বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনটি বিরাট সম্ভাবনা নিয়ে শুরু হলেও তা বিফল হয়। ইতিহাস গবেষকরা এর চুল চেরা বিশ্লেষণ করে দেখিয়ে দিয়েছেন কারণগুলি।
আন্দোলনের প্রথম অবস্থায় তীব্রভাবে কার্জনের শাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেও ,ধীর ভাবে তা গতিবেগ হারিয়ে ফেলে। ‘Extremist challenge’ গ্রন্থে অমলেশ ত্রিপাঠী বলেছেন, 'The movement began with a bang and ended with a whimper'.
যে কারণ অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে সামনে আসে সে গুলি হল,
প্রথমতঃ আন্দোলনের সাংগঠনিক দুর্বলতা।
দ্বিতীয়তঃ নেতাদের আদর্শবাদের সীমাবদ্ধতা।
তৃতীয়তঃ ভারতীয় ব্যবসার অতি মাত্রায় বিদেশি নির্ভরতা
চতুর্থতঃ সরকারের দমন নীতি
ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত
যে সমিতিগুলি স্বদেশী আন্দোলন পরিচালনা করার জন্যে তৈরি হয়েছিল সেগুলোর নেতারা ছিলেন ভদ্রলোক শ্রেণীর।যেমন স্বদেশ বান্ধব সমিতির ৭৩ জন কর্মকর্তার মধ্যে- জমিদার- ৭ জন,উকিল- ১৯ জন, শিক্ষক -১৫ জন। সুমিত সরকার লিখছেন, 'বাংলার এই আন্দোলনে অচিরেই মাথাচাড়া দিল অভ্যন্তরীণ মতভেদ।কারো কারো কাছে বয়কট হয়ে উঠল পুরো একসার নতুন পদ্ধতি স্থির করার সূচনা। ধরে নেওয়া হল বঙ্গভঙ্গ প্রত্যাহার মানে ‘সমস্ত রাজনৈতিক লক্ষ্যের মধ্যে ক্ষুদ্রতম ও সংকীর্ণ তম উদ্দেশ্যের বেশী কিছু নয়।’- যা স্বরাজ বা পূর্ণ স্বাধীনতার সংগ্রামে একটি ধাপ মাত্র' । এই মতবাদটি অরবিন্দ ঘোষের। সুরেন্দ্রনাথের কাছে 'বয়কট ছিল ম্যাঞ্চেস্টারের টাকার থলির বাঁধন দড়িতে টান মেরে বঙ্গভঙ্গ রদ করার শেষ মরিয়া প্রয়াস।' এসব ত্বাত্তিক মতবিরোধে গতি আর অভিমুখ হারিয়ে যাচ্ছিল। এই দুর্বলতার সাথে যুক্ত হয়ে ছিল ভারতবর্ষের হিন্দু –মুসলমান এর চিরকালীন একের প্রতি অন্যের প্রবল অবিশ্বাস জনিত ‘সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা’। 'এই ব্যাপার আমাদের পক্ষে যতই একান্ত কষ্টকর হউক, কিন্তু আমাদের এই শিক্ষার প্রয়োজন ছিল। এ কথা আমাদের সম্পূর্ণ নিশ্চিতরূপেই জানা আবশ্যক ছিল, আমাদের দেশে হিন্দু ও মুসলমান যে পৃথক এই বাস্তবটিকে বিস্মৃত হইয়া আমরা যে কাজ করিতেই যাই-না কেন,এই বাস্তবটি আমাদিগকে কখনোই বিস্মৃত হইবে না।' --- ‘রাজা প্রজা’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ এটা লিখলেন। ‘গোরা’ আর ‘ঘরে বাইরে’তে সবল কলমে জানালেন সমস্যার আসল দিক। লিখে গেলেন, '… শনি তো ছিদ্র না পাইলে প্রবেশ করিতে পারে না, অতএব শনির চেয়ে ছিদ্র সম্বন্ধেই সাবধানতা দরকার।' ১৯০৭ এর পূর্ব বাংলায় দাঙ্গার পর আন্দোলন থেকে সরে এলেন রবীন্দ্রনাথ।
যাই হোক এতো তিক্ততা থাকা সত্বেও কিছু বিষয় একটু অবাক করে বৈকি ।
যেমন শিবাষীস বসু বসু 'বয়কট আন্দোলন : ফিরে দেখা' প্রবন্ধে লিখেছেন, '... স্পষ্টতই, বাঙালী ঐক্যবোধের বিষয়টি এই ধরণের ঐতিহাসিকরা উপেক্ষা করেছেন। আবার একইভাবে বিদেশী পণ্য বর্জনের ফলে লাভ হয়েছিল পূর্ববঙ্গের মুসলমান তাঁতিদেরই, ম্যাঞ্চেস্টারের কাপড়ের আধিক্যে যাদের ব্যবসা লাটে উঠতে বসেছিল। ঠিক এই কথাটিই ১৯০৬ সালের ১৪ই এপ্রিল বরিশালে আয়োজিত বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনের সভাপতির ভাষণে বলেছিলেন আবদুল রসুল — "কোনো কোনো মুসলমান নেতা দলস্থ মুসলমানদের মধ্যে প্রচার করছেন যে, ইহা একটি হিন্দু আন্দোলন এবং সেই কারণে 'ডিসলয়্যাল'। আমি বলি, নেতাদের বাক্য অভ্রান্ত সত্য বলে মেনে না নিয়ে যদি তারা নিজেদের মনে একটু চিন্তা করে দেখে তাহলেই বুঝতে পারবে যে, হিন্দুগণ অপেক্ষা এই আন্দোলনে মুসলমানদের উপকার হচ্ছে বেশী। কোনো মুসলমান একথা কি অস্বীকার করতে পারবে যে, স্বদেশী আন্দোলনে দেশের বয়ন-শিল্পের যে উন্নতি হয়েছে, তাতে মুসলমান তাঁতিগণ উপকৃত হচ্ছে না? একথা কি কেউ অস্বীকার করতে পারবে যে, কলিকাতার বহু দরিদ্র মুসলমান পরিবার, যারা এতদিন অনাহারে মারা পড়ছিল, তারা এক্ষণে বিড়ি শিল্পের উন্নয়নে ভালোভাবে জীবিকা উপায় করছে না?" স্পষ্টতই, ব্রিটিশদের ভেদনীতি এবং ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহের হিন্দু বিদ্বেষের কথা চিন্তা করেই রসুলসাহেব এই বক্তব্য রেখেছিলেন। যাঁরা বোঝার, তাঁরা ঠিকই বুঝেছিলেন — 'নবনূর' পত্রিকায় প্রকাশিত 'স্বদেশানুরাগ' প্রবন্ধে খায়রন্নেসা খাতুন ডাক দিয়েছিলেন, 'ভগ্নীগণ, আইস, আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হইয়া বিদেশী সাড়ি পরিত্যাগ করি ; বিলাতি বডিজ, সেমিজ ও মোজা ইত্যাদি ঘৃণার চক্ষে দেখি ... তবে আমরা স্বদেশের উপকার করিতে পারিব ... গরীব তন্তুবায় ও শ্রমজীবীরা খাটিয়া দুইটা শাক-অন্নের সংস্থান করিয়া লইতে পারিবে।'
কৃষ্ণ কুমার মিত্র
এ আন্দোলনের সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু স্বদেশী আন্দোলনকে জনমুখী করার জন্যে এর সঙ্গে অর্থনৈতিক আন্দোলন যুক্ত করা উচিত ছিল। সে সময় সাধারণ কৃষক শ্রেণী দুরবস্থার শেষ ছিল না। খাজনার প্রবল চাপ, জমিদারদের অত্যাচার। এই ধরণের আসল সমস্যাগুলোকে আলোচনার বিষয় করা হয়নি। সাধারণ মানুষের কষ্ট আর সমস্যা থেকে নেতারা অনেক দূরে অবস্থান করছিলেন। বয়কট আন্দোলন : ফিরে দেখা প্রবন্ধে বলছেন,
'… ৫ই নভেম্বর ১৯০৫, বরিশালের 'বিকাশ' সাপ্তাহিক 'জারী গানে দেশের কথা' শীর্ষক সংবাদে লিখেছিল, 'এ জেলায় 'জারী' নামক একপ্রকার গান আছে। নিম্ন শ্রেণীর লোকেদের মধ্যে এই গান বিশেষ আদরের। আলাম, আকুব্বর এবং মফেজদ্দী নামক তিনজন মুসলমান তিন দল জারীর নেতা। এই জারী গান এদেশের প্রায় সকল প্রসিদ্ধ স্থানেই হইয়া থাকে এবং সকলে, বিশেষত মুসলমান ভ্রাতাগণ, অতি আগ্রহ সহকারে তাহা শুনিয়া থাকেন। উক্ত তিন দলের জারীতেই এবার দেশের কথা গীত হইতেছে। পুলিশ লাইনে কালীপূজা উপলক্ষে প্রায় প্রত্যেক বৎসরই জারীগান হইয়া থাকে, এ বৎসরেও দুইদিন হইয়াছিল। শেষদিন রাত্রে পুলিশ লাইনে তিন দলেই বিদেশী বর্জন ও স্বদেশী গ্রহণ সম্বন্ধে অনেক গান হয়। ... আলাম, আকুব্বর বা মফেজদ্দী কেহই শিক্ষিত নহে। সরল ভাষায় এই সমস্ত গায়কগণ যে গানগুলি গাহিয়াছে তাহা শুনিয়া অনেকে অশ্রু সম্বরণ করিতে পারেন নাই। বাকরগঞ্জের গ্রামে গ্রামে কৃষকগণ এক্ষণ এই সমস্ত গান গাহিতে আরম্ভ করিয়াছে।''
স্বদেশী আন্দোলন অতি দ্রুত চরমপন্থী দিকে বাঁক নেয়। যার ফলে সাধারণ মানুষের সাথে তার যোগাযোগ কমে যায়। দেশপ্রেম, ত্যাগ সব কিছু অতি মাত্রায় থাকলেও সাধারণ মানুষের পক্ষে এই ‘চরমপন্থা’ সাধারণ জীবনের সাথে গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি।
সুমিত সরকার মতে , মধ্যবিত্ত মানুষ এই আন্দোলনের সাথে থাকলেও ধনী ব্যবসায়ীদের সহায়তা ছাড়া বিলাতি মালের বয়কট সফল হওয়া সম্ভব না। মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীদের সাথে ম্যাঞ্চেস্টারের মাল সরবরাহ করা কোম্পানি গুলির বিরোধিতা চলছিল। ১৯০৫ সাথে তাই আমদানি কমিয়ে দেওয়া হয়। পরবর্তী কালে সেই বিরোধ মিটে যাবার সাথে সাথে আবার আমদানি বাড়তে থাকে। বিলাতি দ্রব্য বয়কট করার জন্যে যে পরিকাঠামোর দরকার তা ছিল না। ভারতীয় বস্ত্র ব্যবসা তৈরি ছিল না ভারতের বিরাট বাজারের চাহিদা মেটানোর জন্যে। বোম্বাইয়ের মিলের কাপড় খুব উৎকৃষ্ট ছিল না। আর তার দাম ছিল ম্যানচেস্টারের দামের চেয়ে অনেক বেশী। পূর্ববঙ্গে একটি দাঙ্গার কারণ হিসাবে বলা হয়, গরীব মুসলিম চাষীদের পক্ষে বয়কট আন্দোলন মেনে চলা অসুবিধা হচ্ছিল। ভারতবর্ষ ‘স্বনির্ভর’ হয়ে ওঠা তখনও স্বপ্নের মধ্যে বিচরণ করছে।শুধু ব্যবসা নয়,শিক্ষা ক্ষেত্র প্রস্তুত ছিল না। ব্রিটিশদের তৈরি শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে অনেকে তাদের সন্তান কে জাতীয় শিক্ষালয়ে ভর্তি করেছিলেন।
কিন্তু তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে না পড়লে তো চাকরি পাওয়া যাবে না। তাই স্বাভাবিক ভাবেই পুনরায় ‘ইংরেজের গোলাম খানায়’ শিক্ষার্থীরা ভর্তি হল।
‘Extremist challenge’ গ্রন্থে অমলেশ ত্রিপাঠী লিখেছেন, স্বেচ্ছাসেবকেরা বেশীদিন পুলিশী নিগ্রহ সহ্য করতে পারেনি। এল কার্লাইল সার্কুলার,যেখানে জানানো হল, 'If any college violates the government order and the student quits the educational institution then no assistance will be provided by the government to the institute'। ফাঁসি, কারাদণ্ড,দ্বীপান্তর,অকারণ মামলা,পিউনিটিভ ট্যাক্স, সম্পত্তি ক্রোক প্রভৃতির মাধ্যমে আন্দোলনের মস্তিস্ক ভেঙ্গে ফেলা হয়। অধ্যাপক সুশোভন সরকার দেখিয়েছেন, বাংলার চরমপন্থী মতবাদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা যথাক্রমে, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত ত, বিপিন পাল, কৃষ্ণ কুমার মিত্র সকলেই কারাদণ্ডে দন্ডিত ও নির্বাসিত হন। ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় বিচার চলাকালীন মারা যান। অরবিন্দ ঘোষ আদালত থেকে মুক্তি পান। এছাড়া সর্ব ভারতীয় স্তরে তিলক,লালা লাজপত রায় ও অজিত সিং এর কারাদণ্ড হয়।
এভাবেই বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন বিফল হলেও ‘স্বাধীন হতে হবে’এই বোধটি জাগিয়ে তুলে পরবর্তী দিনের জন্যে জমি তৈরি করে।
ছবিঃ উইকিপিডিয়া