"...যেখানে যখন যাই, সুন্দর আর অবাক করা কিছু দেখি, তুলে আনি তোমাদের জন্য আর গল্পে বুনে দিই..."ছোটদের জন্য তাঁর নতুন বই,'ছোটোদের গল্পমেলা'-এর ভূমিকাতে এমন কথা লিখেছেন অনিতা অগ্নিহোত্রী।
কথাটা কিন্তু একেবারে সত্যি। বইটার প্রতিটা গল্পের পরতে পরতে রয়েছে অবাক করা যত ঘটনার কথা, আর প্রকৃতির অদ্ভূত সুন্দর বিবরণ। সূচীপত্র অনুযায়ী তেরোটা, কিন্তু আসলে সতেরোটা গল্প আছে এই বইতে। চারটে ছোট্ট শবর / সৌরা উপকথার অনুবাদ রয়েছে একটা শিরোনামের নীচে। এছাড়া রয়েছে এগারোটা ছোট গল্পের সঙ্গে একটা বড় গল্প।
কিছু কিছু গল্প এমন হয়, যেগুলি নিছকই গল্প হয় । সেখান থেকে আলাদা করে পাওয়ার বা মনে রাখার কিছু থাকে না। আর কিছু কিছু গল্প থাকে, যেগুলি তোমার আমার মত সাধারণ মানুষের কথা বলতে বলতে, আমাদের মনের ভেতরে ঢুকে গিয়ে কড়া নাড়ে। কোনো বস্তুর উল্লেখে, বা বিষয়ের কথা আলোচনা করে, কিংবা কোনো একটা জায়গার বা কাজের বিবরণ দিয়ে নানারকমের ঘুমিয়ে থাকা প্রশ্নকে জাগিয়ে তোলে — সঠিক আর বেঠিকের হিসেব কষতে বসায়, অজানা বিষয়ে আগ্রহ জাগায়, অচেনা দেশকে চিনতে উৎসাহ দেয় । এই বইয়ের গল্পগুলি ওই দ্বিতীয় ধরনের।
'ভারত' বলতে যে দেশটাকে আমরা টিভির খবরে, ধারাবাহিকে, হিন্দি -বাংলা সিনেমায় কিংবা জনপ্রিয় কার্টুনে দেখে অভ্যস্ত, সেটা আসলে এই বিরাট দেশের খুব খুব ছোট একটা অংশ। বাকি বিরাট দেশটা সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না বা জানতে পারিনা, কিংবা জানার চেষ্টা করিনা। অনিতা অগ্নিহোত্রী কাজের সূত্রে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় বসবাস করেছেন। সেই সমস্ত জায়গার প্রকৃতি-পরিবেশ, গ্রাম-গঞ্জ-শহরের সাধারণ মানুষদের খুব কাছ থেকে দেখেছেন, তাদের প্রতিদিনের জীবনের নানারকমের সুখ-দুঃখের কথা জেনেছেন। বড়দের জন্য তাঁর লেখাগুলিতে আমরা এই সমস্ত মানুষদের কথাই জানতে পারি, সেখানে বড় শহরের বদলে নদী-জঙ্গল-মফস্বলের কথা থাকে বেশি; বাংলার সঙ্গে সঙ্গে ভারতের অন্যান্য নানা প্রদেশের মানুষ ও প্রকৃতির খোঁজ মেলে বেশি। আর তিনি ছোটদের জন্য কলম ধরলে, আমরা সেই সব কিছুই আবার ফিরে দেখি, কিন্তু ছোটদের চোখ দিয়ে, ছোটদের মন দিয়ে।
সমস্যা, বিপদ, দুঃখ কি শুধু বড়দের হয়? ছোটদের কি হয়না? 'গুলকী' গল্পে তেরো বছরের শুকা আর আট বছরের বুটুর মা আর বাবাকে শাস্তি দিতে ধরে নিয়ে যায় বনদপ্তর থেকে। তাদের অপরাধ, তারা হারিয়ে যাওয়া একটা ভালুকছানাকে খিদের মুখে খেতে দিয়েছিল, আদর করেছিল। ফলে সে ন্যাওটা হয়ে থেকে যেতে চায়। সেটা নাকি অন্যায়। এদিকে এই দুটো ভাই-বোন যে জঙ্গলের ধারে বাড়ীতে একা একা রয়েছে, কোনোমতে খাওয়াদাওয়া হচ্ছে, ইশকুলে যাওয়া হচ্ছেনা, তার হিসেব কে রাখে? ওদিকে 'ভাসানের পরে' গল্পে গোটা পুজোটা যে আকিম আর তার কোলের বোন বুয়াম সারাটা পুজো মা'কে ছেড়ে একা একা কাটাল— কারণ মা'কে কাজ খুঁজতে পাশের গ্রামে যেতে হল— সেই দুঃখের খবর কে জানে? কিংবা বাড়ির পেছনের জঙ্গলটা হঠাৎ 'অভয়ারণ্য' বলে ঘোষণা হয়ে গেলে, কাজু আর তাজুর মত যাদের 'বনের ধারে বাড়ি',তাদের সবাইকে কত নতুন অসুবিধায় পড়তে হয় সেটা কি কলকাতা শহরে বসে বোঝা যাবে? তাঁর গল্পের মধ্যে দিয়ে এমন সমস্ত ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করান অনিতা অগ্নিহোত্রী।
এই বইয়ের সবথেকে বড় গল্প 'সিয়েরা নেভাদার হারানো মানুষ' আমাদের নিয়ে যায় একেবারে পৃথিবীর অন্য গোলার্ধে। উত্তর আমেরিকার ইয়োসেমিটি ন্যাশনাল পার্কের প্রাকৃতিক বৈচিত্রের ছবির মত বিবরণের সঙ্গে সঙ্গে মিশে যায় ইতিহাস, ভূগোল, হারিয়ে যাওয়া মানুষদের গল্প। এই দীর্ঘ গল্পটি পড়ে ইয়োসেমিটি ন্যাশনাল পার্কের মানস ভ্রমণ হয়ে যায়।
এই পৃথিবীতে মানুষ আর গাছপালা, পশুপাখিদের যে পাশাপাশি, একে অপরের সঙ্গে মিলেমিশে থাকারই কথা, একে অপরের প্রতি সহমর্মী হওয়ার কথা, এমন ভাবনার বীজ প্রতিটা গল্পই বুনে দেয় পাঠকের মনে। নদীতে বান আসার সমস্যা, খনি সুড়ঙ্গের বিপদ, মানুষের বসতি বিস্তারের ফলে হারিয়ে যেতে বসা পশুপাখিদের কথাকে ঘিরে বেড়ে ওঠে একেকটি গল্প। একদিকে যেমন রয়েছে কাঁথার বদলে শাড়ি ফেরত দেওয়া হনুমান, জঙ্গলে ফিরে গিয়ে ফের দেখা করতে আসা ভালুকছানা, দুধ-কলা-রুটি খাওয়া পোষা বাঘ;খাবারের খোঁজে পার্কিং লটে আসা ব্ল্যাক বেয়ার; অন্যদিকে রয়েছে চৈতি, তারা, কুট্টুস, রাঙা, শুকা, বুটু, তাজু, কাজু,আকিম,বুয়াম, ঈশান, তন্ময়, পতু,মির্চি, শালুকের মত একঝাঁক ছেলেমেয়ে - যাদের মনে হাজার প্রশ্ন, চোখে শতেক কল্পনা; সেইসব কল্পনায় রং লাগাতে আসেন অন্নজ্যেঠির মত সাহসিনী গৃহিণী,নিদানদাদার মত শিল্পী, পারান আর নটবর বেহেরার মত গাছপাগল মালী, মণিরাম ভঞ্জের মত দোকানী, জহ্নুবুড়োর মত গল্পদাদু, অর্ক জ্যেঠুর মত অভিভাবক।
২০২০ সালে 'সোপান' থেকে প্রকাশিত হয়েছে 'ছোটোদের গল্পমেলা'। বইটির প্রচ্ছদ এবং অলংকরণ আরও ভালো হওয়ার সুযোগ ছিল। এছাড়া বইটির সামগ্রিক নির্মাণে প্রকাশকের তরফে কিছু ত্রুটি রয়ে গেছে। পুনর্মুদ্রণকালে সেগুলি সংশোধিত হলে ভালো লাগবে।
ছোটোদের গল্পমেলা
অনিতা অগ্নিহোত্রী
প্রচ্ছদ ও অলংকরণঃ দিলীপ দাস
প্রকাশকঃ সোপান
প্রথম প্রকাশঃ ২০২০
মূল্যঃ ২২৫ টাকা