সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
স্বাধীনতার গল্পঃ দ্বিতীয় পর্যায়ঃ পর্ব ২ঃ অবশিল্পায়ন


ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের সুত্রপাতে যে খারাপ জিনিস গুলো শুরু হতে লাগল তার মধ্যে প্রধান হল ভারতবর্ষের উৎকৃষ্ট কুটির শিল্প নষ্ট হয়ে যাওয়া।এই অবশিল্পায়ন হবার কারণ নিয়ে নানান মত বিরোধ আছে।গবেষক রা সব দিক নিয়ে নানান আলোচনা করেছেন।

'ট্রেড রিলেশন বিটুইন ইংল্যান্ড ও ইন্ডিয়া' গ্রন্থে হ্যামিল্টন (C. J. Hamilton ) বলছেন, যন্ত্র চালিত সস্তা, উন্নত মানের পণ্যের সাথে প্রতিযোগিতায় ভারতীয় হস্তশিল্প ইতিহাসের নিয়মেই ভেঙ্গে পড়ে। এজন্যে ব্রিটিশ সরকার কে দোষ দেওয়া উচিৎ নয়। কিন্তু রমেশ চন্দ্র দত্তের মতে, ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় উৎপাদকদের নিরুৎসাহিত করার ফলেই ভারতীয় শিল্প ধবংস হয়। সোজা ভাবে বললে বিপদগ্রস্ত কারিগর ও কুটির শিল্পী দের যে রক্ষা কবচ দেওয়া উচিৎ ছিল কোম্পানির শাসন তা দেয়নি। পরবর্তী কালে ব্রিটিশ সরকার ও কিছু করেনি। কী কারণে ভারতীয় শিল্প ভেঙ্গে পড়েছিল সেগুলো পর্যালোচনা করতে গেলে দেখা যায়-

ব্রিটিশ ঐতিহাসিকদের দৃষ্টিভঙ্গী থেকে দেখলে

- মুঘল শাসনের শেষ দিকে নানান রাজনৈতিক দোলাচল থাকায় শিল্প উপযোগী পরিবেশ নষ্ট হয়।

- বর্গী আক্রমণে বাংলার তাঁতিরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বণিকদের অনেক আর্থিক ক্ষতি হয়। পণ্য পরিবহন সুরক্ষিত না থাকায় ব্যবসার অবনতি ঘটে।

- ছিয়াত্তরের মন্মন্তরে প্রচুর মানুষ মারা যায়। সেইজন্যে তাঁতি ও কারিগর রা তাদের শিল্প চালিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম ছিল না।

- ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যে সব গোমস্তা ও কর্মচারীদের নিয়োগ করেছিল তারা খুব অত্যাচারী ছিল। তাঁদের শোষণে বস্ত্রশিল্প ধংস প্রাপ্ত হয়।

১৮৪৮ সালে কলকাতা বন্দর
শিল্পীর তুলিতে ১৮৪৮ সালে কলকাতা বন্দর

আবার নোল্‌স্‌(Lilian Knowles ) তাঁর গ্রন্থ 'The Economic development of British Overseas Empire' তে লিখছেন, ভারতীয় বস্ত্রের বাজার ছিল দূর প্রাচ্যে, জাপান, চীন,বার্মা, থেকে মধ্য এশিয়ার পারস্য, আরব দেশ ও ইউরোপে বিস্তৃত। নোল্‌স্‌ বলতে চাইছেন, ব্রিটেনের বাজার চলে গেলে তেমন কিছু ক্ষতি হওয়ার কথা নয়।কিন্তু ভারতীয় গবেষকরা এই যুক্তি গুলি মেনে নিতে রাজি নন।ছিয়াত্তরের মন্মন্তর ও বর্গী আক্রমণের মতো সাময়িক বিপদগুলো সহ্য করেও,ভারতীয় শিল্প হয়ত আবার ঘুরে দাঁড়াত। কিন্তু অন্য আরও কিছু কারণ ছিল।

১ । ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় বস্ত্রের আমদানির ওপর চড়া হারে ট্যাক্স বসান। ১৭৯৭ সালে ভারতীয় মসলিনের ওপর ১৮% ট্যাক্স, সেই ট্যাক্স ১৮০৫ সালে বেড়ে হয় ৬৬%। এর ফলে মসলিন আর সাধারণ ভোগ্য থাকে না। যারা ইংল্যান্ডে বিক্রি করত তাদের কিছু লাভ থাকলেও, যারা মসলিনের কারিগর বা ভারতীয় বিক্রেতাদের হাতে খুব একটা কিছু আসত বলে মনে হয় না।

২। ভারতীয় উপনিবেশ থেকে প্রচুর অর্থের আমদানি করার ফলে ইংল্যান্ড তথা ইউরোপে যান্ত্রিক আর প্রযুক্তি গত উন্নতি হতে থাকে। এই প্রবল যন্ত্রশক্তির সাথে বাংলার হাতে বোনা তাঁতের টিঁকে ওঠা দুষ্কর হয়। এই হাতে বোনা উৎকৃষ্ট শিল্পটিকে আদৌ বাঁচাতে চাওয়া হয়নি,অথচ উচিৎ ছিল। ভারতবর্ষ থেকে প্রথম দিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, পরে ব্রিটিশ রাজ ( অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে) সম্পদ ইংল্যান্ডে নিয়ে চলে যেতে থাকে।

মহার্ঘ মসলিনের পোষাকে ফ্রান্সের রানী মারি আতোঁয়ানেত, ১৭৮৩ সালে আঁকা ছবি

৪।নোল্‌স্‌-এর মতটি গ্রহণ করা যায় না। কারণ ,ব্রিটেন ভারতের একমাত্র ভারতীয় বস্ত্রের বাজার ছিল না ,এটা সত্য ।তেমনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন স্থাপন হবার পর, ভারতীয় বহির্বাণিজ্য একচেটিয়া কোম্পানির হাতে চলে আসে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অন্য কোন সংস্থা কে সুযোগ না দিয়ে Re-exportবা পুনঃরপ্তানি করত। পদ্ধতিটা ছিল এই রকম, কোম্পানি ভারতীয় মাল খরিদ করে ব্রিটেনে পাঠাতো। সেখানকার বনিকরা সেই মাল ইউরোপে রপ্তানি করতো। ইংল্যান্ডের আইনে অন্য কোম্পানি সরাসরি তা করতে পারত না। ভারত থেকে আগত বস্ত্রের ওপর চড়া শুল্কের কারণ ছিল –ইংল্যান্ডের বস্ত্র উৎপাদনকে বাঁচানোর শুল্ক প্রাচীর। চড়া শুল্কের ফলে দুর্মূল্য মসলিন আর কাপাস বস্ত্র আন্তর্জাতিক বাজার হারিয়ে ফেলে। ভারত ধীরে ধীরে পাট, তুলা, নীল, গন্ধক উৎপাদনকারী দেশে পরিণত হয়। উইলসন (William Wilson Hunter) তাঁর ,'History of India' গ্রন্থে বলছেন, যদি ভারতীয় বস্ত্রের ওপর চড়া হারে শুল্ক এবং আমদানির ওপর নিষেধ জারী না আরোপ হত, তাহলে ম্যাঞ্চেস্টারের বস্ত্রকলগুলি চালু থাকত না।


প্রাচীন নকশা এবং বুনন পদ্ধতি মেনে তৈরি আজকের মসলিন জামদানি শাড়ি

ভারতীয় হস্তশিল্পের শেষমেষ পরাজয় হত একথা বলা যায় না। সমর কুমার মল্লিক তাঁর 'আধুনিক ভারতের দেড়শ বছর' গ্রন্থে লিখছেন,

'…বস্তুত উৎপাদন ব্যবসার বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনার জন্যেই বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের প্রয়োজন অনুভুত হয়েছিল।সুতরাং এটা বলা ঠিক হবে না যে, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের জন্যেই শিল্প বিপ্লব হয়ে ছিল। যাই হোক শিল্প বিপ্লবের ফলে ইংল্যান্ডের সমাজ ও অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত হয় এবং ভারতের সাথে ইংল্যান্ডের বাণিজ্যিক সম্পর্কের রূপান্তর ঘটে।'

তাঁর এই বই থেকে আরও কিছু তথ্য পাচ্ছি আমরা-

১। ইংল্যান্ডের পুঁজিপতি, শিল্পপতিদের সাথে কোম্পানির সংঘাত হয়েছিল। মিল মালিকেরা চাইছিল ভারতের বাজার উন্মুক্ত হোক।অন্যদিকে কোম্পানির সমৃদ্ধি দাঁড়িয়ে ছিল ভারত থেকে নিয়ে যাওয়া সুতী বস্ত্রের উপর। তাই সংঘর্ষ অনিবার্য ছিল। ১৭৮৮ থেকে ১৭৯৩- এর পরে অবস্থা পরিবর্তন হল। কোম্পানিকে পিছু হটতে হল।

২। ১৭৯৩ সাল থেকে ইংল্যান্ডের সাথে ফ্রান্সের একটা যুদ্ধ শুরু হল। নেপোলিয়ান-এর করা 'মহাদেশীয় অবরোধ' প্রথার জন্যে ইংল্যান্ড ইউরোপে আর রপ্তানি করতে পারছিল না। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির খারাপ সময় এলো। তখন ভারতীয় বস্ত্র একেবারে ইউরোপের বাজার থেকে অদৃশ্য হয়নি। কিন্তু শুরু হয়ে গিয়েছিল।

৩। ১৭৯৫ সালে বাংলা থেকে ইউরোপে রপ্তানি হয় ৪৭,৩২,৫৪৫ টাকা। ১৭৯৭ সালে তাঁর পরিমাণ কমে দাঁড়ায় ১৮, ৫৮, ১৩৫ টাকায়।

উনবিংশ শতকের গোড়ায় এই ভাবে ইউরোপে ভারতীয় বস্ত্রের বিক্রি সম্পূর্ণ মুছে যায়।

এই অবশিল্পায়নের ফলে ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনে সুদুর প্রসারী প্রভাব পড়ে।

- হস্তশিল্পের কারিগর, শিল্পীরা কর্মহীন অর্থহীন হয়ে পড়ে। ভারতীয় সমাজ সম্পূর্ণ ভাবে কৃষি নির্ভর সমাজে পরিণত হয়।

- সাধারণ মানুষের হাতে শিল্প থেকে আয় করা যে মূলধন থাকত তা নষ্ট হবার ফলে সমাজ স্বয়ম্ভরতা হারায়।

- ভারতের তুলো ইংল্যান্ড থেকে কাপড় হয়ে এদেশে এসে ব্যবসা করে। ভারতবর্ষ ইংল্যান্ডের বাজার হিসাবে তৈরি হয়। অফুরান মুনাফাতে ইংল্যান্ড আরো ধনী হয়ে উঠতে থাকে। ডঃ তারাচাঁদের মতে ভারত ব্রিটিশের অর্থনৈতিক দাসে পরিণত হয়।

এই প্রসঙ্গে উল্লেখ না করলেই নয়, ভারত সরকারের কর্তৃক নিযুক্ত শিল্প কমিশন তাঁদের রিপোর্টে মন্তব্য করেন যে, 'যে যুগে আধুনিক শিল্পের জন্মভুমি পশ্চিম ইউরোপ ছিল অনুন্নত জাতি গোষ্ঠীর বাসভুমি, ভারতবর্ষ তখন তার শাসকদের সম্পদের জন্য ও ভারতীয় কারিগরদের উন্নত মানের শিল্প দ্রব্য উৎপাদনে দক্ষতার জন্যে বিশ্বে খ্যাতি ভোগ করত।'

ছবিঃ উইকিপিডিয়া
সাদা জামদানি মসলিন শাড়ির ছবি সৌজন্যেঃ সুতাইরা, DW Studios

সূত্র ছবিঃ যেভাবে তোলা হয় জামদানি শাড়ির নকশা

খুব ছোট থেকে পড়তে ভালবাসেন। তার থেকেই লেখা শুরু। ছোটদের জন্যে কিছু লেখা সব চেয়ে কঠিন। একটু চেষ্টা করছেন লিখতে।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা