সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
ষাঁড়ের বাড়ি

শীত পড়তে আর বেশী দেরী নেই। একটি ষাঁড় একদিন খবর পেল, এবার ভীষণ শীত আসবে তাদের সবুজ রঙা বনে। সাদা বরফের চাদরে ঢেকে যাবে বনভূমি। ষাঁড় খুব চিন্তায় পড়লো। এবারকার শীতের প্রকোপ থেকে তাকে যে বাঁচতেই হবে। ষাঁড় তাই মনস্থির করলো, সে একটি বাড়ি বানাবে। যেমনটি ভাবা ঠিক তেমনটি কাজ। বাড়ি বানাবার সরঞ্জাম যোগার করতে সে তড়িঘড়ি রওয়ানা দিল গভীর জঙ্গল অভিমুখে।

পথে দেখা হল ভেড়ার সাথে। সে ভেড়াকে বলল, "প্রিয় ভাই ভেড়া, দয়া করে আমাকে একটি বাড়ি বানাতে সাহায্য করো। হাড়হিম করা শীতে আমি তোমাকে আমার বাড়িতে থাকতে দেবো। কথা দিচ্ছি"।

"না, আমার কোন বাড়ির প্রয়োজন নেই। আমার ঘন লোমের আবরণ কি দেখতে পাচ্ছো না তুমি? যত ঠান্ডাই পরুক না কেন এবার, আমার কোন ক্ষতি হবার সম্ভাবনা নেই।", অবজ্ঞা ভরে বলে উঠলো ভেড়াটি।

ষাঁড় আর কী করে! সে আবার জঙ্গলের পথ ধরে এগিয়ে চলল। কিছু দূরের পথ পেরিয়ে দেখা হল রাজহাঁসের সাথে। সে রাজহাঁসকে বলল, "প্রিয় বোন রাজহাঁস, আমি একটি বাড়ি বানাবো, তাই সরঞ্জাম যোগার করতে জঙ্গলে চলেছি। আমাকে বাড়ি বানাতে সাহায্য করতে আমার সাথে কি জঙ্গলে যাবে? এবার খুব শীত পড়বে কিন্তু"।

রাজহাঁস হিসহিস করে বলল, "কাজ করতে আমার বয়েই গেছে। এসব কাজ করলে আমার নখ নষ্ট হবে না বুঝি? তাছাড়া, তোমার বাড়ি আমার কোন কাজে আসবে? আমার তো সুন্দর মসৃণ পালক আছে। শীত আমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। বুঝেছো?" এই বলে রাজহাঁস মুখ ফিরিয়ে নিল।

ষাঁড় আবার এগিয়ে চললো জঙ্গলের পথে। এবার মোরগের দেখা মিলল। সে মোরগকে বলল, "প্রিয় মোরগ ভাই, চল না একটু জঙ্গলে আমার সাথে। আমাকে একটা বাড়ি বানাতে সাহায্য করো দয়া করে। এবার প্রচন্ড শীত পড়বে। আমার বাড়িতে তখন তোমায় জায়গা দেবো"।

মোরগ তার মোরগ ঝুঁটিখানা উপরে তুলে যথেষ্ঠ প্রত্যয়ের সঙ্গে বলল, "দেখো ভাই, আমার পরিশ্রম করবার একেবারেই অভ্যেস নেই। তাছাড়া আমি ভাল করেই জানি, শীতকালে আমার মালিক আমাকে উনুনের পাশে উষ্ণ জায়গাতে থাকতে দেবেন। এবারের শীতের দিনগুলিতে তাই ঠান্ডায় কষ্ট পাবার কোন আশঙ্কাই নেই আমার"।

অগত্যা মোরগকে পেছনে ফেলে ষাঁড় আবার এগিয়ে চলল। কিছু পথ গিয়ে ষাঁড়ের দেখা হল পায়রার সাথে। সে পায়রাকে বলল, "প্রিয় বোন পায়রা, একটা বাড়ি বানাবো আমি। আমার সাথে জঙ্গলে গিয়ে সরঞ্জাম যোগার করতে একটু সাহায্য করবে? এবার শীতে আমার বাড়িটিতে তোমায় থাকতে দেব"।

পায়রা মুখ ভেঙচিয়ে বলল, "ইস্, আমি কেন অকারণে পরিশ্রম করতে যাব? শীতের সময় আমার মালিক ওনার বাড়িতে আমাকে ঠিক থাকতে দেবেন"।

এই কথা শুনে ষাঁড় কিছু না বলে আবার জঙ্গলের দিকে যাত্রা করলো। মনে বড় দুঃখ পেল সে। তাকে সাহায্য করতে কেউ আর এগিয়ে এল না। সব দুঃখ, অভিমান মনে চেপে রেখে সে একা-একা জঙ্গলে গেল এবং বাড়ি বানাবার সব সরঞ্জাম সংগ্রহ করল। অবশেষে অনেক পরিশ্রমের ফলে সে একটি ছোট্ট সুন্দর বাড়ি গড়ে তুলতে সক্ষম হল।

একদিন গাছের সব পাতা ঝরিয়ে শীত এল। সঙ্গে নিয়ে এল হিম শীতল বাতাস। চারিপাশ ঢেকে গেল সাদা তুষার চাদরে। এদিকে ষাঁড় তো মহা খুশী। গতবারের শীতের মত এবার আর তার পিঠে তুষার কুচি ঝরে পড়বে না। নিশ্চিন্ত মনে ঘরের জানালার পাশে বসে সে মনে মনে বলল, "ইসি্! কী হাড়হিম করা শীত পড়েছে এবার! অক্লান্ত পরিশ্রম করে একা-একা বাড়িটি বানিয়েছি একথা সত্যি, কিন্তু ভেবে আনন্দ হচ্ছে শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচবার জন্য এখন আমার একটি শান্তির আশ্রয় আছে"।

হঠাৎ জানালার বাইরে চোখ পড়তেই সে দেখতে পেল, ভেড়া ব্যস্তসমস্ত হয়ে তার বাড়িটির দিকে ধেয়ে আসছে। বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে ভেড়া করুণ কন্ঠে বলে উঠলো, "ভাই ষাঁড়, তোমার বাড়িতে আমায় একটু থাকতে দেবে? দেখো, আমার ঘন সাদা লোম আর নেই! আমার কর্ত্রী সব লোম ছেঁটে ফেলেছেন। এখন আমি ঠান্ডায় জমে যাচ্ছি"।

"না ভাই ভেড়া, এখন আর তা সম্ভব নয়", ষাঁড় উত্তর দিল। "যখন বাড়ি বানাবার জন্য সাহায্য চেয়েছিলাম, তুমি সাহায্য করতে রাজি ছিলে না। তুমি তখন বলেছিলে ঠান্ডাকে তুমি পরোয়াই করো না"।
এ কথা শুনে ভেড়া ভীষণ ক্ষেপে উঠলো। "তুমি কি চাও আমি শিং দিয়ে তোমার বাড়িটা ধ্বংস করে দিই?", ভেড়া চিৎকার করে বলল।
ভেড়ার হুমকি শুনে ষাঁড় খুব ভয় পেল। বাধ্য হয়ে সে ভেড়াকে বাড়িতে থাকতে দিল।

ষাঁড়ের বাড়ি

পরের দিন সে অবাক হয়ে দেখলো, রাজহাঁস ডানা ঝাপটাতে-ঝাপটাতে তার বাড়ির দিকে আসছে। বাড়ির দরজায় পৌঁছে রাজহাঁস তার ঠোঁট দিয়ে দরজায় ঠকঠক শব্দ করল। "প্রিয় ভাই ষাঁড়, আমাকে দয়া করে তোমার বাড়িতে সামান্য জায়গা দেবে? দেখো, মাল্‌কিন আমার সব পালক তুলে ফেলেছেন আর এই ভীষণ ঠান্ডায় তিনি আমায় বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন", রাজহাঁস কাঁদতে-কাঁদতে বলে উঠলো।
"না বোন, এখন আর তা সম্ভব নয়", ষাঁড় উত্তর দিল। "বাড়ি বানাবার জন্য তোমার সাহায্য চেয়েছিলাম। তুমি সাহায্য করতে রাজি ছিলে না। তুমি তখন বলেছিলে ঠান্ডা তোমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না"।
রাজহাঁস গলা বাড়িয়ে তর্জন করে উঠলো, "তুমি কি চাও বাড়ির দেওয়ালের কাঠের ফাঁকে গুঁজে রাখা সব শৈবাল আর শেওলা আমি ঠোঁট দিয়ে টেনে তুলে ফেলি? মনে রেখো, আমি তা করলে কিন্তু বাড়ির ভেতর ঠান্ডায় তোমরা জমে বরফ হয়ে যাবে"।

রাজহাঁসের হুমকি শুনে ষাঁড় খুব ভয় পেয়ে গেল এবং অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকে বাড়িতে থাকতে দিতে বাধ্য হল।

কিছু সময় পর মোরগ তার পাখা ঝাপটাতে-ঝাপটাতে এসে উপস্থিত হল ষাঁড়ের বাড়ির দরজায়। জানালা দিয়ে ষাঁড় তাকে দেখতে পেয়ে ভাবলো, "দেখা যাক, আমাদের লাল ঝুঁটিধারী বন্ধু এখন কী সুরে গান গেয়ে ওঠেন!"
মোরগ তার নখ দিয়ে বাড়ির দরজায় টোকা মারলো এবং তারপর, খুব বিনীত কন্ঠে বললো, "বন্ধু ষাঁড়, আমাকে দয়া করে তোমার বাড়িতে একটু জায়গা দাও"।
ষাঁড় কিন্তু মোরগের ভাল কথায় একটুও পাত্তা দিল না। সে অবজ্ঞা ভরে বললো, "তুমিই তো একদিন বলেছিলে, শীতকালে মালিকের রান্নাঘরের চুলার পাশের উষ্ণ জায়গায় আরামে থাকবে। মনে পড়ে কি? এখন তবে আমার দরজায় এসেছো কেন হে ভাই?"
"প্রিয় ভাই ষাঁড়, ব্যাপারটা সত্যিই খুব দুঃখের! মাত্র একটি রাতের জন্য আমি চুলার পাশের উষ্ণ স্থানে আরামে ঘুমোবার সুযোগ পেয়েছিলাম"। মোরগের গলার স্বর কেঁপে উঠলো, "পরের রাতে যেই না আমি মাঝরাতে ডেকে উঠেছি, অমনি মালকিন আমাকে ঘাড়ে ধরে বাড়ির বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। আমার ডাক শুনে নাকি মালকিনের ছোট্ট মেয়েটির ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল"।
নির্বিকার মুখে ষাঁড় বললো, "না ভাই, তোমাকে বাড়িতে থাকতে দিতে পারবো না। বাড়ি বানাবার সময় তোমার কাছ থেকে কোন সাহায্য পাইনি"।

মোরগ রাগে ফুঁসে উঠলো। তার ঝুঁটিখানা টকটকে লাল বর্ণ ধারণ করলো। "আমি কিন্তু আমার ডানা দিয়ে তোমার বাড়ির সব কাঁচের জানালা ভেঙ্গে দেব। তারপর সবাই মিলে বাড়ির ভেতর ঠান্ডায় জমে যাবে। তুমি কি তা চাও?"
ষাঁড় তখন ভয় পেয়ে মোরগকেও বাড়িতে থাকতে দিল।

অল্প সময় পর ষাঁড় দেখতে পেল জানালার পাশের প্রশস্ত অংশে পায়রা এসে ঘাঁটি গেড়ে বসেছে। পায়রা তার ঠোঁটের সাহায্যে জানালার শার্সিতে টোকা দিল এবং বাড়িটিতে সামান্য জায়গা দেবার জন্য ষাঁড়কে অনুনয় বিনয় করতে লাগলো।
"বাড়ি বানাবার সময় কোথায় ছিলে তুমি?" ষাঁড় বেশ অনুযোগের সুরে বললো।
"আমি তখন উড়তে ব্যস্ত ছিলাম", পায়রা উত্তর দিল।
ষাঁড় বিরক্ত হয়ে বললো, "ভাল কথা। এখন আবার আকাশে ওড়ো গিয়ে"।
"আমার ডানা দু’টি জমে বরফ হয়ে গেছে। আমি আর উড়তে পারছি না। দয়া কর ষাঁড় ভাই, আমাকে তোমার বাড়িতে একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই দাও"।
ষাঁড় এবার স্পষ্ট করে জানিয়ে দিল, "না বোন, তোমাকে আমার বাড়িতে জায়গা দিতে পারবো না। ক্ষমা কর।"
পায়রা খুব রেগে গেল। "ঠিক আছে। তুমি কি চাও আমি আমার তীক্ষ্ণ নখ দিয়ে আঁচরিয়ে তোমার বাড়ির খড়ের চাল নষ্ট করে ফেলি?"
ষাঁড় আবার ভীষণ ভয় পেল। বাধ্য হয়ে সে পায়রাকে বাড়িতে থাকতে দিল।

ষাঁড়ের বাড়ি

সারা শীতকাল জুড়ে এভাবেই ষাঁড়ের বাড়িতে তারা সকলে জোর করে আস্তানা গেড়েছিল। তবে সত্যি কথা বলতে কী, এক ছাদের নীচে বেশ আনন্দেই কেটেছিল তাদের সেই দিনগুলি। যতদিন না রঙিন ফুলের বসন্তকাল এল, তারা কিন্তু ষাঁড়ের বাড়ি ছেড়ে এক চুলও নড়লো না।

(লিথুয়ানিয়ার উপকথা)
উৎসঃ
'The sky is falling- Lithuanian folk tales' বইয়ের 'The Ox’s House' 
লেখক- অজ্ঞাত

 

 

ছবিঃ মঞ্জিমা মল্লিক

পেশায় আইনের শিক্ষক। ছোট-বড় সকলের জন্য গল্প ও প্রবন্ধ লিখতে ভালবাসেন। পশ্চিমবঙ্গ ও আসাম থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে। অবসর সময় কাটান বই পড়ে, ছবি এঁকে ও সঙ্গীত চর্চা করে। এছাড়া বিভিন্ন দ্রষ্টব্য স্থানে ভ্রমণ এবং সেখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য ক্যামেরাবন্দি করতে উৎসাহী।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা