সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
 স্বাধীনতার গল্পঃ দ্বিতীয় পর্যায়ঃ পর্ব ১ঃ ভারতীয় জাতীয়তাবাদ গড়ে ওঠার পটভূমি

আধুনিক ভারতবর্ষ বা ইন্ডিয়া বলে যে দেশটাতে আমরা বাস করি, সেটা গড়ে ওঠার দিকে একবার তাকিয়ে দেখি চল। এই দেশটা থেকে এখন প্রচুর সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার সারা পৃথিবী ব্যাপি কাজ করছে .এই দেশ থেকে আবার মঙ্গল গ্রহে রকেট গেল। কিন্তু ১৮৮০ র দশকে এ হেন দেশের কোন সন্মানজনক অস্তিত্ব ছিল না । এই বিরাট দেশটা ব্রিটিশ–ইন্ডিয়া বলে পৃথিবীর অন্য দেশের কাছে পরিচিত ছিল আর এখানকার মানুষ ছিল অত্যন্ত গরীব ,সুরক্ষাহীন।ভারতবর্ষ যে কোন দিন জাতীয়তাবাদী একটা শক্তি হিসাবে গড়ে উঠতে পারে সে নিয়ে ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ আর চিন্তাবিদরা ১৮৮০ দশকে ভাবতে পারেন নি। স্যার জন স্ট্রাচি কেম্ব্রিজের স্নাতক ছাত্রদের উদ্দেশে ১৮৮৮ সালে বক্তৃতাতে বলেন, " ভারত বলে কিছু নেই, কখন ও ছিল না, বা এমন কি ভারত বলে কোনো দেশ...... ভারতীয় জাতি বা 'ভারতীয় জনসাধারন' যাদের সমন্ধে আমরা এতো কিছু শুনি –তার কিছুই নেই। পাঞ্জাব, বাঙলা, উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ, ও মাদ্রাসের লোকেরা নিজেদের কখনো এক বিশাল ভারতীয় জাতির অংশ বলে ভাববে এমন ঘটা অসম্ভব।" এখানে উল্লেখ করার মতো বিষয় হল ১৮৮৫ সালে 'কংগ্রেস' এর প্রতিষ্ঠা হয়। তাহলে এই 'ভারতবর্ষ' বোধটা গড়ে উঠল কী করে? অজস্র ভাষা ,বিভিন্ন সংস্কৃতি, বিচিত্র খাদ্যাভাস, বিচিত্র প্রাকৃতিক রূপ নিয়ে গড়ে ওঠা এই বিশাল ভূখণ্ড কীভাবে আজ ইন্ডিয়া বলে একটা ক্রিকেট দল বিদেশে খেলতে পাঠায়?আরও বলার বিষয় হল দক্ষিন এশিয়ার একটা শক্তিশালী গণতন্ত্র হিসাবে সকলেই তাকে জানে।

আরও পেছনে যেতে হবে। সিপাহী বিদ্রোহের বিদ্রোহীদের চরম শাস্তি দিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আখের গোছাল বটে কিন্তু তার শাসন আর তার হাতে থাকলো না। ১৮৫৮ সাল ' An Act for the better Government of India' অনুযায়ী রানী ভিক্টোরিয়া হলেন আমাদের দেশের শাসক। প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর দেশটিকে শৃঙ্খলার সাথে 'শোষণ' করার জন্যে ব্রিটিশ সরকারের দরকার ছিল দক্ষ ভারতীয় শ্রমিক, সেনা, আর আমলা।খাদ্যহীন , স্বাস্থ্যহীন, ভারতীয়রা বিশ্বস্ত, ভীরু হওয়াতে শাসন ও শোষণ করতে খুব একটা কষ্ট ব্রিটিশ সরকারের হয়নি আরঐক্যবোধও তাদের ছিল না।রেলপথ, রাস্তা, বিভিন্ন নির্মাণ কাজের জন্যে প্রচুর শ্রমিক সহজ লভ্য ছিল। সেনাদলের উপযুক্ত সেনাও পাওয়া গেল। তারা কষ্ট সহিষ্ণু।তাদের পুরোনো যে শাসকরা ছিল, তাদের আর কোন অস্তিত্ব ছিল না।অতএব যত কম মাইনে দিক যত কষ্টই হোক ব্রিটিশ সরকার ছাড়া গতি নাই।সিপাহী বিদ্রোহের অভিজ্ঞতা থাকায় ঠিক কতটা কড়া হতে হবে সেটাও জানত ব্রিটিশ শাসক। এরসাথে প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল দক্ষ আমলা বা কেরানীকুলের। সেটা তৈরি করার জন্যে একটা সুচারু পরিকাঠামোর নির্মাণ করে ফেলে তারা। ইংরাজি শিক্ষা, আধুনিক বিদ্যালয়,কারিগরি বিদ্যালয় বিশ্ববিদ্যালয়, উপযুক্ত শিক্ষক এটা তারা তৈরি করেছিল নিজেদের প্রশাসনিক কাজকর্মের সুবিধার জন্যে। কিন্তু সেখানে ভারতীয়রা নিজেদের দক্ষতা দেখাতে শুরু করল। বাদামী চামড়ার এই 'নেটিভ'দের বুদ্ধি কিন্তু কম ছিল না। ( এই বিষয় নিয়ে পরে আরও বিশদে বলছি)

অনেক ব্রিটিশ ঐতিহাসিক মনে করেন ব্রিটিশরা যদি প্রশাসনিক ঐক্য, রেলপথ, বিশ্ববিদ্যালয় না তৈরি করতেন তাহলে এই মহার্ঘ্য ভারতীয় জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠত না। একই ধরনের শাসন সারা দেশের জন্যে প্রযুক্ত হওয়াতে সকলে এক শাসনের নিচে এলো, রেলপথ দূরত্ব কমিয়ে দিল, আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ভাষায় শিক্ষিত মানুষেরা বিচিত্র সংস্কৃতি সত্বেও কোথাও একটা বৌদ্ধিক ঐক্য খুঁজে পেল। কিন্তু আধুনিক ঐতিহাসিকদের মতে ভারতীয় দের এই 'জাতীয়তাবাদী' জাগরণ ব্রিটিশসরকারের সদাশয়তার জন্যে গড়ে ওঠেনি। তারা যে 'Divide and Rule' অর্থাৎ ভেদনীতিতেই অনৈক্য বজায় রাখতে চেয়েছিল, সে বিষয়ে কোন ভুল নেই।

প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়
প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়

এখন যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি 'প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়' নামে বিখ্যাত সেটি 'হিন্দু কলেজ' নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৮১৭ সালে। রাজা রামমোহন রায়, রাজা রাধাকান্ত দেব, ডেভিড হেয়ার, রানী রাসমনি, বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়, রসময় দত্ত,স্যার এডওয়ার্ড হাইড ইস্ট এর দানের টাকায় এই প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
শিল্পীর তুলিতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়

১৮৫৭ সালের জানুয়ারি মাসে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়, তৎকালীন এশিয়ার সম্ভবত প্রথম এই ধরনের ধর্ম নিরপেক্ষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।এরপর মাদ্রাস ও বোম্বাই তেও একই রকম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। ব্রিটিশদের মধ্যে অযোগ্য,অদক্ষ এবং অশিক্ষিত 'নেটিভ' দের উপযুক্ত করে তোলার চেষ্টা ছিল।তবে এটাও ঠিক একদিকে ব্রিটিশ শাসন যেমন ভারতবর্ষ কে শাসনের ক্ষেত্র হিসেবে দেখছে তেমনি বেশ কিছু মননশীল ব্রিটিশ ব্যক্তিত্ব কিন্তু শিক্ষা বিস্তার আর এই দেশের আধুনিকিকরণে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। 'ধর্ম নিরপেক্ষ' শিক্ষা ব্যাবস্থা হলেও মূলত বাঙালী হিন্দুরা এখানে পড়তে আসত। মুসলিম সমাজ সিপাহী বিদ্রোহের মানসিক ধাক্কাটা কাটিয়ে, তখনও এই আধুনিক শিক্ষা ব্যাবস্থাকে বিশ্বাস করতে পারেনি। কেরানী, উকিল, আমলা ইত্যাদি চাকরী পেতে গেলে 'রাজভাষা' ইংরেজি জানা আবশ্যক ছিল। তাই আধুনিক ব্রিটিশ পরিচালিত বিদ্যালয়ে 'নেটিভ' রা পড়তে শুরু করে।১৮৮০ সালে ইংরেজি জানা ভারতীয়দের সংখ্যা পঞ্চাশ হাজারের বেশী। ১৮৮৭ সালে সেটা বেড়ে দাঁড়ায় দু লাখ আটানব্বই হাজার। ১৮৮৫ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস যখন গড়ে উঠল তখন ইংরেজি সংবাদ পত্রের পাঠক নব্বই হাজার। এইসময় প্রেসিডেন্সী কলেজে যারা পড়তে আসতো তার বেশীরভাগ শহরের উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলেরা। কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে ৫% মেধাবী,নিম্ন মধ্যবিত্ত ও গ্রামবাঙলা থেকে আসা ছাত্র ছিল।এটা অবশ্যই মানতে হবে আধুনিক পরিকাঠামোতে মেধাবী ভারতীয়রা তাদের নিজেদের খুব ভাল ভাবে প্রকাশিত করতে সক্ষম হয়ে ছিল। আর তার প্রকৃষ্ট নিদর্শন হলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।

(ক্রমশঃ)

ছবিঃ উইকিপিডিয়া, ইন্ডিয়াজোন
গ্রাফিক্সঃ মহাশ্বেতা রায়

এই ধারাবাহিকের প্রথম পর্যায়ের সমস্ত নিবন্ধগুলি এই লিঙ্কে ঃ
ধারাবাহিকঃ স্বাধীনতার গল্প

খুব ছোট থেকে পড়তে ভালবাসেন। তার থেকেই লেখা শুরু। ছোটদের জন্যে কিছু লেখা সব চেয়ে কঠিন। একটু চেষ্টা করছেন লিখতে।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা