মোজাটা ঝুলিয়ে দিয়ে লেপের তলায় ঢুকে গেল বুবাই। ও এ বছর বারোতে পড়ল। ক্রিসমাসের আগের দিন রাতে মোজা ঝোলানোর অভ্যাস এখনও যায় নি – ক্রিসমাসের রাতে সান্তাক্লজ তার মোজা ভরে সে যা চায় তাই দিয়ে যাবে এই আশায়। তবে সে এখন ভালো করেই জানে তার সান্তা কে।
প্রত্যেকবারের মতো এবার ও চিরকুটে যা চায় তা লেখে নি। এবার দেখা যাক তার সান্তা কী করে ও যা চায় তা দেয়। না দিতে পারলেই ধরা পড়ে যাবে যে সে আসল সান্তা না।
জানলা দিয়ে পাশের বাড়ীর দিকে তাকালো বুবাই। ওদের পাশেই গোমড়াবুড়োর বাড়ী। বুড়োর কেউ নেই, একাই থাকে আর দিনরাত গোমড়ামুখে ঘোরে আর কি করে – দেখলে কেমন লাগে। বুবাই-এর তিনটে বল ওর জানলার কাঁচ ভেঙে ওর ঘরে ঢুকে গেছে, বুবাইয়ের সাহস হয় নি চেয়ে আনার, বুড়োর দিকে তাকালেই ওর ভয় করে।
বুবাইয়ের বাবার বদলীর চাকরী, এখানে বছর খানেক হলো এসেছে। এখানে বড় বড় অ্যাপার্টমেন্ট, দোকান, বাজার থাকলেও একটু ভিতরের দিকেই একটা বস্তি আছে। বুবাই এখানে আসার পরে বস্তির রাস্তাতে ঘুরঘুর করত, বাবা-মায়ের বারণে আর ও দিকে যায় না। আগে যখন সল্ট লেকে থাকত তখন ওখানে ওর অনেক বন্ধু হয়েছিল। তাদের সাথে মজায় ক্রিসমাস কাটানোর কথা ভাবতে ভাবতে বুবাইয়ের আর ঘুম আসে না। রাত ক’টা বাজে ও ঠিক বুঝতে পারছে না। বাবা-মা পাশের ঘরে ঘুমাচ্ছে। ও জানে ভোরবেলা উঠেই বাবা ঝোলানো মোজাতে গিফট রাখবে। বুবাইয়ের খুব ইচ্ছা এবার যেন বল পায়, ও তিন তিনটে বল হারিয়েছে। কিন্তু বাবা তো তা জানে না, দেবে কী করে? হাসি পেল বুবাইয়ের, বাবা এবার জব্দ!
কিন্তু গোমড়াবুড়োর বাড়ির দিকে তাকাতেই হাসি নিভে গেল। ওর গেট খুলে কেউ একজন বেরোচ্ছে, পোশাক ঠিক সান্তাক্লজের মতো। ব্যাপার কি? কৌতুহলী বুবাই নিঃশব্দে উঠল, জামার উপরে একটা জ্যাকেট চাপিয়ে জুতো পড়ে আস্তে আস্তে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল, জ্যাকেটের টুপিটা দিয়ে মাথা ঢেকে নিল, তারপরে পা টিপে টিপে সান্তার পিছু নিল।
সান্তা বস্তির দিকে যাচ্ছে। যাবে না ভেবেও বুবাই না গিয়ে পারল না, ওর কৌতুহল এখন ওর ভয়কে গ্রাস করেছে। সব ভুলে, এমন কি বাবা-মার বারণের কথাও ভুলে সে সান্তা কী করছে দেখতে এগোতে লাগল।
কয়েকটা বাচ্চা রাস্তার ধারে ভাঙা চালায় শীতে কুঁকড়ে ঘুমোচ্ছে, পায়ে কারো ছেঁড়া কাঁথা, কারো বা বস্তা। সান্তা একটা বড়ো কম্বল দিয়ে সযত্নে ঢেকে দিল তাদের, মাথার পাশে রেখে দিল কিছু খেলনা আর চকোলেট। আরেক ভাঙা চালার সামনে এক বুড়ো শুয়ে ঘুমাচ্ছে, সান্তা তার গা ঢেকে দিল একটা চাদর দিয়ে। আরেকটা চালার ফোকর দিয়ে একটা প্যাকেট ফেলল সান্তা। আরে! এটা তো রিকশাওয়ালা ধীরেনের চালা, ওর তো টি বি হয়েছে! ও তো এখন তো রিকশা চালাতেও পারে না, তাই খেতেও পায় না। সান্তা ওকে কি দিলো? খাবার, না টাকা?
সান্তার কার্যকলাপ দেখতে বুবাই এত বিভোর হয়ে পড়েছিল যে ও একটু অসাবধান হয়েছিল, হঠাৎ সান্তা ঘুরে দাঁড়াল কী সন্দেহ করে। বুবাই তখন নিজেকে লুকানোর অবস্থায় নেই। কিন্তু লাইটপোস্টের আলোয় দেখে বুবাই অবাক! এ যে সেই গোমড়াবুড়ো! ওকে দেখে দাঁড়িগোফের ফাঁকে মিষ্টি হাসল বুড়ো, এমন হাসি ওর মুখে কোনদিন দেখে নি বুবাই, বুড়ো তারপরে একটু মাথা ঝাঁকাল, বুবাইকে ইশারা করল হাত নেড়ে বাড়ি ফিরে যাবার জন্য।
এবার সম্বিত ফিরল বুবাইয়ের। আরে, সে তো দরজা খোলা রেখেই চলে এসেছে! এক ছুটে বাড়ি ঢুকে দরজা আটকে শুয়ে পড়ল বুবাই জ্যাকেট-জুতো ছেড়ে, তারপরেই ওর মন জুড়ে শান্তি ওকে ঘুম পাড়িয়ে দিল।
খুব ভোরে ঘুম ভাঙতে বুবাই ঝোলানো মোজার দিকে তাকাল। ওর চোখে পড়লো মেঝেতে পরে থাকা অন্য একটা লাল মোজা। লাল মোজাটা তুলে হাত ঢুকিয়ে দেখলো বুবাই এতে যে ওর তিনটে হারিয়ে যাওয়া বল! সাথে সাথে ওর চোখে পড়লো জানলার কাঁচ কিছুটা ভাঙা।
বুবাই এখন খুব খুশি। সান্তা শুধু ওকে বল ফেরত দেয় নি, কাঁচ ভাঙার সাজাও দিয়েছে। হাল্কা মনে ও চিৎকার করে বাবাকে ডাকল, "বাবা, তুমি এবার হেরে গিয়েছ, নতুন সান্তা এসে তোমায় হারিয়ে দিয়েছে।"
গল্প লিখেছেঃ বিতান মজুমদার, নবম শ্রেণি, রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যাপীঠ, পুরুলিয়া।
ছবিঃ রাখি পুরকায়স্থ