তোমাকে এর আগে একবার 'সখা' পত্রিকার কথা বলেছিলাম, মনে পড়ে? সেই যে উনবিংশ শতাব্দীর সখা পত্রিকা, যা তোমার মত ছোট পাঠক-পাঠিকাদের কাছে খুব জনপ্রিয় হয়েছিল, সেই সময়কার অনেকে সেই পত্রিকায় লিখতেন, পত্রিকার সম্পাদক প্রমদাচরণ সেন... মনে পড়ে? হ্যাঁ, আজ সেই সখা পত্রিকার জনক শ্রী প্রমদাচরণ সেনের গল্পই তোমাকে শোনাবো।
ঠিক যেমন উপেন্দ্রকিশোর রায় কিংবা সুকুমার রায়, এঁরা ছোটদের জন্য নতুন কিছু করার বা ভাল কিছু করার পরিকল্পনা সব সময় করতেন... সেইরকম প্রমদাচরণ সেনও কিশোর বয়স থেকেই সব সময় বাচ্চাদের সঙ্গে মিশতে ভালবাসতেন, ছোটদের জন্য ভাল কিছু করার প্রবল ইচ্ছে ছিল তাঁর। তাঁর শুভানুধ্যায়ী গুরুজনরা, বন্ধুরা, সতীর্থরা, সকলেই তাঁর পাশে থাকতে চাইতেন তাঁর এই ইচ্ছাগুলোকে বাস্তব রূপ দিতে; অক্লান্ত পরিশ্রমী এবং ভাল মানুষ হিসেবে একই সঙ্গে প্রত্যেকের ভালবাসা এবং শ্রদ্ধা অর্জন করে নিয়েছিলেন অতি অল্প বয়সেই। ছোটছোট পাঠক-পাঠিকারা তাঁকে এবং তাঁর পত্রিকাকে কতটা ভালবেসেছিল তা বোঝা যেত 'সখা' পত্রিকাতে পাঠানো পাঠক-পাঠিকাদের চিঠি থেকে। অথচ দেখো, আজ এত বছর পর কত জনই বা মনে রেখেছে এই ভাল মানুষটির কথা? কতজনই বা জানে, যে ভবিষ্যতের অনেক সুন্দর পত্রিকার পূর্বসূরী এই সখা পত্রিকা; এই প্রমদাচরণ সেনের পরিকল্পনাই বালক-বালিকাদের কাছে সাময়িক পত্রিকাকে জনপ্রিয় করে তোলার প্রথম বৈচিত্রময় এবং আকর্ষনীয় পদ্ধতির জনক? যে মানুষটি তোমার মত ছোট ছোট পাঠকদের হিত আর মুখে হাসি ছাড়া আর কিছুই চান নি তাঁর স্বল্পায়ু জীবনে, আজ সেই প্রমদাচরণ সেনের কথাই তোমাকে বলি... কেমন?
অবিভক্ত বাংলার খুলনাতে সেনহাটি বলে একটি জায়গায় তারিনীচরণ সেন বলে একজনের পৈতৃক বাড়ি ছিল। কিন্তু তারিনীবাবু ছিলেন পেশায় দারোগা; তাই যখন তাঁর পুত্রের জন্ম হয়, সেই সময় চাকরি সূত্রে কলকাতার এন্টালী থানাতে কর্তব্যরত ছিলেন। সেই পুত্রই আমাদের প্রমদাচরণ সেন, জন্ম ১৮ই মে, ১৮৫৯ সালে। দুঃখের বিষয়, বালক প্রমদাচরণ মাত্র সাত বছর বয়সেই তাঁর মাকে চিরকালের জন্য হারিয়ে ফেলেন। ইংরেজ শাসনে দেশ, মাত্র দু'বছর আগে সেপাই বিদ্রোহের অবসান হয়েছে। বুঝতেই পারছ, সেই সময় সরকারী চাকরিতে থাকা ভারতীয়দের অবস্থাটা। তার ওপর তারিনীচরণ ছিলেন আবার দারোগা। এই থানার দায়িত্ব এবং পারিবারিক আরও কিছু কারণে মাতৃহারা প্রমদাচরণকে গ্রামের বাড়ি সেনহাটিতেই পাঠিয়ে দিতে হয়। সেখানে বেড়ে ওঠে বালক প্রমদাচরণ, শুরু হয় তার পড়াশুনো, পাঠশালায় যাওয়া। মা-হারা ছেলে, বাবাও সঙ্গে নেই... এমন অভিভাবকহীন ছেলেদের মধ্যে সাধারণতঃ যা দেখা যায়, বালক প্রমদাচরণের ক্ষেত্রেও তাই-ই হল। পড়াশুনোয় অমনোযোগী এবং ডানপিটে হয়ে উঠল সে। দুষ্টু ছেলেদের সঙ্গে মিশে পাঠশালায় এবং তার বাইরে নানারকম দুষ্টুমি করার জন্য একদিকে বাড়ির বড়দের কাছেও মার খেতো, আবার পাঠশালার গুরুমশায়ের কাছেও ধমক আর মারই পেতো। ছোটদের শাসনের নামে ক্রমাগত গায়ে হাততোলা একটি ভীষণই বাজে পদ্ধতি। এতে শিশুমন আরও জেদী হয়ে যায়, অবাধ্য হয়ে যায়, ক্রমে মনের মধ্যে একটা বিদ্রোহ ফুঁসতে ফুঁসতে তারা আর এই ধরণের মারকে আর ভয় পায় না। বয়স বাড়ার সাথে সাথে সকলকে অমান্য করতে শুরু করে। প্রমদাচরণের সেই গ্রামের গুরুজনেরা এটি বুঝেছিলেন কি না কে জানে, কিন্তু এই ঘটনাগুলির কথা জানলে মনে হয় এই সবের মধ্যে দিয়েই অল্পবয়স থেকে প্রমদাচরণ স্নেহ বা ভালবাসার একটি অভাব বোধ করতেন। আর সেই কারণেই তিনি পরবর্তীকালে সব সময় শিশু-কিশোরদের মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছেন। তাদের একটি সুন্দর শৈশব উপহার দিতে চেয়েছিলেন, যা তিনি নিজে পাননি।
অবশেষে বারো বছর বয়স হ'তে সেনহাটি গ্রামের স্কুল থেকে কিশোর প্রমদাচরণকে কলকাতার স্কুলে ভর্তি করার জন্য নিয়ে আসা হয়। দুষ্টু বা বড়দের অবাধ্য হলেও প্রমদাচরণের মেধা ছিল। তার প্রমাণ পাওয়া যায় যখন ১৮৭২ সালে সে গ্রামের স্কুল থেকে ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তবেই কলকাতার হেয়ার স্কুলে ভর্তি হয়। হেয়ার স্কুলের মত কলকাতার স্কুলগুলিতে সেই সময় ভাল রকম প্রভাব মিশনারী শিক্ষক এবং ব্রাহ্মদের। সুতরাং বুঝতেই পারছ যে গ্রামের জীবন যেমনই হোক, প্রমদাচরণের বাবা চেয়েছিলেন ছেলেকে সুশিক্ষিত করতে। কর্মজীবন বা ব্যক্তিগত জীবনের সব কিছুর মধ্যেও ছেলের প্রতি মঙ্গলচিন্তা ওনার ছিল। পূর্ববঙ্গের সেই গ্রাম থেকে কলকাতায় আসা,তারপরে হেয়ার স্কুলে এক নতুন ছাত্রজীবন শুরু করাই প্রমদাচরণের মানসিক বিকাশের একটি বড় ধাপ ছিল। শিবনাথ শাস্ত্রীর মত পণ্ডিত ব্যক্তি এবং ব্রাহ্মসমাজের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বকে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন প্রমদাচরণ। শিবনাথ শাস্ত্রীও তাঁর অনেক স্বনামধন্য ছাত্রদের মধ্যে এই ছাত্রটিকে বিশেষ স্নেহ করতেন, ভালবাসতেন। প্রমদাচরণের সংক্ষিপ্ত কর্মজীবনের বহু অধ্যায়ে এই গুরু-শিষ্য সম্পর্কের আভাস পাওয়া যায়। শিবনাথ শাস্ত্রীর প্রভাবেই প্রমদাচরণ ব্রাহ্মসমাজে যোগদান করেন। গোঁড়া হিন্দু সমাজে তখন এই ধরণের পদক্ষেপ ছিল দুঃসাহসিক, তিরস্কারযোগ্য। তারিণীচরণ সেন তাঁর পুত্রকে ব্রাহ্মসমাজে যোগদান করার জন্য ত্যাজ্য পুত্র করলেন। কলকাতার বাড়িতে প্রমদাচরনের আর জায়গা হ'ল না, এমনকী কলেজে পড়ার খরচও বন্ধ করে দিলেন তার বাবা। গ্রাম থেকে শহরে এসে যে ছেলেটা একটু একটু করে একটি সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছিল, আবার একটা বড় ধাক্কা পেলো। মেধাবী প্রমদাচরণ ১৮৭৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বৃত্তিসহ পাশ করে এল এ ক্লাসে ভর্তি হয়েছিল প্রেসিডেন্সি কলেজে। কিন্তু তারিণীচরণ বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার ফলে তার সেই পড়াশুনো্র পথে খানিক বাধার সৃষ্টি হল। ব্রাহ্মসমাজেরই কিছু প্রভাবশালী মানুষের সাহায্যে এবং শিক্ষক শিবনাথ শাস্ত্রীর সাহায্যে তিনি আবার করে লেখাপড়া করার জন্য অর্থ সাহায্য পান, ব্রাহ্ম ছাত্রদের সঙ্গে ভাড়াবাড়িতে আশ্রয় পান। বিলেতে গিয়ে উচ্চ শিক্ষা লাভ করার স্বপ্ন প্রমদাচরণকে নিয়ে গেল সেণ্ট জেভিয়ার্স কলেজে। তিনি একই সাথে লাতিন ও ফরাসী ভাষা শিখতে শুরু করেন। প্রস্তুত হ'তে থাকেন গিলখ্রিস্ট পরীক্ষায় (সেই সময়ের মেধাবী ছাত্রদের একটি বিশেষ বৃত্তি পরীক্ষা) বসার জন্য। দুর্ভাগ্য দেখো, ১৮৭৮ সালে যখন প্রমদাচরণ অবশেষে এল এ পরীক্ষায় বসলেন, পরীক্ষার সময় খাতা দিতে দেরি হওয়ার জন্য পরীক্ষক ওনার খাতা ছিঁড়ে ফেলেন। আজ ভাবলে মনে হয় ভারতীয় ছাত্রদের প্রতি ঘৃণা এবং বৈষম্য ছাড়া হয়ত এ আর কিছুই নয়; কিন্তু প্রমদাচরণের আর এল এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া হ'ল না! এর ফলে, পরবর্তীকালে গিলখ্রিস্ট পরীক্ষায় তৃতীয়স্থান অধিকার করেও এল এ পাশ না করার জন্য মেধাবী প্রমদাচরণ বৃত্তি থেকে বঞ্চিত হলেন। লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয়তে আবেদন করেছিলেন বি এ পরীক্ষায় বসার অনুমতি চেয়ে, অথচ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি না পাওয়ায় ওনার আর বি এ পরীক্ষা দেওয়া হ'ল না। পড়াশুনো জীবনে নেমে এলো হতাশার মেঘ, অর্থাভাবে জীবন কাটাতে কাটাতেই লেখাপড়ার স্বপ্ন ভুলে চাকরির সন্ধান করতে শুরু করলেন প্রমদাচরণ।
চাকরির চেষ্টা করতে করতেই একসময় চব্বিশ পরগণার নকিপুর এন্ট্রান্স স্কুলে প্রধান শিক্ষক পদে তিনি মনোনীত হলেন। এখন বসে এই কথা পড়লে তোমরাও অবাক হবে যে বি এ পরীক্ষা দিতে না পারা, মানে বি এ পাশ না করা একজন মানুষ প্রধান শিক্ষক হিসেবে কী করে নিযুক্ত হন! কিন্তু ভেবে দেখো, তখন খুব সংখ্যক মানুষই কলেজে বা বিশ্ববিদ্যালয়তে গিয়ে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেতো। আর উচ্চশিক্ষিতরাই কেউই গ্রামেগঞ্জের স্কুলে বেশিদিন থাকতে চাইত না। এ ছাড়া ডিগ্রী যেমনই হোক, প্রমদাচরণ যোগ্য এবং পরিশ্রমী ছিলেন, না হলে এত অল্প বয়সে কেউ প্রধান শিক্ষকের মর্যাদা পেতে পারে? কিন্তু হতাশা তাঁর পিছু ছাড়ল না, নকিপুরের এই স্কুলটি কিছুকালের মধ্যেই বন্ধ হয়ে গেল। আবার তিনি ফিরে এলেন কলকাতায়, আশ্রয় নিলেন ৫০, সীতারাম ঘোষ স্ট্রীটের ব্রাহ্মসমাজ ভবনে। বর্তমানে কেশব চন্দ্র স্ট্রীট এর কাছেই। এই অঞ্চলটি ব্রাহ্মসমাজ আখড়া হয়ে উঠেছিল সেই যুগে। এইখানে থাকাকালীনই প্রমদাচরণের সঙ্গে পরিচয় এবং বন্ধুত্ব হয় ব্রাহ্মসমাজের অনেক প্রতিভাবান যুবকের সঙ্গে, যাঁরা পরবর্তীকালে স্বনামে বিশেষ সম্মান অর্জন করেন। তাঁদের কথা বলতে হলে প্রথমেই বলতে হয় উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর কথা। এ ছাড়াও ছিলেন গগনচন্দ্র হোম, হেমেন্দ্রমোহন বসু, মথুরানাথ নন্দী, এবং আরও অনেকে। স্কুলের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত কর্মজীবন এবং এই সীতারাম ঘোষ স্ট্রীটে থাকাকালীন অন্যান্য পরিবারের ছোটছোট ছেলেমেয়েদের দেখে প্রমদচারণ উপলব্ধি করতে শুরু করলেন যে আমাদের সমাজে শিশুমনের বিকাশের জন্যেও স্বচেষ্ট প্রয়াস প্রয়োজন, ওদের সুস্থ জীবন, সুস্থ মানসিকতা এবং সুস্বাস্থ্যের জন্য সংকল্প নিয়ে এগিয়ে আসার বিশেষ প্রয়োজন আছে। সেই সব ছোটছোট ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মিশতেই মিশতেই প্রমদাচরণ ছোটদের খুব ভাল বন্ধু হয়ে ওঠেন। জীবিকা, অর্থাভাব এবং ব্যক্তিগত জীবনের হতাশা সরিয়ে এই মিষ্টি কুঁড়িদের হাসিই একটা ঝলমলে রোদ্দুর হয়ে এসে পড়ে ওনার জীবনে। তিনি এমন ভাবে ছোটদের সঙ্গে গল্প করে, আনন্দ করে, খেলাধুলোর মাঝে তাদের সঙ্গে মিশে যেতে পারতেন, তাদের আনন্দ দিতে পারতেন... যে সেই সময়ের অনেকেই তাঁর এই গুণটির কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখ করেছেন। এক ভাবে বলা যায় শিশুমনকে চিনতে তাঁর মত ভাল হয়ত তাঁর আশেপাশে আর কেউ পারত না। আর এই সবের মধ্যেই তিনি ধীরে ধীরে নিজের মনে চিন্তা করতে থাকেন, ছোটদের জন্য কিছু করার... ভাল কিছু করার।
'সখা' পত্রিকার একটি পাতা
যতসামান্য যা অর্থ উপার্জন করতেন জীবিকা চালাতে, তার থেকে কিছুটা তিনি টাকা নিয়মিত ব্যয় করতেন ছোট ছেলেমেয়েদের জন্য। সেই সময়, অত বছর আগে (রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন পরিকল্পনার অত বছর আগে) উনি শিশুদের নিজস্ব পরিবেশ এবং মুক্ত বিদ্যালয়ের স্বপ্ন দেখতেন। 'নীতিবিদ্যালয়' নামের একটি ছোট স্কুল তিনি খোলার চেষ্টা করেন ছোটদের জন্য, যেখানে কেবল রবিবার করেই ছোটরা আসত একসাথে মজা, আনন্দ করতে করতে নতুন কিছু শিখতে। এই নীতিবিদ্যালয়ের জন্যে বা এই কাজের জন্যেই প্রমদাচরণ সকলের কাছে ইচ্ছা প্রকাশ করেন একটি ছোটদের মাসিক পত্রিকার কথা, যে পরিকল্পনা ছোটদের মুখে হাসি নিয়ে আসে 'সখা' পত্রিকা রূপে। সেই সময় শিবনাথ শাস্ত্রীর 'মুকুল' পত্রিকাটি প্রকাশিত হ'তে শুরু করেছে। এ ছাড়া 'অবোধবন্ধু' বা 'বালকবন্ধু'র মত অন্যান্য পত্রিকাগুলিও আত্মপ্রকাশ করেছে। মূলতঃ 'মুকুল' এবং তার বিন্যাস দ্বারা প্রভাবিত হয়েই প্রমদাচরণ 'সখা' পত্রিকার চিন্তা শুরু করেন। কিন্তু 'সখা'র নিজস্বতা ছিল অন্যরকম, একদম নতুন ধারায় তার উপস্থাপনা - যে কারণে বালক-বালিকাদের ভীষন প্রিয় একটি পত্রিকা হয়ে উঠতে পেরেছিল এত অল্পসময়ের মধ্যেই। কিন্তু দেখো মানুষটার কপাল, নিজের আর্থিক অবস্থার কারণে 'সখা' পত্রিকা চালাতে অন্যদের কাছে আর্থিক সাহায্য চেয়েছেন... কিন্তু পাননি। অবশেষে নিজের সঞ্চিত অর্থ ব্যয় করেই পত্রিকাটির কাজ শুরু করেন, মুদ্রিত হয় ব্রাহ্মসমাজের নিজস্ব প্রেস-এ। প্রমদাচরণে স্বপ্ন 'সখা', আলো দেখে ১৮৮৩ সালের ১লা জানুয়ারী, ইংরিজী নববর্ষের দিনে।
এরপর পত্রিকার সম্পাদক প্রমদাচরণ সেনের অক্লান্ত পরিশ্রমে 'সখা'র একের পর এক সংখ্যা প্রকাশিত হতে থাকে। চব্বিশ বছরের এক তরুণের এমন নিবেদিত প্রচেষ্টা দেখে কে না খুশি হবে? ক্রমে একে একে তাঁর বন্ধুরা পত্রিকার জন্য কিছু না কিছু করতে শুরু করলেন। উপেন্দ্রকিশোর লেখা দিতেন, ছবি ইলাস্ট্রেশন বা মুদ্রনের কাজ দেখতেন। বিপিনচন্দ্র পালের মত বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব লেখা দিয়েছেন এই পত্রিকায়। সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীকে নিয়ে লেখা তাঁর প্রবন্ধটি বলা চলে শিশু-কিশোর পত্রিকায় লেখা প্রথম রাজনৈতিক প্রবন্ধ। এ ছাড়া ব্যক্তিগত ভাবেও বিপিনচন্দ্র পাল খুব স্নেহ করতেন প্রমদাচরণকে, তা তাঁর নিজের লেখায় প্রমদাচরণ সম্পর্কে তাঁর মনোভাব থেকেও বোঝা যায়। 'সখা' পত্রিকাকে আকর্ষনীয় করে তুলতে বৈচিত্রময় বিভাগ দিয়ে সাজানো হয়। মুদ্রণের ক্ষেত্রেও চলতে থাকে উন্নতমানের এবং আধুনিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা। ছাপার হরফ, লেখার মাঝে ছবি ছাপানো এই সব কিছু নিয়ে এই যে গবেষণার মানসিকতা, 'সখা'র জন্য কাজ করতে করতেই উপেন্দ্রকিশোরের মনে এইসব কিছু দানা বাঁধতে থাকে, যা পরবর্তীকালে 'সন্দেশ' পত্রিকা শুরু করার সময় পূর্ণরূপ পায়। অল্প সময়ের মধ্যেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠা শিশু-কিশোরদের সাময়িক পত্রিকা 'সখা'য় চিঠিপত্র বিভাগ এলো। সম্পাদক নিজে প্রতিটি চিঠির সস্নেহে উত্তর দিতেন। কোথাও কোথাও সমালোচনা হলে (যা বোঝাই যেত বড় কেউ লিখে অভিযোগ জানিয়েছে), সেখানেও সকৌতুক উত্তর দিতেন প্রমদাচরণ। এই সখা পত্রিকাতেই ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ পেতে থাকে বাংলা সাহিত্যে প্রথম শিশু-উপন্যাস 'ভীমের কপাল', যা অনেক পরে বই হিসেবে প্রকাশ পায়। ভীম নামক একটি গ্রামের ছেলেকে নিয়েই এই ছোট উপন্যাসটি, যাকে আধুনিক সাহিত্যে হয়ত উপন্যাসিকাই বলা হবে - মানে, স্বল্প দৈর্ঘের উপন্যাস।
পত্রিকার কাজে অত্যধিক পরিশ্রম করতে করতেই প্রমদাচরণের শরীর ক্ষয় হ'তে থাকে। তার সঙ্গে ছিল দারুণ অর্থাভাব, নিজের চিকিৎসা বা পথ্যের মত টাকাও ওঁর হাতে থাকত না। এখন এই বিশেষ অংশগুলি নিয়ে চিন্তা করলে সমাজের চেহারাটা বুঝতে কষ্ট হয়। এত গুণী মানুষ, এত অবস্থাপন্ন বন্ধু-পরিচিত... কেউই কি পারতেন না অভাবী প্রমদাচরণকে সাহায্য করে তাঁকে একটা সুস্থ জীবন দিতে? কোনও ভাবেই কি সম্ভব ছিল না? নিজের সম্বন্ধে যতই উদাসীন হোক কেউ, যতই থাকুক আত্মাভিমান... বন্ধু হিসেবে পাশে থেকে কিছুই ঠিক করা যেত না? একদিকে ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সেবাশুশ্রূষার কথা, রাত জেগে উপেন্দ্রকিশোর, গগনচন্দ্র হোমরা অসুস্থ বন্ধু সেবা করেছেন এই কথাগুলো দেখি... আর একদিকে এই অভাব আর অতিরিক্ত অযত্নে ক্ষয় হয়ে যাওয়ার রূঢ় বাস্তব। এ কেমন করে মেলাবো বল তো? একদম বাল্যকাল থেকে জীবনের সঙ্গে সংঘর্ষ করে সমাজের মঙ্গলে ব্রতী মানুষটা মাত্র ছাব্বিশ বছর বয়সে ১৮৮৫ সালের ২১শে জুন আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। একটা প্রবল সম্ভাবনাময় জীবন শেষ হ'ল, এতগুলো স্বপ্ন একসাথে নিভে গেল তাঁর চোখ বোঁজার সঙ্গে সঙ্গে। শেষ সময়ে তিনি এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন যে তাঁকে খুলনায় তাঁর দাদার বাড়িতে রাখা হয়েছিল। ত্যাজ্যপুত্রটিকে তাঁর অন্তিম দশায় দেখে তাঁর বাবা এবং পরিবারের অন্যরা কী ভাবছিলেন, জানি না। সুকুমার রায়ের অকাল প্রয়াণের মত, প্রমদাচরনের অকাল প্রয়াণও বাংলা সাহিত্য এবং বাঙালী সমাজের কাছে একটি বড় ক্ষতি, এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই।
প্রমদাচরণ সেনের মৃত্যুর পরে 'সখা' পত্রিকায় প্রকাশিত শোক সংবাদ
প্রমদাচরণ চলে গেলেন, থেকে গেল তাঁর স্বপ্নের মাসিক পত্রিকা 'সখা'। তিন বছর সাফল্যের সঙ্গে সম্পাদনার কাজ চালানোর পর যখন প্রমদাচরণ সেনের অকাল মৃত্যু হয়, তখন তাঁর অবর্তমানে সাময়িক ভাবে সখার সম্পাদক হলেন শিবনাথ শাস্ত্রী (১৮৮৫ জুলাই থেকে ১৮৮৬)। ১৮৮৭ সাল থেকে 'সখা' পত্রিকা থেকে পরিচালনা করেন অন্নদাচরণ সেন। তাঁর পর দায়িত্ব নিলেন নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্য। এইভাবে এক একজনের সাময়িক সম্পাদনার দায়িত্বে হাতবদল হ'তে থাকলে কোনও ভাল পত্রিকাই বেশিদিন টেঁকে না। এত জনপ্রিয় পত্রিকা হওয়া সত্ত্বেও সখা একসময় বন্ধ হয়ে গেল, শেষ প্রকাশ ১৮৯০ সালে। এর প্রায় চার বছর পর ভুবনমোহন রায় ১৮৯৪ খ্রীষ্টাব্দে 'সাথী' নামে একটি নতুন পত্রিকা প্রকাশ করেন, এবং তার সঙ্গে 'সখা'র নামটি জুড়ে দেওয়ায় পরবর্তীকালে পত্রিকার নাম 'সখা ও সাথী' হয়ে যায়। এই নাম যুক্ত হওয়া দুটো জিনিস প্রমাণ করে -
১) সম্পাদক ভুবনমোহন বাবু 'সখা' পত্রিকাটিকে পছন্দ করতেন নিজে।
২) 'সখা' পত্রিকার জনপ্রিয়তা, যা এই নতুন পত্রিকাকেও সেই পাঠক-পাঠিকাদের কাছে জনপ্রিয় করে তুলতে পারে যার সখার একনিষ্ঠ ভক্ত ছিল।
সখা এখন অতীত, প্রমদাচরণ সেনের মত নিখাদ সোনার মনওয়ালা মানুষও এখন স্মৃতি। তবু আমরা মনে রাখব তাঁকে, মনে রাখতেই হবে। তুমিও জানবে যে এমন মানুষগুলো আমাদের মাঝে এসেছিলেন বলেই এত রকম প্রতিকূলতার মাঝে আমাদের জীবনে কিছু ভাল জিনিস এসেছে। কিছু মানুষ সত্যিই এসেছেন, এখনও আসেন আমাদের মাঝে, যাঁরা প্রমদাচরণ সেনের মত নিঃস্বার্থ ভাবে অন্যের মুখে হাসি ফোটানোর ব্রতেই ব্রতী থাকেন আজীবন!
ছবিঃ উইকিমিডিয়া কমন্স