সাংবাদিক দুর্গাদাসের একটি গ্রন্থ আছে, 'India from Curzon to Nehru' সেখানে তিনি দেখিয়েছেন,যে সব লোক ব্রিটিশ এর সিভিল সার্ভিস চাকরি ছেড়ে চলে গিয়েছিল তারা আসলে ব্রিটিশ শাসনের চরমতম ক্ষতি সাধনের কারণ। উনি হয়ত একটু বেশী সাধারণীকরণ করে ছিলেন। কিন্তু বাস্তবে কয়েকটি উদাহরণ তো বিশদ ভাবে তাঁর মত সমর্থন করে।যেমন হিউম, রাগ করে চাকরি ছাড়লেন আর দেশকে একটি কংগ্রেস নামক দল দিয়ে গিয়েছিলেন। যে দল ব্রিটিশ শাসনের মূল ধরে টান মারে। সুভাষ চন্দ্র বোস, যার জন্যে গোটা দেশ আজও মাঝে মাঝে এক জায়গায় হয়। এবার আসি সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এর কথায়। সেই সময় আদি কংগ্রেসের নেতা ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। আই সি এস পরীক্ষা পাসের পর চাকরিতে যোগদান করেন। কর্তৃপক্ষের সাথে গণ্ডগোল হওয়ায় চাকরি থেকে বরখাস্ত হন। নরমপন্থী রাজনীতির ভক্ত সুরেন্দ্রনাথ দেশ গঠনের কাজে নামেন। যদিও তিনি চাননি কংগ্রেস গণআন্দোলন করুক । এর মধ্যে দাদাভাই নৌরজি আর রমেশ চন্দ্র দত্ত যথাক্রমে লিখেছিলেন, 'Poverty and Unbritish Rule in India' আর 'Economic History of India', যে বই দুটিতে ব্রিটিশ শাসনের কুফল ছত্রে ছত্রে পরিবেশিত।যাই হোক এর মধ্যে লর্ড কার্জনের বাংলা ভাগের সিদ্ধান্ত । শাসক লর্ড কার্জন যখন বলেন , 'partition of Bengal is a settle fact, ….' , 'সারেন্ডার নট' সুরেন্দ্রনাথ উত্তর দেন , '...we shall make the settle fact unsettled' . এই যে 'we' এই 'আমরা' হল বাংলার ছাত্র, বাঙালী শিক্ষিত সমাজ।
যাই হোক বাংলাভাগের সিদ্ধান্ত অত্যন্ত বিতর্কিত ও বহুল আলোচিত একটা বিষয়। লর্ড কার্জন এইজন্যে বাংলার সাধারণের কাছে অত্যন্ত অপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন।যদিও ঐতিহাসিক অমলেশ ত্রিপাঠী তাঁর 'Extremist Challenge' গ্রন্থে লিখেছেন ' The genesis of the partition of Bengal had nothing to do with Curzon's determination to crush the seditious Congress' । লর্ড কার্জন এমনিতে খুব খারাপ লোক ছিলেন না। কিন্তু 'শাসন' করতে চেয়েছিলেন। যারা এই 'বঙ্গভঙ্গের' পক্ষে ছিলেন তারা মূলতঃ এই 'ভঙ্গ' হওয়া কে একটি প্রশাসনিক দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে ব্যাখ্যা করেছিলেন।
১৯০৩ সাল অবধি আমলাদের মধ্যে বাংলা প্রেসিডেন্সির এই বিরাট আয়তন খুব অসুবিধার মনে হত। ১৮৬০ এর দশক থেকেই এর আকার কমানোর কথা ভাবা হচ্ছিল। ১৮৭৪ সালে আসাম ও সিলেট কে আলাদা করার কথা ভাবা হয়। ১৮৯৬ – ৯৭ সালে আসামের কমিশনার উইলিয়াম ওয়ার্ড আসামকে আরও শক্তিশালী সমৃদ্ধ প্রদেশ হিসাবে তৈরি করতে চাইছিলেন। স্বরাষ্ট্র সচিব রিজলি আসামের চা, তেল আর কয়লা শিল্পের বিকাশের জন্যে একটা সামুদ্রিক নির্গম পথের ব্যবস্থা করতে চাইছিলেন। উইলিয়াম ওয়ার্ড চাইছিলেন চট্টগ্রাম বিভাগ, ঢাকা, আর ময়মনসিংহকে আসামের সাথে যোগ করতে। মোদ্দা কথা হল লর্ড কার্জন , রিজলি আর উইলিয়াম ওয়ার্ড তিনজন মিলে প্রসাশনিক ভাবে যে কাজটা করতে চাইছিলেন তা হল-
১। বাংলার ভার লাঘব
২। আসামের প্রসার
১৯০৩ সাল থেকে ১৯০৫ সালের আনুষ্ঠানিক বাংলা ভাগের ঘোষণার মধ্যবর্তী সময়ে যে ব্যবস্থা গুলি লর্ড কার্জন ও রিজলি গ্রহণ করেছিলেন সে গুলি হল-
১। চট্টগ্রাম বিভাগ, ঢাকা, ময়মনসিংহ জেলা ও পার্বত্য ত্রিপুরা আসামের সাথে যুক্ত হবে।
২। সম্বলপুর ও গঞ্জাম , উড়িষ্যা বাংলার সাথে যুক্ত থাকবে।
৩। ছোটনাগপুর মধ্যপ্রদেশের সাথে যুক্ত হবে।
প্রশাসনিক কারণে ব্যবচ্ছেদ করার যে পরিকল্পনা করা হচ্ছিল, তার সমর্থনে বলা হয়, এই প্রেসিডেন্সির জনসংখ্যা খুব বেশী। যেমন ১৮৬৭ সালের উড়িষ্যার ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে কলকাতা থেকে ত্রান পৌছাতে খুব অসুবিধা হয়। ১৮৭৪ সালে আসামকে ২ মিলিয়ন জনসংখ্যা নিয়ে বাংলা থেকে বিছিন্ন করা হয়। মোদ্দা কথা আমলাতন্ত্র চাইছিল বাংলা প্রদেশটি ভাগ হোক। অমলেশ ত্রিপাঠী তাঁর 'ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও জাতীয় কংগ্রেস' বলে গ্রন্থে লিখেছেন, কার্জন তখনো বাংলার বৈজ্ঞানিক সীমাবিন্যাসের কথা ভাবছিলেন। তাঁর মনে কোন রাজনৈতিক অভিসন্ধি দেখা দেয়নি। সুমিত সরকার তাঁর 'আধুনিক ভারত ১৮৮৫ -১৯৪৭' গ্রন্থে লিখছেন, ' ...প্রকাশ্যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য অস্বীকার করা হয়েছিল। কিন্তু বিশেষত দ্বিতীয়ত পর্যায়ে , গোপন সরকারী কাজকর্ম, মন্তব্য, ও ব্যক্তিগত কাগজপত্রের কল্যানে তা টেঁকানো মুস্কিল।'
আমলাতন্ত্র কেবল মাত্র প্রশাসনিক সুবিধার জন্যে এই ব্যবচ্ছেদ চাইছিল না। স্বরাষ্ট্র সচিব রিজলে ১৯০৪ সালে ৭ ফেরুয়ারি আর ৬ ডিসেম্বর দুটি নোট দেন। যা থেকে পরিস্কার বোঝা যায়, রাজনৈতিক কৌশল হিসাবে এই ব্যবচ্ছেদ গুরুত্ব পূর্ণ ছিল। রিজলি লিখেছেন, ' ঐক্যবদ্ধ বাংলা একটা শক্তি। বিভক্ত বাংলা নানা দিকে চলবে।' তাঁর যুক্তি ছিল, পূর্ব বাংলা কলিকাতার ক্ষতিকারক প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে ভালো ভাবে শাসিত হবে আর পূর্ব বাংলার মুসলিম অধিবাসীরা পশ্চিম বাংলার হিন্দু সংখ্যাগুরুদের হাত থেকে মুক্তি পাবে, ন্যায় সঙ্গত অধিকার পাবে। ফ্রেজার আর রিজলি প্রভৃতি আমলারা বিশ্বাস করতেন, বাংলার চরমপন্থী মতকে দমন করতে হলে বাংলা ভাগ করা দরকার। ১৯০৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকাতে কার্জন একটা বক্তৃতা দেন , যা বিশ্লেষণ করে পরিষ্কার বোঝা যায়, পশ্চিম আর পূর্বের রাজনীতিবিদদের মধ্যে একটা সাম্প্রদায়িক প্রভাব সৃষ্টি করে দুর্বল করে দেবার চেষ্টা তিনি করছেন। বিপানচন্দ্র কার্জনের নীতি বিশ্লেষণ করে বলছেন, উভয় বাংলাতেই বাঙালী হিন্দুদের কার্জন সংখ্যালঘু তৈরি করতে এই নীতি গ্রহণ করেন। পূর্ব বাংলা আসামের সাথে যুক্ত হলে অসমীয়া ও বাঙালী মুসলমানরা সেখানে সংখ্যা গুরু ছিল।পশ্চিম অংশ বিহারী ও ওড়িয়াবাসীর সংখ্যা ছিল ৩৭ মিলিয়ন আর বাঙালাভাষী মানুষ ছিল ১৭ মিলিয়ন। আসল কথা বাঙালী জাতীয়তাবাদ দুর্বল হয়ে যাবে,যার সাথে সাথে কংগ্রেস ও দুর্বল হয়ে পড়বে। ভারত সচিব 'বাংলাভাষায় কথা বলা অংশ'-কে ওড়িশা আর বিহার থেকে আলাদা করতে চেয়েছিলেন। একটি টেলিগ্রামে কার্জন তাকে বলেন ' would tend to consolidate the Bengali element by detaching it from outside factors , and would produce the very effect that we desire to avoid.' অমলেশ ত্রিপাঠী র মতে, ' The whole thing was a typical example of how the Indian officialdom forced the hands of the viceroys …' আমলাতন্ত্র আসলে 'সুবিধাজনক' শাসন চাইছিল। অন্যদিকে বাংলার জনগণের একটি স্বাধীন মতামত গড়ে উঠেছিল।
ব্রিটিশ সরকার ১৯০৫ সালের জুলাই মাসে বাংলাভাগের সংকল্প ঘোষণা করে। বেঙ্গলী পত্রিকায় 'একটি গভীর জাতীয় বিপদ' শিরোনামে সুরেন্দ্রনাথ জাতির উদ্দেশ্যে একটি প্রবন্ধ লিখলেন। সুরেন্দ্রনাথ সহ অন্যান্য নরমপন্থী বা মডারেট নেতারা (ভূপেন্দ্র নাথ বসু,কৃষ্ণ কুমার মিত্র প্রভৃতি) কলকাতার সাথে গ্রাম বাংলার যোগাযোগের চেষ্টা করলেন।এই সময়ের আন্দোলন এর কৌশল ছিল:
সভা সমিতির দ্বারা বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো।
কলকাতার টাউন হলে ১৯০৪ এর মার্চ মাসে , আর ১৯০৫ এর জানুয়ারি মাসে দুটি বেশ বড় প্রতিবাদ সভা হয়। কলকাতা ছাড়াও, ঢাকা, ময়মনসিংহ প্রভৃতি জেলায় অনেকগুলি প্রতিবাদ সভা হয়।বাংলার বহু খেতাবধারী জমিদার রাও এতে অংশ গ্রহণ করেন। মহারাজা মনীন্দ্র চন্দ্র নন্দীর বিশেষ অংশগ্রহণের কথা জানা যায়। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই আন্দোলনে সামিল হন।
সংবাদ মাধ্যমে আন্দোলন।
সুরেন্দ্র নাথের 'বেঙ্গলী',সঞ্জীবনী,ডন, ইন্ডিয়ান মিরর, বঙ্গবাসী পত্রিকা,নিউ ইন্ডিয়া,বন্দে মাতরম,সন্ধ্যা, যুগান্তর এই বিষয়ে সরব হয়।
বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে যুক্তি পূর্ণ আবেদন পত্র, পুস্তক-পুস্তিকা প্রকাশ করে প্রশাসনিক ভাবে এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মত স্থাপন।
বিখ্যাত পাঁচটি পত্রিকা র কথা জানতে পারি। এগুলির মধ্যে ছিল ' An open letter to Lord Curzon). এটি ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়। বাকী চারটি কলকাতা থেকে প্রকাশিত। এই পুস্তিকা গুলিতে একটি 'বিকল্প প্রস্তাব' দেওয়া হয় ।এই সময়ের ইতিহাস আলোচনা করতে গিয়ে সুমিত সরকার লিখেছেন, ' The traditional techniques of moderate agitation got a full trial during the first phase of the anti-partition movement from Dec, 1903 to July 1905.'
নরমপন্থীদের এই নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন অগ্রাহ্য করে ১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর বঙ্গ ব্যবচ্ছেদ করা হল।'অরন্ধন' , 'রাখী বন্ধন', 'কালী ঘাটে পূজা দান' ইত্যাদি মাধ্যমে প্রতিবাদ জানানো হয়। ফেডারেশন হলের ভিত্তি স্থাপন করা হয়।কলকাতার একটি সভায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ' বাংলার মাটি বাংলার জল' গানটি রচনা করেন। বাংলা আবেগে উত্তাল হয়। আর আবেদন নিবেদনের রাজনীতি তে কাজ হবে না বুঝে নরমপন্থী সুরেন্দ্রনাথ টাউন হলের ৭ই অগাস্টের সভাতে 'বয়কট' প্রস্তাব করেন। বাংলা তথা ভারতবর্ষের ইতিহাস এক বিরাট আন্দোলনের সূচনাবিন্দুতে এসে দাঁড়ায়।