সেই ১৯৮০'র দশকের শেষের দিকে, আমাদের একটা নতুন বাড়ি হয়। যেখানে বাড়ি তৈরি হয়, সেখানে সেই সময়ে বিদ্যুৎ সংযোগ বা ইলেকট্রিসিটি ছিল না। হ্যাঁ, ঠিক পাঁচ মিনিট দূরত্বে পাশের শিল্পনগরীতে বিদ্যুৎ থাকলেও, আমাদের সেই নতুন পাড়াতে ছিল না। ফলে ছোটবেলা থেকে শিল্পনগরীর কোয়ার্টার্স-এ থেকে ঘরে আলো পাখা, কল খুললেই জল — এমন সব অভ্যাসের বদলে আমাদের জীবনে জায়গা নিল লন্ঠন, মোমবাতি, হাতপাখা আর জলের কুয়ো। আমার আর আমার ভাইয়ের অবশ্য তাতে মজাই হয়েছিল। বেশ সবসময়ে নিত্যনতুন কিছু একটা অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ পাওয়া যেত।
বাড়ির জলের যোগান দিত পেছনের উঠোনের কুয়ো। কুয়ো থেকে জল তোলা হয় কপিকল দিয়ে, সেটাই সাধারণ নিয়ম। কিন্তু কপিকল দিয়ে দড়ি টেনে জল তোমা খুব সহজ কাজ নয়, বেশ জোর লাগে। আমাদের বাড়িতে আবার বাবা, যিনি নিজে একজন বিজ্ঞান শিক্ষক ছিলেন, কুয়ো থেকে সহজে আর তাড়াতাড়ি জল তোলার জন্য অন্য একটা ব্যবস্থা করলেন। তিনি একটা লম্বা বাঁশ আর একটা ভারী পাথরের সাহায্যে, 'প্রথম শ্রেণির লিভারের তত্ব মেনে, কুয়োর থেকে জল তোলার সুবিধাজনক ব্যবস্থা করলেন।
প্রথম শ্রেণীর লিভার হচ্ছে একটি সরল যান্ত্রিক ব্যবস্থা, যাতে একটি সরু রড তার মাঝের একটি স্থির বিন্দুতে ভর করে থাকে আর তার দুই প্রান্ত ঐ বিন্দুকে স্থির রেখে ঘুরতে পারে। দুই প্রান্তের একদিকে থাকে একটি ভার আর অপর প্রান্তে ঐ ভারকে নড়ানোর জন্য কোনওভাবে বলপ্রয়োগ করা হয়।
প্রথম শ্রেণীর লিভারে ভার থেকে স্থিরবিন্দুর দূরত্ব অর্থাৎ ভারবাহু বলপ্রয়োগের বিন্দু থেকে স্থিরবিন্দুর দূরত্ব অর্থাৎ বলবাহুর চেয়ে কম হয়। ফলে ভার যতটা, তার চেয়ে কম বল প্রয়োগ করেই তাকে নড়ানো যায়।
এর আঙ্কিক হিসেব হচ্ছে, ভার/প্রযুক্ত বল = বলবাহু/ভারবাহু। অর্থাৎ বলবাহু ভারবাহুর চেয়ে বেশি হওয়ায় কম বল প্রয়োগ করে বেশি ভার নড়ানো যাবে।
একদম ওপরের ফোটোগ্রাফের ( বহু পুরনো তাই অল্প ঝাপ্সা) ব্যবস্থায় কুয়োর ওপর বসানো ফ্রেমের ওপর একটি বাঁশ এমনভাবে রয়েছে যে বাঁশটির 'স্থিরবিন্দু' ঐ ফ্রেমের ওপর। সেখান থেকে বাঁশের একপ্রান্তে বালতি বা 'ভার' বাঁধা। অন্যদিকে একটি পাথরের খণ্ডর ওজন আর হাতের টান দ্বারা বালতি তোলার জন্য প্রয়োজনীয় বল প্রয়োগ করা হয়। এই ব্যবস্থায় ভারবাহুর থেকে বলবাহুর দৈর্ঘ্য বেশি। ধরা যাক, বলবাহুর দৈর্ঘ্য ভারবাহুর দৈর্ঘ্যের তিনগুণ। তাহলে সোজা বা কপিকল দিয়ে টেনে জলভরা বালতি তুলতে যত বল লাগত, তার এক-তৃতীয়াংশ বল প্রয়োগ করে বালতি ওপরে তোলা যাবে। ফলে বালক বা কমজোরি বয়স্করাও সহজে জল তুলতে পারবে।
এই ব্যবস্থা হওয়ার ফলে যে সুবিধা হয়েছিল, সেটা এই যে, বালতিতে জল ভরে ছেড়ে দিলে, উল্টোদিকের পাথরের ( ভার) ওজন বালতির জলের থেকে কম বলে, বালতিটা নিজেই অনেকটা ওপরে উঠে চলে আসত। তারপরে বাকিটা টেনে নিলেই হল। এই উপায়ে আমাদের সবার জল তুলতে পরিশ্রম অনেক কম হত। এমন অভিনব জল তোলার ব্যবস্থা দেখতে আমাদের বাড়িতে চেনা-অচেনা মানুষের ভিড় জমত। পরবর্তীকালে, বহু ব্যবহারের ফলে ওই বাঁশটা নষ্ট হয়ে গেলে, ওটার বদলে নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্যের একটা ফাঁপা লোহার পাইপ ব্যবহার করা শুরু হয়।
যাদের কোনো না কোনো কারণে কুয়ো ব্যবহার করতে হয়, তাদের বাড়িতে জায়গা থাকলে এই ব্যবস্থা প্রয়োগ করে দেখার কথা ভাবতে পারো। প্রতিদিনের জীবনকে সহজ করে তোলার জন্য প্রাথমিক বিজ্ঞানের এমন প্রয়োগ করাই যেতে পারে। ও হ্যাঁ, আমাদের বাড়িতে প্রায় বছর আটেক পরে বিদ্যুৎ সংযোগ আসে। বাড়িতে জল তোলার পাম্প বসে এবং জলের কলের ব্যবস্থাও হয়। তবুও আমরা আমাদের এই ঘরোয়া যন্ত্রটিকে না না কাজের জন্য নিয়মিত ব্যবহার করতাম।
বিশেষ কৃতজ্ঞতাঃ অনিরুদ্ধ সেন
গ্রাফিকঃ মিতিল