সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo

বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে যে আন্দোলন গড়ে ওঠে সাধারণ ভাবে তাকে স্বদেশী আন্দোলন বলে ঐতিহাসিকরা অভিহিত করেন। এই আন্দোলনের চারটি পর্যায় ছিল।

প্রথম পর্যায়ঃ

মডারেট বা নরমপন্থী নেতারা নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের রীতি অনুযায়ী যুক্তিতর্ক দ্বারা সরকারকে বোঝানোর চেষ্টা করতে থাকেন। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। কলকাতার টাউন হলে ১৯০৪ সালের জানুয়ারি আর মার্চ মাসে দুটি জনসভা হয়, আর রাজাবাজারে মুসলিমদের একটি জমায়েত হয়। এই সভায় রাজা খেতাবধারী জমিদার, হাইকোর্টের উকিল, ব্যারিস্টার, বুদ্ধিজীবি, ছাত্র সমবেত হয়ে বঙ্গভঙ্গ রদ করতে সরকারকে আবেদন জানায়। সুরেন্দ্রনাথ সেখানে বলেন, “এখনও সরকার যদি মত না পাল্টান তাহলে সমগ্র দেশে আগুন জ্বলবে।” এছাড়া বহু বই সে সময় বার হয়। তার মধ্যে 'লর্ড কারজনকে খোলা চিঠি' বিখ্যাত। এই সব আবেদন অগ্রাহ্য করে ১৯০৫ এর ১৬ই অক্টোবর বঙ্গ ব্যবচ্ছেদ সংঘটিত হয়। এইদিন বাঙালী জাতি 'অরন্ধন' আর উপবাস পালন করে নৈতিক প্রতিবাদ জানায়। হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে ঐক্যের প্রতীক হিসাবে রাখি বন্ধন করা হয়। বিদেশী বস্ত্র আগুনে পোড়ান, ধর্না , পিকেটিং শুরু করে ছাত্ররা।

ভারতীয় জাতীয়তাবাদ গড়ে ওঠার পটভূমিঃ ১৯০৫ -এর বঙ্গভঙ্গঃ পর্ব ২
আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়

দ্বিতীয় পর্যায়ঃ

‘গঠনমূলক স্বদেশী’ বলে একটা ধারার আন্দোলন গড়ে উঠেছিল বলে দেখাচ্ছেন ঐতিহাসিক সুমিত সরকার । নিষ্ফল ও আত্ম-অবমাননাকর ‘ভিক্ষা বৃত্তি’র রাজনীতি বর্জন করে, স্বদেশী শিল্প, জাতীয় শিক্ষা, আর গ্রাম উন্নয়ন ও সংগঠনের মাধ্যমে দেশ গড়ে তোলা- এটাই ছিল এই ধারার বৈশিষ্ট্য । প্রতিষ্ঠিত হল প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের ‘বেঙ্গল কেমিক্যাল’, নীলরতন সরকারের ব্যবসায়িক উদ্যোগ, শিক্ষা ক্ষেত্রে সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ‘ডন সোসাইটি’,অশ্বিনী কুমার দত্তের স্বদেশবান্ধব সমিতি । ৮৯ সালিশি কমিটি সমান্তরাল বিচার ব্যবস্থা চালাচ্ছিল। বোলপুরে রবীন্দ্রনাথ ‘ ‘শান্তিনিকেতন’ স্থাপন করেন।জাতীয় শিক্ষা পরিষদ ও বেঙ্গল ন্যাশানাল কলেজ স্থাপিত হয়, যার অধ্যক্ষ হন অরবিন্দ ঘোষ। বরিশালে অশ্বিনী কুমার দত্ত ‘ব্রজমোহন কলেজ’ নামে জাতীয় প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। স্বদেশী আন্দোলন কিছুদিনের মধ্যে বেশ প্রেরণা ছড়িয়ে যায়। ‘বঙ্গলক্ষ্মী কটন মিল’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়’ বেশ জনপ্রিয় বিষয় হয়ে ওঠে। এই গোটা ধারাকে রবীন্দ্রনাথ কথিত ‘আত্মশক্তি’ শব্দের সাথে এক করে দেখা হয়।
কিন্তু সাধারণ, বিশেষ করে তরুণ সমাজ এইভাবে আন্দোলনে ধৈর্য হারিয়ে ফেলে। তারা আরও জোরালো আন্দোলন চাইছিলেন। আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কৃষ্ণকুমার মিত্র, শিবনাথ শাস্ত্রী এই আন্দোলনের মানসিক সীমাবদ্ধতা দেখছিলেন। শিবনাথ শাস্ত্রী লিখছেন, '...স্বদেশী একটি পাগলামিতে পরিনত হয়েছে। জাতীয় ঐক্যের নামে বাঙ্গালির প্রাদেশিকতা এবং উচ্চবর্ণের গোঁড়ামি ও হিন্দুত্ববাদ দেখা দিয়েছে।...’

তৃতীয় পর্যায়ঃ

অরবিন্দ ঘোষ, বিপিন চন্দ্র পাল, ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় প্রভৃতিরা মডারেট বা নরমপন্থী আন্দোলনকে উপযুক্ত মনে করছিলেন না। ‘সঞ্জীবনী’ পত্রিকায় কৃষ্ণকুমার মিত্র ব্রিটিশ পণ্য বয়কটের ডাক দেন। সুরেন্দ্রনাথ টাউন হলের সভায় বয়কটের প্রস্তাব পেশ করেন। দেশ স্বাধীন করতে হবে সেই ভাবনা এবার আকার পেতে শুরু করে। বিপিন পাল ,অরবিন্দ ঘোষ, আর মহারাষ্ট্র এর বাল গঙ্গাধর তিলক সকলে ‘স্বরাজ’ স্বপ্ন দেখতে এবং দেখাতে শুরু করেন। অরবিন্দ ঘোষ তাঁর ‘New lamps for Old’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন, যেখানে তিনি '... নগরবাসী মধ্যবিত্তের সঙ্গে খেতে খাওয়া প্রলেতারিয়েত বা সর্বহারার ব্যবধান দূর করে...' এক জাতীয় আন্দোলন গঠনের কথা বলেন। ১৯০৭ সালে বন্দেমাতরম পত্রিকায় তিনি আরও বলেন, '...এই আন্দোলন এখন কেবলমাত্র কুশাসনের বিরুদ্ধে পরিচালিত হচ্ছে না এই আন্দোলন এখন ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে পরিচালিত। এই শাসন ভাল কি মন্দ এখন এই প্রশ্ন অবান্তর।' 'নিউ ইন্ডিয়া', 'সন্ধ্যা', 'যুগান্তর','বন্দে মাতরম' পত্রিকা বয়কটকে স্বাগত জানায়। 'অমৃত বাজার পত্রিকা'-তে লাল মোহন ঘোষ বিলাতী কাপড় বয়কট করার মাধ্যমে ম্যানচেস্টার এর কাপড়ের কল গুলি অচল করার পরামর্শ দেন।
এই সময়ের আন্দোলন কিছুটা গণ আন্দোলনের রূপ নেয়। বিদেশী কাপড়, চিনি, লবণ, সিগারেট, কাঁচের চুড়ি প্রভৃতি বয়কট, দোকানের সামনে পিকেটিং চলতে থাকে। পুরোহিতরা বিদেশী চিনির তৈরি মিষ্টি ভগবানকে উৎসর্গ করতে চাইছিলেন না, ধোপারা বিদেশী কাপড় কাচতে অস্বীকার করেন। উকিলরা ওকালতি ছাড়েন। সরকারি বিদ্যালয়ে ছেড়ে এসে স্বদেশী স্কুলে ভরতি হন বহু ছাত্র। বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনন্সিটিউশন (এখনকার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়) স্থাপিত হয়। তবে জোর করে কাপড়ের ব্যবসা বন্ধ করা নিয়ে নানান অশান্তি শুরু হয়। এই আন্দোলনের সাথে শ্রমিকদের যোগ দেখা যায়। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, জাতিগত অপমান প্রভৃতির জন্যে স্বাভাবিক ভাবেই ধর্মঘটের পরিবেশ তৈরি ছিল। চটকল আর রেলের কর্মশালায় ধর্মঘট, সরকারি মুদ্রাকরদের ছাপাখানায় ধর্মঘট প্রভৃতি দিয়ে তৈরি হচ্ছিল আন্দোলনের বিরাট পরিমণ্ডল।
কেবল বাংলায় এই আন্দোলন সীমাবদ্ধ ছিল না।মহারাষ্ট্র আর পাঞ্জাবে বয়কট শুরু হয়। তিলকের নেতৃত্বে স্বদেশী জিনিসের সমবায় গড়ে ওঠে। পুনায় কাপড়ের কল স্থাপন হয়।
পাঞ্জাবে স্বামী শ্রদ্ধানন্দ, লালা লাজপত রায়; মাদ্রাজে সুব্রক্ষ্মন্য আইয়ার,চিদাম্বরম পিল্লাই প্রভৃতি; দিল্লিতে সৈয়দ হায়দার রেজা বয়কট আর স্বদেশী প্রচার করেন। মহারাষ্ট্রের ‘প্রভাকর পত্রিকা’-তে পুনার গোপাল রাও দেশমুখ বিলাতী দ্রব্য বয়কটের দাবী তোলেন। ইন্ডিয়ান সোসিওলজিস্ট পত্রিকায় শ্যামাজি কৃষ্ণবর্মা ইংরেজের শাসন ব্যবস্থা বয়কট করে তা অচল করার কথা বলেন।
ছাত্ররা জোরকদমে বয়কট আর পিকেটিং চালাতে থাকেন। কিন্তু পুলিশ আর গোর্খা সেনার প্রচণ্ড অত্যাচারে আন্দোলন ধীরে ধীরে স্থিমিত হতে থাকে।এবার আন্দোলন গণ সংযোগ হারায়।

ভারতীয় জাতীয়তাবাদ গড়ে ওঠার পটভূমিঃ ১৯০৫ -এর বঙ্গভঙ্গঃ পর্ব ২
(বাঁ দিক থেকে) বাঘা যতীন, উল্লাসকর দত্ত, ক্ষুদিরাম বসু

চতুর্থ পর্যায়ঃ

সুমিত সরকার লিখছেন, '...সমিতি বা ‘জাতীয় স্বেচ্ছাসেবক’ আন্দোলনের আকস্মিক উত্থান ছিল স্বদেশী যুগের অন্যতম প্রধান কীর্তি... ” । ‘যুগান্তর’, ‘অনুশীলন সমিতি’, ‘স্বদেশ বান্ধব’, ‘ব্রতী’, ‘ঢাকা অনুশীলন’, ‘সুহৃদ’, ‘সাধনা’ প্রভৃতি অনেক সমিতির নাম পাওয়া যায়। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন ধীরে ধীরে অস্ত্র হাতে তুলে নেয়। পুলিশের সন্ত্রাসের ফলে মানুষের সাথে যোগাযোগ কমতে থাকে, সাধারণ মানুষ ভয় পেতে থাকে। অরবিন্দ ঘোষ, বারীন্দ্র ঘোষ প্রভৃতির অনুপ্রেরণায় আর উদ্যোগে বিপ্লবী সমিতি স্থাপন হতে থাকে। এরা অত্যাচারী ইংরেজ কর্মচারীদের খুন করার পরিকল্পনা করতে থাকে। ১৯০৮ সালে ক্ষুদিরাম আর প্রফুল্ল চাকী কিংসফোর্ডের হত্যার পরিকল্পনা করে ভুলবশতঃ মিস ও মিসেস কেনেডিকে মেরে ফেলেন। মুরারিপুকুর বোমা মামলায় প্রায় ছত্রিশ জনকে পুলিশ ধরে । মানিকতলা বোমা মামলায় চিত্তরঞ্জন দাসের চেষ্টায় মুক্তি পান অরবিন্দ ঘোষ। বারীন্দ্র ঘোষ, উল্লাসকর দত্তের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। বাঘা যতীন, নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, সশস্ত্র বিপ্লবের নিত্য চেষ্টা করতে থাকেন।
 
১৯১১ সালে সরকার বঙ্গভঙ্গ রদ করেন।কলিকাতা থেকে রাজধানী সরিয়ে দিল্লীতে নিয়ে যাওয়া হয়। কলিকাতা তার আগের গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে।

ছবিঃ উইকিপিডিয়া

খুব ছোট থেকে পড়তে ভালবাসেন। তার থেকেই লেখা শুরু। ছোটদের জন্যে কিছু লেখা সব চেয়ে কঠিন। একটু চেষ্টা করছেন লিখতে।

More articles from this author

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা