“দরিদ্রতর ও অযোগ্য তর বাঙালি ছাত্র, যাদের আমরা রাজনৈতিক দিক থেকে চেপে রাখতে চাই,গুরুদাস কিনা তাদের হয়ে সওয়াল করছেন” ওপরের এই মন্তব্য টি লর্ড কার্জন করেছিলেন । গুরুদাস বন্ধোপাধ্যায় এর মতন মৃদু স্বভাবের মানুষ যখন শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারী সংকোচনের চেষ্টার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ছিলেন। লর্ড কার্জন এর এই সামান্য মন্তব্য থেকে বোঝা যায় ভারতে ইংরেজ শাসন আসলে ভারত থেকে সম্পদ আহরণ করে কোষাগার ভর্তি করা ছাড়া আর কিছুই চাইত না। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন ধীরেধীরে সশস্ত্র আন্দোলন এর রূপ নিতে বাধ্য হল। সুমিত সরকার লিখেছেন, “বয়কট বা নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা ও বিফলতাই সকল নেতাকে সন্ত্রাসবাদের পথে পরিচালিত করে।” ১৯০৭ সালে যুগান্তর পত্রিকায় একটি আর্টিকেলে বলা হয়, “প্রতি জেলায় ইংরাজ কর্মচারীর সংখ্যা নগণ্য। দৃঢ় ভাবে চেষ্টা করলে একদিনেই ব্রিটিশ শাসন লোপ করা সম্ভব।”
১৯০৯ সালে মিশনারিদের এক সম্মেলনে ডঃ গারফিল্ড উইলিয়ামস্ কলকাতার ছাত্র জীবনের যে হতাশা ব্যঞ্জক এবং মর্মস্পর্শী ছবি তুলে ধরেছিলেন তা অতিরঞ্জিত মনে হলেও একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে একজন কারিগর,এমন কি মুটে –মজুরও দিনে বারো আনা থেকে একটাকা রোজগার করতে সক্ষম হলেও একজন শিক্ষিত তরুণের পক্ষে সেটা উপার্জন করা প্রাণান্তকর অবস্থা হয়ে গিয়েছিল। সে সময় বাংলায় শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ছিল ৪০,০০০ এর বেশী। যার ফলে ব্রিটিশ শাসনকে স্বাভাবিক ভাবেই তারা সহ্য করতে পারছিল না। এরাই পরবর্তী কালের যে সহিংস আন্দোলনের মূল শক্তি হিসাবে এগিয়ে আসে। স্বদেশী আন্দোলনের সময় থেকেই বাংলার জেলাগুলিতে বহু সমিতি তৈরি হয়। যথা বরিশালের ‘স্বদেশ বান্ধব’,ঢাকার ‘অনুশীলন সমিতি’ , ময়মনসিংহের ‘সুহৃত’, ফরিদপুরের ‘ব্রতী’, কলিকাতার ‘যুগান্তর’। যুগান্তর আর অনুশীলন সমিতি সন্ত্রাস বাদের পথ গ্রহণ করে। অরবিন্দ ঘোষের কনিষ্ঠ ভাই বারীন্দ্রের উদ্যোগে ১৯০৫ সালে একটি বিপ্লববাদী বই — ‘ভবানী মন্দির’ প্রকাশিত হয়। এরপর বারীন্দ্রের নেতৃত্বে অনুশীলন সমিতির বহু শাখা স্থাপিত হয়। বহু তরুণ এই সমিতিতে যোগ দেন। ভগিনী নিবেদিতা ও জনৈক কাউন্ট ওকাকুরাও বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনে প্রেরণা দেন। রমেশ চন্দ্র মজুমদারের ‘হিস্ট্রি অফ ফ্রিডম মুভমেন্ট’ বই এ একটি তালিকা পাওয়া যায় —
এই তালিকা থেকে বোঝা যায় নানান ভাবে বিপ্লবীরা ব্রিটিশ শাসনকে আঘাত করার চেষ্টা করছিল। যুগান্তর পত্রিকা ১৯০৮ সালে নিষিদ্ধ হল। বারীন্দ্র আর যুগান্তর গোষ্ঠী মানিকতলার মুরারিপুকুরে কেন্দ্র স্থাপন করেন। সেই সময় পূর্ব বঙ্গের ছোটলাট ফুলার খুব অত্যাচারী হয়ে উঠেছিলেন। তাকে হত্যার চেষ্টা ব্যর্থ হয়। হেমচন্দ্র কানুনগো ইয়োরোপে গিয়ে এক দেশত্যাগী রুশ বিপ্লবীর কাছে বোমা তৈরি করতে শেখেন। অত্যাচারী কিংসফোর্ড কে মারবার জন্যে ক্ষুদিরাম বোস আর প্রফুল্ল চাকী মজফরপুর যান।এটি একটি ব্যর্থ প্রচেষ্টা। ভুল মানুষকে মেরে ফেলেন দুজন। আর প্রফুল্ল চাকী ধরা আত্মহত্যা করেন, ক্ষুদিরামের ফাঁসি হয়। সাধারণের মনে এর একটা সুদূরপ্রসারী প্রভাব তৈরি হয়। এরপর মুরারিপুকুর বাগান থেকে প্রায় ৩৪ জন বিপ্লবীকে ইংরাজ পুলিশ ধরে সাথে অরবিন্দ ঘোষ। আলিপুর ষড়যন্ত্র মামলা শুরু হয়। চিত্তরঞ্জন দাশের ওকালতির ফলে অরবিন্দ মুক্তি পান। বারীন্দ্র, উল্লাসকর সহ ১৫ জনের দ্বীপান্তরের সাজা হয়। অরবিন্দ ঘোষ যোগ সাধনায় পন্ডিচেরি চলে গেলেন আর বারীন্দ্র দ্বীপান্তরে গেলে স্বাভাবিক ভাবেই কলকাতাকেন্দ্রিক বিপ্লবী কার্যকলাপ বন্ধ হয়।
ঢাকায় পুলিন দাসের নেতৃত্বে ঢাকা অনুশীলন সমিতি সক্রিয় হয়ে ওঠে।এইসময় বেশ কিছু অত্যাচারী রাজ কর্মচারী কে তারা হত্যা করে। ১৯১৪ সালে কলকাতার রডা কোম্পানির ৫০ টা বন্দুক আর ৪৬০০০ গুলি বিপ্লবীরা দখল করে। ‘বাঘা যতীন’ অর্থাৎ যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ‘যুগান্তর’ গোষ্ঠী গড়েন তাতে স্বামী প্রজ্ঞানানন্দের ‘বরিশাল দল’ , হেমেন্দ্র কিশোরের ‘ময়মনসিংহ দল’, এবং পূর্ণ দাসের ‘মাদারিপুর দল’ যোগ দেয়। বিপিন গাঙ্গুলি, নরেন ভট্টাচার্য, যাদুগোপাল মুখোপাধ্যায় প্রভৃতি বিপ্লবীও এই দলে ছিলেন। নরেন ভট্টাচার্য পরবর্তীকালে বিখ্যাত চিন্তাবিদ মানবেন্দ্রনাথ রায় বলে খ্যাত হন। ১৯১৫ সালে বুড়িবালামের খণ্ড যুদ্ধে বাঘা যতীন এর মৃত্যু হয়।
বাঘা যতীনের এই পরিকল্পনা ছিল, এক বৃহত্তর সর্বভারতীয় পরিকল্পনার অঙ্গ। ব্রিটিশ সরকারের ভারত রক্ষা আইনের কঠোর প্রয়োগ, সন্ত্রাসবাদীদের মধ্যে দলাদলি, যতীন্দ্রনাথ মতো নেতার অভাবে বিপ্লবী আন্দোলন ঝিমিয়ে পড়ে। তার মধ্যেও ১৯১৯ থেকে ১৯২৯ পর্যন্ত বাংলায় প্রায় ৪৭ টি সহিংস ঘটনা লিপিবদ্ধ আছে। ১৯৩০ সাল এ দেশের একদিকে যখন গান্ধিজী লবণ সত্যাগ্রহ করছেন, তখন মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের মতো ঘটনা ঘটল বাংলায়। ১৯৩০ সালেতে সহিংস ঘটনা ঘটে ৫৬ টি। মাস্টারদার সহযোগীদের নামের তালিকা দীর্ঘ। অনন্ত সিং, নির্মল সেন, গনেশ ঘোষ, লোকনাথ বল ও অম্বিকা চক্রবর্তী প্রভৃতি। বহু শিক্ষিতা মহিলারা এই কাজে এগিয়ে আসেন,প্রীতিলতা ওয়াদেদার, কল্পনা দত্ত, সুহাসিনি গাঙ্গুলি। ১৯৩০ সালে ৮ ডিসেম্বর দীনেশ গুপ্ত, বিনয় বসু ও বাদল গুপ্ত কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিং অভিযান করেন। এই ঘটনাগুলি সব নানান দিক থেকে উল্লেখ যোগ্য হলেও ,বিরাট ব্রিটিশ শক্তির সামনে ব্যর্থ পরিগণিত হয়েছিল।
বাংলার বাইরেও অনুশীলন সমিতির বিপ্লবী কেন্দ্র স্থাপিত ছিল। সরকারী রিপোর্ট থেকে জানা যায়, পাটনা, দুমকা, বারানসী ও এলাহবাদে বিপ্লবী কেন্দ্র স্থাপন হয়। বঙ্গভঙ্গের সময় থেকে পাঞ্জাবের বিপ্লবীদের সাথে যোগসূত্র হয়েছিল। ১৯০৪ সালে শাহারানপুরে প্রথম কয়েকজন যুবক দেশের মুক্তির জন্যে গুপ্ত সমিতি তৈরি করেছিলেন। পাঞ্জাবে আর্যসমাজ আন্দোলন ও শিখদের গুরুদ্বার আন্দোলন জাতীয় চেতনা তৈরি করে ছিল। লালা হরদয়াল, সুফী অম্বাপ্রসাদ ও অজিত সিং সহিংস আন্দোলনের নেতৃত্ব হিসাবে উঠে আসেন। ১৯১১ সালে রাসবিহারী বসু লর্ড হার্ডিঞ্জ এর শোভাযাত্রায় তার ওপর বোমা ছোড়েন। লালা হরদয়ালকে বিপ্লবী মতবাদ প্রচার করার জন্যে নির্বাসন দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ১৯০৮ সালে মুক্তি পেয়ে তিনি আবার তাঁর কাজ চালাতে থাকেন। আর অজিত সিং খুব উদ্যোগী হয়ে কাজ করছিলেন। লাহোরে তিনি 'আঞ্জুমান-ই-মহব্বতি-ওয়াতন' ও ‘ভারত মাতা’ এই নামে দুটি পত্রিকা বার করতেন। মুসলমান আর হিন্দু নামের মিলন ব্রিটিশ শাসন কে চিন্তিত করে ফেলে। অজিত সিংহ হলেন প্রখ্যাত বিপ্লবী ভগত সিং এর কাকা। কৃষক খেপানোর অভিযোগে ১৯০৭ সালে অজিত সিং আর লাজপত রায়কে দ্বীপান্তরে পাঠানো হয়েছিল। সরকারী রাজস্ব, জল কর ও অন্যান্য কর না দেওয়া বন্ধ করার জন্যে তারা মানুষ কে একত্র করে ফেলেছিলেন। নানান ধরণের নিপীড়নমূলক আইন প্রয়োগ করার ফলে স্বাভাবিক ভাবেই আন্দোলনগুলি ধীরে ধীরে গুপ্ত ভাবে নিজেদের জায়গা করে নিল। অজিত সিং এর অন্যান্য সহযোগীরা সহিংস ভাবে ব্রিটিশ বিরোধিতার জন্যে তৈরি হলেন।
১৯০৭ থেকে ১৯০৮ সালে মহারাষ্ট্র ও মুম্বাই শহরে বাল গঙ্গাধর তিলকের দুটি প্রধান কাজ দেখতে পাওয়া যায়, প্রথম, মদের দোকানের সামনে ধর্না আর দ্বিতীয়, শ্রমিক শ্রেণীর সাথে যোগ গড়ে তলার চেষ্টা। তিলক ও তাঁর সহযোগীরা মহারাষ্ট্র ও অনান্য প্রদেশে স্বরাজের অঙ্গিকার বিস্তৃত বয়কট বা নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধের কথা উদ্যম সহকারে প্রচার করতেন। বাংলার সন্ত্রাসবাদ নিয়ে ‘কেশরী’তে একটি প্রতিবেদন লেখার জন্যে ছয় বছর দ্বীপান্তর দণ্ডিত হন। সাধারণ মানুষ এই জনপ্রিয় নেতার জন্যে ক্ষেপে ওঠে। ২২ শে জুলাই থেকে ২৮ শে জুলাই পর্যন্ত বিরাট ধর্মঘট হয়। ৮৫টি সুতোকলের মধ্যে ৭৬টি বন্ধ ছিল। নানান ঘটনায় ষোলো জন পুলিশের গুলিতে মারা যায়। তিলকের অভাবে মহারাষ্ট্রের ব্যক্তি সন্ত্রাস জায়গা করে নিল। বিনায়ক দামোদর সাভারকার লন্ডন থেকে গোপনে যেসব পিস্তল পাঠিয়েছিলেন ১৯০৯ সালে তাই দিয়ে নাসিকের জেলাশাসক কে হত্যা করা হয়।
বঙ্গভঙ্গের পরবর্তীতে বিছিন্ন ভাবে সহিংস আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। দেশের মানুষদের মধ্যে নানা ভাবে এই ঘটনাগুলি আত্মবিশ্বাস তৈরি করছিল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার।প্রবল সরকারি নিপীড়ন,অন্যায় ভাবে আর্থিক শোষণ, শিক্ষিত সাধারণ মানুষের স্বাধীন চিন্তা গড়ে ওঠা, এই সব গুলি দেশের শাসন একটি বিদেশী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত থাকাকে একটি প্রশ্নের সামনে নিয়ে আসছিল। সহিংস আন্দোলন এক দিকে শক্তিশালী ছিল না। মানুষের মনের স্বাভাবিক বিক্ষোভ পরিকল্পনাহীন ভাবে বার হয়ে আসছিল। এই ব্যর্থতা ধীরে ধীরে সাধারণের মধ্যে জাগরণ গড়ে তুলছিল।
ছবিঃ উইকিপিডিয়া