পৃথিবীর পরিবেশ ও প্রকৃতির অন্যতম অপরিহার্য সদস্য গাছেরা। আমাদের গ্রহের বাস্তুতন্ত্রের গঠন ও প্রাণের বর্তমান বিন্যাস রচনায় তাদের অবদান অপরিসীম। বিশেষত মানবজাতির বিবর্তন এবং মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতির উন্নয়নে গাছেদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। আনুমানিক ৪৫০ মিলিয়ন বছর আগে, অর্ডোভিশিয়ান (Ordovician) যুগে, স্থলভূমিতে উদ্ভিজ্জ প্রাণের আবির্ভাব ঘটে বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা। ২০০৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক রাজ্যে ওয়াটিজা (Wattieza) নামে এক প্রাগৈতিহাসিক ফার্ন জাতীয় উদ্ভিদের জীবাশ্ম পাওয়া যায়। প্রায় ৩৮৫ মিলিয়ন বছরের পুরনো, মধ্য ডিভোনিয়ান যুগের, এই জীবাশ্মের ওপর পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়ে বিজ্ঞানীরা সিদ্ধান্তে এসেছেন, সম্ভবত ওয়াটিজা বিশ্বের প্রাচীনতম বৃক্ষ। ওয়াটিজার জীবাশ্ম আবিষ্কারের পূর্ব পর্যন্ত, উচ্চতর ডিভোনিয়ান (Devonian) যুগ থেকে নিম্ন কার্বনিফেরাস (Carboniferous) যুগ পর্যন্ত সময়কালের (৩৮৩ থেকে ৩২৩ মিলিয়ন বছর আগের) ফার্ন জাতীয় উদ্ভিদ আর্কিওপ্টেরিস (Archaeopteris)- কেই বিজ্ঞানীরা বিশ্বের প্রাচীনতম বৃক্ষ বলে মনে করতেন।
'বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি।'
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জন্মদিনে কাব্যগ্রন্থ
২০১৫ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী পৃথিবীর বুকে পরিণত গাছের সংখ্যা ৩.০৪ ট্রিলিয়ন, যার মধ্যে ১.৩৯ ট্রিলিয়ন (৪৬%) গ্রীষ্মমন্ডলীয় বা প্রায় গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলে, ০.৬১ ট্রিলিয়ন (২০%) নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে এবং ০.৭৪ ট্রিলিয়ন (২৪%) উত্তরাঞ্চলীয় সরলবর্গীয় বনভূমিতে রয়েছে। এদের মধ্যে আবার প্রায় ৬০ হাজার থেকে ১ লক্ষ ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির দেখা মেলে। গাছেদের মধ্যে তাই বৈচিত্রের অভাব নেই। তবে দুঃখের বিষয়, আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সাথে গাছেরা এতটাই আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রয়েছে যে আমরা গাছেদের সাধারণ মনে করে উপেক্ষা করি। তদের রূপ-বৈচিত্র তেমন ভাবে আমাদের নজরে পড়ে না। কিন্তু আমাদের চারিপাশের চেনা গাছের দুনিয়া ছাড়িয়ে, বিশ্বের নানান অচেনা প্রান্তে এমন কয়েকটি ব্যতিক্রমী বৈশিষ্টযুক্ত গাছের অস্তিত্বের সন্ধান মিলেছে, যাদের সামনা-সামনি দেখলেও সত্যি বলে বিশ্বাস হতে চায় না। তারা আর সকলের চাইতে একেবারেই আলাদা। সেই বিস্ময়কর গাছেদের উপেক্ষা করা আমাদের পক্ষে অসম্ভব! এমন অচেনা বৃক্ষগুলির মধ্যে কেউ দীর্ঘজীবি, আবার কেউ ভয়ঙ্কর প্রতিকূল পরিস্থিতিতে দিব্যি বেঁচে আছে, কারো বা শরীরে রয়েছে আজব রংয়ের খেলা, কেউ আবার দেখতে এতটাই অদ্ভুত যে পিলে চমকে যাবার যোগাড়। চলো, তেমনই কয়েকটি অদ্ভুত দর্শন ও অবিশ্বাস্য গাছের সাথে আমরা পরিচিত হই।
জীবন বৃক্ষ ( Tree of Life)
মধ্যপ্রাচ্যের দ্বীপরাষ্ট্র বাহরাইনের ঊষর মরুভূমিতে প্রায় ৪০০ বছর ধরে একলা দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি চিরহরিৎ বৃক্ষ – নাম তার জীবন বৃক্ষ বা ট্রি অব্ লাইফ। বৈজ্ঞানিক নাম Prosopis cineraria হলেও, স্থানীয় আরবি ভাষায় গাছটি শাজারাৎ-আল-হায়াৎ (Shajarat-al-Hayat) নামেই বিশেষভাবে পরিচিত। বাহরাইনের সর্বোচ্চ পাহাড় জবল আদ-দুখান (Jabal ad-Dukhan) থেকে ২ কিলোমিটার দূরে ধু-ধু বালুকা তরঙ্গ দ্বারা পরিবৃত হয়ে একটি নাতি-উচ্চ বালির পাহাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে আছে সেই বিচিত্র গাছ। প্রকৃতপক্ষে এই সুবিশাল, শুষ্ক আরব মরুভূমিতে জীবনের দেখা মেলা দুষ্কর। সেই অঞ্চলে তাই এই গাছখানিকে বাদ দিলে যতদূর চোখ যায় অন্য কোন গাছের চিহ্ন মেলে না। এই অঞ্চলের গড় তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা প্রায়শই ৪৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস ছুঁয়ে যায়। মাঝে মধ্যেই উত্তাল বালির ঝড়ে তোলপাড় হয় এই মরু অঞ্চল। এখানে সারা বছর এক ফোঁটা বৃ্ষ্টিপাত না হওয়াটাও একেবারেই আশ্চর্যের কথা নয়। তবুও কি এক আশ্চর্য উপায়ে প্রায় ৩২ ফুট উচ্চতার এই গাছটি ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা, মিষ্টি জলের অভাব, এবং তীব্র অপুষ্টি সত্ত্বেও ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। এমন চূড়ান্ত প্রতিকূল আবহাওয়ার সাথে লড়াই করে গাছটির সুস্থ স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার রহস্য ভেদ করতে আজ পর্যন্ত কেউ পারেনি। বিজ্ঞানীদের ধারণা, প্রায় দুই মাইল দূর দিয়ে বহমান একটি ভূগর্ভস্থ জলধারা গাছটির সবচেয়ে নিকটবর্তী সম্ভাব্য জলের উৎস এবং গাছটির অতি গভীর ও বিস্তৃত মূলতন্ত্র দ্বারা সেই ভৌম জলস্রোত থেকে খাদ্যরস আহরণ করা সম্ভবপর হয়। অনেকে অবশ্য বলেন, গাছটি খুব সম্ভবত পারস্য উপসাগর থেকে বয়ে আসা বায়ু কিংবা মরুভূমির বালির দানা থেকে আর্দ্রতা নিষ্কাশন করতে শিখেছে। স্থানীয় অধিবাসীদের আন্তরিক বিশ্বাস, পৌরাণিক ব্যাবিলনীয় জলের দেবতা এনকির আশীর্বাদে গাছটি দীর্ঘ জীবন লাভ করেছে। আবার অনেকেই দাবি করেন, গাছটি যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে, তা আসলে বাইবেলে বর্ণিত ইডেন বাগানের প্রকৃত অবস্থান, আর সে কারণেই গাছটির জলের উৎস আজও রহস্যে ঘেরা। রুক্ষ অনুর্বর মরুভূমির মাঝে সবুজ পাতায় ঢাকা এই গাছ প্রকৃতির অপ্রতিরোধ্য শক্তি ও জীবনের জাদুকরী ক্ষমতার প্রতীক, তাই তো গাছটি ‘জীবন বৃক্ষ’ নামে সমগ্র বিশ্বে পরিচিতি লাভ করেছে।
ড্রাগন ব্লাড গাছ ( Dragon Blood Tree)
ইয়েমেন দেশের অন্তর্ভুক্ত সকট্রা দ্বীপপুঞ্জে (Socotra archipelago) এমন একটি অসাধারণ বৈশিষ্টপূর্ণ উদ্ভিদ রয়েছে যা উদ্ভিদবিজ্ঞানী থেকে সাধারণ প্রকৃ্তিপ্রেমী মানুষ, সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। গাছটির নাম ‘ড্রাগন ব্লাড ট্রি’। গাছটির গুঁড়ি কাটলে রক্ত-লাল রস ক্ষরিত হয়, তাই গাছটির এমন নামকরণ করা হয়েছে। মনে করা হয়, ‘ড্রাগন ব্লাড ট্রি’ একটি অতি প্রাচীন উদ্ভিদ যা টারশিয়ারী (Tertiary) যুগে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল, উত্তর আফ্রিকা এবং আরব দেশে বহুবিস্তৃত ছিল। বর্তমানে সকট্রায় তারই শেষ চিহ্ন বিদ্যমান। ১৮৩৫ সালে লেফটেন্যান্ট ওয়েলস্ট্যাডের নেতৃত্বে ইষ্ট ইন্ডিয়া কম্পানী সকট্রায় একটি সমীক্ষা চালায়। সেইসময় প্রথম এই গাছটি সম্পর্কে জানা যায়। তখন এর বৈজ্ঞানিক নাম দেওয়া হয় Pterocarpus draco। ১৮৮০ সালে স্কটিস উদ্ভিদবিজ্ঞানী আইজ্যাক বেইলি বেলফোর গাছটির নতুন নামকরণ করেন Dracaena Cinnabari। অদ্ভুত দর্শন এই গাছটি পরিণত অবস্থায় খোলা ছাতার আকৃ্তি ধারণ করে। আসলে অভিযোজন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সকট্রার ঊষর মরু অঞ্চলীয় আবহাওয়াতে মানিয়ে নেবার তীব্র প্রচেষ্টার ফলে গাছটি এই অদ্ভূত আকৃ্তি পেয়েছে। গাছটির ‘ছাতা’ আকৃ্তি সহজেই ছায়া প্রদান করে, যা বাষ্পীভবন প্রক্রিয়ায় বাঁধা দেয় এবং নিকটবর্তী চারা গাছগুলিকে বৃ্দ্ধি পেতে সাহায্য করে। অতি মন্থরগতিতে বৃদ্ধি পেলেও গাছগুলি কিন্তু দীর্ঘজীবী। বিজ্ঞানীদের গবেষণা থেকে জানা গেছে, গাছগুলির আয়ু সম্ভবত কয়েকশ বছর। সকট্রায় অবস্থিত চুনাপাথরের মালভূমি রোকেব ডি ফিরমিহিনে (Rokeb di Firmihin) এই গাছের এক ঘন অরণ্যের সন্ধান মেলে। এই অরণ্য অঞ্চলেই এ প্রজাতির গাছগুলি সর্বশ্রেষ্ঠরূপে সংরক্ষীত রয়েছে বলে মনে করা হয়।
রামধনু ইউক্যালিপ্টাস গাছ (Rainbow Eucalyptus Tree)
পাপুয়া নিউ গিনির বৃহত্তম দ্বীপ নিউ ব্রিটেন, ইন্দোনেশিয়ার নিউ গিনি, সিরাম ও সুলভাইসি দ্বীপ এবং ফিলিপিন্সের মিন্দানাও দ্বীপে প্রকৃতিগতভাবে জন্মায় একটি বিশেষ প্রজাতির সুউচ্চ রঙবাহারি গাছ। সেই দ্বীপ দেশে প্রকৃতির মোহময়ী জাদুতে আকাশের ইন্দ্রধনুর সাতটি রঙ যেন পৃথিবীতে নেমে এসে সেই গাছগুলির দেহ আবৃত করে রাখে। গাছগুলির কান্ডে এমন রকমারি উজ্জ্বল বর্ণের সমারোহ রীতিমতো চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। গাছটি সাধারণভাবে রেইনবো ইউক্যালিপ্টাস বা মিন্দানাও গাম নামে জনপ্রিয়, তবে উদ্ভিদবিজ্ঞানের বই পড়ে জানা যায়, গাছটির বৈজ্ঞানিক নাম Eucalyptus deglupta। প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় এমন গ্রীষ্মমন্ডলীয় বনগুলি এই গাছগুলির বেড়ে উঠবার পক্ষে আদর্শ। স্বাভাবিক প্রাকৃতিক পরিবেশে গাছগুলিকে প্রায় ২ মিটার (৬ ফুট) চওড়া এবং ৬০ মিটার (২০০ ফুট) পর্যন্ত লম্বা হতে দেখা যায়। এটিই ইউক্যালিপ্টাস গোত্রীয় গাছের একমাত্র প্রজাতি যার প্রাকৃতিক পরিসীমা উত্তর গোলার্ধ পর্যন্ত বিস্তৃত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ এবং ক্যালিফোর্নিয়া, টেক্সাস ও ফ্লোরিডার দক্ষিণাঞ্চলে তুষারপাত মুক্ত আবহাওয়ায় রামধনু ইউক্যালিপ্টাসের খোঁজ মেলে। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপমহাদেশীয় অঞ্চলে গাছটি কেবলমাত্র ১০০ থেকে ১২৫ ফুট পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। বিবিধ রঙে রাঙ্গানো কান্ডের কারণেই গাছটি অন্যান্য উদ্ভিদের সাথে স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে চলেছে। দেখে মনে হয় যেন কোন খেয়ালি শিল্পী রঙ করে দিয়েছে গাছের কান্ডে। আসলে কিন্তু এই রঙের ছড়াছড়ির জন্য দায়ী গাছটির বাকল। গাছটির বাইরের ছাল ছোট ছোট লম্বা টুকরো হয়ে বছরের বিভিন্ন সময়ে ঝরে গেলে নজরে পড়ে বাকলের নীচের উজ্জ্বল সবুজ রঙ। এটি তারপর সময়ের সাথে আরও গাঢ় হয়ে ক্রমশ নীল, বেগুনী, কমলা ও শেষমেশ মেরুন বর্ণ ধারণ করে। নতুন ঋতুর আবির্ভাবে এই একই পদ্ধতিতে পুরনো বাকল নানান লম্বা টুকরো হয়ে ঝরে যায়। আবারও রঙের খেলা দেখাবার জন্য প্রস্তুত হয় নীচের কাঁচা সবুজ বাকল। বাকল পরিবর্তনের এই প্রক্রিয়ায় আবারও গাছের কান্ডে দেখা দেয় লাল, কমলা, নীল, সবুজ ও ধূসর রঙের মেলা। বৈচিত্রময় প্রকৃতি যে কত বিচিত্র রঙের সম্ভার নিয়ে মানুষের মন রাঙাতে প্রস্তুত তা এই গাছটিকে দেখলে স্পষ্টতই বোঝা যায়।
সিল্ক কটন গাছ (Silk Cotton Tree)
কম্বোডিয়ার সিয়েম রিপ (Siem Reap) প্রদেশের অন্তর্গত প্রাচীন অ্যাংকর নগরীর বিখ্যাত স্থাপত্যগুলির মধ্যে অন্যতম তা প্রোম (Ta Prohm) মন্দির। দ্বাদশ শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত কম্বোডিয়ার খেমার (Khmer) সাম্রাজ্যের শেষ রাজধানী অ্যাংকর থম (Angkor Thom) থেকে এক কিলোমিটার পূর্বে অবস্থান করছে মন্দিরটি। আনুমানিক দ্বাদশ শতাব্দীর শেষ থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর সূচনা পর্যন্ত বিস্তৃত সময়কালে খেমার রাজা সপ্তম জয়ভর্মণ মহাযান বৌদ্ধ মঠ ও বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেই আমলে মন্দিরটির নাম রাজাভিহার হলেও, বর্তমানে মন্দিরটি ‘জাঙ্গল টেম্পল’ নামেই বেশি পরিচিত। কয়েক শ বছর ধরে এই মন্দির তো বটেই, পুরো শহরটাই জঙ্গলের অন্তরালে ঢাকা পড়ে ছিল। আর সেই সুযোগে তা প্রোম মন্দিরকে অক্টোপাসের মত আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে বেড়ে উঠেছে এক বিশাল গাছ। তা প্রোম মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে থেকে উঠে আসা সেই বিখ্যাত গাছটির বৈজ্ঞানিক নাম ‘Tetrameles nudiflora’। তবে বিশ্বের মানুষের কাছে গাছটি ‘সিল্ক কটন ট্রি’ নামেই অধিক পরিচিত। প্রায় ৭০ ফুট উচ্চতার এই উর্ধকায় গাছটির রেশমের মত চকচকে সুপুষ্ট শিকড়গুলি মন্দিরের ঢালু বেয়ে মন্দির প্রাঙ্গণে প্রায় ৩৫ ফুট এলাকা জুড়ে পরিব্যাপ্ত রয়েছে। গাছটির প্রকান্ড মোটা শিকড়গুলো মন্দিরটিকে এমনভাবে জড়িয়ে রেখেছে যে দেখে মনে হয় কোন এক বিশাল পৌরাণিক সরীসৃপ মন্দিরটিকে গিলে খাচ্ছে। বর্তমানে প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দির প্রাঙ্গণে এই অদ্ভুত আকৃতির গাছটি যেন বহু প্রাচীন ইতিহাসের এক নীরব সাক্ষী।
ট্যুলের গাছ (The Tree of Tule)
মেক্সিকোর ওয়াহাকা রাজ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক অঞ্চল মিটলা যাবার পথে, রাজধানী শহর ওয়াহাকা থেকে প্রায় ৯ কিলোমিটার পূর্বে, সান্তা মারিয়া দেল ট্যুলে (Santa María del Tule) শহরের এক গির্জার ময়দানে দাঁড়িয়ে আছে একটি স্থূলকায় বৃক্ষ। গাছটির বৈজ্ঞানিক নাম Taxodium mucronatum। স্থানীয় নাওয়াটল (Nahuatl) ভাষায় গাছটির আরেক নাম Ahuehuete, যার আক্ষরিক অর্থ ‘জলের মধ্যে খাড়া ঢাক’ কিংবা ‘জলের বৃদ্ধ মানুষ’। তবে গাছটি কিন্তু ‘ট্যুলের গাছ’ বা ‘দ্য ট্রি অব্ ট্যুলে’ নামেই বিশ্বে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। ২০০৫ সালে বৃক্ষটির কান্ডের পরিধি ছিল ৪২ মিটার (১৩৭.৮ ফুট), এবং ব্যসের মাপ ছিল ১৪.০৫ মিটার (৪৬.১ ফুট)! স্বভাবতই বিশ্বের সকল গাছের মধ্যে সবচেয়ে স্থূলকায় কান্ডের অধিকারী এই গাছটি। তবে গাছটির প্রকৃত বয়স জানা যায় না। অনেকের অনুমান গাছটি সম্ভবত ১২০০ থেকে ৩০০০ বছরের পুরনো, তবে তার বেশী নয়। আরেক দল অবশ্য দাবি করেন, গাছটির বয়স প্রায় ৬০০০ বছর। বৃদ্ধির হারের উপর ভিত্তি করে গাছটির বয়স সম্পর্কে বৈজ্ঞানিকদের অনুমান, গাছটির বয়স ১৪৩৩ থেকে ১৬০০ বছর। স্থানীয় জাপোটেক কিংবদন্তি অনুসারে, আজারেক বায়ু দেবতা এহেকাতলের (Ehecatl) উপাসক ছিলেন পেকোচা (Pecocha) নামে এক ব্যক্তি। তিনি প্রায় ১৪০০ বছর পূর্বে গাছটি রোপন করেছিলেন। গাছটির বয়স সম্পর্কে স্থানীয় কিংবদন্তির সাথে বৈজ্ঞানিক অনুমান আশ্চর্যভাবে মোটামুটি মিলে যায়। গাছটির কান্ড এতটাই প্রশস্ত যে এক আমলে মনে করা হত, এটি মূলত একাধিক গাছের সমষ্টি, কিন্তু পরবর্তীকালে DNA পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে, এটি কেবলমাত্র একটি গাছ। তবে কয়েকজন বিজ্ঞানী অবশ্য দাবি করেছেন, এটি আসলে একক গাছ থেকে গঠিত একাধিক কান্ডের সমষ্টি। সবচেয়ে মজাদার বিষয়, গাছটির এবড়ো-খেবড়ো সুবিশাল গুঁড়িতে জাগুয়ার, হাতি প্রভৃতি বিভিন্ন প্রকার পশুদের চিত্র স্পষ্টরূপে দৃশ্যমান।
রকমারি আজব গাছেদের তালিকা কিন্তু এখানেই শেষ হবার নয়। সেই তালিকায় অস্ট্রেলিয়ার ওলেমি পাইন গাছ (Wollemi Pines), মাদাগাস্কারের বাওবাব গাছ (Baobab Trees), স্পেনের এল আরবল ডি লা সাবিনা বা সাবিনা বৃক্ষ (El Arbol de la Sabina), পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার বোয়াব প্রিজন গাছ (Boab Prison Tree), স্কটল্যান্ডের ফর্টিংগেল ইউ গাছ (Fortingall Yew Tree), জাপানের প্রায় ১৪৪ বছর বয়সী উইস্টেরিয়া গাছ (Wisteria Tree), যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যের জেনারেল শেরম্যান গাছ (General Sherman Tree), নিউজিল্যান্ডের সাউথ আইল্যান্ডের উইন্ডসয়েপ্ট গাছ (Windswept tree), যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ ক্যারোলিনা রাজ্যের জোন্স আইল্যান্ডের প্রায় ৪০০ বছরের পুরনো এঞ্জেল ওক গাছ (Angle Oak Tree) প্রভৃতি বিচিত্র সুন্দর গাছগুলির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
জাপানের প্রায় ১৪৪ বছর বয়সী উইস্টেরিয়া গাছ
‘জানার মাঝে অজানারে করেছি সন্ধান,
বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান।’
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রকৃতি পর্যায়, গীতবিতান
বিশ্ব প্রকৃতি বিস্ময়ে পরিপূর্ণ। এই অদ্ভুত দর্শন ও ব্যতিক্রমী গাছগুলি তারই আশ্চর্য দৃষ্টান্ত। তবে আমাদের সকলেরই বোঝা উচিৎ, চেনা হোক কি অচেনা, দেখতে সুন্দর হোক কি ভয়ঙ্কর, সকল গাছেরাই আমাদের পরম বন্ধু। গাছ আমাদের নীল গ্রহকে সবুজ করেছে। গাছপালা একদিকে যেমন নিসর্গের শোভা বৃদ্ধি করে, অন্যদিকে তারা প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করে। গাছপালা বৃষ্টিকে ডেকে আনে। সবুজ পাতায় সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়ায় খাদ্য তৈরীর সময় গাছ বাতাস থেকে কার্বন-ডাই অক্সাইড নামক বিষাক্ত গ্যাস শোষণ করে বাতাসে অক্সিজেন গ্যাস যোগান দেয়। সেই জীবনদায়ী গ্যাস গ্রহণ করে আমরা বেঁচে থাকি। তাই গাছপালা না থাকলে পরিবেশ হয়ে উঠত উষ্ণ। পৃথিবী প্রাণরস বিহীন মরুভূমিতে রূপান্তরিত হত। মানুষের অস্তিত্ব হত বিপন্ন। আবার এই গাছেদের কেন্দ্র করেই পৃথিবীর বুকে বেড়ে উঠেছে বিপুল প্রাণী সম্পদ। এক্ষেত্রে গ্রীষ্মমন্ডলীয় বৃষ্টি বনগুলির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। যদিও বর্তমানে বৃষ্টি বনগুলি ভূ-পৃষ্ঠের ৬ শতাংশেরও কম অংশ জুড়ে বিস্তৃত রয়েছে, তবু আমাদের গ্রহের অর্ধেকেরও বেশি জীব প্রজাতির স্থায়ী ঠিকানা কিন্তু সেখানেই। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায়, মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীকুলের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরিতে গাছেদের কোন তুলনা নেই।
ভারতের শিবপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনের সুপ্রাচীন বটগাছ
“দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর।
লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর
হে নবসভ্যতা!”
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সভ্যতার প্রতি, চৈতালী কাব্যগ্রন্থ
১৯৯০ সালের ১১ জুলাই ক্যালিফোর্নিয়ার অক্সনার্ড থেকে প্রকাশিত The Press Courier পত্রিকায় একটি বিশেষ প্রতিবেদন অনেকেরই চোখে পড়েছিল। মেক্সিকোর সান্তা মারিয়া দেল ট্যুলে শহরের সেই বিখ্যাত ‘দ্য ট্রি অব্ ট্যুলে’ এখন মৃত্যু পথযাত্রী! সেই প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, রোজকার জল সংকট, দূষণ এবং অত্যধিক যান চলাচলের ফলে ট্যুলের গাছটির শিকড়গুলি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। জানা গেছে, গাছটির কাছাকাছি একটি প্রধান সড়ক দিয়ে রোজ প্রায় ৮ হাজার গাড়ি চলাচল করে। মার্কিন প্রত্নতত্ত্ববিদ জোহান প্যাডকের মতে, এ ব্যাপারে জরুরী ভিত্তিতে ব্যবস্থা না নেওয়া হলে গাছটির আয়ু ৫০ বছরের বেশি নয়! এই প্রতিবেদনটি কি আমাদের একটুও ভাবায় না? নগর সভ্যতার ক্রমাগত বিস্তারের কুফলে একে একে এভাবেই কি হারিয়ে যাবে আমাদের বৈচিত্রময় উদ্ভিদ জগৎ? পৃথিবী ক্রমশ ধ্বংসের মুখে এগিয়ে যাবার এ যেন এক অশনি সঙ্কেত!
গাছেদের কাছে আমরা চির ঋণী। তবে দুঃখের কথা, সে ঋণ আমরা হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে ব্যর্থ হয়েছি। পৃথিবীতে বনভূমির অস্তিত্ব ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। সমীক্ষায় জানা গেছে, প্রতি বছর প্রায় ১৫ বিলিয়ন গাছ কাটা হয়, কিন্তু গাছ লাগানো হয় কেবলমাত্র ৫ বিলিয়ন। কৃষিভিত্তিক সমাজ গঠনের সূচনা থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় ১২ হাজার বছর ধরে বিশ্বব্যাপী গাছেদের সংখ্যা প্রায় ৪৬% হ্রাস পেয়েছে।
নিউজিল্যান্ডের সাউথ আইল্যান্ডের উইন্ডসয়েপ্ট গাছ
প্রতি দিন মানুষ পৃথিবীর বুকে চালিয়ে যাচ্ছে নির্মম গাছ নিধন যজ্ঞ। এভাবে চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে পৃথিবীর বৈচিত্রময় জৈব প্রজাতির বৃহদাংশকে মানুষ ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেবে, ক্রমশ পৃথিবীর পরিবেশ হয়ে উঠবে প্রাণ ধারণের পক্ষে অনুপোযুক্ত, এবং অচিরেই এমন দিন আসবে যে দিন মানুষের চিহ্ন চিরতরে মুছে যাবে এই গ্রহের বুক থেকে। এখনও সব শেষ হয়ে যায় নি, এখনও সময় আছে। তাই বিশ্ব পরিবেশ বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তোলা একান্ত প্রয়োজন। নগরায়ন ও শিল্পায়নের নামে ইচ্ছেমতো গাছ কাটা ও বন উজাড় করা অবিলম্বে বন্ধ করা জরুরী। সর্বত্র গাছ লাগানোর উদ্যোগ বাস্তবায়ন হওয়া দরকার। তবে পরিবেশের উন্নয়ন মানব জাতির সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া কোনভাবেই সম্ভব নয়। চলো, আমরা চারপাশে প্রচুর গাছ লাগাই, সকলে মিলে আমাদের বৈচিত্রময় জীব জগতকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসি এবং সর্বোপরি আমাদের গ্রহকে পুনরায় সবুজ করে তুলবার প্রক্রিয়ায় সামিল হই। তবেই আমরা পাবো একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ ও স্বাস্থ্যজ্জ্বল বসুন্ধরা।
‘এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমি-
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’
– সুকান্ত ভট্টাচার্য, ছাড়পত্র কাব্যগ্রন্থ
ছবিঃ
উইকিপিডিয়া /উইকিমিডিয়া কমন্স্
ইমেজার
অ্যামিউজিংপ্ল্যানেট