বেলি'র অন্ধকূপ থেকে উঠে এসে যখন বাইরে দাঁড়ালাম, সূর্য মাথার ওপর থেকে পশ্চিমের দিকে হেলতে শুরু করেছে। গাড়ির কাছে এগিয়ে এসে দেখি মহেশ ড্রাইভার সীট কে পেছন দিকে ঠেলে চোখ বন্ধ করে ঘুমোচ্ছে। জানলার কাঁচে আলতো টোকা দিতেই চোখ খুলে তাকাল। বললাম, এবার রঙ্গনাথ স্বামী মন্দিরের দিকে গাড়ি ঘোরাতে। কোনও কথার উত্তর দিলো না। ঘুমচোখে গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে এসে, বোতল থেকে চোখে মুখে জল দিল। তারপর হাত-ঘড়ি দেখিয়ে বলল, "থ্রী ও ক্লক সাব, টেম্পল বন্ধ হোনা।" বুঝলাম তিনটে থেকে মন্দিরের দরজা দর্শনার্থীদের জন্য বন্ধ হয়ে যায়, আবার সন্ধের সময় খোলে (যেমন অনেক মন্দিরের নিয়ম)। জিজ্ঞেস করলাম, তাহ'লে দরজা আবার কখন খুলবে? হেসে বলল "প্যায়েলেই বোলা থা সার... দর্শন করলো... অব লেট হোতা। ইভিনিং হো যাতা।" সত্যি বলতে, রঙ্গনাথ স্বামীর থেকেও তখন আমার কাছে অনেক বড় আকর্ষণ মাইসোর প্যালেস... ওয়াদেয়ারদের প্রাসাদ। তা ছাড়া তিনটে বাজতে চলল, আর তখনও দুপুরের খাওয়াও হয়নি। মহেশের একাধিক কারণে ক্ষেপে ওঠা স্বাভাবিক। ওকে বললাম, ঠিক আছে... তাহলে চলো একটা হোটেল দেখে খেয়েনি। তারপর পরের প্ল্যান ভাবা যাবে। মহেশ গাড়িতে বসে বলল, "মাইসুর প্যালেস সার... প্যালেস আচ্ছা।" আমি তখনও বাইরেই দাঁড়িয়ে... দূরে ডাবওয়ালার সামনে চার-পাঁচজন পর্যটক ডাব খাচ্ছে। ডাবওয়ালা হাঁকছে 'টেন রুপিস... দস রুপায়... কোকোনাট ওয়াটার। পিওর। ফ্রেশ।'তবে এখন গেলে হয়ত আর দশে জুটবে না ও জিনিস, কম করে কুড়ি টাকা চেয়ে বসবে! মহেশকে বললাম, "ঠিক হ্যায়... প্যালেস জায়েঙ্গে... প্যাহেলে লাঞ্চ, ফির প্যালেস। কোকোনাট ওয়াটার পিওগে?" মহেশ বলল ওর আগেই খাওয়া হয়ে গেছে। মনে হয়, আমি যখন নিচে ছিলাম তখন ব্যাটা আগেই খেয়ে নিয়েছে। কিংবা ইচ্ছে করেই খেতে চাইলো না... কে জানে? আমি আর এই নিয়ে কিছু না ভেবে ডাবওয়ালার দিকে চলে গেলাম। দশ টাকার ডাব... বেশ বড়, সবুজ। বেছে বেছে খুব ভাল একটা ডাব দিয়েছিল, চিনির মত মিষ্টি জল, আর তেমন কচি শাঁস, খিদের পেটে অমৃত!
মাইসোর শহরের দিকেই গাড়ি এগিয়ে নিয়ে গেছিলাম আমরা। একটা মোটামুটি পরিষ্কার হোটেল, ছিমছাম চেহারা... তার নাম মনে নেই। সেখানেই দুপুরের খাবার খেলাম। মাইসোরের বিশেষ পদ বলে আমার কিছু চোখে পড়ল না। মাইসোর দোসা এক আলাদা রকমে দোসা, একটু অন্যভাবে তৈরী হয়। তবে ঐ দুপুরে দোসার থেকে ফ্রায়েড রাইস খাওয়াই বেশি কাজের মনে হ'ল। মাইসোর পাক নামের একরকমের ঘি-এর মিষ্টি ওখানে নাম করা। তবে, জবজবে ঘি আমার সহ্য হয় না... আর মিষ্টির ভক্তও আমি নই খুব একটা। তাই ওটাও বাদ দিলুম। তোমার ইচ্ছে হলে দুটোই চেখে দেখতে পারো।
আলোয় সাজানো মাইসোর প্রাসাদ
মহীশূর, মাইসোর, মাইসুর, মাইসুরু... এক এক রকম নামে পরিচিত এই প্রাচীন শহর। মাইসোর নামটা ইংরেজদেরই দেওয়া। স্থানীয় মানুষদের কাছে এর নামে মাইসুর অথবা মাইসুরু। সেই ব্যাঙ্গালোর শহর থেকে এতদূর আসার পর এই প্রথম আবার একটা বড় শহর দেখলাম। বেশ সাজানো, সুন্দর এবং বোঝা যায় পুরনো জনবসতি। ওয়াদেয়ার সাম্রাজ্যের রাজধানী হওয়ার সুবাদে একটা আভিজাত্য আছেই, তার সঙ্গে নিজস্ব বৈচিত্র। বাগান, পুরনো মন্দির, মসজিদ, সন্ত ফিলোমেলার নামে বিশাল গির্জা... এবং রাজবংসের রাজত্ব থাকাকালীন গড়ে ওঠা ইমারৎ যা শহরের এদিক সেদিক ছড়িয়ে আছে। কোনওটা আজ সরকারী দফতর, কোনওটা লাইব্রেরী, কোনওটায় এখনও শরীকদের বসতি। কর্ণাটক রাজ্যোৎসবে যে লালহলুদ পতাকা উড়তে দেখা যায়, ব্যাঙ্গালোরের অটো স্ট্যাণ্ডগুলোয় হামেশাই যে লালহলুদ রঙ বা পতাকার দেখা মেলে... সেই লালহলুদ পতাকা এই ওয়াদেয়ারদেরই পতাকা... মাইসুরের পতাকা। প্রিন্সলি স্টেট অফ মাইসোর আর নেই... কিন্তু এই পতাকার মধ্যে কর্ণাটকের গর্ব থেকে গেছে।
শুরুর দিকে এই মহীশূর ছিল দক্ষিণের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাম্রাজ্য বিজয়নগরের অন্তর্গত অঞ্চল। ১৫৬৫ সালে তালিকোটার যুদ্ধে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের পতন হয়... এবং তার পর দেবরায়-দের অধীনে থাকা আঞ্চলিক ছোট শাসকরা স্বাধীন হয়ে যায় (অবশ্যই কোনও বড় সুলতানের নেক নজরে থেকে)। যেমন শোনা যায় মহীশূর প্রথম দিকে বিজাপুরের আদিল শাহীদের সঙ্গে ভাব রাখত, পরবর্তীকালে হায়েদ্রাবাদের নিজামরা ক্ষমতায় বাড়লে তাদের সঙ্গে সদ্ভাব রাখার চেষ্টা করে। যখন ঔরঙ্গজেব দক্ষিণে এসে একে একে কুতুব শাহী, আদিল শাহী, সবাই কে কাত করছেন... সেই সময়ও মুঘল বাদশাহর সঙ্গে কোনও বিবাদেই যায়নি এই ওয়াদেয়ার বংশ। ওয়াদেয়ারদের হাত থেকে যে সামান্য সময়ের জন্য মাইসোরের দখল হায়দার আলী এবং তার ছেলে টিপুর হাতে গেছিল (নাবালক এবং অযোগ্য রাজার জন্য), সেইটুকু সময়তেই ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী বাহাদুরের বিরুদ্ধে মাইসোরকে দেখা যায়। ওয়াদেয়ার বংশ অতি দ্রুত নিজেদের সামলে নিয়ে আবার ইংরেজ-শাসকের অনুগত হয়ে যায়... টিপুর মৃত্যুর পরেই একেবারে শান্তিপূর্ন প্রগতিশীল প্রিন্সলি স্টেট অফ মাইসোর! বলতে বিন্দুমাত্র সংকোচ হয় না... ওয়াদেয়ার রাজত্বের ইতিহাসে বীরগাথা নেই একেবারেই... এরা শান্তিপূর্ণ ভাবে সব কিছু মেনে নিয়ে নিজেরা ভাল থাকা সাম্রাজ্য। এবং সেই কারণেই রাজপরিবার বা রাজত্ব কখনও শাসকের রোষানলে পড়েনি।
১৫২৪ সালে মহীশূরের দুর্গটি নির্মান করেন তৃতীয় চামরাজা ওয়াদেয়ার (যার আজ ধ্বংশাবশেষও খুঁজে পাওয়া যায় না)। এবং এই সময় থেকেই ওয়াদেয়ার উত্থান, যা ওনার পুত্র চামরাজা চতুর্থের হাতে যায়। ষোড়শ শতকের শেষ দিক থেকেই মহীশূর এক বর্ধিষ্ণু নগরী হয়ে ওঠে। বাড়তে থাকে ওয়াদেয়ারদের বোলবালা। আর বিজয়নগরের পতনের পরে ওয়াদেয়ারদের পায় কে! রাজা নরসরাজা ওয়াদেয়ার স্বাধীন মাইসোরের একেবারে স্বাধীন রাজা... তখন ১৬৩৭ খ্রীষ্টাব্দ, দিল্লীর বাদশাহ শাহ জাহান মোটা অংকের খাজনা আর নজরানা পেলেই খুশ! এর পর রাজত্বের সীমানা বাড়তে থাকে... দক্ষিণ কর্ণাটকের প্রায় পুরোটাই এবং তামিলনাড়ুরও কিছু অংশ চলে আসে মাইসোর সাম্রাজ্যে। হায়দার আলী আর তার ছেলে টিপু সুলতানের বিক্রমের কথা তো আগেই বলেছি তোমাদের। মনে রেখো, এই ওয়াদেয়ার রাজারা যাই করুন... মাইসোর সাম্রাজ্যের সোনালী সময় এবং ব্যাপক উত্থান কিন্তু এসেছিল ওই হায়দার আলীর হাত ধরেই।
দিওয়ান পূর্ণাইয়া
টিপু সুলতানের মৃত্যুর পর নতুন করে মাইসোরের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী। নাবালক রাজার অভিভাবক দিওয়ান পূর্ণাইয়া নিজের হাতে দায়িত্ব তুলে নেন সাম্রাজ্য শাসনের। সাম্রাজ্য বিস্তারের পরিকল্পনা পাকাপাকি ভাবে বন্ধ হল, শুরু হ'ল জন সাধারণের জন্য উন্নয়নের কাজ। এই সময়তেই পাশ্চাত্য নির্মান শৈলীর প্রয়োগে গড়ে ওঠে ব্রীজ, রেল লাইন, রাস্তা এবং অনেক রকম জন-পরিষেবার কাঠামো। ১৮৩১ সাল, ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর থাবা আরও মজবুত হ'ল। নখগুলো বেরিয়ে এলো। দেশজুড়ে চলছে তখন স্বাধীন রাজ্যদখলের কূটনৈতিক চক্রান্ত। ঔপনিবেশিক শাসন বসানোর ব্রিটিশ চক্রান্ত তখন একেবারে স্পষ্ট সবার কাছে। মাইসোরকেও তার প্রশাসনিক ক্ষমতা হারাতে হ'ল... রাজধানী সরিয়ে আনা হ'ল ব্রিটিশ শাসিত ব্যাঙ্গালোরে। সিপাহী বিদ্রোহের অনেক পরে, রাণী ভিক্টোরিয়ার শাসনকালে আবার মাইসোরে ফিরে যায় প্রশাসনিক দফতর, তখন ১৮৮১ সাল। এরপর ১৯৪৭ সালে, ভারত স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত এই মাইসোর শহরেই ছিল প্রিন্সলি স্টেট অফ মাইসোরের রাজধানী। এর পর কর্ণাটক রাজ্য গঠন হয় এবং কর্ণাটকের রাজধানী হয়ে যায় ব্যাঙ্গালোর। ঐতিহ্যপূর্ণ শহর বলেই মাইসোরকে এই নগরায়ন এবং ব্যাপক উন্নয়নের যুগে রেহাই দেওয়া হয়েছিল। নাহ'লে বেড়ে ওঠা নির্মানশৈলী এবং শহরকেন্দ্রিক প্রসারের ফলে ঐতিহাসিক এই শহরের সৌন্দর্যটাই হারিয়ে যেতো একই রকম দেখতে ফ্ল্যাটবাড়ী, ফ্লাইওভার, ট্রাফিক জ্যাম, দূষণে। আমরা আর মাইসোর বেড়াতে যাওয়ার আনন্দটা পেতাম না... এখনও যেমন পাচ্ছি।
নতুন রাজার মাথায় মাইসোর পেটা
তবে প্রশাসনিক রাজধানী না থাকলেও, কর্ণাটক রাজ্যের সাংস্কৃতিক রাজধানী এখনও এই মাইসোরকেই বলা হয়। মাইসোর ঘরানার সিল্ক, সিল্কের শাড়ী, সিল্কের পাগড়ী (যাকে মাইসোর পেটা বলে)... খুব বিখ্যাত। এই মাইসোর পেটা তুমি ভারতের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি ডঃ সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণনের মাথাতেও দেখবে। তেমনই দেখবে বিখ্যাত সিভিল ইঞ্জিনিয়ার তথা শিক্ষাবিদ এম বিশ্বেশ্বরাইয়ার মাথায়। মাইসোরের স্বতন্ত্র শিল্প শৈলী মাইসোর স্টাইল অফ পেইন্টিংও খুব জনপ্রিয়। মাইসোর প্যালেসের ভেতরেও অনেক জায়গায় এই মাইসোর ঘরানার পেইন্টিং-এর নিদর্শন ছড়িয়ে আছে।
মাইসোরের দশেরা
এ ছাড়া, মাইসোরে উদযাপিত দশেরা উৎসব আর দিওয়ালি উৎসবও বেশ প্রসিদ্ধ। এই সময় দলে দলে পর্যটকরা ভীড় করে। হাতির পিঠে সোনার হাওদায় বসিয়ে সোনার দুর্গামূর্তি রাজপথ দিয়ে যায়... ভিড় হয়ে যায় পথের দু'ধারে এই দৃশ্য দেখার জন্য। চামুণ্ডেশ্বরী পাহাড়ের চূড়োয়, মাতা চামুণ্ডেশ্বরীর পুজো হয় নবরাত্রির সময়। আলোয় সেজে ওঠে প্রাসাদ আর ঝলমল করে ওঠে গোটা শহর। এই সময় যে মাইসোর শহর আর মাইসোর প্যালেস এর সৌন্দর্য দেখেনি... তাকে বলে বোঝানো সম্ভব নয়। হয়ত, এই সময়তেই এই প্রাচীন শহরের অতীত গৌরব অনেকটা ফিরে আসে।
আর মাইসোর স্যান্ড্ল সোপ... মানে চন্দনের সুগন্ধী সাবানের কথা তো তুমি শুনেই থাকবে। চন্দন কাঠের ব্যবহারে কাঠের নানারকম শিল্পদ্রব্য (হাতি, ঘোড়া, বাক্স, ইত্যাদি) এবং চন্দন-গন্ধ ধূপ, সাবান... সব কিছুর সঙ্গেই মাইসোরের নাম জড়িয়ে আছে। এত দূর যখন এসেছি... তখন চন্দন কাঠের কিছু একটা সঙ্গে নিয়ে গেলে মন্দ হয় না! কিন্তু কোথা থেকে কিনলে ভাল জিনিস সঠিক দামে পাবো? ঠকিয়ে দেবে না তো? এইসব ভাবতে ভাবতেই দেখি কখন একটা বিশাল লম্বা দেওয়ালের কাছাকাছি এসে গেছে গাড়িটা... একটা বিশাল গেট আর তার ওপারে পড়ন্ত বেলার রোদে ঝলমল করছে প্রাসাদ... ওয়াদেয়ারদের মাইসোর প্যালেস!
ছবিঃ বিভিন্ন সংবাদভিত্তিক ওয়েবসাইট