মাইসোর প্যালেসের চত্বরে ঢোকার একটি প্রধান দরজা আছে, যাকে বলে সিংহদ্বার। আসলে, প্যালেস চত্বর ঘিরে চারদিকে এক প্রশস্ত প্রাচীর। তার বাইরে নাকি এককালে পরিখা কাটা ছিল। এখন দেখি বাগান হয়ে গেছে সেখানে। আর চারদিকেই এমন সিংহদ্বার। একটি সিংহদ্বার যার সামনে থেকে প্যালেসের খুব সুন্দর একটা দৃশ্য ধরা যায়... সেটি দেখেই বোঝা যায় যে বিশেষ দিনে এই সিংহদ্বার খোলা হয়, যেমন রাজপরিবার বা বিশেষ অতিথি এলে। এ ছাড়া জুলুস বেরোলেও ওই গেট দিয়েই যাওয়া আসা করে। তবে পর্যটকদের প্রবেশ করার সিংহদ্বারটি আলাদা। হতেই হবে। কারণ সেই দিকে মেটাল ডিটেক্টার, নিরাপত্তারক্ষী, প্রবেশ এবং প্রস্থানের আলাদা ব্যবস্থা... এমন অনেক কিছু রয়েছে পর্যটকদের জন্য। এমনকী গাড়ি দাঁড় করানোর আলাদা কার পার্কিং ব্যবস্থাও। যাতে রাস্তায় যানজট না হয়। প্রতিদিন পর্যটকদের ভিড় হয়, কোনওদিন কম কোনওদিন বেশি। স্কুল পড়ুয়ারা বাসে করে আসে এক্সকার্শানে। এক্সকার্শান মানে জানো তো? এক্সকার্শান (excursion) একটি ইংরেজী শব্দ যার মানে হ'ল একটি ছোট্ট বেড়াতে যাওয়ার ব্যবস্থা, অল্পদিনের জন্য। স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য এমন বেড়াতে যাওয়ার ব্যবস্থা স্কুল থেকেই আয়োজন করে... এমন কোথাও নিয়ে যাওয়া হয় যেখানে এই বেড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই কিছু জানার অবকাশ থাকে। ছাত্রছাত্রীরা নানারকম মজার মাঝে অনেক কিছু শিখতে পারে, জানতে পারে। এমনকী কলেজেও এমন শিক্ষামূলক এক্সকার্শনের ব্যবস্থা থাকে নানারকম বিভাগে। সেই সময় কী কী শিখল তারা, কী কী জানল সেই নিয়ে একটা কাজ করতে হয়। হয়ত একটু উঁচু ক্লাসে উঠলে দেখবে তোমার স্কুল থেকেও এমন বেড়াতে নিয়ে যাচ্ছে... কলকাতার যাদুঘর, কিংবা মুর্শিদাবাদের হাজার দুয়ারী, অথবা ব্যাণ্ডেল... পশ্চিম বাংলায় এমন কত জায়গা ছড়িয়ে আছে যেখানে এক্সকার্শান করে ছাত্র-ছাত্রীরা ভীষণ আনন্দ পায়। যাই হোক, মহেশ আমাকে টাটা করে সেই পার্কিং এর দিকেই চলে গেল, যেখানে অন্য অনেক প্রাইভেট গাড়ি পার্ক করা আছে। বুঝলাম না টাকা দিতে হয় কি না আলাদা করে পার্কিং এর জন্য। ওই প্রধান সিংহদ্বারের বাইরেটা যেন একটা ছোটখাটো মেলার মত। ফেরিওয়ালার ছোট ছোট হাতের কাজ বিক্রী করছে, টুপি বিক্রী হচ্ছে নানা রকমের, ময়ূরের পালক বিক্রি হচ্ছে। এছাড়াও আইসক্রীম, বরফের গোলা, আখের রস... কী নেই! আমার মনে হ'ল অন্য কোথাও... অন্য কোনও দেশে কোনও প্রাসাদের বাইরে কি এইভাবে ভিড় করে বাজার বসে যেতে পারে? হয়ত কর্তৃপক্ষ বসতেই দেবে না এই ভাবে। দু তিন জন পোস্টকার্ড ছবির তোড়া নিয়ে এর মধ্যেই আমার সঙ্গে ধানাইপানাই জুড়ে দিলো কেনার জন্য। মাইসোর আর শ্রীরঙ্গপত্তনমের ছবি। দু-তিনটে ঘোড়াও দেখলাম, সহিসরা জিন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। হয়ত টাকা দিয়ে চড়া যায়, মাইসোর প্যালেসের একটা চক্কর লাগিয়ে দেবে। পড়ন্ত রোদে যেন একটা মেলা বসে আছে গেটের সামনে... স্থানীয় মানুষ, স্থানীয় ভাষায় বিকিকিনিতে মেতে আছে। পর্যটকরাও শখের কেনাকাটা করছে। হয়ত খুব ঠকছে, তাও হাসছে। তার মধ্যে থেকেই বাংলা ভেসে এলো - 'মাথা খারাপ! এত দাম দিয়ে কে কিনবে! কলকাতায় এর হাফ দামে পেয়ে যাবো!'
মাইসোল প্যালেসের একটি সিংহদরজা
এই প্রথম নিজের একটা ভুল বুঝতে পারলাম - মাইসোর-শ্রীরঙ্গপত্তনমের সব কিছু একদিনে দেখে শেষ করা সম্ভব নয়। অন্ততঃ পক্ষে দু'দিন লাগবেই ভাল করে ঘুরে দেখতে। একদিনে দেখতে গেলে কিছু না কিছু ছেড়ে দিতেই হবে। যখন সকালে গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছিলাম, বুঝতেই পারিনি যে মাইসোর প্যালেসে আসতেই বিকেল এসে যাবে। এখনও চামুণ্ডেশ্বরীর মন্দির বাকি... যা পাহাড়ের ওপরে, বৃন্দাবন গার্ডেন্স আর কৃষ্ণরাজ সাগর বাঁধ দেখা বাকি - সেও শহর থেকে বেশ খানিকটা বাইরে অন্য প্রান্তে। এযাত্রায় হবে না... আজ রাতে ফিরতে হ'লে আর এ যাত্রায় দেখা হবে না। এই সব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকে পড়লাম। প্রাসাদের ভেতর ক্যামেরা বা মোবাইলে ছবি তোলা নিষিদ্ধ, তাই একটি আলাদা কাউণ্টারে ক্যামেরা জমা দিয়ে দেওয়ার নিয়ম। মোবাইল ফোন সুইচ অফ্ করে দিতে বলা হয়। প্রাসাদের বাইরে ছবি তোলা যায়... বাইরের সৌন্দর্য, বাগান, নানারকম মূর্তি, মন্দির, সেই রাজকীয় সিংহ-দ্বার... এই সব কিছুর ছবি তোলা যায়। আমার সঙ্গে ক্যামেরা ছিল না, মোবাইল ফোনে প্রাসাদের বাইরে কিছু ছবি নিতে নিতে এগিয়ে গেলাম।
পুরনো রাজপ্রাসাদের ছবি
এই যে বিখ্যাত মাইসোর প্যালেসের কথা তোমাকে বলছি, যাকে দেখতে পৃথিবীর সব প্রান্ত থেকে পর্যটকরা আসেন... তারও নিজস্ব ইতিহাস আছে। যদুরায় মাইসোর দুর্গ নির্মানের কাজ শুরু করেই একটি ছোটখাটো প্রাসাদ নির্মান করেছিলেন সেই ষোড়শ শতকে। তারপর চতুর্থ চামরাজা ওয়াদেয়ার দুর্গকে আরও শক্তিশালী করেন, এবং একই সাথে গড়ে ওঠে এক সুনির্মিত প্রাসাদ। তারপর একসময় হায়দার আলির ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, আর টিপু সুলতান নাকি প্রাসাদের এক অংশ ভাঙারও ব্যবস্থা করেছিলেন, তাঁর নতুন রাজধানীতে যাওয়ার রাস্তা প্রশস্ত করবেন বলে! এমন সত্যিই হয়েছিল না নিন্দুকের অপপ্রচার, জানি না... তবে এই প্রাসাদের ভাঙাগড়া আর পুননির্মাণ যে লেগেই থাকত এটা সত্যি। জানো তো... এখন কার এই বর্তমান প্রাসাদ আসলে একটি নতুন করে নির্মিত প্রাসাদ। আসল প্রাসাদটি ছিল অতি উতকৃষ্ট মানের শাল, টীক আর চন্দন কাঠের তৈরী, ১৮৯৭ সালে হঠাৎ একটা অগ্নিকাণ্ডে যার একাংশ পুড়ে ছাই হয়ে যায়। অতি উৎকৃষ্ট কারুকার্য খোদাই করা প্রকাণ্ড কাঠের স্তম্ভ ছিল এই প্রাসাদের সামনের দিকে, প্রধান ভারবহনকারী পিলার হিসেবে... এগুলি ছিলো সেই কাঠের প্রাসাদের অন্যতম প্রধান আকর্ষন। আনুমানিক ১৮৫৫ খ্রীষ্টাব্দে উইলিয়াম হেনরি (William Henry Pigou) সাহেবের তোলা আলোকচিত্রতে পুরনো মাইসোর প্যালেস আর সেই কাঠের স্তম্ভের ছবি দেখা যায়। অগ্নিকাণ্ডে সেগুলিও নষ্ট হয়ে যায়।
প্রাসাদ ভাল রকম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেখে নতুন ভাবে প্রাসাদ নির্মানের পরিকল্পনা শুরু করেন তৎকালীন রাজা চতুর্থ কৃষ্ণরাজ ওয়াদেয়ারের মাতা মহারাণী বাণীবিলাস (দশম চামরাজেন্দ্র ওয়াদেয়ারের বিধবা স্ত্রী)। সিংহাসনে বসা রাজার বয়স তখন মাত্র ১৩ বছর, নাবালক। একাধিক বিদেশী স্থাপত্যশিল্পীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে হয়, অবশেষে দায়িত্ব পড়ে ব্রিটিশ স্থপতি হেনরি আরউইনের (Henry Irwin) র ওপর। ১৯১২ সালে নির্মাণ সম্পূর্ণ হয় এই নবনির্মিত মাইসোর প্যালেসের, যাকে আমরা আজকে দেখছি। ভারতীয় এবং ইওরোপীয় স্থাপত্যের মিশেল দেখা যায় বলেই হয়ত এই শৈলীকে বলে 'Indo-Saracenic Revival architecture'। স্তম্ভ, দরজা, গেট, দেওয়ালের নকশা, সিঁড়ি বা দরজায় কাঠের কাজ, আর প্রস্তর মূর্তি... এইসব কিছুর মধ্যেই উৎকৃষ্ট স্থাপত্যশিল্প এবং নির্মানশৈলীর নিদর্শন রয়েছে।
প্রাসাদের ভেতরের কিছু অংশ
মাইসোর প্রাসাদে ঢোকার একটু আগে, বাইরে জুতো জোড়াও জমা করে দিতে হয়। চটি দুটো তাদের জিম্মায় রেখে টোকেনটা টুক করে নিজের পকেটে পুড়ে নিলাম। সামনে আর এক দফা মেটাল ডিটেকটার, সেই দিকে এগনোর পথেই একটা ছোট্ট লাইন হয়ে গেছে পর্যটকদের। সেই লাইনে দাঁড়িয়ে দেখলাম মোবাইলে, প্রায় চারটে বাজে... সুইচ অফ্ করে দিলাম। মাইসোর প্যালেসের ভেতর যেহেতু ছবি তোলার ওপর কড়া নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, তাই সেখানে যে কী বিপুল ঐশ্বর্য মানুষ দেখতে পায়... তার কোনও ছবিই তোমাকে দেখাতে পারব না। আর খালি বর্ণনা শুনে কখনওই বুঝবে না যে সে ঠিক কেমন উচ্চমানের সংগ্রহশালা, বা যাদুঘর। একদম একতলা থেকে শুরু করে প্রতিটি ঘরে, প্রতিটি দেওয়ালে, বারান্দায়... চারিদিকে কিছু না কিছু রয়েছে যা তোমার দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। যদি প্রতিটা ঘর নিয়ে আলাদা করে বিস্তারিত বলতে বসি তাহলে এক একটা ঘরের প্রদর্শনী নিয়েই অনেক কিছু বলতে হবে। আবার সব কিছু না বললেও কিছু বিশেষ জিনিসের কথা না বলেও পারছি না। যেমন সেই সুসজ্জিত হাওদা, যার ওপরে বসে রাজারা হাতির পিঠে চড়ে যেতেন। সেই সোনার পালঙ্ক, যার ওপর দুর্গামূর্তী (মানে চামুণ্ডেশ্বরীকে) বসিয়ে দশহরার সময় পথে নামে ওয়াদেরার রাজ পরিবারের সদস্যরা। আর ওয়াদেয়ারদের বিখ্যাত 'রত্ন সিংহাসন' বা 'গোল্ডেন থ্রোন'। এখনও বিশেষ উৎসবের দিনে বা অভিষেকের সময় এই সিংহাসন বসার রীতি আছে। দেখতে পাবে বেশ কিছু বাক্স যেগুলো তামা, পেতল অথবা হাতির দাঁতের ওপর নক্সা করে তৈরী। অনেকগুলো কামান সাজানো আছে নিচের করিডোরে। আর বেশ কিছু সিংহ (সিংহ না বলে সিংহী বলা উচিৎ, কারণ তাদের কেশর নেই)... যাদের নির্মানশৈলী, তাদের দাঁড়ানোর ভঙ্গিমা, চোখ-মুখের অভিব্যক্তি দেখার মতন। ওয়াদেয়ার পরিবারের সদস্যদের বেশ কিছু তৈলচিত্র আছে, সঙ্গে তাঁদের নাম এবং পরিচয় লিখে দেওয়া আছে। সেই সব তৈলচিত্রের মধ্যে বেশ কিছু ছবি বিখ্যাত প্রতিকৃতি শিল্পী রাজা রবিবর্মার আঁকা। এরপর একে একে পাবে নাচমহল, দরবার... দেওয়ালে দেওয়ালে বিশাল ওয়াল পেইণ্টিং, ম্যুরাল আর ছাতে আঁকা ফ্রেস্কোর সৌন্দর্য। বেলজিয়াম কাঁচের ঝাড়বাতি। দেওয়াল আর ছাতে আঁকা ছবিগুলোর মধ্যে কোথাও ফুটে উঠেছে হিন্দু দেবদেবীর কথা, আবার কোথাও ফুটে উঠেছে বিদেশী শিল্পীর আঁকা বিশাল একটি দৃশ্য... মাইসোর রাজা দরবার, প্রাসাদের বাইরের জমায়েৎ, রাজদরবারের সদস্যরা... এমন অনেক কিছু! রাজার নিজস্ব দরবার, বিশেষ সভাসদ বা পারিষদদের জন্য... তার নাম 'অম্বাবিলাস'। কী নিপুণ তার শিল্পসজ্জা সে তোমাদের কী বলব! যেখানে নাচমহল আর বিবাহ ইত্যাদি পারিবারিক উৎসবের জায়গা, সেই 'কল্যাণমণ্ডপ'-এ এখনও ঝাড়বাতির শোভা আর স্টেইন্ড গ্লাসের রঙ ঝলমল করছে! এ ছাড়া একটা ঘড় আছে, যেখানে বেশ কিছু অস্ত্র-শস্ত্র, বর্ম, ইত্যাদি দেখতে পাবে।
প্রাসাদের ভেতরের ছাদের কিছু অংশ
রাতের আলোয় মাইসো্র প্যালেস
আধঘণ্টার মধ্যে একতলা আর দোতলা শেষ করে সেই দরবার হলে চলে এলাম যেখান থেকে সামনের সেই প্রধান সিংহদ্বার দেখা যায়। এইখানটাই আসলে প্রাসাদের সামনের দিক, যেখানে রাজার সঙ্গে সাধারণ প্রজাদের সাক্ষাতের ব্যবস্থা আছে... অনেকটা দিওয়ান-এ-আম এর মত। রাজার বসার জন্য ব্যবস্থা করা জায়গাটা দেখেই বোঝে যায়, যে এইখানে সিংহাসন পাতা থাকত। আর নিচে অনেকটা জায়গা প্রজাদের জন্য। সেইখান থেকে সোজা তাকালেই সামনে প্যালেস কম্পাউণ্ড, দূরে সেই বড় গেট যেখান থেকে গাড়ি আসতে পারে... সেই সময় গাড়ি, হাতি, ঘোড়া সবই আসত এবং যেতো ওই দরজা দিয়েই। অনেকেই দেখলাম বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন দরবারের এই জায়গাটাতে। কেউ কেউ মোবাইল বার করে একটা দুটো ছবিও যে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করেন না, এমন নয়। তবে খুব সাবধান, তুমি কিন্তু এমন দুষ্টুবুদ্ধি করো না। কোনও জায়গার একটা নিয়ম থাকলে তাকে মেনে চললেই তাদের এবং নিজেকে সম্মান দেওয়া হয়। নিরাপত্তারক্ষীরা কিন্তু দেখতে পেলেই ফোন কেড়ে নেবে, আর ফেরৎ দেবে না! এমনকী অনেক টাকা জরিমানাও হ'তে পারে নিয়ম না মানার জন্য!
প্রাসাদ-দর্শন নাকি সংগ্রহশালা দেখতে দেখতে মোহিত হয়ে যাওয়া... কী বলব জানি না। তবে এমন মনভাল করা সংগ্রহশালা কেবল আর দু'বার দেখেছি... এক কলকাতার ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম, আর দুই হায়দ্রাবাদে সালারজঙ্গ মিউজিয়াম। যখন সব শেষ করে নেমে এলাম তখন, মোবাইল সুইচ অন করে দেখি বিকেল চারটে পঁয়তাল্লিশ। স্থানীয় কুটির শিল্পের নিদর্শন হিসেবে নানা রকমের হাতের কাজ, চন্দন কাঠ, ধূপ, সাবান, মাইসোর সিল্কের শাড়ি, কাঠের ছড়ি, ইত্যাদি অনেক কিছু ছিল একটা হ্যাণ্ডিক্র্যাফট-এর শোরুমে, যা প্রাসাদের নিচে। তবে সেখানে যাওয়ার বিশেষ ইচ্ছে হ'ল না। জুতোর রাখার ওখানে টোকেন জমা দিয়ে চটপট চটি গলিয়ে বাগানের দিকে এগিয়ে গেলাম। প্রাসাদের বাগানটাও বেশ সাজানো, সুন্দর। পেল্লায় সিংহীদের সামনে পর্যটকরা ছবি তোলে। এদিক ওদিক সাজানো গাছের কেয়ারি। আর মন্দিরের চূড়ো দেখা যায়।
প্রাসাদের বাগানের বিখ্যাত সিংহী
এখানে বলে রাখি, ছোট বড় মিলিয়ে মোট বারোটি মন্দির আজ এই প্রাসাদেরর চতুর্দিকে ছড়ানো। প্রত্যেকটিতে রয়েছেন রাজ পরিবারের আরাধ্য দেবতা, যার মধ্যে শ্বেত বরাহস্বামীর মন্দিরটি নাকি একটু বেশি গুরুত্বপায় স্থানীয় মানুষদের কাছে... কারণ বিষ্ণুর অন্যতম অবতার বরাহ অবতারের রূপ এই শ্বেত বরাহস্বামী জাগ্রত দেবতা এবং রাজ পরিবারের প্রধান আরাধ্য।
এ ছাড়া অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ মন্দিরগুলি হ'ল -
মহাদেবের জন্য সোমেশ্বর মন্দির, বিষ্ণুর জন্য লক্ষ্মীরমণ মন্দির, গায়ত্রী দেবীর মন্দির, ভুবনেশ্বরী মন্দির ইত্যাদি
এমনই নানা দেব-দেবীর প্রতি উৎসর্গ করা বারোটি ছোট বড় মন্দির, যাদের মধ্যে শেষ মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল ১৯৫৩ সালে। নাহ্ সে সব মন্দির আর ঘুরে ঘুরে দেখার ইচ্ছে হয় নি। সম্ভবও নয়, কারণ সব মন্দিরের দরজা সব সময় খোলা থাকে না, শ্বেত বরাহস্বামীর মন্দিরের মত বড় মন্দিরগুলো বাইরে থেকে লোকে দেখে, রাতেও সুন্দর আলো দিয়ে সাজানো হয়। মাঝে মাঝে দরজা খোলা পেলে এই মন্দিরেই লোকজন যায়। দরজা বন্ধ থাকলে স্থানীয়দের দেখেছি বন্ধ দরজাতে আর সিঁড়ির ধাপে মাথা ঠুকে প্রণাম করে যায়। যখন মাইসোর প্যালেস থেকে বেরিয়ে আসছি, তখনও দেখলাম কেউ কেউ এই ভাবেই প্রণাম করছে ভক্তি ভরে।
শ্বেতবরাহমন্দির
মোবাইলে বেশ কিছু ছবি তুলে, আর গেটের বাইরে দোকানিদের কাটিয়ে যখন গাড়ির পার্কিং এরিয়া অবধি এলাম, দেখলাম মহেশ অন্য দুজন ড্রাইভারের সঙ্গে খোশ গল্প করছে। আমাকে আসতে দেখে ঘড়িটা চট করে একবার দেখে এলো। আমি বললাম 'অলমোস্ট ফাইভ', সে শুধু হাসল। গাড়িটা রাস্তায় বার করে আনতে আমি বসলাম। জিজ্ঞেস করলাম পার্কিং বাবদ কত দিতে হবে, কিন্তু নিতে চাইল না। বলল 'অব কিধার জানা সার... হিল্স গয়া তো ইভিনিং হো যাতা' জানতাম চামুণ্ডী হিল্স এ যাওয়া আসা করতে অন্ধকার নেমে আসবে। ওদিকে শ্রীরঙ্গনাথ দেখা হ'ল না... এদিকে আবার বৃন্দাবন গার্ডেনে যাওয়ার কোনোও সম্ভাবনাই দেখছি না। আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে মহেশ বলল - "রঙ্গনাথ স্বামী টেম্পেল জানা সার?" আমি বললাম, ' চার্চ হ্যায় না সামনে... সেন্ট ফিলোমেনা'স চার্চ চলো" মন্দিরের যেতে না চেয়ে গির্জা যেতে চাইলাম বলে হয়ত বাবুর পসন্দ হ'ল না। মুখটা হাড়ি করে বলল 'ওককে সার'... তারপর স্টিয়ারিং ঘুড়িয়ে চার্চের রাস্তা নিলো... সামনে ট্রাফিকের লাল আলো, গাড়ির লম্বা লাইন। মহেশ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে এফএম রেডিওতে কানাডা সিনেমার গান চাইলে দিলো।
(ক্রমশঃ)
ছবিঃ উইকিপিডিয়া ও অন্যান্য ওয়েবসাইট