চিত্র ১ - কম্পাস
কয়েক সহস্রাব্দ আগেই মানুষ এক অদ্ভুত পাথর আবিষ্কার করেছিল যার দু'টি আশ্চর্য ধর্ম ছিল। প্রথমত, সেগুলো লোহাজাতীয় জিনিসকে নিজেদের দিকে টেনে নিত। দ্বিতীয়ত, সুতোয় ঝুলিয়ে রাখলে সেগুলো উত্তর-দক্ষিণ দিকে ঘুরে স্থির হতো। তুরস্কের ম্যাগনেশিয়া অঞ্চলে প্রথম পাওয়া গিয়েছিল বলে এই পাথরের নাম দেওয়া হয়েছিল ম্যাগনেটাইট। তার থেকে নাম ম্যাগনেট, বাংলায় বলা হয় চুম্বক।
চুম্বকের বিশেষ ধর্মকে মানুষ নানা কাজে লাগিয়েছে, যেমন কোনও মিশ্রণের মধ্য থেকে লোহার গুঁড়ো বা টুকরো আলাদা করার জন্য। কিন্তু তার সবচেয়ে বড়ো ব্যবহার ছিল জাহাজ চলার সময় দিকনির্দেশের কাজে। অথৈ সমুদ্রে দিক বুঝতে সে যুগে একমাত্র সম্বল ছিল বিভিন্ন গ্রহতারার অবস্থান সম্বন্ধে মানুষের জ্ঞান। ক্যাপ্টেন ও নাবিকদের এ ব্যাপারে অভিজ্ঞতার ঘাটতি থাকলে অথবা আকাশ মেঘে ঢাকা থাকলে দিকভ্রষ্ট হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। এই সময় ঐ চুম্বক এল আশীর্বাদ হয়ে। কোনও চুম্বক শলাকাকে একটা কেসের মধ্যে সূচের ফলা অর্থাৎ 'পিভট'-এর ওপর ভর দিয়ে রাখলে তা খুশিমতো ঘুরতে পারে। তখন সেটা উত্তর-দক্ষিণ মুখ করে থাকবে। একটা ডায়াল তার সঙ্গে সেঁটে দেওয়া হয়, যাতে সেটাও চুম্বকের সাথে সাথেই ঘুরতে থাকে। এই ডায়ালে চুম্বকের একটা দিককে উত্তর, বিপরীতটাকে দক্ষিণ ও মধ্যের জায়গাগুলিকে পুব, পশ্চিম ও অন্যান্য কোণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় (চিত্র ১)। সেই বুঝে ক্যাপ্টেন জাহাজ চালনার নির্দেশ দিতে পারেন।
চিত্র ২
অবশ্য এই পদ্ধতিতেও নানা ত্রুটি থেকে গিয়েছিল। চুম্বক নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমেই সেগুলো মানুষ কাটিয়ে ওঠে। এইসব পরীক্ষার ফলে মানুষ আরও জানতে পারে যে: (১) লোহা ছাড়াও চুম্বক নিকেল, কোবাল্ট ও লোহার ধাতুসঙ্কর বা 'অ্যালয়'কে আকৃষ্ট করে। (২) চৌম্বক ধর্ম চুম্বকের দুই প্রান্তে বেশি, তারপর কমতে কমতে একেবারে মধ্যে এসে শূন্য। এই দুই প্রান্তকে বলা হয় দুই 'মেরু'। যদি লোহাচুরের স্তুপে চুম্বক রেখে উঠিয়ে নেওয়া হয়, দেখা যাবে দুই দিকে অর্থাৎ দুই মেরুর কাছেই বেশি লোহা লেগে আছে (চিত্র ২)। যে মেরু উত্তর দিকে ঘুরে থাকে, তাকে বলে উত্তর মেরু আর যে দক্ষিণ দিকে ঘুরে থাকে তাকে বলে দক্ষিণ মেরু। (৩) একই রকম মেরু পরস্পরকে বিকর্ষণ করে অর্থাৎ দূরে ঠেলে। বিপরীত মেরু পরস্পরকে আকর্ষণ করে অর্থাৎ কাছে টানে।
তাহলে চুম্বক উত্তর-দক্ষিণে কেন ঘুরে থাকে? নিশ্চয়ই অন্য কোনও চুম্বকের আকর্ষণে? গোটা পৃথিবীতেই এই ঘটনা ঘটে। তাই বিজ্ঞানীরা এই আশ্চর্য সিদ্ধান্তে এলেন যে পৃথিবীটাই একটা বিরাট চুম্বক আর তার আকর্ষণেই অন্যান্য চুম্বক উত্তর-দক্ষিণমুখো হয়ে থাকে! কিন্তু পরস্পরকে আকর্ষণ করে তো বিপরীত মেরু? তাহলে নিশ্চয়ই চুম্বকের উত্তর মেরু যেদিকে ঘুরে থাকে অর্থাৎ ভৌগোলিক উত্তর, সেদিকে পৃথিবী-চুম্বকের দক্ষিণ মেরু আর ভৌগোলিক দক্ষিণে রয়েছে পৃথিবী-চুম্বকের উত্তর মেরু। আরও পরীক্ষার পর বিজ্ঞানীরা সূক্ষ্ণভাবে নির্ণয় করলেন যে পৃথিবী-চুম্বকের মেরু আর ভৌগোলিক মেরু ঠিক এক নয়, একটু এদিক-ওদিকে। তাই কম্পাস শলাকার 'উত্তর' যেদিকটা দেখায় সেদিকটা পৃথিবী-চুম্বকের উত্তর মেরু, ভৌগোলিক উত্তর মেরু নয়। এর জন্য দিকনির্ণয়ে প্রয়োজনীয় সংশোধনের হিসেবও বিজ্ঞানীরা বাৎলে দিলেন। এই সংশোধনের পরিমাণ দুই মেরুর যত কাছে যাওয়া যায়, তত বাড়ে। আর সত্যি বলতে মেরুর খুব কাছে গেলে কম্পাস কার্যত অকেজো হয়ে যায়।
দিকনির্দেশের জন্য আজকাল অনেক আধুনিক ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার হয়। তবু নৌচালনা, বিমানচালনা বা সাধারণভাবে দিকনির্দেশের কাজে এই ম্যাগনেটিক কম্পাসের উন্নত সংস্করণ আজও ব্যবহার হয়।
চুম্বকের ব্যবহার বাড়ার সাথে সাথে তার চাহিদাও বাড়তে থাকে। অত চাহিদা তো খনিজ ম্যাগনেটাইট মেটাতে পারবে না। প্রয়োজনই উদ্ভাবনের স্রষ্টা। মানুষ আবিষ্কার করল যে বিভিন্ন লৌহজাত পদার্থ অর্থাৎ চৌম্বক পদার্থকে বিশেষ পদ্ধতিতে একটা চুম্বক দিয়ে অনেকক্ষণ ঘষলে সেই পদার্থটাও চুম্বকে পরিণত হয়। তবুও এই পদ্ধতিতে হাতে হাতে সীমিত সংখ্যক চুম্বকই বানানো যেত, তাদের শক্তিও হতো সীমিত। সেসব দিয়ে তাই সীমিত কাজই করা যেত। এ বিষয়ে বৈপ্লবিক পরিবর্তন হল আধুনিক যুগে, যখন প্রথম বিদ্যুৎশক্তি আবিষ্কার হল আর তারপর হল চৌম্বকশক্তি আর বিদ্যুৎশক্তির মধ্যে যোগসূত্র আবিষ্কার।
চিত্র ৩
সেসব আবিষ্কারের অনেক গল্প আছে। সেটা পরে বলা যাবে, আপাতত তার একটা ফল বলে নিই। দেখা গেছে কোনও চৌম্বক পদার্থের ওপর বিদ্যুৎ পরিবাহী তার পেঁচিয়ে তার মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত করলে তার প্রভাবে ঐ ধাতুগুলি চুম্বকে পরিণত হয় (চিত্র ৩)। যদি ঐ ধাতুগুলি কাঁচা লোহা বা লোহার কতগুলো বিশেষ অ্যালয় হয়, তবে এই চৌম্বকধর্ম অস্থায়ী – বিদ্যুৎপ্রবাহ বন্ধ করলেই তা উধাও হবে। আবার অ্যালনিকো (অ্যালুমিনিয়াম-স্টীল) প্রভৃতি কিছু ধাতুসঙ্করের ক্ষেত্রে বিদ্যুৎপ্রবাহ যদি জোরালো হয় ও তারের পাক যদি যথেষ্ট থাকে, তবে বিদ্যুৎপ্রবাহ বন্ধ হলেও পদার্থটা বেশ কিছুটা চৌম্বক ধর্ম ধরে রাখতে পারবে। তাকে তখন বলা হবে স্থায়ী তড়িৎচুম্বক বা ইলেকট্রো-ম্যাগনেট। বলা বাহুল্য, এখন যেসব স্থায়ী চুম্বক পরীক্ষাগারে বা অন্যত্র দেখা যায়, তার প্রায় সবই ঐ তড়িৎচুম্বক। এই পদ্ধতিতে উপযুক্ত ধরনের ইস্পাত থেকে অজস্র পরিমাণে চুম্বক তৈরি করা যায়। প্রবাহিত বিদ্যুতের মাত্রা (কারেন্ট), চৌম্বক পদার্থটির ওপর তারের পাকের সংখ্যা ও চৌম্বক পদার্থটির আড়াআড়ি ক্ষেত্রফল (ক্রস-সেকশন এরিয়া) বাড়িয়ে এই চুম্বককে উপযুক্ত মাত্রায় শক্তিশালীও করা যায়।
তাই চুম্বকের ব্যবহারের ক্ষেত্রও ক্রমে প্রসারিত হয়ে চলেছে। স্থায়ী-অস্থায়ী দু'ধরণের তড়িৎচুম্বকেরই ব্যবহার অজস্র। স্থায়ী তড়িৎচুম্বককে ফ্রিজ বা ঘরের দরজা ধরে রাখার কাজে ব্যবহার হতে তোমরা নিশ্চয়ই দেখেছ। এছাড়া টিভি বা মিউজিক সিস্টেমে যে স্পীকার থাকে, তাতেও একটা বড়ো চুম্বক থাকে। পরীক্ষাগারেও চুম্বকের ধর্ম নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজে স্থায়ী চুম্বক ব্যবহার হয়।
অস্থায়ী তড়িৎচুম্বকের ব্যবহার আরও অজস্র, যার অনেকটাই ঘটে সাধারণ মানুষের অজান্তে। তোমরা হয়তো ক্রেনে করে ভারী মাল তুলতে দেখেছ। ক্রেনে জোড়া থাকে এক অস্থায়ী তড়িৎচুম্বক আর মালের সঙ্গে বাঁধা হয় এক লোহার স্ল্যাব। তড়িৎচুম্বকের মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত করলে তা চুম্বকে পরিণত হয় আর লোহাকে আকর্ষণে বেঁধে ফেলে। ফলে মালটা ক্রেনের সঙ্গে লেগে থাকে। ক্রেন মাল যথাস্থানে পৌঁছে দেওয়ার পর তড়িৎচুম্বকের বিদ্যুৎপ্রবাহ বন্ধ করা হয়। ফলে মালটা ক্রেন থেকে আলগা হয়ে সেখানে থেকে যায়।
চিত্র ৪
আর একটি সবার জানা প্রয়োগ হচ্ছে বৈদ্যুতিক ঘণ্টা বা ইলেকট্রিক বেল। আমি এখানে টুই-টিঙ্কল ইলেকট্রনিক বেল নয়, ক্যাঁ-অ্যাঁ-অ্যাঁ আওয়াজের বৈদ্যুতিক ঘণ্টিগুলোর কথা বলছি। হয়তো জানো, বিদ্যুৎ একটা পূর্ণ বর্তনী বা সার্কিটের মধ্য দিয়েই প্রবাহিত হতে পারে। যেমন মেইনের 'লাইভ' তার থেকে বিদ্যুৎ সুইচ হয়ে লাইটে এসে আবার সেখান থেকে বেরিয়ে 'নিউট্রাল' তার দিয়ে ফিরে যায়। ফ্যানের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। সার্কিট ছিন্ন হলে (যেমন, সুইচ অফ করলে) বিদ্যুৎপ্রবাহও বন্ধ হয়। ইলেকট্রিক বেলে থাকে একটা পাতলা ইস্পাতের রড, তার আগায় একটা ছোট্ট ধাতুপিণ্ড (চিত্র ৪)। একটা স্প্রিং লোহার রডটাকে বৈদ্যুতিক টার্মিনালের সাথে জোর করে ধরে রাখে। ফলে বেলের সুইচ অন করলে সার্কিট দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়। এই সার্কিটে আরও জোড়া থাকে একটা কাঁচা লোহার টুকরো, যার ওপর প্যাঁচানো অজস্র তারের পাক। বিদ্যুৎ প্রবাহিত হলে ঐ লোহার টুকরোটি অস্থায়ীভাবে শক্তিশালী চুম্বকে পরিণত হয়। তখন সেটা লোহার রডটাকে স্প্রিংয়ের বাঁধন ছাড়িয়ে নিজের দিকে টেনে আনে। এতে দুটো কাজ হয়। প্রথমত, ঐ রডের মাথার ধাতুপিণ্ড একটা ঘণ্টায় আঘাত করে শব্দ তৈরি করে। দ্বিতীয়ত, এর ফলে বিদ্যুৎপ্রবাহ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ফলে লোহার টুকরোটি চুম্বকধর্ম হারিয়ে লোহার রডটিকে ছেড়ে দেয়। তখন স্প্রিংয়ের টানে রডটা আবার আগের জায়গায় ফিরে যায়। (যেমন ডোর ক্লোজার লাগানো দরজা ছেড়ে দিলে তা স্প্রিংয়ের চাপে আগের জায়গায় ফিরে যায়।) ফলে সার্কিট আবার জোড়া লাগে, আবার বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়, আবার লোহার টুকরোটা চুম্বক হয়ে রডটাকে আকর্ষণ করে, আবার তার মাথাটা ঘণ্টায় ধাক্কা মেরে শব্দ করে। এইভাবে ঘন ঘন রডটা সামনে-পেছনে চলে ঘণ্টাকে ক্রমাগত আঘাত করতে থাকে। আমাদের কান পরপর অত তাড়াতাড়ি তৈরি হওয়া শব্দগুলিকে আলাদা শব্দ বলে ধরতে পারে না, তাই আমরা একটানা ক্রি-ই-ইং শব্দই শুনি।
স্থায়ী-অস্থায়ী তড়িৎচুম্বকের মিলিত প্রয়োগ আজ সভ্যতা পাল্টে দিয়েছে। বিশেষ করে বলার মতো হচ্ছে বিদ্যুৎ তৈরির জেনারেটর, ইলেকট্রিক মোটর, বিদ্যুৎযন্ত্র ট্রান্সফর্মার। ম্যাগনেটিক টেপ ও বিভিন্ন প্রজন্মের কম্পিউটার মেমরিতেও তড়িৎচৌম্বকত্ব ব্যবহার করা হয়েছে। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে ম্যাগনেটিক ইমেজ রেজোনেন্স বা এম-আর-আই শরীরের অভ্যন্তরের নিখুঁত ছবি তুলবার অন্যতম পদ্ধতি। 'ম্যাগ লেভ' বা ম্যাগনেটিক লেভিটেশনে ট্রেনে গাড়ির নিচের ও লোহার লাইনের অস্থায়ী তড়িৎচুম্বকের বিকর্ষণের বল ব্যবহার করে ট্রেনকে লাইনের একটু উঁচুতে তুলে ধরা হয়। লাইনের ঘর্ষণ না থাকায় এর ফলে ট্রেন অনেক জোরে ছুটতে পারে। শুধু চিন, জাপান ও জার্মানিতে চলা এই ট্রেন আমাদের দেশেও আসতে পারে। তড়িৎচুম্বকীয় ফলের এমন আরও অজস্র ব্যবহার, যার কিছু কিছু নিয়ে পরে একটু বিস্তারিত বলার ইচ্ছে রইল।
একটা প্রশ্ন দিয়ে শেষ করি। সত্যজিৎ রায়ের গল্প অবলম্বনে সিনেমা 'টিনটোরেটোর যীশু'তে আছে জঙ্গলের মধ্যে পাওয়া একটা তলোয়ার রাতারাতি চুম্বকে পরিণত হয়ে গেছে দেখে ফেলুদা সিদ্ধান্তে এল, এখানে আগের রাতে বাজ পড়েছিল। কেন?
রেখাচিত্র নির্মাণঃ মহাশ্বেতা রায়
ছবিঃ বিভিন্ন ওয়েবসাইট