কলকাতা শহরের এক জনবহুল এলাকায় একটা ইঁটের একতলা বাড়িতে থাকে ছয় বছরের ছোট্ট মেয়ে টুকি। বাবা বাড়ির সামনে যে বিশাল ফ্ল্যাট বাড়িটা আছে সেখানে দারোয়ানের কাজ করে আর মা ওদের পাড়ায় যে কাপড়ের দোকান, সেখানে কাপড় সেলাইয়ের কাজ করে। টুকি সকালে উঠে কিছুক্ষন পড়াশুনো করে নিয়ে তারপর স্কুলে চলে যায়। দুপুরে বাড়ি ফিরে খাবার খাওয়ার পর নিজের মনে খেলতে থাকে। টুকিকে ওর মা বলে দিয়েছে ও যেন বাড়ির বাইরে বেড়িয়ে কারুর সাথে কথা না বলে। তাই ওর এ পাড়ায় কোনো বন্ধু নেই। সম্প্রতি ওর স্কুলে গরমের ছুটি পড়েছে। ছুটির আগেই স্কুলে একটা পরীক্ষা হয়ে গেছে। নতুন পড়া সেরকম নেই। তাই ছুটির দিনে সারা সময়টাই টুকির খেলতে ইচ্ছে করে। কিন্তু খেলবে কার সাথে? ওর তো কোনো বন্ধুই নেই। ওর সারাদিন বড্ড একা একা লাগে। টুকি ভাবে,"না, এভাবে একা একা আর খেলা যাচ্ছে না। এবার একটা বন্ধু আমাকে বানাতেই হবে। কিন্তু কে হবে আমার বন্ধু?" ও উত্তর খুঁজে পায় না।
একদিন মার সাথে দোকান থেকে ফেরার সময় টুকি জলি দিদিকে কার সাথে ফোনে কথা বলতে শোনে,"হ্যাঁ মেঘ, আমি না এখন একটু ব্যস্ত আছি, পড়ে কথা বলব"।জলি থাকে ওদের সামনের ফ্ল্যাটবাড়ির তিনতলায় যার বাড়িতে টুকির মা মাঝে মাঝে কাপড় বিক্রি করে আসে।জলি দিদির কথাটা শুনেই টুকি অবাক হয়ে যায়।ও ভাবে, “ওমা, মেঘ বুঝি কারও বন্ধু হয়? তাহলে নিশ্চই সে আমারও বন্ধু হবে!" টুকি ঠিক করে নেয় যে ও মেঘকেই ওর বন্ধু করবে।পরদিন সকালে ও ওদের ছোট ছাদটাতে গিয়ে ঝলমলে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে,“মেঘদিদি,ও মেঘদিদি,তুমি আমার বন্ধু হবে?" সঙ্গে সঙ্গে একটা সাদা তুলতুলে মেঘ কোথা থেকে উড়ে এসে বসে নীল ঝক্ঝকে আকাশের ওপর আর ওর দিকে তাকিয়ে হাসে।টুকি বুঝতে পারে মেঘদিদি ওর প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়েছে।ব্যস, টুকির আর আনন্দের শেষ থাকে না।এতদিনে ও একটা বন্ধু খুঁজে পেয়েছে।তারপর থেকে ও ওর সব মনের কথা মেঘ দিদিকে বলে আর মেঘ দিদিও সেই শুনে কখনো লাল হয়,কখনো কালো আবার কখনো সাদা।ইদানীং কোলকাতা শহরে প্রচন্ড গরম পড়েছে।টুকির মা-বাবা প্রায়ই বলে,“গরমের জ্বালা আর সহ্য করা যাচ্ছে না।এই বৃষ্টিটা যে এখনও কেন হচ্ছে না কে জানে!" টুকিও রাত্রে ভালো করে ঘুমোতে পারে না গরমের জন্য।টুকির হঠাৎ মনে আসে,“এই কথাটা মেঘদিদিকে বললে কেমন হয়?মেঘ দিদিতো পারে বৃষ্টি দিতে!" টুকি ঠিক করে মেঘ দিদিকে ও চিঠি লিখবে।কিন্তু তার কাছে চিঠি পৌঁছবে কি করে?হঠাৎ টুকির একটা কথা মনে পড়ে যায়।ও অনেকদিন আগে ওদের ছাদে কুড়িয়ে পাওয়া একটা ঘুড়ির ওপর ওর বার্তা লেখে।তারপর একদিন বিকেলে ওই ঘুড়িটা আকাশে উড়িয়ে দেয় যাতে মেঘদিদি ওর চিঠিটা পড়তে পারে।ঘুড়ি ওড়ানোর সময় ও একটা জিনিস লক্ষ্য করে।জলি দিদি ওদের ফ্ল্যাটের জানলার সামনে মুখ বেজার করে বসে আছে আর মনে হল যেন কাঁদছেও।এটা দেখেও টুকির খারাপ লাগে।যাই হোক্,পরেরদিন টুকি ভেবেছিল যে ওর কথা শুনে মেঘ দিদি বৃষ্টি দেবে।কিন্তু মেঘ দিদি তা না করে শুধু মুখ ফ্যাকাসে করে থাকে।এই দেখে টুকির খুব রাগ হয়।ও মেঘ দিদির সাথে আড়ি করে দেয়।সেদিনই ওর মা বাড়িতে বলে যে জলি দিদির খুব মন খারাপ কারণ ওর বন্ধুর সাথে ওর ঝগড়া হয়েছে।টুকির মুখ থেকে বেরিয়ে যায়, “ঠিক আমার মতো?" ওর মা বুঝতে পারে না।
টুকি আবার নতুন বন্ধুর খোঁজ করে,যদিও মেঘ দিদির কথা ও এখনও ভোলেনি।স্কুলের দিদিমণি বলে যে গাছ আমাদের বন্ধু।টুকির মনে হয়,কই গাছ তো ওর সাথে কোনোদিনও কথা বলেনি?ওর পরক্ষণেই মনে পড়ে গাছ ওর সাথে বন্ধুত্ব করবে কি করে,ওর আশেপাশে তো কোন গাছই নেই।ও ঠিক করে ও নিজে গাছ পুঁতবে, তারপর তার সাথে খুব বন্ধুত্ব করবে।ও বাবার কাছে অনেক বায়না করে একটা তুলসি গাছের চারা আনিয়েছে।চারাটাকে ও ওর বাড়ির পাশের ছোট্ট জমিতে সযত্নে পুঁতে ফেলে।তারপর ফ্যাকাসে মেঘের দিকে তাকিয়ে বলে,“যাও, তোমাকে আমার কথা শুনতে হবে না।আমার নতুন বন্ধু এসে গেছে।"তখনই ওর নজরে আসে জলি দিদি জানলা থেকে ওর চারাটার দিকে তাকিয়ে আছে।তারপর থেকে ও রোজ চারাটায় জল দেয়।নতুন ফুটে ওঠা ছোট্ট ছোট্ট পাতাগুলোর ওপর আলতো করে হাত বোলায় আর আপন মনে গল্প করে যায়।
হঠাৎ একদিন টুকির ঘুম ভাঙে মেঘের প্রচন্ড একটা গর্জনে। ও তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠে জানলার ধারে এসে দেখে আকাশ প্রচন্ড কালো করে এসেছে।কিছুক্ষণ পরই ঝম্ঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হয়। টুকি দেখে ওর সদ্য বেড়ে ওঠা গাছটা বৃষ্টির জলে আর হাওয়ায় নেচে উঠেছে।ওপরের দিকে তাকিয়ে ও দেখে জলি দিদি জানলা থেকে হাত বার করে খিল্খিল্ করে হাসছে আর ওর দুহাত ভিজিয়ে দিচ্ছে বৃষ্টির অসংখ্য বড় বড় ফোটা। টুকিরও আনন্দে নাচতে ইচ্ছে করে আর ও জোরে জোরে বলে ওঠে, “থ্যাঙ্ক ইউ, মেঘ দিদি! তোমার সঙ্গে আবার ভাব!!"
শ্রীরূপা সরকার সেন্ট জন্স ডায়োসেশন স্কুলের দ্বাদশ শ্রেণীর বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী।বই পড়তে (বিশেষ করে গোয়েন্দা গল্প), লিখতে, আঁকতে এবং গান শুনতে ভালবাসে।শ্রীরূপার প্রিয় লেখিকা লীলা মজুমদার
ছবিঃ মহাশ্বেতা রায়