মহিশূর রাজবংশের তৈরি বিজয় মিনার
টিপুর প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ (বা নেই অবশেষ) কে বাঁদিকে রেখে এগোতেই কিছু দূরে একটা রেল লাইন দেখা যায়। আর তার পাশেই একটা ছোট মিনার দেখা যায়, যাকে বলে ওবেলিস্ক (Obelisk)। এই মিনারের বয়স বেশি নয়, ১৯০৭ সালে তৎকালীন মহিশূর সরকার দ্বারাই নির্মিত হয় এই স্তম্ভ। কেন জানো? দ্বিতীয় অ্যাংলো-মাইসোর যুদ্ধে ব্রিটিশদের জয় এবং ইংরেজ সৈনিকদের আত্মত্যাগকে স্মরণীয় করে রাখতে! এর থেকেই বোঝা যায়, মহিশূর রাজবংশ তথা ওয়াদেয়ার পরিবার কেমন মানসিক ভাবে টিপু বিরোধী এবং ইংরেজ-তোষণকারী ছিল।
বৃত্তাকার বেদী এক এক করে চারটে ধাপ উঠে গিয়ে ওই স্তম্ভ। স্তম্ভের গায়ে নিচের দিকে লেখা কেন এই স্তম্ভ, এবং তার ওপর চোঙের মত স্তম্ভ ওপর দিকে উঠে গেছে। ভাল করে দেখলে লক্ষ্য করবে, চারদিকে চারটে কামানের গোলার ওপর এই পিরামিড আকৃতি স্তম্ভের ওপরের অংশ। কাছে গেলে দেখবে, স্তম্ভের গায়ে ইংরেজিতে লেখা –
" This monument is erected by the government of Mysore in 1907 in order to commemorate the siege of Seringapatam by the British forces under lieutenant general G. Harris and its final capture by assault on the 4th May 1799. As also the names of those gallant officers who fell during the operations."
এ ছাড়াও চারদিকে পাথরে আরও অনেক কিছু লেখা আছে। সেই যুদ্ধের তথ্য, শহীদ সেনাদের কথা।
পর্যটকরা খুব একটা আসে না এই স্তম্ভের দিকে, সোজা বাঁক নিয়ে রঙ্গনাথ স্বামীর মন্দিরের দিকে চলে যায়। রেল লাইনের ধারে এই ভিক্টোরীয় ওবেলিস্ক আর দূরে কাবেরী নদীর স্রোত একরকম বুঝিয়ে দেয়, এই শ্রীরঙ্গপত্তনার সীমা। এরপর আর দেখার কিছু নেই। তবে না, আমাদের জন্য কিন্তু এখনই শেষ হয় নি। শ্রীরঙ্গপত্তনা ভ্রমণের শেষ দিকে এসে গেলেও এখনও খানিকটা বাকি আছে বই কি? ওই যে বললাম ওবেলিস্কের পেছনে কাবেরী নদীর স্রোত... সেই নদীর ওপরেই একটা পাথর দিয়ে নির্মিত সেতু দেখা যায়। খোঁজ করলে জানবে, দুশো বছরেরও বেশি পুরনো পাথর দিয়ে তৈরী এই সেতু, একেবারে খাস ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ারিং প্রভাবে নির্মিত। যে দিওয়ান পুর্ণাইয়া টিপু'র আনুগত্য ত্যাগ করে মাইসোরের রাজপরিবারকেই প্রভু স্বীকার করেছিলেন, অ্যাংলো-মাইসোর যুদ্ধের পর শ্রীরঙ্গপত্তনার দায়িত্ব অনেকটাই এসে পড়ে ওনার ওপর। ১৮০৪ সালে বৃদ্ধ দিওয়ান পুর্ণাইয়ার তত্ত্বাবধানেই এই সেতু নির্মিত হয়। নাম দেওয়া হয় ওয়েলেস্লি ব্রিজ (Wellesley Bridge)। প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা খরচ করে (তখনকার হিসেবে) এই সেতু নির্মিত হয়। সেতুর এক পারে একটি ফলকে ঊর্দু এবং ইংরাজীতে যা লেখা আছে, তা এখনও স্পষ্ট পড়া যায় –
"Dedicated To Richard Marquess Wellesley K:P: Governer General of India by Krishnaraj Wodeir Bahaudur in a public testimony of his gratitude and as a lasting monument of the benefits conferred on the people and country of Mysore. Begun August 1802 Finished October 1804 under the care of Poorniah Dewan "
মানে - ওয়াদেয়ার রাজা ইংরেজ শাসকের প্রতি তাঁর কৃতজ্ঞতা জাহির করে এই সেতু ওয়েলেসলির নামে উৎসর্গ করলেন!
ওয়েলেসলি সেতু
এই সেতুর প্রধান অঙ্গ যেমন পিলার, কর্বেল, গার্ডার... সবই পাথরের। কর্বেল (corbel) কি জানো? এই যে সেতুর নিচে বাড়তি ভার বহন করার জন্য পিলার থেকে দুদিকে যে অংশ অনেকটা উলটো ইংরেজি অক্ষর L এর মত থাকে, সেই জিনিস টা। আর গার্ডার (girder) হ'ল বিম-এর মত। দুজনেরই কাজ ভার বহন করা। একটা সেতু কতটা মজবুত, সে কতটা ভার বহন করতে সক্ষম আর প্রাকৃতিক দুর্যোগ কত দূর সহ্য করতে পারবে তা বোঝা যায় তার পিলার, কর্বেল, গার্ডার প্রভৃতি ভার-সহ্য করা অঙ্গগুলো কে দেখে। সেই নির্মান এতই উৎকৃষ্ট মানের ছিল, যে আজও সেই সেতু রয়ে গেছে দুশো বছরের ঝড় ঝাপটা সহ্য করে। এখনও লোকজন হেঁটে বা সাইকেল করে সেতু পার হয়। যদিও, স্বাভাবিক কারণেই... কোন রকম আধুনিক যানবাহনের এই সেতু্র ওপর দিয়ে যাতায়াত একেবারে নিষিদ্ধ। এই সেতু এখন শ্রীরঙ্গপত্তনার ঐতিহ্য, এ রক্ষণাবেক্ষণও প্রশাসনের দায়িত্ব। তবে পর্যটকরা এই সেতুতেও যায় না, কেবল দূর থেকে দেখতে পায়। আর, যাদের ইচ্ছে হয়, তারাই খোঁজ করে বা কাছে গিয়ে দেখার চেষ্টা করে।
কর্নেল বেইলির কারাগার
আর ওবেলিস্ক এর ডানদিকে, কাবেরী নদীর তীরেই টিপু সুলতানের সময়ের শেষ নিদর্শন এক কোণে অদ্ভুতভাবে ঝিমিয়ে থাকে - Colonel Bailey's Dungeon (কর্নেল বেইলির কারাগার), যার কথা আগের পর্বে বলেছিলাম তোমাকে। কারাগার না বলে, বলা উচিৎ অন্ধকূপ, কিংবা গুমঘর। মাটির তলের থেকে অনেকটা নিচে এই কারাগার, সিঁড়ি দিয়ে ধাপে ধাপে নেমে আসতে হয় বেশ খানিকটা নিচে... একদম নদীর জলস্তরের কাছাকাছি।
কর্ণেল বেইলির কারাগারের ভেতরে
এখন সাদা রঙ করে চুনকাম করা, ভেতরটা একদম পরিষ্কার করে রাখা... তাও কেমন একটা সোঁদা গন্ধ। কেউ ফিসফিস করে কথা বললেও প্রতিধ্বনি হয়। তুমি যদি সেখানে যাও, তোমারও প্রথমে ইচ্ছে করবে এদিক ওদিক ছুটোছুটি করে একটু ধরাধরি কিংবা লুকোচুরি খেলে নিতে... কিন্তু এসবের মধ্যে একটু গা ছমছমও যে করবে না, তা নয়। স্যাঁত স্যাঁতে ঠাণ্ডা দেওয়াল আর কনকনে মেঝে দেখে আমারই কেমন একটা লাগছিল, তার সঙ্গে আবার একটা সোঁদা গন্ধ। জানলাম, নদীর জল এই কারাগারের ভেতরে চলে আসত বর্ষাকালে।
দেওয়ালের দিকে তাকালে দেখা যায়, মানুষের কাঁধ সমান উচ্চতায় পাথরের খণ্ড ইঁটের মত বেড়িয়ে আছে কিছু তফাত রেখে রেখে। আর সেই পাথরের মধ্যে গোল গর্ত করা। আসলে সেই সব গর্তের মধ্যে দিয়ে লোহার শেকল ঢোকানো হ'ত, আর সেই শেকল দিয়েই বাঁধা থাকত বন্দীদের হাত। বন্দীরা দিনের পর দিন দাঁড়িয়ে থাকত এই অন্ধকূপে, অত্যাচার সহ্য করে। নদীর জল ক্রমে বাড়তে বাড়তে এই কারাগারে প্রবেশ করত, ধাপে ধাপে গোড়ালি, কোমর, বুক... সব জলে ডুবে যেত। হয়ত গলা অবধি নদীর জলে ডুবে হাবুডুবু খেত, ছটফট করত বন্দীরা। সেই জল কি আর পরিস্কার জল? না জানি কতরকম জলের প্রাণী তার সঙ্গে ঢুকে পড়ত কারাগারে... সাপ, জোঁক, বিছে... ভাবলেই গা শিউরে ওঠে!
বন্দীদের হাত শেকল দিয়ে বেঁধে রাখার গর্ত
যে অ্যাংলো-মাইসোর যুদ্ধকে পলিলূরের যুদ্ধ (Battle of Pollilur)বলে চেনা হয়, সেপ্টেম্বর ১৭৮০'র সেই যুদ্ধে টিপু সুলতান জোরালো ভাবে মাত দিয়েছিলেন ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর সেনাদের। পরাজিত ব্রিটিশ সেনাদের যুদ্ধবন্দী করে এই কারাগারেই নিয়ে আসা হয়। কর্ণেল বেইলি বন্দী হ'ন, এবং তার সঙ্গে বন্দী হন আরও অনেক। এরপর এক এক করে আরও অনেক ইংরেজ বন্দীকে এই কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাম – কর্ণেল ব্রাইথহোয়াইট স্যাম্পসন, ক্যাপ্টেন বেয়ার্ড, প্রভৃতি। মোটকথা, এই অন্ধকূপ কারাগার ছিল সেই সময়ের এক বিভীষিকা, যাকে মৃত্যুর থেকেও ভয়াবহ শাস্তি হিসেবে ভাবা হ'ত। ইংরেজরা টিপুর প্রাসাদ ধূলিসাৎ করে আক্রোশ মেটালেও, এই কারাগারকে কিছুই করেনি। হয়ত টিপুর শাসনকাল শেষ হওয়ার পরেও এই কারাগারের ব্যবহার ছিল... কি জানি, হয়ত ইংরেজরা নিজেদের যুদ্ধবন্দীদের জন্যেও এই কারাগারকে বেছে নিতো... সেই বন্দীদের নাম আর জায়গা পায়নি ইতিহাসে।
কারাগারের ছাত ভেঙে পড়া কামান
ও হ্যাঁ, এই কারাগারের একটা দারুণ চমক যা তোমার চোখ কোনও ভাবেই এড়িয়ে যেতে পারে না... তা হ'ল একটা কামান। মেঝে তে থম মেরে পড়ে থাকা একটা সাধারণ কামান... কিন্তু প্রশ্ন, তা কারাগারের ভেতরে কেন? কেনই বা এভাবে মেঝেতে পড়ে আছে বছরের পর বছর? কিছুটা উত্তর পাওয়া যায় কামানের ঠিক মাথার ওপর, কারাগারের ছাতের দিকে তাকালে... যেখান থেকে একফালি রোদ এসে কারাগারের ভেতরটা আলো করে দেয় দুপুরবেলা। এই কামান নিয়ে অনেকরকম গল্প শোনা যায়। তবে সব থেকে বিশ্বাসযোগ্য ঘটনাটি হ'ল – শেষ সংঘাতের দিন যখন টিপুর গড় রক্ষা করতে একাধিক কামান গর্জে উঠছিল, তার মধ্যে কারাগারের ছাতে নদীর দিকে মুখ করে থাকা এই কামানটিও ছিল। বন্দুকে যেমন রিকয়েল হয় (রিকয়েল কি তা ভাল ভাবে বুঝতে নিউটনের তৃতীয় সূত্রটাও তোমার পড়তে হবে, একটু বড় হয়), তেমন কামানেরও রিকয়েল হয়। মানে, যতটা জোরে সে সামনের দিকে গোলা ছুঁড়ে দিচ্ছে, সেরকমই একটা ধাক্কা আসে পেছন দিকে। কামানকে এমন ভাবে তৈরী করা হ'ত এবং রাখা হ'ত, যাতে সেই ফিরতি ধাক্কা সে সহ্য করতে পারে। কোনও কারণে সেদিন গোলা ছোঁড়ার পর সেই ধাক্কা সহ্য করতে না পেরে কামানটা তার জায়গা থেকে পড়ে যায়, এবং তারপর ছাদ ভেঙে সোজা কারাগারের মাটিতে (এর নিচে চাপা পড়েও কেউ মারা গেছিল কি না কে জানে!)।
কারাগারের ভাঙা ছাত আলো ফেলে কামানের ওপর
তারপর থেকে এই কামান মাটিতেই পড়ে আছে এই ভাবে। কারাগার সংস্কার করার সময়েও কামানটিকে সরানো হয়নি এখান থেকে। বরং কারাগারের ইতিহাসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িয়ে নিজেও একটা গল্প হয়ে থেকে গেছে এই আপাত সাধারণ কামানটি। কারাগারের অলিন্দে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে চুপচাপ, যুদ্ধে পরাজিত সেনার মৃতদেহ'র মত। এভাবেই পড়ে থাকবে পরাজয়ের গ্লানি মেনে নিয়ে, আর দুপুরবেলা একফালি রোদ এসে রোজ হাত বুলিয়ে দিয়ে যাবে তার পিঠে।
ছবিঃ লেখক