আমি না অবহেলা করেছি বিজ্ঞান-প্রযুক্তিকে, না দেশকে। এতদিন দেশের জন্য নিয়মিত নানা ছোটখাটো কাজ করে গেছি। অবশেষে আমার এই বিরাট কর্মযজ্ঞ হাতে নেওয়ার সামর্থ্য হয়েছে।"

(৭)

"তাহলে তুমি এখনই চলে যেতে চাও? বেশ, আমার ছেলেরা তোমাকে সসম্মানে ফেরত দিয়ে আসবে। তুমি মাস্টারমশাইর নাতি, তোমার ওপর আমি কোনও জোর খাটাতে পারি না। আর আমি নিশ্চিত, তুমি আজীবন তোমার দাদুর আদর্শেই অবিচল থাকবে।"
"কিন্তু আমি তো একা ফিরতে পারব না, জেঠু। জয়, উদয়ন আর দেবলের বাবা-মা'কে আমি কীভাবে মুখ দেখাব? আর আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন, আমার মতো ওরাও চিরকাল বিজ্ঞান আর দেশের প্রতি ভালোবাসায় অটুট থাকবে।"
এই সময় জয়ন্তর ফোনে একটা কল এল। তুলে একটু পরে তাঁর মুখে হাসি ফুটে উঠল। বললেন, "না, কিছু কোরো না। শুধু ওদের নজরে রাখো।"
তারপর সত্যেনের দিকে ফিরে বললেন, "আমার আর কিছু করতে হবে না। তোমাদের টিচার তোমাদের খোঁজে এখানে এসে গেছেন, সঙ্গে তাঁর এক পুলিশ অফিসার। তাঁদের সঙ্গেই তোমরা ফিরে যাবে।"
"তৃপ্তি ম্যাডাম!" সত্যেনের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। পরক্ষণেই সে উদ্বিগ্ন হয়ে বলল, "কিন্তু পুলিশ আপনাকে কিছু করবে না তো? আমরা সবাই তাহলে বলব, আমরা স্বেচ্ছায় জেঠুর কাছে বেড়াতে এসেছি।"
জয়ন্ত তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললেন, "তোমার ধারণা নেই জয়ন্ত মল্লিকের কতটা ক্ষমতা। পুলিশ আমার কেশাগ্রও ছুঁতে পারবে না। আমি চাইলে তাদের নাকের ডগা দিয়ে তোমাদের উড়িয়ে এমন জায়গায় নিয়ে যেতে পারতাম যেখানে তারা কোনওদিন তোমাদের খোঁজ পেত না। কিন্তু সব দেখেশুনে আমার ধারণা অন্তত কিছুটা পাল্টাচ্ছে। যেমন দেখো, আমি ভাবতাম ভারতের শিক্ষাব্যবস্থায় তোমাদের মতো দূরদর্শী প্রতিভার বিকাশের কোনও সুযোগ নেই, কারণ মাস্টারমশাইর মতো নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক আর নেই। কিন্তু আজ দেখছি তোমাদের ঐ তৃপ্তি ম্যাডাম, তিনি ছাত্রদের বাঁচাতে নিজের সব বিপদের সম্ভাবনা তুচ্ছ করে এতদূর ছুটে এসেছেন। আর কী শানিত তাঁর বুদ্ধি! তোমার লোকেশন ট্র‍্যাক করার জন্য তিনি আলগোছে তোমার হাতে ঐ 'তাবিজ'টি বেঁধে দিয়েছেন। তারপর তোমার চিঠির সঙ্কেত উদ্ধার করে ঠিক লাক্ষাদ্বীপে হাজির হয়েছেন। এমন বুদ্ধিদীপ্ত, নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক থাকলে তোমাদের মতো ছাত্রও বিরল হবে না।"
"আপনি আগেই সব বুঝেছিলেন? বুঝেও —"
"বালক, আমি ধারালো বুদ্ধির কদর করতে জানি আর বুদ্ধির খেলা ভালোবাসি।"
"আমরা কিন্তু ফিরে গিয়েও আপনার সঙ্গে যোগাযোগ রাখব। নতুন কিছু করলে বা ভাবলে জানাব। বড় হয়ে আমরা আপনার প্রচেষ্টায় হাত মেলাব।"
"সেই বিশ্বাসেই বেঁচে থাকব। আর যদি কোনও কারণে নিয়মিত আপডেট পাঠাতে ভুলে যাও তবে সেটা জোগাড় করে নেবার রাস্তাও জেঠু জানে। কীভাবে, সেটা তোমাদের তৃপ্তি ম্যাডামের কাছ থেকে জেনে নিও।
যাবার আগে একটা কথা। তুমি মাস্টারমশাইর নাতি আর ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। কিন্তু শুনেছি তোমাদের আর্থিক অবস্থা তত ভালো না। আমি তোমার জন্য একটা স্টাইপেন্ডের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি, যাতে তোমার পড়াশোনার কোনও অসুবিধা না হয়।"
সত্যেন বিনীতভাবে বলল, "আপনার মতো বিজ্ঞানী যে দাদুকে শ্রদ্ধা করেন, এটাই আমাদের বড় পাওয়া। দয়া করে এর বেশি কিছু দিতে চাইবেন না। আমি ছোটবেলার থেকেই বিভিন্ন অসুবিধার সঙ্গে বোঝাপড়া করে বড় হতে শিখেছি। আমাকে এভাবেই থাকতে দিন।"
"বাঃ!" জয়ন্ত সপ্রশংস দৃষ্টিতে সত্যেনের দিকে চেয়ে বললেন, "তুমি পারবে। তোমরা পারবে।
এবার পাশের ঘর থেকে বন্ধুদের নিয়ে নিচে লবিতে যাও। ওখানে তোমার টিচার তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন।"

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনীয়ার ও মুম্বইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চের অবসরপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী অনিরুদ্ধ সেন কলকাতা-মুম্বইয়ের বিভিন্ন সাময়িকপত্র ও ওয়েব ম্যাগাজিনের নিয়মিত লেখক। তাঁর লেখা ও অনুবাদ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়, এবং সংকলিত বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা