সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
প্রাচীন ভারতের মুদ্রা

কিছুদিন আগেই কী হইহই-রইরই না গেল! ভারত সরকারের উদ্যোগে 'ডিমনিটাইজেশন' -এর সিদ্ধান্তে বাজার থেকে কয়েকদিনের মধ্যে তুলে নেওয়া হল যত পুরনো পাঁচশো আর হাজার টাকার নোট। তার বদলে কিছুদিনের মধ্যে এসে গেল নতুন চেহারার পাঁচশো টাকা আর দুই হাজার টাকার নোট। ওদিকে বেশ কিছু দশ টাকার মুদ্রাকে 'জাল' বলে আতঙ্ক ছড়াচ্ছিল কিছু দুষ্টু লোক। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তরফ থেকে নোটিস দিয়ে সবাইকে বলা হল যে সেরকম কিছুই নয়, সব দশ টাকার মুদ্রাগুলোই সচল।

এইসব দেখতে দেখতে মনে হতেই পারে- এইরকম সব মুদ্রা ব্যবস্থা এল কোথা থেকে আর কেনই বা এল? এস, তার উত্তর একটু খুঁজে দেখার চেষ্টা করি।

'বিনিময় প্রথা'- ওটাই ছিল আধুনিক অর্থনীতির প্রথম প্রয়াস।তোমার কাছে যেটা বেশী আছে আমার কাছে সেটা নেই।আমার কাছে যেটা হেলা ফেলায় নষ্ট হচ্ছে সেটা তোমার খুব প্রয়োজন। আমার মুলোটার বদলে তোমার মুরগির ডিম।গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষেরা এইভাবেই নিজেদের প্রয়োজন মেটাত।কিন্তু সেটা বেশিদিন খুব সহজ ব্যবস্থা রইল না। কেন, সেটা বলি। ধর , পুরাণের গল্পগুলি পড়লে, মুনি ঋষি দের যজ্ঞে গরু দান করার যে সব গল্প পাওয়া যায় তা থেকে সহজেই বোঝা যায় গরু সম্পদের মতো ভাবা ও ব্যবহার হত। কিন্তু, এখন যদি গরু টাকার বদলে ব্যবহার হত ? তাহলে তো হিমসিম অবস্থা হত! বাবা অফিস থেকে চারটে গরু নিয়ে এলো। বন্ধুর জন্মদিনে গরু উপহার দেওয়া হবে।তাই গরুকে খুব করে চান করাতে হবে। ট্যাক্স জমা দেবার লাইনে সব্বাই একটা করে গরু ধরে নিয়ে আছে। ভেবে দেখ কী কান্ডই না হত !তবে কোন কোন ক্ষেত্রে ধান ও বিনিময়ের একক ছিল। সেটা ভারত স্বাধীন হবার আগেও অনেক জায়গায় ছিল। বোঝাই যাচ্ছে, এইভাবে বেশিদিন কাজ চলা সম্ভব ছিল না; তাই কোন না কোন সময়ে হিসাব সহজে রাখার জন্য মুদ্রার ব্যবহার মানুষ শুরু করে।

ভারতবর্ষে প্রথম কবে মুদ্রার ব্যবহার হতে শুরু হল সেটা এখনও জানা নেই। বহু শিলালিপি, পুরনো সাহিত্য, ধ্বংসাবশেষ থেকে যে তথ্য গুলো পাওয়া যায় তার থেকে ভারতবর্ষের মুদ্রার ইতিহাস তৈরি করার চেষ্টা করা হয় মাত্র।যে সময় বেদ রচনা হচ্ছে*, তখন আদৌ কোন মুদ্রার ব্যবহার ছিল কিনা তা নিয়ে বিস্তর জল্পনা কল্পনা রয়েছে।এটা জানা যায়,গরুকে মূল্যের একক ধরা হত।'নিষ্কর' বলে একটি শব্দ সেকালের সাহিত্যে পাওয়া যেত। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন ওটা আসলে 'স্বর্ণমুদ্রা'। কিন্তু এর বাস্তব উপস্থিতি নেই। তাই এই তত্ব মেনে নেওয়া হয় না।

প্রাচীন ভারতের মুদ্রা
মগধ সাম্রাজ্যের কর্ষপণ

প্রাচীন ভারতে মুদ্রা ব্যবহারের একটি প্রামানিক তথ্য পাওয়া গেছে হেরডোটাসের* রচনা থেকে । উত্তর পশ্চিম ভারতের কিছু অংশ পারসিক আকিমেনিয় সম্রাটদের কর দিত।৩৬০ স্বর্ণ মুদ্রা ছিল সেই করের পরিমাণ। ঐতিহাসিকদের এক অংশ মনে করেন পারসিক প্রভাবেই ভারতীয় অর্থনীতিতে মুদ্রা ব্যবস্থা এসেছিল। বৌদ্ধ সাহিত্যে প্রথম 'কর্ষপণ' বা 'কহপণ' বলে মুদ্রার কথা পাওয়া যাচ্ছে। সারা ভারত জুড়ে নানা ধরণের 'কর্ষপণ' পাওয়া গেছে। এছাড়া যে কয়েকটি মুদ্রার কথা জানা যায়। যেমন , 'নিষ্ক', ও 'সুবর্ণ' হল সোনার মুদ্রা। আর বেশ কিছু ব্রোঞ্জ ও তামার মুদ্রা পাওয়া গেছে,-'কংস','পাদ', 'মাসক', আর 'কাকনিক'।

প্রাচীন ভারতের মুদ্রা
কুষাণ যুগের মুদ্রা

তবে স্থান ভেদে মুদ্রার 'দামের' তফাৎ হত। এখন যেমন কলকাতা তে ১০ টাকায় যে চকোলেটটা পাচ্ছ, ১০ টাকা দিলে দিল্লিতেও সেই চকোলেট পাবে। কিন্তু তখন তা হত না।স্থান ভেদে সেই টাকার দাম পরিবর্তন হত।এখন যেমন মুদ্রার একটা নির্দিষ্ট আকার আছে সেই সময়ের মুদ্রায় তা ছিল না। যে মুদ্রাগুলি সাধারন জীবনে বেশী প্রচলিত ছিল সে গুলি প্রধানত রুপোর বা ব্রোঞ্জের সমতল টুকরোর ওপরে ছাপ দেওয়া বা ছিদ্র করা। যীশুখৃষ্টের জন্মের ২য় শতাব্দীর আগে ভারতবর্ষে মুদ্রার নিয়মিত নির্মাণের কোন প্রমাণ নেই। রাজা মুদ্রা নির্মাণ করতেন । কুষাণযুগ* থেকে টাঁকশালের প্রধানকে বলা হত লক্ষণাধ্যক্ষ। অনেক ধনী সোনা ও রূপার বাঁট জমা দিয়ে মজুরি দিয়ে টাঁকশালে মুদ্রা তৈরি করে নিতে পারতো।সোনা ,রূপা, তামা, যেমন মুদ্রা তৈরিতে ব্যবহার হত, তেমনি সাধারন মানুষের জীবনে কড়ির ব্যবহার ছিল। গ্রেকো- ব্যাকট্রিয় শাসকরা নিজেদের নাম লেখা নিকেলের মুদ্রা প্রচলন করে। আবার দক্ষিণ ভারতীয় সাতবাহন* রাজারা সীসার মুদ্রা প্রচলন করে।

প্রাচীন ভারতের মুদ্রা
সাতবাহন রাজাদের মুদ্রা

মুদ্রা তার সময়কে জানতে সাহায্য করে। মুদ্রার ওজন আর তার বিশুদ্ধতা থেকে কোন এক সময়ের অর্থনীতির অবস্থা বোঝা যায়। মুদ্রায় খাদ বেশী মানে রাজার অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয়।যদি কোন সময় রূপার মুদ্রার ব্যবহার বেশী থাকে, তবে বুঝতে হবে তখন মধ্যবিত্ত সমাজের প্রভাব বেশী ছিল। মুদ্রার লিপি থেকে, ছবি থেকে, সেই মুদ্রা প্রচলনকারী রাজাকে জানা যায়। সে সময়ের ধর্ম বিশ্বাস, সাজসজ্জা, সংগীত, আরও অনেক কিছু জানা যায়। রোমানদের বেশ কিছু মুদ্রা ভারতে পাওয়া গেছে।এই থেকে বোঝা যায় রোমানদের সাথে ভারতবর্ষের ব্যবসা চলত। প্রখ্যাত রোমান সম্রাট নিরোর মুদ্রাতে খাদ বেশী থাকায় এই মুদ্রা ভারতীয়রা বেশী জমিয়ে রাখেনি। আর কুষাণ যুগের রাজারা রোমান মুদ্রা বেশী জমিয়ে রাখেনি। তারা মুদ্রা গলিয়ে নিজেদের মুদ্রাতে পরিণত করে।

আমরা তো নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছি, সময়ের সাথে সাথে নানারকমের বদল হয়। হয়তো আজ আমরা যে মুদ্রা ব্যবহার করি , সেগুলো কোন একদিন অপ্রচলিত হয়ে যাবে। আমাদের জীবন থেকে সেইসব টাকা আর পয়সা গুলো হারিয়ে যাবে। কিন্তু ইতিহাস সব তার বাক্সে জমিয়ে রেখে দেবে।


*বেদের রচনাকাল-হিন্দুদের প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ বেদের রচনা কাল আনুমানিক, যীশুখৃস্টের জন্মের আগে ১৫০০ অব্দ থেকে ৫০০ অব্দ পর্যন্ত।
*হেরডোটাস-গ্রিক ঐতিহাসিক। সক্রেটিসের সমসাময়িক। যীশুখৃস্টের জন্মের আগে ৪৮৪ অব্দ থেকে ৪২৫ অব্দ পর্যন্ত তাঁর থাকার প্রামানিকতা পাওয়া যায়।
*কুষাণ -কুষাণরা উত্তর পশ্চিম ভারতে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছিল।তারা বিদেশী হলেও ধীরে ধীরে ভারতীয় ভাবধারা তে প্রভাবিত হয়ে পড়ে।
*সাতবাহন-দাক্ষিণাত্যের একটি শক্তিশালী রাজবংশ। যীশুখৃস্টের জন্মের আগে ২৭১ অব্দ থেকে ৩০ অব্দ পর্যন্ত তাদের শাসন কাল।

তথ্যসূত্রঃ প্রাচীন ভারত, সুনীল চট্টোপাধ্যায়


ছবিঃ উইকিপিডিয়া

খুব ছোট থেকে পড়তে ভালবাসেন। তার থেকেই লেখা শুরু। ছোটদের জন্যে কিছু লেখা সব চেয়ে কঠিন। একটু চেষ্টা করছেন লিখতে।

More articles from this author

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা