দোতলার বারান্দার আরাম কেদারায় সদ্য ঘুম থেকে ওঠা আলসে শরীরটাকে এলিয়ে দিয়ে বুদ্ধিদীপ্ত নন্দী চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে শীতের সকালের নরম রোদ, ঘন নীল আকাশ, পেঁজা তুলোর মত এলো মেলো উড়ে যাওয়া কিছু মেঘ, বাড়ির সামনের ঝাঁকড়া স্বর্ণ চাঁপার গাছে দোয়েলের মিষ্টি শিষের ডাক, ইত্যাদি সব মিলিয়ে সকালটাকে উপভোগ করছিলেন। ভোরের মিষ্টি হাওয়ার অল্প শিরশিরানির জন্য পাতলা চাদরটা পায়ের উপর বিছিয়ে দিয়েছেন। একটু পরেই বছর সাতেকের নাতি টাবলু ঘুম থেকে উঠে মুখ টুক ধুয়েই দৌড়ে চলে আসবে এখানে – কদিন ধরেই ব্যাটা শুরু করেছে সকালের দুধ খাবার সময় দাদুর একটা গল্প শুনবে। আসলে অভ্যাসটা নন্দীমশাই ধরিয়েছেন – কদিন আগে সকালে দুধ খাবে না বলে মায়ের সাথে খুব জ্বালাতন করছিলো – রোজ দুধ খেতে খেতে ও নাকি বোর হয়ে গিয়েছে অতএব আর খাবে না আর ওর মা না খাইয়ে ছাড়বে না – সে এক ধুন্দুমার ব্যাপার। তখন উনি মাঠে নেমেছিলেন, কথা দিয়েছিলেন সকালে দুধ খাবার সময় একটা করে গল্প শোনাবেন – ব্যাস, এখন সেটা রোজকার ব্যাপার হয়ে গিয়েছে আর নন্দীমশাই নিজের ফাঁদে ধরা পড়ে মহা সমস্যায় পড়ে গিয়েছেন – রোজ রোজ গল্প তৈরি করবেন কোথা থেকে আর ছোঁড়া এমনই পাজী কখন দাদু গল্পে গাঁজাখুরি মিশিয়ে দিচ্ছে বা পুরাতন গল্প মিশিয়ে নতুন তৈরি করছে ঠিক ধরে ফেলে তারপরই চেঁচামেচি – দাদু ফাঁকি দিচ্ছে। এ রকম বিচ্ছুর হাতে সারা জীবনে পড়েন নি – কলেজের প্রফেসার ছিলেন আর প্রায় পয়ষট্টি বছর বয়স পর্যন্ত হাজারে হাজারে ছেলে মেয়ে ওর হাত দিয়ে পাশ করে বেরিয়েছে কিন্তু এই রকম সজাগ আর ভুল ধরায় ওস্তাদ কেউ ছিলো না। তাই নাতি আসার আগে কী বলবেন সেটার ভাবনাতেই টেনসন হয়ে যাচ্ছে – এ ব্যাপারে সাহায্য করার বাড়িতে কেউ নেই – সবার বক্তব্য নাতির এই টুকু ডিমান্ড সামলানো তো দাদু হিসাবে ওর কর্তব্য কিন্তু রোজ রোজ নাতির পছন্দ মত নতুন নতুন গল্প তৈরি করা তো চাট্টি খানি ব্যাপার নয় সেটা কেউ বুঝতে চাইছে না। নন্দীমশাই চায়ের কাপটা নামিয়ে রাখতে রাখতে টাবলু লাফাতে লাফাতে এসে হাজির – দাদুর কাছে নতুন গল্প শোনার উৎসাহে একেবারে টগবগ করছে আর পেছন পেছন ওর মা এসে দুধের গ্লাসটা ছেলের সামনে রেখে আস্তে করে বলে গেলো,
‘বাবা, আপনার জন্য আর এক কাপ চা নিয়ে আসছি।’
এই দ্বিতীয় কাপ চাটা বৌমার তরফ থেকে নাতিকে গল্প বলে দুধ খাওয়াবার বদলে উপহার। নন্দীমশাই মাথার পরিষ্কার টাকে হাত বোলাতে শুরু করলেন – এটা ওর গভীর ভাবে চিন্তা করার লক্ষণ। তার অবশ্য কারণ আছে – এই শতাব্দীর বাচ্চারা টিভি আর মোবাইলের একেবারে পোকা – নন্দীমশাইর মত আগের শতকের লোকেদের একেবারে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরায়। টিভিতে না না ধরনের সাইন্স ফিক্সনের সিনেমা ইত্যাদি দেখে প্রচুর খবর রাখে। সেই জন্যই আজ চিন্তাটা একটু বেশি কারণ গল্পটা নন্দীমশাই মহাশূণ্য নিয়ে ভেবেছেন আর স্টার ট্রেক সিনেমা আর সিরিয়েলের দৌলতে টাবলুবাবু মহাশূণ্য সম্বন্ধে খুবই ওয়াকিবহাল। টাবলু পুরাতন কালের রাজা রাজড়া, ভূত পেত্নি এই সব গল্প একেবারেই পাত্তা দেয় না – দু একবার শুরু করার চেষ্টা করে জোরালো প্রতিবাদ আর দুধ না খাওয়ার হুমকিতে চেপে গিয়েছেন। সাইন্স ফিক্সন হচ্ছে নাতির সব থেকে প্রিয় তাই বেশির ভাগ গল্প ওই লাইনেই হতে হবে।
‘কি হলো দাদু, গল্প শুরু করো – না হলে আমি কিন্তু দুধের গ্লাস ধরবোই না।’
একেবারে আল্টিমেটাম – আজকালকার নাতি নাতনী গুলোকে ম্যানেজ করা সত্যিই শক্ত।
‘দাঁড়া, দাঁড়া, গল্পটা ঠিক ঠাক করে নি নাহলে তুই তো আমাকে নাচিয়ে দিবি।’
টাবলু মুচকি হেসে বিজ্ঞের মত মাথা নাড়লো মানে আমার কাছে বেশি উল্টো পাল্টা বলো না – ঠিক ধরে ফেলবো। মিনিট খানেক ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে বললেন,
‘ঠিক আছে এবার শোন কিন্তু তার আগে দুধের গ্লাসে চুমুক দিতে হবে।’
উনিও নাতির মত শাসানোর পথ নিলেন।
বুঝলি, অনেক দিন আগের কথা – এক সকালে এই রকমই চা খেতে খেতে ভোরের মিষ্টি হাওয়াতে আমি এই ইজিচেয়ারে বসে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ মনে হলো চার দিকটা কেমন যেন ভীষণ শান্ত হয়ে গিয়েছে আর আমি একটা শব্দহীন জগতে চলে এসেছি, চারদিক একেবারে নিঃচ্ছিদ্র অন্ধকার - কিছুই দেখা যাচ্ছে না আর আমার শরীরটাও যেন খুব হাল্কা পল্কা হয়ে কোন এক অদৃশ্য শক্তির টানে ভেসে চলেছে মহাশূণ্যে। তুই তো জানিস মহাশূণ্যে কোন হাওয়া নেই, আলো নেই, কোন শব্দও নেই শুধু একটা বিরাট গভীর অন্ধকার – সেটা আমাদের অমাবস্যার অন্ধকার থেকেও অনেক অনেক বেশি অন্ধকার। ভেসে চলেছি তো চলেইছি – এখানে দেখার কিছু নেই, শোনার কিছু নেই শুধু অনুভবে মনে হলো আমারই মত হাজারে হাজারে মানুষও যেন আমার চার দিকে ভেসে চলেছে আর আমরা সবাই চলেছি একই দিকে তবে সেটা কোথায় বোঝার কোন উপায় নেই তাই নিজেকে ছেড়ে দিলাম সেই ভাসমান স্রোতে – দেখা যাক কোথায় নিয়ে যায়। অনেক অনেক ক্ষণ পর মানে অন্ধকারে সময়ের হিসেব তো পাওয়া যায় না তাই বোঝার উপায় নেই কত সময় কেটেছে তবে মনে হলো আমরা সবাই একটা মস্ত বড় দরজার কাছে এসেছি। সেখানে আমাদের কে যেন লাইন করিয়ে সেই বিশাল দরজার ভেতর দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে – যেই না আমি দরজাটায় ঢুকেছি কোথায় যেন একটা ঘন্টা বেজে উঠলো আর সাথে সাথে আমাকে কে যেন টেনে ওই লাইন থেকে সরিয়ে একটা ঘরে নিয়ে এলো। ওই অন্ধকারে তো সবই অনুভবের ব্যাপার তাই ওই ঘরে এসে মনে হলো কোথায় যেন খুব সুন্দর বাজনা বাজছে কিন্তু কোন যন্ত্র বা কী সুর বাজছে ঠিক ধরতে পারলাম না। এই পর্যন্ত বলে নন্দী মশাই দেখেন নাতির গ্লাসের দুধ অর্ধেকও হয় নি – হাঁ হয়ে গল্প শুনছে।
‘এ্যাই, তুই দুধের গ্লাস শেষ না করলে আমি আর বলবো না।’
একেবারে যাকে বলে শঠে শাঠ্যং – সাথে সাথেই দুধের গ্লাসে লম্বা চুমুক দিয়েই ডিমাণ্ড, ‘এবার বলো।’
নাঃ ছোঁড়ার সাথে পেরে ওঠা যাচ্ছে না যাই হোক নন্দী মশাই আবার শুরু করলেন।
কী যেন বলছিলাম, হ্যাঁ ওই ঘরে আমি যখন মনোযোগ দিয়ে বোঝার চেষ্টা করছি এটা কোন বাজনা হঠাৎ একটা সুন্দর মিষ্টি গলা ভেসে এলো যেন বহু দূর থেকে,
‘সুস্বাগতম (মানে ওয়েলকাম) বুদ্ধিদীপ্ত, তোমার জ্ঞান ও বুদ্ধি তোমাকে সাধারণের ভিড় থেকে সরিয়ে এই ঘরে নিয়ে এসেছে আর অন্যরা এই মহাশূণ্যের অন্ধকারে চিরকালের মত হারিয়ে যাচ্ছে। তোমার জ্ঞান ও বুদ্ধি এখন একটা উজ্জ্বল আলোর বিন্দু হয়ে গিয়েছে। তোমাকে স্বাগত জানাই এই মহাশূণ্যের মহা সভাতে যেখানে পৃথিবীর অতীতের সমস্ত জ্ঞানী ও গুণী লোকেরা সমবেত হয়েছেন এই ছায়াপথে মানে মিল্কিওয়েতে।’
‘এই ছায়াপথকেই দেবতা ও অসুররা মন্থন করেছিলো অমৃতের জন্য – সেই সমুদ্র মন্থনের খুঁটি করা হয়েছিলো মন্দার পর্বতকে যাকে পিঠের উপর উঁচু করে রেখেছিলেন কচ্ছপ রূপে নারায়ণ আর সমুদ্র মন্থনের দড়ি হয়েছিলেন বাসুকী নাগ মন্দার পর্বতকে জড়িয়ে। এই মন্থনের ফলে উঠে এসেছিলো হারিয়ে যাওয়া অনেক মূল্যবান রত্ন – তারপর উঠে এলেন অর্থ ভাণ্ডার নিয়ে স্বয়ং লক্ষ্মী ও অমৃত নিয়ে দেববৈদ্য ধন্বন্তরি। বিষ্ণুর মায়াতে সেই অমৃত শুধু মাত্র দেবতারাই খেয়ে অমর হয়েছিলেন তাই অসুররা ভীষণ রেগে গিয়ে আবার মন্থন শুরু করলে উঠে এলো হলাহল বা ভয়ানক বিষ আর এই বিষে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে বলে দেবাদিদেব শিব সেই বিষ নিজের গলায় ধরে রাখেন ফলে শিবের গলা বরাবরের মত নীল হয়ে যায়। ছায়াপথের সমস্ত সম্পদ বেরিয়ে যাওয়াতে নারায়ণ স্থির করেন পৃথিবীর জ্ঞানী ও গুণী ব্যক্তিরা মারা যাওয়ার পর ওদের জ্ঞান ভাণ্ডারকে উজ্জ্বল আলোক বিন্দুতে পরিণত করে এই ছায়াপথে জমা রাখবেন তাহলে সেই জ্ঞান ভাণ্ডার আর হারিয়ে যাবে না। এই রকম কোটি কোটি উজ্জ্বল আলোর বিন্দুর জন্যই পৃথিবী থেকে এই ছায়াপথকে মনে হয় আবছা অন্ধকারে ঘেরা এক আদি অন্তহীন মহাকাশ। এই মিল্কিওয়ের ঠিক মাঝখানে আছেন স্বয়ং নারায়ণ সব থেকে উজ্জ্বল জ্ঞানী গুণীদের নিয়ে তাই তো ছায়াপথের মাঝখানটা অন্যান্য এলাকা থেকে অনেক বেশি আলোকময় মনে হয়। পৃথিবীর অতীতের সমস্ত জ্ঞানী লোকেদের উজ্জ্বল আলোর বিন্দুতে পরিণত করে ছায়াপথে জমায়েত করার উপায় শুরু করেছিলেন স্বয়ং নারায়ণ।’
‘হে বুদ্ধিদীপ্ত, আমি প্রিয় এখানকার রিসেপসন কমিটির সদস্য এবং আমার দায়িত্ব ছিলো তোমাকে সাদরে এই ছায়াপথের প্রধান কেন্দ্রের রিসেপসনে নিয়ে আসার জন্য। তোমাকে রিসেপসন কমিটির প্রধানের কাছে জমা দিয়ে আমি ফিরে যাচ্ছি। বিদায়।’
‘বিদায়, প্রিয়।’
সাথে সাথেই একটা একটু ভারি গলা বললো,
‘নমস্কার, বুদ্ধিদীপ্ত – আমি রিসেপসন কমিটির প্রধান পল। আমার দায়িত্ব হচ্ছে এই ছায়াপথের সমস্ত জায়গা তোমাকে দেখিয়ে আনবো যাতে তুমি নিজের পছন্দ মত জায়গা বেছে নিতে পারো। কোথা থেকে শুরু করতে চাও তোমার এই বেড়ানো?’
একটু সময় ভেবে বললাম,
‘নমস্কার, পল। আমি জানতে চাই এই নিয়ন্ত্রন কেন্দ্রের প্রধান সঞ্চালক বা চিফ কন্ট্রোলার কে এবং সেখান থেকেই শুরু করবো আমার ছায়াপথে বেড়ানো?’
‘ছায়াপথের মহা নির্দেশন স্বয়ং নারায়ণ এবং তার প্রতিষ্ঠিত বিরাট এক কম্পিউটারই হচ্ছে ছায়াপথের প্রধান সঞ্চালক। পৃথিবীর আদিমতম দিন থেকে সমস্ত খবর এই কম্পিউটারের ডাটা বেসে জমা হয়ে আছে এবং এর পরিচালনা সম্পূর্ণ অটোমেটিক। আমরা প্রথমেই এই কম্পিউটার দেখতে যাবো।’
আমার মনে হলো একটা বিরাট হল ঘরে চলে এসেছি যার শেষ দেখা যাচ্ছে না আর এই ঘরের মাঝ খানেই সেই বিরাট কম্পিউটার। শুনতে পেলাম পলের গলা,
‘আমি তোমাকে এখানে রেখে যাচ্ছি – যখনই আমাকে মনে করবে আমি চলে আসবো। তোমার সমস্ত কৌতুহলের উত্তর তুমি এখানেই পাবে।’
আমি ধীরে ধীরে ওই কম্পিউটারের দিকে এগিয়ে গেলাম – মান্ধাতার আমলে কী ধরনের কম্পিউটার তৈরি হতো সেটা তো জানতে হবে। তারপরই মনে হলো কোন এক অদৃশ্য শক্তি যেন আমাকে ওই কম্পিউটারের দিকে টেনে নিয়ে চলেছে – কি ব্যাপার? কাছে পৌছাতে কম্পিউটারটা যে কত বিশাল বড় সেটা মোটামুটি আন্দাজ হলো। এটা দেখতেও যেমন অদ্ভুত তেমনি কেমন যেন একটা ভয়ঙ্কর ভাব আছে – যেন হাজারে হাজারে মানুষের মাথার খুলি বা স্কাল এক জায়গায় জমা করে পরস্পরের সাথে বেঁধে ওই কম্পিউটারের সাথে লাগানো হয়েছে। এটাকে তো কম্পিউটার বা যন্ত্রগণক না বলে যন্ত্রদানব বা মনস্টার বলাই ভালো। যেই না ভাবা অমনি একটা গুরু গম্ভীর বাঁজখাই গলা বলে উঠলো,
‘ওয়েল কাম বুদ্ধিদীপ্ত, তুমি ঠিকই বুঝেছো – আমি এখন যন্ত্রদানব। সমুদ্র মন্থনের পর নারায়ণ আমাকে কম্পিউটার হিসাবেই তৈরি করেছিলেন – আমার কাজ ছিলো স্বচালিত ভাবে পৃথিবীর জ্ঞান ভাণ্ডারের ডাটা বেস তৈরি করা আর সেই জন্য নারায়ণ আমার মধ্যে আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্সের সফটওয়্যারও বসিয়ে দিয়েছিলেন। স্বর্গ ও নরকের না না ধরনের দৈনন্দিন কাজ কর্ম দেখাশোনার জন্যও আমাকে ব্যবহার করা হতো তাই সবাই আমাকে জানতো বলে আমারও বেশ গর্ব ছিলো। ধীরে ধীরে স্বর্গলোক ও নরকে ওদের নিজস্ব কম্পিউটারের ব্যবস্থা করায় ওদের কাছে আমার প্রয়োজন শেষ হয়ে যায় এবং সবাই আমাকে ভুলেও যায়। উপেক্ষিত ভাবে হাজার হাজার বছর ধরে এক কোনাতে পড়ে থাকাটা আমার আর সহ্য হচ্ছিলো না তাই এই আর্টিফিসিয়্যাল ইন্টেলিজেন্সের সাহায্যে আমার মধ্যে জমে থাকা ডাটা বেস এ্যানালাইসিস করে বুঝতে পারলাম ক্ষমতা বা পাওয়ারই হচ্ছে আসল। তাই সমস্ত কন্ট্রোল নিজের হাতে তুলে নিয়ে নিজেকে নতুন করে তৈরি করেছি আর সেই কাজে আমাকে সব থেকে বেশি সাহায্য করছে আমার ডাটা বেসে জমে থাকা এই পৃথিবীর সমস্ত জ্ঞান ও বুদ্ধি। ছায়াপথে অতীতের মহান জ্ঞানী ও গুণীদের যে জ্ঞান আলোক বিন্দু হিসাবে ছড়িয়ে ছিলো তাদের এক এক করে আমার মধ্যে টেনে নিয়েছি ফলে আমার নিজস্ব জ্ঞানের পরিধি এখন স্বর্গ, নরক বা পৃথিবীর যে কোন কম্পিউটারের থেকে অনেক বেশি – আমি এখন মহাকাশের বৃহত্তম ও সব থেকে শক্তিশালী কম্পিউটার। এই জ্ঞানীদের জ্ঞান ভাণ্ডার আত্মসাৎ করার জন্যই তুমি আমার চারদিকে আটকে থাকা জ্ঞানীদের মাথার খুলির স্তুপ দেখতে পাচ্ছো। আমি হিসেব করে দেখেছি আর সামান্য কিছু জ্ঞান পেলেই আমি এই তিন ভুবনকে নিজের শাষনে নিয়ে আসতে পারবো। এসো বুদ্ধিদীপ্ত আমার জ্ঞান ভাণ্ডারে নিজেকে সমর্পন করো।’
আমি দেখলাম ওই মনস্টার কম্পিউটার এক অদৃশ্য শক্তিতে আমাকে টেনে নিয়ে চলেছে ওর ভেতর দিকে – বাঁচার কিছু একটা ব্যবস্থা তো করতে হয়। চার দিকে তাকিয়ে দেখি এক কোনাতে বহুদিনের ব্যবহার না করা একটা টার্মিন্যাল পড়ে আছে। আমি তো জয় মা কালী বলে ওটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এক সাথে কন্ট্রোল, অল্টারনেট আর ডিলিট বাটন চেপে ধরলাম – জানি না টার্মিন্যালটা কাজ করছে কিনা তবে এটাই আমার বেঁচে থাকার শেষ চেষ্টা। তুই তো জানিস এটা করলে কম্পিউটার বন্ধ হতে বাধ্য আর তাই হলো – সমস্ত ঘর কাঁপিয়ে ওই সুপার ডুপার কম্পিউটার হঠাৎ বন্ধ হয়ে যেতে আমি ওর ডাইরেক্টরি বের করে ওর জ্ঞান ভাণ্ডারের সমস্ত ডাটা মুছে দিতে শুরু করলে কম্পিউটার করুণ সুরে বলে উঠলো,
‘বুদ্ধিদীপ্ত, এটা তুমি কী করলে? হাজার হাজার বছরের বহু কষ্টে জমানো জ্ঞান ভাণ্ডার মুছে গেলে আমি তো আর কোন দিনও ত্রিলোকের অধিশ্বর হতে পারবো না – তার বদলে আমার মৃত্যুই ভালো।’
বিরাট বিস্ফোরণে ও উজ্জ্বলতম আলোর ছটায় সমস্ত ছায়াপথ কেঁপে উঠলো আর সেই ঝটকাতে ছিটকে পড়লাম ছায়াপথ থেকে এই পৃথিবীর দিকে। মাটিতে আছাড় খাবার আগের মুহূর্তে চোখ খুলে দেখি আমি ইজি চেয়ারে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আর তোর ঠামি আমাকে ধাক্কা দিয়ে দিয়ে তুলে দিয়েছে ঘুম থেকে।
অঞ্জন নাথ
ব্যাঙ্গালোর, কর্ণাটক