ব্রিটিশ শাসক তার সুজলা সুফলা এই উপনিবেশ টিকে হাতের মুঠোয় রাখতে গিয়ে উপনিবেশের সাধারণ মানুষ কে ‘যন্ত্র’ হিসাবে ব্যবহার করেছিল। সে জন্যে শিক্ষার পরিকাঠামো যেমন গড়ে তুলেছিল তেমনি , সাধারণ মানুষের ওপর শোষণ করে চলেছিল নিখুঁত ভাবে। আমরা যদি সিপাহী বিদ্রোহের পরের ভারতবর্ষের দিকে তাকয়ে দেখি... তাহলে দেখবো... যে ভারতীয় মানুষদের একটি খুব সামান্য অংশ ছিল শিক্ষিত ,তারা এই বিদ্রোহের সাথে সরাসরি যুক্ত নয়, অন্যদিকে কৃষক, উপজাতি রা অবিরাম ভাবে সংগ্রাম জারী রেখেছিল। ‘শিক্ষিত মানুষ’ রা প্রবল ভাবে ভারতীয় প্রাচীন সাহিত্য ও সংস্কৃতি কে উজ্জীবিত করে পাশ্চাত্য সভ্যতার পাশে নিজেদের পরম গৌরবময় অতীতের ওপর বিশ্বাস রাখছিলেন। কুসংস্কার মুক্ত হয়ে , কী ভাবে তাদের ধর্ম, সভ্যতা আরও উজ্বল হবে তার চেষ্টা চলছিল। ঠিক তার অন্যদিকে চাষের জমিতে লাঙ্গল চালানো মানুষরা, বনবাসী নিজস্ব সংস্কৃতিতে ধনী মানুষরা--- নিয়ত যুদ্ধ চালাচ্ছিল। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত অনুযায়ী জমির সেসের বৃদ্ধি করা হয়।ডঃ অবনি রাজনের ‘রিলেশন্স্ ইন ব্রিটিশ ইন্ডিয়া’ তে বলছেন , লর্ড মেয়োর আমল থেকে সেসের হার দ্রুত বাড়ে। যার ফলে ভূমিহীন কৃষি মজুরের সংখ্যা বাড়ে। যেটা অত্যন্ত দুঃখজনক। জমি না থাকলে কৃষক আরও দরিদ্র আর অসুরক্ষিত হয়ে পড়ে ।এর মধ্যে বিভিন্ন উপজাতির মানুষেরাও ছিলেন।এরা বিদ্রোহ বা আন্দোলন করতে বাধ্য হয়।
এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য বিদ্রোহ ছিল
- নীল আন্দোলন (১৮৫৯-৬০)
- সাঁওতালদের খেরওয়ার আন্দোলন(১৮৭০- ৮০)
- দাক্ষিনাত্যের কৃষক বিদ্রোহ (১৮৭৫)
- মহারাষ্ট্রের পুণে ও আহমদ নগরের কৃষক বিদ্রোহ(১৮৭৪-৭৫)
- অন্ধ্র প্রদেশের রম্পা উপজাতি কৃষকের বিদ্রোহ (১৮৮০)
- মুন্ডা বিদ্রোহ (১৯০০-১৯০৬)
বাঁদিকে দীনবন্ধু মিত্র;ডান দিকে 'নীল দর্পন'- এর ইংরেজি অনুবাদ
এই প্রত্যেকটি বিদ্রোহ দমন করা হয়েছিল ভয়াবহ ভাবে। অত্যাধুনিক অস্ত্র প্রয়োগ, বিভেদ করে দল ভেঙ্গে দেওয়া ইত্যাদি উপায়ে । সাধারণ ভাবে ভারতীয় শিক্ষিত মানুষ এর থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছিল। কিন্তু সংযোগ ঘটাল সংবাদ পত্র। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মহার্ঘ উদাসীনতার পাশে কয়েকজন একটুও ভয় না পাওয়া মানুষ , যেমন হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। হিন্দু পেট্রিয়টে তিনি নীল চাষিদের দুর্দশা আর অত্যাচার নিয়ে দীর্ঘ আর সুচিন্তিত প্রবন্ধ লেখেন। দীনবন্ধু মিত্র লেখেন নীল দর্পণ। এই ধরণের রিপোর্ট এর ফল স্বরূপ একটি নীল কমিশন বসানো হয়। যেটি স্বীকার করে নীলকররা অত্যন্ত অত্যাচার করেছিল। আর ব্রিটিশ সরকার ঘোষণা করে , জোর করে কাউকে নীল চাষ করানো যাবে না। মহারাষ্ট্রের পুনা ও আহমদ নগরের কৃষক বিদ্রোহ দেখা দেয় অন্যভাবে কৃষকেরা মহাজনদের সামাজিক ভাবে বয়কট করে তাতে কাজ না হওয়ায় মহাজনদের বাড়িঘর ধ্বংস করে ঋণপত্র পুড়িয়ে দেয়। এদের নেতা ছিলেন কেংলিয়া। পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করলেই নেতার অভাবে আন্দোলন থেমে যায়। ঐ এক সময়ে অন্ধ্র প্রদেশের রম্পা উপজাতি কৃষকের বিদ্রোহ গড়ে ওঠে। স্থানীয় জমিদার কর বৃদ্ধি করলে প্রায় ৫ হাজার বর্গ মাইল জুড়ে গোদাবরী আর বিশাখাপত্তনম জেলায় বিদ্রোহ দেখা যায়। মাদ্রাজ থেকে ছয় ব্যাটেলিয়ান সেনা নিয়ে এসে বিদ্রোহ দমন করা হয়। এদের পাশে সংবাদপত্র সেভাবে ছিল কিনা কে জানে।
এবার মধ্যবিত্তদের দিকে তাকানো দরকার:
মধ্যবিত্তদের মধ্যে বেশ উচ্চ শিক্ষিত হলেও উচ্চস্তরের চাকরী গুলি ব্রিটিশদের জন্যে রাখাছিল। যেমন একটা তথ্য পাওয়া যাচ্ছে-
১৮৬৭- ১৮৮৭ সালে সরকারী চাকুরীর সংখ্যা ছিল ২১,৪৬৬ টি। এরমধ্যে হিন্দুদের ভাগে ৪৫%। মুসলিমদের ভাগে ৭%। বাকী সব অভারতীয় । বড় চাকরীতে ইংরেজদের জন্যে ২৯% আর অ্যাংলো- ইনডিয়ান ১৯%। এজন্যে পূর্ব ভারতের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত আইন, শিক্ষকতা, সাংবাদিকতার স্বাধীন বৃত্তি নেয়। পশ্চিম ভারতে শিল্প-বাণিজ্যের পরিমাণ কিছু বেশী থাকায় তারা কেরানী হবার জন্যে চিন্তা করত না। স্বাধীন বৃত্তি গ্রহণ করার ফলে সরকারের সমালোচনা করত। উচ্চস্তরের চাকুরীগুলি যথার্থ যোগ্য ভারতীয়দের জন্যে খুলে দিতে বলে। সুরেন্দ্রনাথ বন্ধোপাধ্যায় এ ব্যাপারে অগ্রণী ভুমিকা নেন। অনিল শীল তাঁর “এমারজেন্স অফ ইন্ডিয়ান ন্যাশানালিজম” এ লিখছেন, “ উনবিংশ শতকের শেষের দশক গুলিতে ব্রিটিশ রাজ এবং তাঁর শিক্ষিত ভারতীয় প্রজাদের মধ্যে একটা বিচ্ছেদ মূলক ব্যবধান দেখা যায়।” একদিকে যেমন রাজনৈতিক চেতনা গড়ে উঠেছিল তেমনি অন্যদিকে ধর্মীয় জাগরণ আর সমাজ সংস্কার মূলক কাজ এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর হাত দিয়েই শুরু হয়।
সরকারী কর বৃদ্ধি, ভূমি বন্দোবস্ত ও ভূমি-রাজস্ব নীতির তীব্র সমালোচনা বিভিন্ন পত্র পত্রিকায়, সভা সমিতির মাধ্যমে নিয়মতান্ত্রিক প্রতিবাদ শুরু হয়। স্থানীয় স্বায়ত শাসিত সংস্থা যেমন কর্পোরেশন , মিউনিসিপ্যালিটির সদস্যপদ ,এই সমস্ত প্রশাসনিক কাজকর্মে যোগদানের জন্যে বিভিন্ন সমিতি গঠন করে। ঐতিহাসিক অনিল শীল এই সমিতি গুলিকে 'রাজনৈতিক সমিতির আদিযুগ' বলে অভিহিত করেছেন।
এই রকম সমিতি গুলি হলঃ
কলিকাতায় ব্রিটিশ-ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশান ( স্থাপিত ১৮৫১)
বোম্বাই অ্যাসোসিয়েশান ( স্থাপিত ১৮৫২)
মাদ্রাজ ব্রিটিশ-ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশান )( স্থাপিত ১৮৫২, পরে নাম বদলে নেটিভ অ্যাসোসিয়েশান )
সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতায় ব্রিটিশ-ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশান ভেঙ্গে দুটি সমিতি তৈরি হয়। ইন্ডিয়ান লীগ ও ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশান। ইন্ডিয়ান লীগের প্রতিস্থাতা ছিলেন শিশির কুমার ঘোষ। ইন্ডিয়ান লীগে থেকেই সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় আর আনন্দ মোহন বসু ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশান তৈরি করে বেড়িয়ে আসেন। তাঁদের লক্ষ্য ছিল ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশান জনসাধারণের রাজনৈতিক বিকাশের কাজে সাহায্য করবে। ১৮৭৬- ৭৭ নাগাদ এর প্রায় ১০ টি শাখা গড়ে ওঠে। ১৮৮৪ সালে প্রজাস্বত্ব আইনের খসড়া এরা প্রতিবাদ করেন। বৈষম্য মূলক ইলবারড বিলের প্রবল বিরোধিতা করেন । ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশান-এর কর্মকর্তা রা ধীরে ধীরে বুঝতে পারেন এই অ্যাসোসিয়েশানটির একটি সর্বভারতীয় শাখা দরকার। তার তোড়জোড় চলে।
আল্যান অক্টাভিয়ান হিউম
এদিকে আল্যান অক্টাভিয়ান হিউম বলে এক ইংরেজ উচ্চ সচিব জাতীয় কংগ্রেসের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। ভারতবর্ষের ইতিহাসে একটি অন্য অধ্যায় শুরু হতে চলে।
ছবিঃ উইকিপিডিয়া