একটা ছোট্ট চৌকো মতন বই, তার সাদা মলাটে কালোয় আঁকা এক গ্রামীণ ল্যান্ডস্কেপ, মাঝে এক লাল টকটকে বড় সূর্য, তার ওপরে সাদায় লেখা 'ভালো রাক্ষসের বই'। লেখক জয়া মিত্র। 'ভালো রাক্ষস' কেমন হয়, জানার জন্য বইটি হাতে তুলে নিলাম।
বইয়ের শুরুতে লেখক জানিয়েছেন, এই সংগ্রহের 'কথা' বা গল্পগুলি এসেছে বিভিন্ন জায়গা থেকে, বিভিন্ন মানুষের মুখে মুখে ঘুরে ঘুরে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এবং বিদেশ থেকেও, তিনি সেগুলিকে একত্রিত করে লিখেছেন শুধু। তাই এই বইয়ের গল্পগুলিতে মিশে আছে নানা মানুষের স্বর।
এই বইতে মোট নয়টা গল্প আছে। গল্প না বলে বলা ভালো 'নতুন রূপকথা' তার মধ্যে প্রথম রূপকথাটার নাম নাম 'সুখু-দুখু' । না, এটা সেই আমাদের অতিচেনা সুখু-দুখুর গল্পটা নয়, যেখানে সবার বাধ্য, ভালো মেয়ে দুখু গল্পের শেষে রাজরানী কিংবা জমিদারনী হল, আর হিংসুটে, অলস সুখু খালি শাস্তি আর দুঃখই পেল। জয়া মিত্রের 'সুখু-দুখু'কে বলা যেতে পারে একসঙ্গে সেই প্রথম গল্পটার পুনর্কথন এবং তার পরে তার সিক্যোয়েল। এই গল্পের আমরা দেখি, অনেক বছর পরে, সুন্দরী, লক্ষ্মী দুখু, যার কিনা ধনীর ঘরে বিয়ে হয়েছিল, আর কুৎসিত, মুখরা সুখু, যে কিনা বাড়িছাড়া হয়েছিল, তাদের জীবন দুটো কেমন যেন যেমনটি-হওয়ার-কথা-ছিল-না-তেমনভাবে বদলে গেছে। ধনী বাড়ির নরমসরম বৌ দুখু, সাত ছেলের জন্ম দিতে দিতে আর সংসার সামলাতে সামলাতে ক্লান্ত, রুগ্ন হয়ে পড়েছে। তাকে কেউ দেখেনা, ছেলেরাও যত্ন করেনা, সবাই খালি ভাবে, মায়ের কাজই তো সবার সেবা করা, দেখভাল করা। তার দেখভাল নিয়ে কেউই চিন্তিত নয়। অন্যদিকে সুখু বরাতফেরে হাটে মাঠে কাজ করে, ক্ষেতখামারি করে ফসল ফলিয়ে এবং সেসব বিক্রি করে আর্থিকভাবে স্বাধীন জীবন যাপন করে। গল্পের শেষে ভাবতে ইচ্ছে করে- আসলে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে দুই বোনের মধ্যে কে বেশি শান্তির জীবন যাপন করছে? চিরকাল সবার বাধ্য, সব রকমের অন্যায়-অপমান সয়ে চলা দুখু, নাকি নিজের পাওনা বেশি বেশি করে আদায় করে নিতে চাওয়া , অবাধ্য , মুখরা সুখু?
এই বইয়ের প্রতিটা গল্পই এমনতরো আলাদা ভাবনার জন্ম দেয়। 'হলুদ নদীর কনে' শীর্ষক কাহিনিটি জলজঙ্গলের ছেলে বালুর বুদ্ধিদীপ্ত প্রতিবাদের মধ্যে দিয়ে শিশুকন্যা হত্যা বা কন্যা বিসর্জনের বিরুদ্ধে কথা বলে; নদীর মত প্রাকৃতিক শক্তিকে ভালোবেসে শ্রদ্ধা করার, আর ভক্তির নামে বুজ্রুকির বিরুদ্ধে গল্প শোনায়। ' সবচেয়ে বেশি জোর যার' গল্পটা পড়তে পড়তে আমার বিহারের 'মাউন্টেন ম্যান' দশরথ মানঝির কথা মনে পড়ছিল। মনে পড়ছিল হাতুড়ি হাতে জন হেনরির কথা। আধুনিক লোককথার এই চরিত্রদের সঙ্গে এই গল্পের প্রধান চরিত্র কুড়োরামের মিল খুঁজে পেলাম। একই সঙ্গে এই গল্প কোনও বাধাকেই বাধা না ভাবার, আর স্বপ্ন দেখার সাহস থাকার গল্পও বটে।
এই বইয়ের শুরুতে লেখক বলেছেন- 'এবারের বেশিরভাগ গল্পেই গায়েই যেন লেগে আছে নিজের দেশে ছেড়ে নিজের গ্রাম ছেড়ে মানে নিজের ভুঁই ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হবার কষ্ট। দেশের এত বেশি জন মানুষ এই কষ্ট পাচ্ছেন প্রতিদিন যে তা-ই যেন চারপাশের বাতাস থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে কখন 'কথা'গুলোর ভেতরে ঢুকে পড়েছে। ...' 'আত্মীয়দের গ্রাম' নামের গল্পটিতে এইরকম ঘরহারা, দেশহারা মানুষদের দেখা মেলে। তারা সবাই মিলে 'স্বজনপুর' নামের সবুজে ঘেরা গ্রামটিতে নতুন করে বসতি গড়ে তোলে।
'ভালো রাক্ষসের গল্প' আসলে প্রকৃতিকে ভালোবাসার, ভালো রাখার রূপকথা। এই গল্পের প্রধান চরিত্র আলোমণি রাজকন্যা যার প্রাণের সখী বনের মেয়ে নদী। নদীর বাবা-মায়ে ছবিতে ফুটে ওঠে বনবাসী জনজাতির জীবনগাথা। গল্পের খলনায়ক হল 'সবচাই' নামের দৈত্য, যে 'এত খারাপ যে অন্য কেউ সুখেশান্তিতে আছে দেখলেই তার রাগ হয়। যা কিছু সুন্দর সেগুলিকে নষ্ট করতে পারলে সে খুশি...।' আলোমণিকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে ভালো রাক্ষস, যে চাইলেই যেকোনও রকমের চেহারা ধারন করতে পারে, তার সঙ্গে হাত মেলায় বাতাস বন্ধু, নানাভাবে সাহায্য করে পিঁপড়ের মত ছোট্ট প্রাণী থেকে শুরু করে বিশাল মহীরূহের দল। লেখকের সক্রিয় পরিবেশসচেতনতা এবং পরিবেশকে , বিশেষ করে নদী বা জলাধারগুলিকে রক্ষা করার বিষয়ে তাঁর মানসিক অবস্থান এই গল্পের ছত্রে ছত্রে ফুটে ওঠে।
আলোমণি আর ভালো রাক্ষস কি বন্ধু নদীকে 'সবচাই' দৈত্যের হাত থেকে রক্ষা করতে পেরেছিল? কিংবা চাঁদ আর সূর্য আকাশে থাকে কেন? বালু কেমন ভাবে ছোট্ট ছোট্ট মেয়েদের হলুদ নদীর কনে হয়ে যাওয়া থেকে আটকালো? এইসব যদি জানতে চাও, আর আরোও কয়েকটা নতুন ও পুনর্কথিত রূপকথা পড়ে ফেলতে চাও, তাহলে যোগাড় করে ফেলতে পারো এই বইটা।
'থীমা' থেকে প্রকাশিত 'ভালো রাক্ষসের বই' এর নতুন (দ্বিতীয়) সংস্করণে সাদায়-কালোয় সুন্দর সব ছবি এঁকেছেন গৌতম চট্টোপাধ্যায়।
বইঃ ভালো রাক্ষসের বই
লেখকঃ জয়া মিত্র
চিত্রশিল্পীঃ গৌতম চট্টোপাধ্যায়
প্রকাশকঃ থীমা
মূল্যঃ ১৪০ টাকা