সেবার কলকাতায় শীত পরেছিল বেশ জাঁকিয়ে। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি একরাতে আচমকাই ছোটকা ফিরে এলো। বাড়িতে তখন সাজো সাজো রব। বহুদিন বাদে ছোটকা ফিরেছে কলকাতায়। পরদিন জেঠুমনি বাজার থেকে এতো বড় রুই মাছ আনলেন, ছোটকা যে রুই খেতে সবচেয়ে ভালোবাসে। তার সাথে আনলেন গলদা চিংড়ি, সেটাও ছোটকার ভীষণ পছন্দের। বাবা আবার সেই ভোর থেকে লাইন দিয়ে, মণিদার দোকানের স্পেশাল পাঁঠার মাংস কিনে আনলেন। মা-জ্যেঠিরাও কোন অংশে কম যান না। ভোর থেকেই রসুইঘরে ঢুকে পড়লেন। পঞ্চ-ব্যঞ্জনের আয়োজনে সবাই মত্ত। কারোর মুখে এতটুকু পরিশ্রমের রেখা ফুটে উঠছে না, বরং এক চরম প্রশান্তি লুকিয়ে রয়েছে সবার চোখেমুখে। আজকের দিনে এমন একান্নবর্তী পরিবার, গোটা কলকাতায় আর একটা খুঁজে পাওয়া মুশকিল। আমরা ভাইবোনেরা তাই এটা নিয়ে বেশ গর্ব বোধ করতাম।
বাড়ির বাকিরা কাজে ব্যস্ত হলেও আমাদের সেদিন ছুটি। ছোটকাকে গোল করে ঘিরে বসে আমরা আমেরিকার গল্প শুনছিলাম। কত সব মজার গল্প, বলে শেষ করা যায় না। তবে সবচেয়ে মজার যে গল্পটা ছোটকা বলেছিল সেটা একটা সার্কাস নিয়ে, সে গল্প না হয় অন্য একদিন তোমাদের শোনাব। আজ যে গল্প বলতে আমার আসা, সেটাও অবশ্য সার্কাস নিয়ে।
ছোটকার মুখে সার্কাসের গল্প শুনে আমরা এতই খুশি হয়ে উঠেছিলাম যে আমাদেরও সার্কাসে নিয়ে যাওয়ার বায়না জুড়ে বসলাম। দাদাভাই জানত তখন পার্ক সার্কাস ময়দানে সার্কাস চলছে, আমরা কেউ কোনদিন সার্কাসে যাইনি – তাই ছোটকাকে হাল্কা জোরাজুরি করতেই সে রাজি হয়ে গেল। ঠিক হল, পরদিন সন্ধ্যায় সার্কাস দেখতে ছোটকার সঙ্গী হব আমরা চারজনায়, অর্থাৎ আমি, নিলু, রানি আর দাদাভাই।
পরদিন স্কুল থেকে ফিরেই এক খারাপ খবর শোনাল দাদাভাই। সে নাকি তার কোন বন্ধুর কাছ থেকে শুনেছে এখন আর সার্কাসে পশুর খেলা দেখানো হয় না। এ খবর শোনার পর আমাদের মন ভেঙে গেল। ছোটকা যে সার্কাসের গল্প বলেছিল তা জুড়ে তো কেবলই পশুপাখির দাপাদাপি। দুটো হাতি নাকি সামনা সামনি চেয়ারে বসে ‘আমপাতা জোড়া জোড়া’ খেলছে, ঘোড়ারা নাকি তলোয়ারবাজি করছে, সীল মাছ নাকি নাগরদোলায় চড়ছে কিংবা বাঘমামা তার বীরত্ব দেখাতে পরের পর আগুনের চাকতির মধ্যে দিয়ে লাফ দিয়ে যাচ্ছে – এসব কিছুই আমরা তাহলে দেখতে পারব না। অগত্যা জোকারের কেরামতি আর ট্রাপিজের খেলা দেখতেই আমরা ছোটকার সাথে রওনা দিলাম। তখনও আমরা জানিনা যে আমাদের ভাগ্যে পশুর খেলা লেখা রয়েছে। তবে এ খেলা সার্কাসের বদ্ধ পরিসরে নয়, প্রকৃতির মুক্ত মঞ্চে তারা পরিবেশিত করবে।
আমাদের বাড়ি উত্তর কলকাতার ছিদাম মুদি লেনে। সঙ্কীর্ণ গলিপথ ধরে বেশ খানিকটা পথ হেঁটে শোভাবাজার মোড় থেকে বাস ধরি আমরা। সেদিনও আমরা চার ভাইবোন ছোটকার সাথে সাথে চলেছিলাম শোভাবাজারের দিকে। আমি আর দাদাভাই চলেছি আগে আগে আর ছোটকার হাত ধরে রানি আর নিলু আসছে আমাদের পিছন পিছন। সোজা কিছুটা চলার পর গুলু ওস্তাগর লেন ধরার জন্য যেই না বাঁদিকে ঘুরেছি, অমনি মস্তিষ্ক থেকে প্রেরিত নির্দেশে আমি নিজের পায়ে ব্রেক লাগালাম। দাদাভাইও থমকে দাঁড়িয়েছে। রানিদের দিকে ঘুরে না তাকালেও বেশ বুঝতে পারছি, ওদের গতিও স্তব্ধ হয়েছে, সাথে সাথে রানির মুখের বুলিও। হওয়াটাই স্বাভাবিক, সামনে যে দাঁড়িয়ে রয়েছে তাকে দেখে যেকোনো কারোর বুলি বন্ধ হয়ে যাবে।
আমার চোখের দিকে চোখ রেখে প্রায় সম্পূর্ণ রাস্তা আগলে দাঁড়িয়ে রয়েছে, এক মস্ত ষাঁড়। তার মাথার শিঙ দুটো যেন রীতিমত ধার দেওয়া, আলগা ছোঁয়াতেই শরীর এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে যাবে। তেমনি তার পর্বতপ্রমাণ চেহারা, চোখেমুখে এক গুরুগম্ভীর ভাব – একটুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে কেমন গা ছমছম করে। ওর পাশ কাটিয়ে যাওয়ার একটা চেষ্টা করব কিনা ভাবছি, ওমা! ষাঁড়টা আমার মনের কথা যেন আগাম টের পেয়ে গেল। একটা প্রবল হুঙ্কার ছেড়ে, বড় আর ছোট কর্মের সাহায্যে রাস্তার বাকি অংশ ভরাট করে ফেলল। এখন সেই গোবর ডিঙিয়ে ওপারে যাওয়া এক কথায় অসম্ভব।
অগত্যা উপায়ান্তর না থাকায় আমরা ঘুরপথে যাওয়ার জন্য পিছন ঘুরলাম। ঠিক সেই সময় এক ভদ্রমহিলা তার স্কুল ফিরতি ছেলের সাথে ঐ গলিতে এসে ঢুকলেন।
ছেলেটা কলা খাচ্ছে। ভদ্রমহিলার হাতে আরও খান তিনেক কলা ধরা রয়েছে। আমাদের পাশ কাটিয়ে ওরা এগিয়ে গেল, তারপর ষাঁড় টাকে লক্ষ্য করে খানিক থমকেছে। ঠিক সেই মুহূর্তে কোত্থেকে একটা বাদর উড়ে এলো আর এক লাফে প্রায় ছোঁ মেরে ছেলেটার হাত থেকে কলাটা ছিনিয়ে নিলো। পাশের বাড়ির রকে বসে, চোখের নিমেষে কলাখানা সে অধরস্থ করল। তারপর দাঁত বের করে এক বিকট হাসি হেসে, বিজয়োল্লাসে লুটিয়ে পরল।
-ওমা, ও আমার কলাটা খেয়ে নিল। ছেলেটা কথা বলছে না কাঁদছে ঠিক বোঝা গেল না।
-কাঁদে না, বাবা। দেখ, এবার আমি ওকে কেমন মজা দেখাই।
এরপর ভদ্রমহিলা এক অদ্ভূত কাণ্ড ঘটালেন। একটা কলা নিয়ে বাঁদরটার দিকে দেখালেন, আর যেই না বাঁদরটা ওটা নেওয়ার জন্য ছুটে এল, অমনি কলার গোছা চালান করলেন ব্যাগের ভিতর।
বাঁদরটা আবার রকে ফিরে গেল, শূন্য হাতে। মা-ছেলে সে দৃশ্য দেখে কি খুশী, হাসির প্লাবনে তারা যেন ভেসে যাচ্ছে।
এই ধৃষ্টতা বাঁদরের পছন্দ হল না। পরক্ষনেই আরো তীব্র বেগে ছুটে এল ভদ্রমহিলার দিকে। কিছু বুঝে উঠবার আগেই তাঁর চশমাখানা পৌঁছে গেছে বাঁদরের পাঞ্জার ভিতর। ভদ্রমহিলা পড়ি-মরি করে ছুটে গেলেন বাঁদরের দিকে, কিন্তু বেশী দূর এগোতে পারলেন না, ভীষণ গর্জনে ষাঁড় তার উপস্থিতির প্রমাণ দিল। ততক্ষণে বাঁদর মহাশয় ঐ চশমা চোখে লাগিয়ে তরতর করে ছাদের উপরে উঠে গেছে, তার নাগাল পাওয়া এখন অসম্ভব।
ভদ্রমহিলাও চিৎকার জুড়ে দিয়েছেন, তার আওয়াজ শুনে আশেপাশের বাড়ির বারান্দায় লোক জড়ো হয়ে গেছে। সবাই বেশ উৎসাহ সহকারে বাঁদরের কার্যকলাপ দেখছে। অনেকে আবার হাততালি দিচ্ছে –তবে সেটা বাঁদরকে তাড়াতে না তাকে আরো উৎসাহ দিতে, কে জানে ? তবে আমরা যে পুরো ঘটনাটা বেশ উপভোগ করছি তা বলাই বাহুল্য।
বাঁদরটার আচমকা কি হল কে জানে ? চোখ থেকে চশমাটা খুলে ফেলে মটমট করে চশমার ডাঁটি দুটো সে ভেঙে ফেলল। তারপর ভদ্রমহিলার দিকে একঝলক তাকিয়ে ছুড়ে ফেলে দিল চশমাটা, আর বিকট চিৎকার করতে করতে মিলিয়ে গেল অট্টালিকার জঙ্গলে।
কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন ভদ্রমহিলা, চশমা মাটি স্পর্শ করার সাথে সাথে ছুটে গেলেন অবশিষ্টাংশ কুড়িয়ে নিতে, কিন্তু হায় অদৃষ্ট ! খেলা যে এখনও শেষ হয়নি!এতক্ষণ সুবোধ বালকের মত দাঁড়িয়ে থাকলেও এবার ষাঁড় বাবাজীবন নড়ে চড়ে উঠল। গগনভেদী হাঁক ছেড়ে সামনে এগিয়ে এল, আর ভদ্রমহিলার চোখের সামনে তার বাহারি চশমার অংশবিশেষকে খুরের চাপে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিল। তারপর নিজের মর্জিতে পিছন ফিরে চলতে শুরু করল।
ভদ্রমহিলার মুখের দিকে আর তাকানো যায় না। হাঁটু মুড়ে তিনি রাস্তার উপর বসে পরলেন, তার সামনে যেটা পরে রয়েছে তাকে চশমা বলা যায় না, সেটা কেবল কাচ আর প্লাস্টিকের গুঁড়ো মাত্র।
আশপাশের বাড়ির লোকেরা আবার যে যার ঘরে ঢুকে গেছে। আমাদেরও পথ উন্মুক্ত, এবার আর সামনে যেতে মানা নেই।
রানি এসময় হঠাৎ হাততালি দিয়ে বলে উঠল – দাদাভাই তোর বন্ধুকে বলিস পশুদের সার্কাস বন্ধ হয়ে যায়নি, শুধু জায়গা বদল হয়েছে। এখন ওরা লাইভ শো করে, শহরের পথেঘাটে। অসাধারণ এই সার্কাস, মানুষের মাঝখানে পশুদের আধিপত্য।
ছবিঃ ত্রিপর্ণা মাইতি