
স্বামী বিবেকানন্দ একাধারে প্রদেশিকতা ,জাতিবাদ, ধর্মীয় পরিচয় বাদ দিয়ে ভারতে বসবাসকারী ব্রিটিশ অধীনদের ‘ভারতবাসী’ বলে সম্বোধন করলেন, অন্যদিকে এই সম্ভাবনাময় জনগোষ্ঠী যে প্রবল কলহপরায়ণ সেটাও বলে গিয়েছিলেন। ১৯০৫ এর বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন আর কংগ্রেস দুয়ের মধ্যেই একাধিক মতাদর্শের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়েছিল। সব পক্ষই নিজেদের ভাবনা কে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করছিল।১৯০৭ সালে কংগ্রেসের দুই গোষ্ঠীর মধ্যে দ্বন্দ্ব অতি স্পষ্ট হল। একদিকে মডারেট বা নরমপন্থী সমঝোতা আর আবেদন নিবেদন এর নীতি নিয়ে কংগ্রেসের রাজনীতি টিকিয়ে রাখতে চাইছিল। তাদের অনেকের ব্রিটিশ সরকারের ‘গুড বুকে’ থাকার দরকার খুব প্রয়োজন ছিল। কিন্তু মডারেটদের বিরুদ্ধে অবশ্য ১৮৯৩-৯৪ সাল থেকেই নিন্দাবাক্য বর্ষণ শুরু হয়েছিল। অরবিন্দ ঘোষ ইংরেজের কাছে তাদের এই দয়া ভিক্ষা কে ঘৃণা জানিয়েছেন। আর মডারেট নেতাদের ‘নাক উঁচু’ মনোভাব আর সাধারণ ভারতবাসীর সাথে কোন যোগাযোগ না রাখাকে ধিক্কার দেন। মডারেটদের আন্দোলনের নানান সীমাবদ্ধতা স্বাভাবিক ভাবেই তরুণ নেতাদের পছন্দ ছিল না। যারা মডারেটপন্থার বিরুদ্ধে দাঁড়াল ,তাদের বক্তব্য ছিল-
১।আত্মশক্তিতে দেশ কে গড়ে তোলা। তার জন্যে তারা কিছু পন্থা ঠিক করেছিল।
- জাতীয় শিক্ষা পরিকল্পনা
- মাতৃভাষায় শিক্ষা
- নিজেদের প্রাচীন সভ্যতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া
- শিল্প গঠন
- গ্রাম উন্নয়ন
২।আন্দোলনের পদ্ধতি নিয়ে চরমপন্থীদের অন্যরকম মতামত ছিল।
- নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ। অর্থাৎ ধর্মঘট, বিলাতি দ্রব্য না কেনা,সরকারী চাকরি ত্যাগ করে স্বাধীন পেশা গ্রহণ করা ইত্যাদ
- বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদ
চরমপন্থী আর নরমপন্থী মতবাদের আর একটি বিশেষ দূরত্ব হল নরমপন্থী বা মডারেটরা ডোমেনিয়ান স্ট্যাটাস পেলেই খুশি হয়ে যেত। তাদের মতে ব্রিটিশদের অধীনে একটি অঞ্চল হিসাবে ভারতবর্ষ থাকবে। কিন্তু তরুণ চরমপন্থীরা ‘পূর্ণ স্বরাজ’ থেকে একটুকুও কমে রাজী নন।তারা কোন মতেই ব্রিটিশ সরকারের অংশ বলে থেকে যেতে চায় না।

বাঁদিকে জন মর্লে, ডান দিকে লর্ড মিন্টো
ব্রিটিশ সরকার কংগ্রেসের মতো 'সেফটি ভাল্ভ'-এর ব্যবস্থা মেনে নিয়েও বুঝেছিল, সাধারণ নাগরিকদের ক্ষোভ আরও বেশী। তাই এই ক্ষোভ প্রশমনের জন্যে কিছু চিন্তা ভাবনা করছিল। তার ফলশ্রুতি ছিল ১৮৬১,১৮৯২,১৯০৬ সালের 'ইনডিয়ান কাউন্সিল অ্যাক্ট' । এরপরে 'মর্লে-মিন্টো' অ্যাক্ট নিয়ে আসা হয় । ১৯০৯ সালের ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অ্যাক্ট, যাকে মর্লে-মিন্টো রিফর্মসও বলা হয়, ব্রিটিশ পার্লামেন্ট দ্বারা ১৯০৯ সালে প্রণীত সংস্কার পদক্ষেপগুলির একটি সিরিজ, যার প্রধান উপাদানটি সরাসরি ভারতে ইম্পেরিয়াল এবং স্থানীয় আইন পরিষদে সদস্য হওয়ার জন্য নির্বাচনী নীতি চালু করেছিল। গ্রেট ব্রিটেনে লিবারেল পার্টি ১৯০৬ সালে একটি নির্বাচনী বিজয় অর্জন করেছিল যা ব্রিটিশ ভারতের জন্য সংস্কারের একটি নতুন যুগের সূচনা করেছিল। অপেক্ষাকৃত নতুন সেক্রেটারি অফ স্টেট --- যদিও তিনি ভারতের ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড মিন্টো (১৯০৫-১০) দ্বারা বাধাগ্রস্ত হয়েছিলেন --- ব্রিটিশ ভারতীয় সরকারের আইন ও প্রশাসনিক যন্ত্রপাতিতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন প্রবর্তন করতে সক্ষম হন। রানী ভিক্টোরিয়ার ভারতীয়দের জন্য সুযোগের সমতার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করে, তিনি হোয়াইটহলে তার কাউন্সিলে দুইজন ভারতীয় সদস্যকে নিযুক্ত করেন: একজন মুসলিম, সাইয়্যেদ হোসেন বিলগ্রামী, যিনি মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন; এবং অন্য একজন হিন্দু, কৃষ্ণ জি. গুপ্ত, ভারতীয় সিভিল সার্ভিস (ICS) এর একজন সিনিয়র ভারতীয়। মর্লে একজন অনিচ্ছুক লর্ড মিন্টোকে ১৯০৯ সালে প্রথম ভারতীয় সদস্য সত্যেন্দ্র পি. সিনহাকে ভাইসরয়ের কার্যনির্বাহী পরিষদে নিয়োগ করতে রাজি করান।

(বাঁদিক থেকে)সাইয়্যেদ হোসেন বিলগ্রামী, স্যার কৃষ্ণ গোবিন্দ গুপ্ত, সত্যেন্দ্র প্রসন্ন সিন্হা
যদিও ১৯০৯ আইন দ্বারা স্থির হয়েছিল, যারা প্রাথমিক নির্বাচকমণ্ডলীতে মনোনীত হবেন, তাদের একটি নির্দিষ্ট সম্পত্তির মালিকানা থাকতে হবে এবং আর শিক্ষার মাপকাঠি একটি ছিল। এরা ছিল ভারতীয়দের একটি ক্ষুদ্র সংখ্যালঘু অংশ। ১৯১০ সালে প্রায় ১৩৫ জন নির্বাচিত ভারতীয় প্রতিনিধি সমগ্র ব্রিটিশ ভারতে আইন পরিষদের সদস্য হিসাবে তাদের আসন গ্রহণ করেছিলেন। এই আইনএর বলে ইম্পেরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সদস্যপদ ১৬ থেকে (যাতে এটি ১৮৯২ সালের ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অ্যাক্ট দ্বারা উত্থাপিত হয়েছিল) থেকে ৬০ বৃদ্ধি হয়েছে। বোম্বে ,বেঙ্গল এবং মাদ্রাজ এর প্রাদেশিক পরিষদে, যা তৈরি করা হয়েছিল। ১৮৬১ সালে, ১৮৯২ সালের ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অ্যাক্ট দ্বারা অনুমোদিত মোট সদস্য সংখ্যা ২০-এ উন্নীত করা হয়েছিল। ১৯০৯ সালে এই সংখ্যা ৫০ এ উন্নীত করা হয়েছিল, যদিও অধিকাংশ সদস্য অনানুষ্ঠানিক হওয়া উচিত ছিল। অন্যান্য প্রদেশে কাউন্সিল সদস্যদের সংখ্যা একইভাবে বৃদ্ধি করা হয়েছিল। গোপাল কৃষ্ণ গোখলে এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অন্যান্য উদারপন্থী নেতাদের পরামর্শে, মর্লে যখন প্রাদেশিক আইনসভার সরকারী সংখ্যাগরিষ্ঠতা বাতিল করেন। এখানে উল্লেখ যোগ্য রমেশ চন্দ্র দত্ত। তিনি শুধু আইসিএস নয়, তার নিজের ভাইসরয় এবং কাউন্সিলের তিক্ত বিরোধিতাকেও অগ্রাহ্য করেছিলেন। তখন অন্যান্য অনেক ব্রিটিশ লিবারেল রাজনীতিবিদদের মতো, মর্লি বিশ্বাস করতেন, ব্রিটেনের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান: সংসদীয় সরকারকে সমর্থন করা, ভারতে ব্রিটিশ শাসনের একমাত্র ন্যায্য কাজ । লর্ড মিন্টো এবং কলকাতা এবং সিমলা এর কর্মকর্তারা সংস্কার বাস্তবায়নের জন্য কঠোর আইন রচনা করেছিলেন এবং সমস্ত আইনের উপর নির্বাহী ভেটো ক্ষমতা বজায় রাখার জন্য জোর দিয়েছিলেন। নতুন কাউন্সিলের নির্বাচিত সদস্যদের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল, বার্ষিক বাজেট সংক্রান্ত সমস্ত দিক সম্পর্কে অনানুষ্ঠানিক বা আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাহীকে প্রশ্ন করার জন্য। সদস্যদের তাদের নিজস্ব আইনী প্রস্তাব উপস্থাপন করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।
সুমিত সরকার তাঁর বই ‘আধুনিক ভারত ১৮৮৫ -১৯৪৭’ এ লিখেছেন, “ভারতে যাবতীয় ব্রিটিশ সাংবিধানিক পরীক্ষার মধ্যে সবচেয়ে স্বল্পস্থায়ী বলে প্রমাণিত হলো ১৯০৯ এর ভারতীয় কাউন্সিল আইন।”
কারণ
- এই আইন নরমপন্থীদের এক জায়গায় রাখতে পারল না।
- রাজনৈতিক ভাবে সক্রিয় হিন্দু আর মুসলমানদেরও আলাদা রাখতে পারল না। কারণ মুসলমানরাও ব্রিটিশদের প্রতি বিশ্বস্ত থাকছিল না। েই সময় দুটি অন্য গোষ্ঠী নিজেদের পৃথক ভাবে গড়ে উঠল। একটি মুসলিম লীগ। অন্যটি হোমরুল । মুসলমানরা ধর্মীয় আর সামাজিক ভাবে হিন্দুদের থেকে স্বতন্ত্র থাকতে চাইছিল।তারা নানা কারণে বিশ্বাস করতে পারছিল না হিন্দু সংখ্যা গরিষ্ঠ ভারতীয় রাজনীতিকে।আর পূর্ববঙ্গে বিলাতি বস্ত্র না ব্যবহার করার আন্দোলনকালে ঘটে যাওয়া বহু দাঙ্গার জন্যে তাদেরকে বিশ্বাস করতে পারছিল না মূল স্রোতের রাজনীতিবিদরা। মুসলিম লীগকে ব্রিটিশ শাসক তৈরি করেছিল নিজেদের দলে রাখার জন্যে।
মুসলিম লীগ, আসল নাম অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ, রাজনৈতিক দলটি ব্রিটিশ ভারত (১৯৪৭) বিভক্ত হওয়ার সময় একটি পৃথক মুসলিম জাতি গঠনের আহ্বান জানিয়ে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিল। মুসলিম লীগ ভারতীয় মুসলমানদের অধিকার রক্ষার জন্য ১৯০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। প্রথমে লীগটিকে ব্রিটিশরা উৎসাহিত করেছিল এবং সাধারণত তাদের শাসনের পক্ষে ছিল, কিন্তু সংগঠনটি ১৯১৩ সালে ভারতের জন্য স্ব-শাসনকে তার লক্ষ্য হিসাবে গ্রহণ করেছিল।
হোম রুল লিগ, ভারতে একই নামের দুটি স্বল্পকালীন সংগঠনের মধ্যে যেটি ১৯১৬ সালের এপ্রিল এবং সেপ্টেম্বরে যথাক্রমে ভারতীয় জাতীয়তাবাদী বাল গঙ্গাধর তিলক এবং ব্রিটিশ সমাজ সংস্কারক এবং ভারতীয় স্বাধীনতার নেতা অ্যানি বেসান্ত দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আয়ারল্যান্ডের অনুরূপ আন্দোলন থেকে ধার করা এই শব্দটি ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের ব্রিটিশ ভারতীয় সরকারের কাছ থেকে স্ব-শাসন অর্জনের প্রচেষ্টাকে নির্দেশ করে।

বাঁদিকে বালগঙ্গাধর তিলক, ডান দিকে অ্যানি বেসান্ত
পুনাতে (বর্তমানে পুনে, মহারাষ্ট্র) প্রতিষ্ঠিত তিলকের গোষ্ঠীটি বেশিরভাগ পশ্চিম ভারতে প্রধান্য বিস্তার করেছিল এবং মাদ্রাজ (বর্তমানে চেন্নাই, তামিলনাড়ু)-এ স্থাপিত বেসান্তের দলটি সর্বভারতীয় পরিধির বেশি ছিল। উভয়ই, যাইহোক, ভারতীয় জনমতকে সংগঠিত করার একই উদ্দেশ্যের দিকে কাজ করেছিল --- বেশিরভাগ শান্তিপূর্ণ উপায়ে --- স্ব-সরকারের পক্ষে, এবং শুরু থেকেই একে অপরের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছিল। ১৯১৭ সালে ভারতের সেক্রেটারি অফ স্টেট এডউইন স্যামুয়েল মন্টাগু কর্তৃক মন্টাগু ঘোষণার খসড়া তৈরিতে দেখা যায় যে ,প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে ব্রিটিশ ভারতে রাজনৈতিক সংস্কারের ভিত্তি স্থাপিত হয়। যাইহোক, হোম রুল সংস্থাগুলির প্রভাব হ্রাস পেয়েছে। যদিও ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে তাদের ভূমিকা ছিল কিছুটা বিনয়ী, তবুও তারা যুদ্ধের বছরগুলিতে আন্দোলনের গতি বজায় রাখতে সাহায্য করতে সফল হয়েছিল - যেমনটি ১৯১৬ সালের ডিসেম্বরে লক্ষ্ণৌ চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল।
লক্ষ্ণৌ চুক্তি, (ডিসেম্বর ১৯১৬), মারাঠা নেতা বাল গঙ্গাধর তিলকের নেতৃত্বে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বাধীন সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ দ্বারা করা চুক্তি; এটি ২৯ ডিসেম্বর কংগ্রেসের লখনউ অধিবেশনে এবং ৩১ ডিসেম্বর,১৯১৬-এ লীগ দ্বারা গৃহীত হয়েছিল। চুক্তিটি ভারত সরকারের কাঠামো এবং হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের সম্পর্কের সাথে সম্পর্কিত ছিল।পূর্বের গণনায়, প্রস্তাবগুলি ছিল গোপাল কৃষ্ণ গোখলের "রাজনৈতিক টেস্টামেন্ট" এর অগ্রগতি। প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় আইনসভার চার-পঞ্চমাংশ একটি বিস্তৃত ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচিত হতে হবে এবং কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সহ অর্ধেক কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্যরা নিজেদের কাউন্সিল দ্বারা নির্বাচিত ভারতীয় হতে হবে। কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী বিভাগের বিধান ব্যতীত, এই প্রস্তাবগুলি মূলত ১৯১৯ সালের ভারত সরকারের আইনে মূর্ত ছিল। কংগ্রেস প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী এবং তাদের পক্ষে গুরুত্ব দেওয়ার জন্যও সম্মত হয়েছিল (জনসংখ্যা দ্বারা নির্দেশিত অনুপাতের বাইরে) পাঞ্জাব এবং বাংলা ছাড়া সমস্ত প্রদেশে, যেখানে তারা হিন্দু ও শিখ সংখ্যালঘুদের কিছু জায়গা দিয়েছে। এই চুক্তিটি ১৯২০ সাল থেকে খিলাফত আন্দোলন এবং মোহনদাস গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনে হিন্দু-মুসলিম সহযোগিতার পথ প্রশস্ত করেছিল।
ছবিঃউইকিপিডিয়া