সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo

সেই আদ্যিকালে পৃথিবীর বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইড ছিল প্রচুর, অক্সিজেন ছিল কম। তাই প্রাণের বিকাশ মূলতঃ হচ্ছিল ডাঙায় নয়, জলে। তোমরা সালোকসংশ্লেষ বা 'ফোটো-সিন্থেসিস'এর কথা 'ইচ্ছামতী'র পাতায় আগে পড়েছ। এই প্রক্রিয়ায় গাছ বাতাসের কার্বন ডাই-অক্সাইড ও জলীয় বাস্প থেকে নিজের খাদ্য গ্লুকোজ তৈরি করে ও বাতাসে অক্সিজেন ছেড়ে দেয়। এই প্রক্রিয়ার প্রয়োজনীয় শক্তি জোগায় সূর্যের আলো আর অনুঘটক বা 'ক্যাটালিস্ট' হিসেবে কাজ করে সবুজ পাতার ক্লোরোফিল।

গাছ, বায়ুমণ্ডল ও পরিবেশ

কার্বন ডাই-অক্সাইডে ভরা আদিম পৃথিবীর ডাঙায় তাই প্রথমে সৃষ্টি হয়েছিল কার্বন ডাই-অক্সাইডভোজী সবুজ গাছপালার জঙ্গল। তারা ধীরে ধীরে ফোটো-সিন্থেসিসের সাহায্যে বায়ুমণ্ডলের কার্বন ডাই-অক্সাইড কমিয়ে ও অক্সিজেন বাড়িয়ে ডাঙায় অক্সিজেন-নির্ভর প্রাণী, যেমন স্তন্যপায়ী বা 'ম্যামাল'দের সৃষ্টি হবার রাস্তা খুলে দিয়েছিল। মানুষ এমনই একটি প্রজাতি।

আজ কিন্তু মানব সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে এই গাছেরা বিপন্ন হয়ে পড়ছে। গাছকে বাঁচিয়ে রেখে আমরা ফুল, ফল, ছায়া ও অক্সিজেন পাই। কিন্তু গাছকে 'খুন' করলেও লাভ কম নয়। কাঠ লাগে ঘরবাড়ি, আসবাবপত্র বানাতে, লাগে কাগজ তৈরিতে। আবার গাছ কেটে ফেললে সেই জায়গায় বসতি বা কলকারখানা গড়া যায়। ফলে অবোলা গাছ বেচারারা ডাইনে-বাঁয়ে, আইনি-বেআইনিভাবে কাটা পড়ছে। তার সাথে সাথে আমরাও হয়ে উঠছি বেচারা। কারণ এভাবে প্রকৃতির কার্বন ডাই-অক্সাইড ও অক্সিজেনের ভারসাম্য বজায় রাখার যন্ত্রগুলিকে ধ্বংস করে আমরা মানব প্রজাতির অস্তিত্বের সঙ্কট ডেকে আনছি।

বায়ুমণ্ডল নির্মল রাখতে গাছের ভূমিকা অনেক। এক একর জঙ্গল প্রতি বছর বাতাস থেকে ছ'হাজার কিলোগ্রাম কার্বন শোষণ করে আর চার হাজার কিলোগ্রাম অক্সিজেন ফিরিয়ে দেয়। এটা ১৮ জন মানুষের এক বছর নিঃশ্বাস নেবার পক্ষে যথেষ্ট। গাছ আবার প্রাকৃতিক এয়ার কন্ডিশনারও বটে। গাছ মাটির থেকে জল টেনে ধীরে ধীরে পাতা দিয়ে ছেড়ে দেয়, যাকে বলে বাস্পমোচন বা ট্রান্সপিরেশন। এই জল আবার ধীরে ধীরে বাস্পীভূত হয়ে শীতলতার সৃষ্টি করে। একটা সাইজমাফিক গাছ থেকে দিনে যে বাস্পীভবন হয়, তাতে দশটা রুম এসি'র কুড়ি ঘণ্টা চলার সমান কাজ হয়। এছাড়া, গাছ ধুলোও আটকায়। তোমার বাড়ির সামনে একটা বড় পাতাওয়ালা গাছ থাকলে বাইরের দিকে বাতাসে যত ধুলো, ভেতর দিকে অর্থাৎ বাড়ির দিকে তার তিনভাগের একভাগের মতো ধুলো হবার কথা।

গাছ, বায়ুমণ্ডল ও পরিবেশ

গাছ জল আর মাটির ক্ষয়ও আটকায়। পৃথিবীতে জল অঢেল। কিন্তু তার বেশির ভাগই সমুদ্রের নোনা জল যা রান্না-খাওয়ায় তো বটেই, চাষবাস, কলকারখানার কাজেও অচল। পৃথিবীতে 'মিঠে' অর্থাৎ নোনতা নয় এমন জলের ভাণ্ডার সীমিত। এই ভাণ্ডারে যোগ হয় বাস্পীভূত সমুদ্রের জল, যা শেষ অবধি বৃষ্টি হয়ে পৃথিবীতে মিঠে জল হিসেবে ফিরে আসে। এছাড়া রয়েছে হিমবাহ গলে নেমে আসা নদীর জল। এই দুয়েরই এক বড় অংশ আবার সমুদ্রে ফিরে গিয়ে 'নষ্ট' হয়ে যায়। এই মিঠে জলটুক ধরে রাখার লড়াই তাই মানুষ ও সভ্যতার টিঁকে থাকার লড়াই। এই লড়াইয়েও মানুষের এক বড় অস্ত্র গাছ। তারা মাটি থেকে জল টানে, আবার প্রবাহিত বৃষ্টির জলের বাঁধ হয়ে তাকে মাটিতে আটকে রাখতে সাহায্য করে।

পৃথিবীতে মাটির স্তরও খুব গভীর। কিন্তু তার মধ্যে মাত্র ওপরের কয়েক ফুট অবধিই উর্বর 'টপ সয়েল', যাতে ফসল হতে পারে। বৃষ্টি বা অন্য প্রাকৃতিক কারণে এইটুকু মাটিও ক্রমে হাওয়ায় ভেসে বা জলে ধুয়ে সমুদ্রে গিয়ে পড়ছে, ফলে আমাদের খাদ্যের ভাণ্ডার কমে আসছে। গাছের শিকড় মাটি আঁকড়ে রেখে মাটির ক্ষয় কমায়। বিশেষ করে পাহাড়ি ঢালে ধস রুখবার জন্য গাছ থাকাটা খুবই দরকার। এই কথাটা মাথায় না রেখে নির্বিচারে গাছ ও পাথর কেটে ঘরবাড়ি, গেস্ট হাউস বানানো অথবা চাষবাস করার ফলে উত্তরাখণ্ড, কাশ্মীর ও আরও অনেক পাহাড়ি এলাকায় ধস ও বন্যার ফলে বিরাট বিপর্যয় হয়েছে।

গাছের আর এক উপকারিতা হচ্ছে, চোখ ও মনকে শান্তি দেওয়া। সবুজ আলোর তরঙ্গ চোখের ওপর চাপ বা 'আই-স্ট্রেইন' দূর করতে সাহায্য করে। তাই অনেকক্ষণ কাজে চোখ ও মন পীড়িত হলে তাদের শান্ত করার এক উপায় হচ্ছে দূরে সবুজ গাছপালা থাকলে কয়েক মিনিট সেদিকে তাকিয়ে থাকা।

গাছের যা উপকারিতা, এগুলো স্রেফ তার মধ্যে প্রধান কয়েকটি। গাছেদের বাঁচিয়ে রাখার ওপর যে মানুষের টিঁকে থাকা নির্ভর করে, এ ব্যাপারেও সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে – সেটা করা যায় কীভাবে?

প্রথমেই এটা বুঝতে হবে যে গাছের সংখ্যা যত কমবে, আমরা তত বিপন্ন হব। কোনও কারণে যদি গাছ কাটা হয়, তবে আবার অন্ততঃ সমপরিমাণে গাছ লাগাবার নিয়ম অনেক দেশেই চালু আছে। কিছু গাছ অন্য জায়গায় বসানো বা 'ট্রান্সপ্ল্যান্ট' করাও সম্ভব। কাগজ তৈরি করতে প্রচুর কাঠ লাগে। কাগজ পুনর্ব্যবহার বা 'রি-সাইকল' করে এটা কিছু কমানো যায়। এছাড়াও আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সংস্থা PREPS লক্ষ্য স্থির করেছে, কাগজের জন্য একটা গাছ কাটলে অন্ততঃ চারটি চারাগাছ লাগাতে হবে। এই দুই বিধি কতটা মানা হচ্ছে বুঝে বিভিন্ন কাগজকে ৫ থেকে ১ অবধি PREPS গ্রেড দেওয়া হয়। ভারতে তৈরি কাগজের গ্রেড বড়জোর ৩। কলকাতার প্রকাশকরা সাধারণতঃ সর্বনিম্ন ১ গ্রেডের কাগজ ব্যবহার করেন, কারণ পাঠকেরা লালচে রি-সাইকেল করা কাগজ পছন্দ করেন না। ভবিষ্যতের কথা ভেবে আমরা নয় এটুকু অসুবিধা মেনেই নিলাম? সঙ্গে সঙ্গে আমাদের কাগজের বদলে ক্রমে ই-বুক, ই-ম্যাগ ব্যবহারেও অভ্যস্ত হতে হবে। ঘরোয়া ব্যবহারে পুরনো কাঠের জিনিস স্রেফ 'ব্যাক-ডেটেড' হয়ে গেছে বলে ফেলে দেওয়ার অভ্যেসও ছাড়তে হবে। আমাদের দেশে অনেক অভাবী মানুষ কাঠকুটো জ্বালানির জন্য ব্যবহার করেন। সস্তা সৌর চুল্লি, সৌর টর্চ ইত্যাদির প্রচলন হলে গাছ কাটার এই প্রয়োজনীয়তাটাও কমবে।

গাছ, বায়ুমণ্ডল ও পরিবেশ

বিজ্ঞানীরা অবশ্য কৃত্রিম 'ফোটো সিন্থেসিস'-এর গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। এর অর্থ, কোনও রাসায়নিক পদার্থের ওপর সূর্যের আলো ফেলে গাছের মতো সরাসরি শক্তি তৈরি করা আর তার সঙ্গে কার্বন ডাই-অক্সাইড থেকে অক্সিজেন মুক্ত করে বায়ুমণ্ডল কিছুটা নির্মল করা। এই পদ্ধতিতে গাছের ক্লোরোফিলের বদলে অনুঘটক বা 'ক্যাটালিস্ট' হিসেবে ব্যবহার করা হয় কোনও রাসায়নিক পদার্থ। এই পদার্থের উপস্থিতিতে সৌরশক্তির সাহায্যে বাতাসের জলীয় বাস্পের হাইড্রোজেন ও কার্বন ডাই-অক্সাইডের কার্বন নিয়ে গ্লুকোজের বদলে তৈরি করা হয় কার্বন ও হাইড্রোজেনের কোনও জৈব যৌগ 'হাইড্রোকার্বন', যেমন মিথেন। সেটা পরে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। আর জল ও কার্বন ডাই-অক্সাইডের অক্সিজেন বাতাসে মিশে যাবে।

তবে এই গবেষণা বাস্তবে ফলপ্রসূ হতে বেশ ক'বছর দেরি আছে। তার পরও পৃথিবীর অজস্র গাছের তুলনায় এই কৃত্রিম অক্সিজেন তৈরির যন্ত্রগুলোর মোট ক্ষমতা নগণ্যই থাকার সম্ভাবনা। তাই আমাদের এখন যুদ্ধকালীন তৎপরতায় বৃক্ষনিধন নিয়ন্ত্রিত করতে হবে। কারণ তার ওপরই নির্ভর করছে আমাদের ভবিষ্যতে টিঁকে থাকার সম্ভাবনা। নইলে কার্বন ডাই-অক্সাইড বেড়ে বাড়বে প্রদূষণ, বাড়বে গ্রীনহাউস এফেক্ট। এককালে কার্বন ডাই-অক্সাইড ভরা পৃথিবীর বুকে ছিল গাছেদের রাজত্ব। এখন অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়ার ফলে রাজত্ব করছে মানুষ প্রমুখ স্তন্যপায়ী। নিজেদের নির্বুদ্ধিতায় যদি আমরা আবার বাতাস কার্বন ডাই-অক্সাইডে ভরে তুলি, তবে হয়তো ভবিষ্যতের পৃথিবীতে মানুষের বদলে রাজত্ব করবে যন্ত্রমানব বা রোবো, যাদের অক্সিজেন লাগে না।


রেখাচিত্র নির্মাণঃ মহাশ্বেতা রায়
ছবিঃ উইকিপিডিয়া ও ফ্রিপিক

এই সিরিজের পূর্ববর্তী লেখাদুটি লিঙ্কঃ
গ্রীনহাউস এফেক্ট
গ্রীনহাউস গ্যাস ও বিকল্প শক্তি

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনীয়ার ও মুম্বইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চের অবসরপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী অনিরুদ্ধ সেন কলকাতা-মুম্বইয়ের বিভিন্ন সাময়িকপত্র ও ওয়েব ম্যাগাজিনের নিয়মিত লেখক। তাঁর লেখা ও অনুবাদ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়, এবং সংকলিত বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা