খেলাঘরখেলাঘর

“এই ট্রেনে না আজকাল – ভীষণ ডাকাতি হয়।”

রোহন মুচকি হেসে সহযাত্রীটির দিকে তাকিয়ে বললো, “আপনি বুঝি খুব মুম্বই এক্সপ্রেসে যাতায়াত করেন?”

একটু থতমত খেয়ে ভদ্রলোক বললেন, “ঠিক তা নয়। তবে লোকমুখে শুনেছি।”

“অ”, বলে রোহন আবার চলন্ত ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরে নজর দিলো। তাই দেখে ভদ্রলোক বললেন, “কিন্তু এত রাতে বাইরে দেখছোটা কী? ওখানে তো শুধু অন্ধকার।”

“কেন, অন্ধকারই দেখছি! খাঁটি অন্ধকার দেখতে আমার ফ্যান্টাস্টিক লাগে। কলকাতায় তো ইনভার্টার-জেনারেটরের অত্যাচারে লোড শেডিংয়ের সময়েও কম সে কম টুয়েন্টি পার্সেন্ট আলোর ভেজাল।”

“কী জানি বাপু, তোমাদের সব অদ্ভুত খেয়াল!” ভদ্রলোক বিড়বিড় করে বললেন, “আমার কিন্তু অন্ধকার দেখলেই চোর-ডাকাতের কথা মনে হয়। তা বাপু, অন্ধকার দেখতে গিয়ে মালটার ওপর থেকে নজর সরিও না। দূরপাল্লার ট্রেন – কখন কী হয় বলা যায় না!”

“থ্যাঙ্ক ইউ, আঙ্কল”, বলে রোহন মৃদু হেসে আবার বাইরে তাকালো। ভদ্রলোক আসলে একটু ভীতু আর নিটপিটে। তার ওপর আবার কপাল খারাপ – তাঁর সঙ্গের লোকজনের সীট পড়েছে পাশের কামরায়। তাই এখানে একা বসে তিনি আগ মার্কা টেনশন ছড়িয়ে যাচ্ছেন। একটা জরাজীর্ণ স্যুটকেস সীটের সঙ্গে এক পোক্ত চেন আর পেল্লায় তালা দিয়ে বেঁধেছেন আর মাঝে মাঝে টেনে দেখে নিচ্ছেন বাঁধনটা ঠিক হয়েছে কিনা। পথে কত ফিরিওয়ালা জিভে জল ঝরানো খাবার নিয়ে উঠছে। কিন্তু তিনি নিজে তো খাবেনই না, রোহন সেদিকে তাকালেই হাঁ-হাঁ করে উঠছেন, “কী সর্বনাশ – কোনটাতে কী মেশানো আছে তার ঠিক আছে! এদের সাথে কেপমারদের সাঁট থাকে, বেহুঁশ করে দিয়ে সর্বস্ব লুটে নেবে। রাস্তায় খেতে হলে – জাস্ট হোম-মেড ফুড, বুঝলে মিস্টার?” আর মাঝে মাঝে বোধহয় টেনশন বেশি হলে তিনি সেটা এক্সপোর্ট করতে “যাই, দেখে আসি ওরা আবার ঠিকঠাক আছে কি না” বলে পাশের কামরায় যাচ্ছেন। সেই সময়টুকুতেই যা একটু নির্বিঘ্নে দৃশ্য দেখা বা ‘ফেলুদা’ পড়ার সুযোগ।

রোহন চলেছে ভিলাইয়ে মামাবাড়ি। এগারো-বারো ক্লাসের দু’বছর অনেক কোচিং-টিউশন-জয়েন্টের জাঁতাকলে রগড়োফায়েড হয়ে শেষে সে কলকাতার এক ইঞ্জিনীয়ারীং কলেজে অ্যাডমিশন পেয়েছে। ক্লাস শুরু হবার আগে ক’দিনের একটু ব্রেক জুটে গেলো, ছোটমামার ‘যখন খুশি চলে আসা’র আমন্ত্রণটাও লোভনীয়ভাবে পড়ে ছিলো। তবে শেষ মুহূর্তের রিজার্ভেশন জুটলো ঐ ছ্যাকড়া গাড়ি শালিমার-মুম্বই এক্সপ্রেসে।

তাতে অবশ্য রোহনের খেদ নেই। ট্রেন ঢিকোতে ঢিকোতে থামতে থামতে চললেই তার বেশি মজা। হরেকরকমের ফেরিওয়ালা, মাঝে মাঝে নতুন নতুন যাত্রী, ছোটখাটো স্টেশনে নেমে পায়চারি – এসব সুখ কি সুপার ফাস্টে জোটে? তাই বেশ মৌজেই মামাবাড়ি চলেছে রোহনবাবু। দুপুর নাগাদ চড়েছে, এখন সন্ধে পেরিয়ে রাত হতে চলেছে। রাতটা কাটলেই কাল সকালে দুর্গ, ভিলাই যেতে ওখানেই নামতে হয়। অবশ্য রাতে ঘুমোবে, না জানালায় মুখ লাগিয়ে বসে থাকবে সেটা রোহন এখনো ঠিক করতে পারেনি।

সবই ভালো ছিলো, শুধু নিটোল সুখের মধ্যে এক খুচরো উৎপাত ঐ সহযাত্রী ভীতুবাবু। যাক গে, বেচারা –

কী যেন একটা মাঝারিগোছের স্টেশন এসেছে। ‘রিজার্ভ, রিজার্ভ’ – কামরার যাত্রীদের সম্মিলিত প্রতিরোধ অগ্রাহ্য করেও কিছু লোক উঠে পড়েছে। তাদের একজন আবার নির্দ্বিধায় রোহনের লোয়ার বার্থে বসে পড়েছে। লোকটা পাট্টা জোয়ান, গা-মুখ চাদরে ঢাকা। কেন? বাইরে অবশ্য বৃষ্টি হয়ে কিছুটা ঠাণ্ডার আমেজ, তবে চাদর মুড়ি দেবার অবস্থা নয়।

“ভেরি সাসপিশাস ক্যারেক্টর, ডাকাত-ফাকাত হওয়া অসম্ভব নয়! হুঁশিয়ার থেকো। আমি একটু আসছি।” ফিসফিসিয়ে বলে ভীতুবাবু উঠলেন – সম্ভবতঃ পাশের কামরার আত্মীয়স্বজনদের সাথে দেখা করে অথবা বাথরুম ঘুরে এসে এই নতুন চাপটা হালকা করতে। অমন তাগড়া জোয়ানের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ার থেকেই বা রোহন কী করতে পারবে সে অবশ্য অন্য প্রশ্ন।

“খোকাবাবু!”

চমকে ফিরে দেখলো রোহন, নবাগত যাত্রীটি তাকে ডাকছে। চাদরের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে শুধু তার দুই জ্বলজ্বলে চোখ। সে দুটো যেন কৌতুকে মিটিমিটি হাসছে।
“কী বলে গেলো ঐ বাবু? আমি বোধহয় ডাকু – তাই না? খুব একটা ভুল বলেনি। আমি সত্যিই এককালে ডাকু ছিলাম।”
“মানে – ছেড়ে দিয়েছো নাকি?” রোহনের শরীরে ভয় বস্তুটা তেমন নেই। (মা বলে, ও আসলে ব্যাপারটা বোঝে না।) সে বরং কৌতুহলী হয়ে উঠলো।
“ক’বছর ধরে আমি শোধরাবার চেষ্টা করে যাচ্ছি। তবে সেসব কথা থাক।” কেমন উদাসভাবে বললো লোকটা।
“ইন্টারেস্টিং গপ্পো মনে হচ্ছে?”
“নাঃ, তোমার ভালো লাগবে না। তুমি কিতাব পড়ছো, পড়ো।”
“কিতাব তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না – তুমি আর ভাও না বাড়িয়ে শুরু করো। গপ্পো ভালো না লাগলে – চলতা হ্যায়। আর যদি লাগে – আলুর পরোটা খাওয়াবো। ফ্যান্টাস্টিক বানায় মা।”
“মাঈজির হাতের ভালোবাসার ছোঁয়া – বড্ড লোভ হচ্ছে। তবে তা আর বোধহয় কপালে নেই। যাক, এত করে শুনতে চাইছো, তাই দু’কথায় বলছি। অবশ্য পড়িলিখি নই, তাই গুছিয়ে বলতে পারবো কিনা জানি না।

“হ্যাঁ, এককালে আমি ডাকাত ছিলাম। কেন, কোথায়, কীভাবে শুনলে তোমার মেজাজ বিগড়ে যাবে, অতশত বলার সময়ও হাতে নেই। আমি বরং শোধরাবার চিন্তাটা কেন, কখন মাথায় এলো, সেটা বলি।

“আমি তখন তোমাদের বাংলারই এক জেলে। শেষ অবধি ধরা পড়ে লম্বা মেয়াদ হয়েছে। জেলের লাইফ যে কী জিনিস, তা তুমি ঐ পিকচারে দেখে বুঝতে পারবে না। জেলের নাম আজকাল হয়েছে ‘সংশোধনাগার’। কিন্তু আদতে তা এক কথায় বললে – নরক। শুধু কী, আমার মতো খুচরো পাপীরা তাতে পচে মরে। আর যারা পাইকিরি রেটে পাপ করে তারা সব রাজাগজা হয়ে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়।

“এমনটা তো বছরের পর বছর হয়ে আসছে। কিন্তু হঠাৎ তার মধ্যে এক ঝলক তাজা হাওয়া ঢুকে পড়লো – এক জেল সুপার সাব আর এক নাচিয়ে দিদি। তাঁরা বলতে লাগলেন সব মানুষের মধ্যেই ভালো আছে, শুধু সেটা অবস্থার দোষে চাপা পড়ে যায়। তাই যে যতবড় পাপীই হোক না কেন তার মধ্যের গুণী মানুষটাকে জাগিয়ে তুলে তাকে শোধরানো যায়। রামচরিত লিখেছেন যে তুলসীদাসজী, তিনিও নাকি এককালে –”

“তুলসীদাস নন, বাল্মীকি। প্রথম জীবনে তিনি রত্নাকর দস্যু ছিলেন।”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ। তারপর একদিন তিনি অনুতাপে জ্বলতে জ্বলতে শুদ্ধ হলেন আর এখন তো তাঁর শ্লোক পড়লেও লোকের পুণ্য হয়। সুপার সাবের উৎসাহে ঐ দিদিটি তখন কয়েদীদের নাচাগানা শেখাতে লাগলেন। বললেন – এসবের মধ্য দিয়েই তাদের মনের ময়লা একটু একটু করে কেটে গিয়ে তারা একদিন ভালো হবে। তাঁরা ঐ বাল্মীকিজীর কী একটা নাচাগানার নাটকও কয়েদীদের দিয়ে শুরু করলেন।”

“বাল্মীকির নাটক নয়, রবীন্দ্রনাথের ‘বাল্মীকি প্রতিভা’।”

“হ্যাঁ হ্যাঁ, তাই হবে। তুমি দেখছি অনেক জানো। তারপর যা বলছিলাম। দিদি শুরু তো করলেন। কিন্তু কাজটা দারুণ কঠিন ছিলো। ভালো কাজে বাগড়া দেবার মানুষের তো অভাব হয় না। তারপর এটা এমনই আজগুবি কথা যে কেউ চট করে বিশ্বাস করবে না। আমারও তো মনে হয়েছিলো এসব পড়িলিখি দিদির উল্টোপাল্টা ভাবনা, অমনটা সত্যিই হয় না।"

“কিন্তু দম ছিলো বটে সুপার সাব আর দিদির। মানুষ কত হাসাহাসি, কত অপমান করে তাঁদের কাঁদিয়ে ছেড়েছে। চোর-চোট্টারাও কি আর কম টেনশন দিয়েছে! কিন্তু শেষ অবধি ঐ মানুষ দুটো যা বলা তাই করে ছাড়লো! কয়েদীদের নিয়ে নাটকের দল বানালো, তাদের কতজন মন থেকে শুধরেও গেলো। এখন তো শুনি চারদিকে দিদির কত নামযশ, কয়েদীরা তো তাঁকে প্রায় পূজা করে।”

“তুমিও বুঝি ঐ নাচগানের দলে ছিলে?” রোহন উৎসাহিত হয়ে বললো।

লোকটা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “নাঃ, আমার ওসব আসে না। তাছাড়া আমি ছিলাম অন্য জেলে। তবে মুখে মুখে কথাটা আমাদের কানেও পৌঁছেছিলো। আর কীভাবে যেন সেটা এই পাপীমনেও নাড়া দিয়েছিলো। অমন মানুষও হয়! আজকাল যখন চারদিকে আওয়াজ অপরাধীদের জেলে না রেখে পিটিয়ে মারো বা ফাঁসিতে লটকে দাও, তার মধ্যে ঐ দুটো মানুষ কিনা আমাদের মতো পাপীতাপীদের উদ্ধারের জন্য এত কষ্ট, এত ঝামেলা মাথায় নিয়েছেন! ওঁদের আমি মনে মনে দেবতা জ্ঞানে পুজো করতে লাগলাম। ওঁদের কথা ভেবে আমার মনটাও যেন শুদ্ধ হতে লাগলো। জেলে বসেও অনেক বদ ধান্দা করা যায় – সেসব একটু একটু করে ছেড়ে দিলাম। আর ঠিক করলাম – কখনো যদি ছাড়া পাই আমি নিজে আর পাপকাজ করবো না, অন্যদেরও ঠিক পথে ফেরাবার চেষ্টা করবো।”

“ফ্যান্টাস্টিক! তারপর ছাড়া পেয়ে তুমি আর ওসব লাইনে গেলে না, তাই তো?”

লোকটা হঠাৎ কেমন উদাস হয়ে গেলো। স্বপ্নাচ্ছন্নের মতো বলতে লাগলো, “তারপর সব যেন কেমন উল্টোপাল্টা হয়ে গেলো। তবু আমি ইরাদা ভাঙিনি, আজও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।”

“তার মানে?”

হঠাৎ যেন ঘুম থেকে উঠে লোকটা বললো, “সেসব কথা পরে হবে। এখন খোকাবাবু, তোমাদের সামনে বড় বিপদ। তোমার উল্টোদিকের প্যাসেঞ্জার – ও লোক সুবিধের নয়।”
“সে কী – ও তো একটা ভীতুর ডিম!”
“মোটেই নয়। ও নাটক করছে, আসলে ওর ধান্দা বহুৎ বুরা। ঐ যে, আবার ফিরে আসছে –”
“আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করে।”
“না, ওর সাকরেদদের সাথে লুটপাটের প্ল্যান ফাইনাল করে। ও-ই হচ্ছে লীডার। তোমাকে এবার চটপট কয়েকটা কাজ করতে হবে। এক নম্বর – সামনে গিয়ে পাশের কামরার দিকে যাবার দরজাটা লক করে দিতে হবে। পারবে তো?”
“পারবো। কিন্তু কেন?”
“তাহলে ওর সাকরেদরা আর এদিকে আসতে পারবে না। তারপর – তোমার কলজেয় দেখছি ডর নেই – একলা পেলে লোকটাকে নিশ্চয়ই কব্জা করতে পারবে?” রোহনকে ইতস্তত করতে দেখে লোকটা বললো, “যাও, দেরি ক’রো না। আর যাবার সময় ওর বাঁদিকের হিপ পকেটের পাশটা একটু লক্ষ করো।”

তার কথার স্বরে কী ছিলো কে জানে, রোহন সত্যিই উঠে দরজাটা বন্ধ করতে গেলো। যাবার সময় প্যাসেজে ভীতুবাবুর সাথে দেখা হলো। তখন তাঁর যেন অন্য মূর্তি – বুক টানটান, মুখ আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। কিন্তু রোহনকে দেখেই হঠাৎ গুটিয়ে গিয়ে কাঁচুমাচু ভঙ্গীতে বললেন, “সারা ট্রেনে বাজে লোক – আমার ভীষণ ভয় করছে। তা, চললে কোথায়?”

“বাথরুমে”, বলে রোহন এগোলো। হুঁ, লোকটা তাহলে সত্যি সত্যিই নাটক করছে! ওকে পেরিয়ে গিয়ে ওর বাঁদিকের হিপ পকেটটা আড়চোখে লক্ষ করলো রোহন – জায়গাটা বিচ্ছিরিভাবে ফুলে আছে! হঠাৎ মনে পড়লো তার মামাতো দাদা পিন্টুদা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করে, তার হিপ পকেটটাও ওভাবে ফুলে থাকে! চট করে দুই কামরার মধ্যের দরজাটা লক করে রোহন ফিরে এলো। ভীতুবাবু তখন পেছন ফিরে ওপর থেকে জলের বোতল বের করার চেষ্টা করছেন। চাদর মুড়ি দেওয়া লোকটা রোহনকে চোখের ইঙ্গিত করলো, আর রোহনের হাত-মাথা কাজ করলো বিদ্যুৎবেগে। ঝাঁ করে সে ভীতুবাবুর হিপ পকেটের পাশের ফোলা জায়গায় হাত ঢুকিয়ে দিলো আর মুহূর্তে তার হাতে চলে এলো একটা রিভলভার। একটা ফিসফিসানি কানে এলো, “এবার সেফটি ক্যাচটা টানো!” রোহন রিভলভার চেনে, সেফটি ক্যাচ টেনে যন্ত্রটা ভীতুবাবুর বুকে ধরে সে চেঁচিয়ে উঠলো, “হ্যান্ডস আপ!”

“এ-এসব ক-কী হচ্ছে?” ভীতুবাবু ঊর্ধ্ববাহু হয়ে তোতলাতে লাগলো। চেঁচামেচি শুনে আশেপাশের বার্থ থেকে কিছু লোক চলে এসেছে। চাদর মুড়ি দেওয়া লোকটা বললো, “তেমন কিছু নয়, ডাকাত। আপনাদের সর্বনাশ করার ধান্দায় ছিলো। এই খোকাবাবুর সাহসে ধরা পড়েছে, এইবার আপনারা ওকে ভালোভাবে বেঁধে ফেলুন।”

কয়েকজন যাত্রী সাথে সাথে কোথা থেকে যেন একগাছা দড়ি এনে ভীতুবাবুকে বাঁধতে শুরু করেছে। প্রাথমিক ধাক্কাটা কাটিয়ে ভীতুবাবু গলা চড়িয়ে বললেন, “একটা উটকো লোকের কথায় বিশ্বাস করে আপনারা ভুল করছেন।”

“আর এটা কী, চাঁদু? তোমার পকেটে ছিলো না?” রোহন রিভলভারটা দেখিয়ে দিলো।
“আরে, আমি গোয়েন্দা পুলিশ। উল্টোপাল্টা লোকজনের ওপর নজর রাখার জন্য রেল আমাদের রেখেছে।” বলে ভীতুবাবু একটু দম নিয়ে তেড়েফুঁড়ে বললো, “আর যার কথায় আপনারা নাচছেন, সে নিজেই যে সন্দেহজনক। মুখটাও তো দেখাচ্ছে না।”
“দেখবি, বাচ্চু সামন্ত?” বলে লোকটা চাদরটা সরিয়ে নিতেই আত্মপ্রকাশ করলো এক বিকটদর্শন মুখ, যার ডান গালে আড়াআড়ি লম্বা একটা কাটার দাগ। ভীতুবাবুর মুখটা মুহূর্তে ছাইয়ের মতো সাদা হয়ে গেলো। “ছো-ট্টু-স-র্দা-র – তুই আমার পেছনে কেন লেগেছিস?” সে কাঁপতে কাঁপতে বললো।
“তোর ভালোর জন্য। ক’টা ছাপোষা মানুষের সর্বস্ব লুটতিস, কিছু নিরীহ যাত্রীর প্রাণ নিতিস, তারপর নিজে পাবলিকের ধোলাই খেয়ে বা ফাঁসিকাঠে ঝুলে মরতিস। তার চেয়ে এখন কিছুদিন জেলের ভাত খা। তারপর যখন বেরোবি, আর বুঢ়া ধান্দা করিস না। মানুষের থেকে লুটে কম পয়সা তো করিসনি – সেসব দিয়ে এরপর বরং কিছু সৎ ব্যবসা-ধান্দার চেষ্টা করিস।”

ভীতুবাবু ওরফে বাচ্চু সামন্ত ততক্ষণে প্রায় মূর্ছা গেছে। সেদিকে চেয়ে ছোট্টু সর্দার বললো, “ওকে ছাড়বেন না, সামনের স্টেশনে পুলিশ ডেকে ধরিয়ে দেবেন। আর ঐ যে ওর চেন বাঁধা বাক্সটা, ওটাও পুলিশের হাতে তুলে দেবেন। ওতে ডাকাতির অস্ত্রশস্ত্র আছে।”
“কিন্তু ওর সাকরেদগুলো?” রোহন বলে উঠলো।
“সর্দার ধরা পড়েছে জানলে নিজে থেকে ভাগবে। ওগুলো চুনোপুঁটি, এটাই জোরজার করে ওদের দলে ভিড়িয়েছিলো।”
ট্রেনের গতি কমছে। “স্টেশন আসছে। চলি খোকাবাবু, খুব সাহস দেখালে”, বলে ছোট্টু সর্দার দরজার দিকে এগোলো।
“কোথায় যাচ্ছো, পুলিশ আসা অবধি তো থাকো। তোমার জন্যই লোকটা ধরা পড়লো, তোমার মেডেল পাওয়া উচিত।” রোহন বললো।
“উপায় নেই, খোকাবাবু।” ছোট্টু ম্লান মুখে বললো, “আমার তো নামের চেয়ে বদনামই বেশি – পুলিশ এলে কি আর বিশ্বাস করবে যে আমি বে-গুনহা? তাই আগেভাগে কেটে পড়াই ভালো। ভালো থেকো, সাহস রেখো।” পরমুহূর্তে সে ঐ দশাসই চেহারা নিয়ে যেন একটা বিদ্যুতের ঝলকের মতো ছুটে গেলো আর চলন্ত গাড়ির দরজা খুলে বাইরের একরাশ অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো।

মামাবাড়ি গিয়ে এসব বৃত্তান্ত অবশ্য রোহন কাউকে বলেনি। ছোটমামা নিজেও ভীতুর ডিম, তাছাড়া কথাটা বাড়িতে একবার পৌঁছোলেই হয়েছে আর কি! হয়তো এরপর এ-লে-প্লে-নে ছাড়া তাকে আর যাতায়াতই করতে দেবে না। তার মানে সব মজা মাটি!

ক’দিন মামাবাড়ির আদর খেয়ে রোহন কলকাতা ফিরলো। ফেরার সময় অবশ্য আর কোনো থ্রিল হয়নি, ছোট্টু সর্দারের দেখাও মেলেনি। বাড়ি ফিরেও রোহন মুখে কুলুপ এঁটে রইলো। তবে কিছুদিন পর গোয়েন্দা দাদা পিন্টুদার সঙ্গে তার অফিসে গিয়ে দেখা করলো।

“বাড়ির কাউকে যেন ব’লো না, পিন্টুদা।” রোহন ফিসফিসিয়ে বললো, “ছোট্টু সর্দার বলে কারো নাম শুনেছো? ডাকাত, কলকাতার কোনো জেলে ছিলো? ইয়া তাগরাই চেহারা আর ডান গালে একটা লম্বা কাটার দাগ?”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ, শুনবো না কেন? আমি তো এক সময় ওর কেস নিয়ে ডিলও করেছি। সে এক স্যাড কেস। লোকটা এককালে কুখ্যাত ডাকাত ছিলো, তারপর ধরা পড়ে বোধহয় চোদ্দ বছরের মেয়াদ হয়। বেশ কিছুদিন ভেতরে থাকার পর হঠাৎ কেন যেন তার মনটা বদলে গেলো। জেলে বলতে গেলে সাধুসন্তের জীবন যাপন করছিলো। কিন্তু বদনসিব – যখন মেয়াদ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, ও ঘটনাচক্রে একটা জেল পালানো দলের মধ্যে পড়ে গেলো। যাবো কি যাবো না ভাবতে ভাবতে ও শেষ অবধি পালায়, কিন্তু হয়তো দ্বিধার ফলে দেরি করে ফেলায় ওর গায়ে পুলিশের গুলি লাগে। সম্ভবতঃ তার থেকেই পরে তার মৃত্যু হয়। অবশ্য নিশ্চিত করে বলা শক্ত – তবে কিছুদিন পর একটা পচাগলা লাশ গঙ্গায় ভেসে উঠেছিলো, যেটা ছোট্টুর বলে পুলিশের অনুমান।”

“না, ছোট্টু সর্দার মরেনি।” রোহন যেন আপন মনে বললো।

পিন্টুদা তার মুখের দিকে সন্ধিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, “ব্যাপার কী রে? তুই লোকটাকে কোথাও দেখেছিস নাকি? বল, তাহলে তো আবার খোঁজ শুরু করতে হয়।”

রোহনের মুখে এক রহস্যময় হাসি ফুটে উঠলো। বললো, “তাকে খুঁজতে হলে দূরপাল্লার ট্রেনগুলিতে যেতে হবে। সেখানে সে বিপন্ন রেলযাত্রীদের বন্ধু হয়ে তার ভালো হবার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।”


অনিরুদ্ধ সেন
থানে, মহারাষ্ট্র


ছবিঃদীপায়ন সরকার

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনীয়ার ও মুম্বইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চের অবসরপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী অনিরুদ্ধ সেন কলকাতা-মুম্বইয়ের বিভিন্ন সাময়িকপত্র ও ওয়েব ম্যাগাজিনের নিয়মিত লেখক। তাঁর লেখা ও অনুবাদ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়, এবং সংকলিত বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে।